ভূমিকা: বঙ্গ রঙ্গমঞ্চের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত না হলেও নাট্যকার রূপে জনগণমন হরণে ডি. এল. রায় সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর বাংলা নাটকের আসরে অবতীর্ণ হওয়া ছিল কিছুটা বিলম্ব। গিরিশ প্রতিভা তখন মধ্যগগনে। আবার জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ এমনকি অমৃতলাল ও ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ পর্যন্ত নাট্যকার রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত। স্বভাবতই দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্য প্রতিভা এই সব ব্যক্তিত্বের সমকক্ষ হওয়ার শক্তির আয়ত্ত করেছিলেন আপনগুণের অভিনবত্বে। কবি ও নাট্যকারের যুগ্ম জামনায় সেই গুণের প্রকাশ। বস্তুত উনিশ শতকের বাংলাদেশের নব চেতনার বিকাশে নাটক হয়েছিল সর্বোত্তম মাধ্যম, আর দ্বিজেন্দ্রলালের মধ্যে দেখা যায় তার শক্তিশালী বহিপ্রকাশ।

দ্বিজেন্দ্রলালের নাটক গুলোকে প্রধানত চারটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যেতে পারে

  • ১। প্রহসন : একঘরে (১৮৮৯), সমাজবিভ্রাট বা কল্কি অবতার (১৮৯৫) বিরহ (১৮৯৭), এ্যহস্পর্শ বা সুখী পরিবার (১৯০১), প্রায়শ্চিত্য (১৯০২), পূর্ণজন্ম (১৯১১) আনন্দ বিদায় (১৯১২)।
  • ২। নাট্যকাব্য : (ক) পৌরাণিক–পাষাণী (১৯০০), সীতা (১৯০৮), ভীষণ (১৯১৪)। খ) ইতিহাস মিশ্রিত রোমান্টিক নাট্যকাব্য-তারাবাঈ (১৯০৩), সোরাব রুস্তম (১৯০৮)
  • ৩। ঐতিহাসিক নাটক : রাণাপ্রতাপ সিংহ (১৯০৫), দুর্গাদাস (১৯০৬), নূরজাহান (১৯০৮), মেবারপতন (১৯০৮), শাজাহান (১৯০৯), চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১), সিংহল বিজয় (১৯১৫)।
  • ৪। সামাজিক নাটক : পরপারে (১৯১২), বঙ্গনারী (১৯১৫)।

নাট্য জগতে দ্বিজেন্দ্রলালের প্রথম আবির্ভাব প্রসহনকার রূপে। প্রহসন রচনার কারণ সুরুচিপূর্ণ বিশুদ্ধ হাস্যরসের পরিবেশন। তিনি এ প্রসঙ্গে নিজেই বলেছেন : “প্রথমতঃ প্রহসনগুলির অভিনয় দেখিয়া সেগুলির স্বাভাবিকতা ও সৌন্দর্যেমোহিত হইতাম বটে, কিন্তু সেগুলির অশ্লীলতা ও কুরুচি দেখিয়া ব্যথিত হইতাম।” তাই বোধহয় প্রহসন রচনায় প্রথম তিনি হাত পাকান। তাঁর প্রথম রচনা ‘একঘরে’। ১৮৮৭ সালে বিলেত থেকে দেশে ফেরার পর তাঁকে বিনা প্রায়শ্চিত্তে হিন্দু সমাজ গ্রহণে অসম্মত হয়। সমাজের এই অন্যায় ব্যবহারে ক্ষুব্ধ মনের প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় একঘরে’। নাট্যকারের মতে—ইহার ভাষা অন্যায় ক্ষুব্ধ তরবারির বিদ্রোহী ঝনৎকার। ইহার ভাষা পদদলিত ভজঙ্গমের ক্রুদ্ধ দংশন।” “কল্কিঅবতারে’ নব্য হিন্দু, ব্রহ্ম, রক্ষণশীল, পণ্ডিত ও বিলাত ফেরত—এই পাঁচটি সম্প্রদায়ের প্রতি ব্যঙ্গবাণ নিক্ষিপ্ত। বিরহ নাটকটি বিশুদ্ধ প্রহসন। সামাজিক বিদ্রুপ অনেক কম। এর গানগুলি কৌতুকরসে প্লাবিত। তুলনামূলকভাবে তার ‘এ্যহস্পর্শ’ প্রহসনটি আখ্যান পরিকল্পনা বা হাস্যরস কোন দিক থেকেই তেমন সার্থক হয়নি। প্রায়শ্চিত্ত প্রহসনটিতে আছে—বিলাত ফেরত সমাজের অর্থলোলুপতা, কৃত্রিমতা, ও বিলাসিতার বিরুদ্ধে বিদ্রুপবর্ষণ, পুনর্জন্মে, এক কৃপণ, নির্মম ও স্বার্থপর সুদখোরের হাস্যকর পরিণতি বর্ণিত হয়েছে। সর্বশেষ আনন্দ বিদায়’ প্রহসনটিতে আছে রবীন্দ্র বিরোধিতার এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। দ্বিজেন্দ্রলাল ও রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কাব্যে অস্পষ্টতা ও নীতিমূলক রচনা নিয়ে যে মতান্তর ঘটেছিল তার অশালীন ব্যক্তিগত আক্রমণ এখানে সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্যকাব্যগুলির বিষয় পুরাণ ও ইতিহাস থেকে সংগৃহীত। পৌরাণিক নাটক রচনার ক্ষেত্রে তিনি স্বভাবতই ভিন্ন পথের যাত্রী। তাঁর পাষাণী (অহল্যা) নাটকটিতে অভিশাপের প্রভাবে অহল্যার পাষাণ হওয়ার কাহিনী পরিত্যক্ত, এখানে অহল্যা কামনাময়ী নারী, ইন্দ্র পরস্ত্রী লুব্ধ লম্পট পুরুষ মাত্র। ‘সীতা’ নাটকটির কাহিনী অংশ ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ এবং বাল্মীকি রামায়ণের উত্তরকাস্ত থেকে আহরিত এই নাটকের অন্যতম অবদান কাব্যময় ‘সংলাপ’। ইতিহাসাশ্রিত নাট্যকাব্যের মধ্যে ‘তারাবাঈ’ বিশেষ উল্লেখযোগ্য। দ্বিজেন্দ্রলালের মোঘশার রাজপুত সম্পর্ক অবলম্বন করে নাটক লেখার এখানেই সূচনা ইতিহাসের ধূসর জগতের মধ্যে নাট্য প্রসঙ্গ অনুসন্ধানের প্রাথমিক প্রয়াসও এখানে সুস্পষ্ট। তবে তারাবাঈ, নাটকরূপে ততটা সার্থক হয়নি। ‘নাট্যরঙ্গ’ জাতীয় নাটক ‘সোরাবরুস্তম’। ফিদৌসির শাহানা গ্রন্থটি এর মূল উৎস। এটি সঙ্গীতবহুল অপেরাধর্মী নাটক। স্বভাবতই আফ্রিদ চরিত্রে দেশপ্রেমের দিকটি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।

দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্য প্রতিভা বিকাশের সর্বোত্তম ক্ষেত্র হল, ঐতিহাসিক নাটক। এই জাতীয় নাটকগুলি রচিত হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সমকালে। তবে মোঘল ও রাজপুত এই দুই বীর জাতিকে কেন্দ্র করে দ্বিজেন্দ্রলাল ইতিহাস নির্ভর নাটক লিখেছেন। ‘দুর্গাদাস’, ‘রাণা প্রতাপ সিংহ’, ‘মেবার পতন’ নাটকগুলিতে রাজপুতদের বীরত্ব, আত্মত্মর্যাদাবোধ ও দেশপ্রেমের পরিচয় প্রস্ফুটিত। ‘দুর্গাদাস’ এবং মেবার পতন নাটকের উৎস টডের গ্রন্থ। কিন্তু এখানে যথাযথ ঐতিহাসিক আনুগত্য সর্বত্র লক্ষিত হয়নি। ঘটনার আতিশয্য এবং বিচ্ছিন্ন দৃশ্যাবলীর উপস্থাপনায় নাটকীয় ঐক্য ব্যাহত হয়েছে। যদিও ‘মেবার পতন’ নাটকে রাণা অমর সিংহের কাহিনীটি বিস্তৃত, তবে ইতিহাস এখানে ভাবের ছায়ায় আচ্ছন্ন। আর মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর এবং শাজাহানের পরিবারের কলহ ইত্যাদি ঘটনার পটভূমিতে লেখা হয় নূরজাহান’ ‘শাজাহান নাটকদ্বয়। নূরজাহানে ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে নায়িকা চরিত্রের মনস্তত্ত্ব সুনিপুণভাবে উদ্ঘাটিত। শাজাহানে—ঔরঙ্গজেবকে উপলক্ষ করে বৃদ্ধ পিতা শাজাহানের সম্রাটসত্ত্বা ও পিতৃসত্ত্বার দ্বন্দ্ব প্রবণ দোদুল্যমানতায় রূপায়িত। স্নেহের সুধা বা গরলে পূর্ণ শাজাহানের জীবনপাত্র। এই সর্বনাশা স্নেহই ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে দারার অভিমানে দ্বিধান্বিত হয়েছে, স্বেচ্ছায় বিদ্রোহী পুত্রকে সসৈন্যে দিল্লী প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে এবং পরপর তিনটি পুত্রের হত্যাকারী ঔরঙ্গজেবকে শেষ পর্যন্ত ক্ষমা করেছে। লেখক এর এটিই শ্রেষ্ঠ নাটক।

প্রাচীন ভারতের হিন্দুযুগ থেকে বিষয় নির্বাচন করেও দ্বিজেন্দ্রলাল দুটি নাটক লিখেছিলেন— ‘চন্দ্রগুপ্ত’ এবং ‘সিংহল বিজয়’। চন্দ্ৰগুপ্তে নাটকীয় কাহিনী বস্তু, পুরাণ, সংস্কৃত নাটক ‘মুদ্রারাক্ষস’ এবং গ্রীসিয় ইতিহাস অবলম্বনে রচিত হয়। তবে উপকরণের অভাবে কাহিনী অনেকটাই হয়ে পড়েছে কল্পনা ভিত্তিক। নাটকের কাহিনী চন্দ্রগুপ্তকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও মূল আকর্ষণীয় চরিত্র হল চাণক্য। জনৈক সমালোচকের ভাষায়—“বিদ্বান বিচক্ষণ ও কুশাগ্র বুদ্ধি, এই ব্রাহ্মণ ভাগ্য বিড়ম্বিত ও নিপীড়িত। ভাগ্য বিড়ম্বিত চাণক্য সৌন্দর্য চাণক্যের বক্তব্যেওঃ “যখন ছুরি শানাচ্ছ তখন মুখে হাসতে হবে, যখন পানীয়ে বিষমেশাচ্ছ তখন আলাপে মোহিত করতে হবে। এরই নাম চাণক্যের রাজনীতি।” এ থেকেই মনে হয় এ নাটকের নায়ক চন্দ্রগুপ্ত নয়৷ নায়ক হলেন—পণ্ডিত চাণক্য। আর পরবর্তী সিংহল বিজয়’ নাটকে ইতিহাস অংশ নগণ্য। ইতিহাস অপেক্ষা ইতিকথা বা পুনরাবৃত্তিই প্রধান। তাই এ নাটকটি নাটক হিসাবে তেমন কৃতিত্বের দাবী রাখতে পারেনি।

তার দু’খানি সামাজিক ও পারিবারিক নাটক—পরপারে ও বঙ্গনারী খুব সার্থক না হলেও উত্তেজক ঘটনায়—যেমন খুন, জখম, ফাসি ইত্যাদিতে পূর্ণ বলে একদা বঙ্গীয় নাট্য সমাজে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। কিন্তু এই নাটক দুটির নাট্য লক্ষণ বিশেষ কিছুই না থাকায় এবং সাহিত্য লক্ষণ ততটা স্বতঃক্ষরিত না হওয়ায় পরবর্তীকালে পাঠক সমাজে আপস অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে অসমর্থ হয়েছিল।

অবদান : দ্বিজেন্দ্রলালের বাংলা নাটকে অবদান স্মরণকালে দেখা যায় বেশ কিছু নতুন রীতি ও বৈচিত্র্য। যেমন—

  • নাটকের মধ্যে আধ্যাত্মিকতা এবং অলৌকিকতা বর্জন করে আধুনিক জীবন ভাবনার প্রকাশ।

  • ইউরোপীয় নাট্যরীতির আদর্শে মঞ্চসজ্জার অনুপুঙ্খ নির্দেশ দান।

  • নাটকীয় সংলাপে স্বগোতোক্তি বর্জন করে চরিত্রের একাত্ম ভাষা (Monolyne) প্রচলন, ‘নুরজাহান’ নাটক থেকে তিনি এই স্বগতোক্তি বর্জন করেন।

  • চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব রূপায়ণে গুরুত্ব দান।

  • হাস্যরস সৃষ্টিতে বিদূষক জাতীয় চরিত্র বর্জন।

  • কাব্যময় গদ্য সংলাপের প্রচলন।

তাই বলতে হয় বাংলা নাটকের ধারায় দ্বিজেন্দ্রলালের নাটক এক অনন্য সংযোজন।