ভূমিকা: বাংলা নাট্য সাহিত্যে মধুসূদন দীনবন্ধু, গিরীশচন্দ্র ঘোষের অবিস্মরণীয় অবদান বাংলা নাট্য ধারাকে বিপুল প্রসারী করে যে আবহমণ্ডল সৃষ্টি করেছিল তারই স্রোতে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় কবি ও নাট্যকার হিসাবে আবির্ভূত হয়ে আমাদের নাট্য চেতনার দৃষ্টি ভঙ্গিকে বিপুল বিস্তৃত করতে সহায়ক হয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল নাট্য কল্পনাকে গভীর ও একটা সূক্ষ্ম শিল্পের উপর স্থাপিত করতে চেয়েছিলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল বাংলা নাট্য সাহিত্যে আগমন করে পূর্বসূরীর নাট্যকারদের অতিক্রম করবার এক দুর্জয় বাসনা গ্রহণ করলেন। তঁর পূর্বে বাংলা নাটকে মূলত, প্রহসন, ব্যঙ্গধর্মীতা, পৌরাণিকতা সামাজিকতা ও সামান্য কিছু ঐতিহাসিকতা নির্ভর কাহিনী তথ্য আমাদের প্রায় সীমিত করে তুলেছিল। তার পূর্বে ঐতিহাসিব নাটক বলতে আমরা যা বুঝি তা একমাত্র কৃষ্ণকুমারী ও গিরীশচন্দ্রের দুএকটি গৌণ নাটক ছাড়া আর কোন নাটক লিখিত হয়নি। অবশ্য নীলদর্পণ নাটক লেখার পশ্চাতে একটি মৌলি চেতনা কাজ করলেও তা কিন্তু ঐতিহাসিক নাটকে তার পদ সঞ্চার এক ধরনের সামাজিক ও ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রয়েছে। ঊনিশ শতকের একটি বিশেষ সংকটপূর্ণ সমস্যা ও অত্যাচারের বাস্তব কাহিনীও ঐতিহাসিক গুরুত্ব দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার নয়। এই প্রসঙ্গে বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক উপন্যাসের কথা আমাদের চেতনাকে উদ্বুদ্ধ করে। স্বয়ং গিরীশচন্দ্র সেগুলির নাট্যরূপ দিয়ে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন কিন্তু মৌলিক ঐতিহাসিক নাটকে তিনি কৃতিত্ব দেখাতে পারেননি। নবীনচন্দ্র সেনের পলাশীর যুদ্ধ, বাংলা সাহিত্যে প্রথম দেশপ্রেম মূলক ঐতিহাসিক কাব্য, যদিও রঙ্গলালের পদ্মিনী উপাখ্যান, আখ্যান কাব্যটি ইতিহাসের অনুসরণ করে একটি স্বদেশ বাণীকে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছে কিন্তু তা উজ্জ্বল হয়ে দীর্ঘ স্থায়িত্ব লাভ করেনি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এমনি একটি ঐতিহাসিক নাট্যচেতনার অবক্ষয়কালে আবির্ভূত হয়ে তাঁর কবি মনের আবেগ স্পর্শ ও ভাবের জোয়ারে ব্যক্তিগত উচ্ছ্বাসকে স্বদেশবাসীর মূর্তি পরিগ্রহ করেছেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রঙ্গব্যাঙ্গ নাটক :
ঊনবিংশ শতাব্দীর সমগ্র ভারতব্যাপী যে প্রবল স্বাধীনতা আন্দোলনের তুফান উঠেছিল সেই আবহাওয়ায় পরিবর্ধিত ও সংস্কৃতির জোয়ারে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় বাংলা নাট্য সাহিত্যে একটি মৌলিক চিত্ত সম্পদ নিয়ে আবির্ভূত হলেন। দ্বিজেন্দ্রলাল ও সাহিত্য জীবনের প্রথমে পূর্বসূরী নাট্যকারদের মতো রঙ্গব্যঙ্গ ও প্রহসনধর্মী নাটক নিয়ে লেখনী মাত্রা শুরু করেছিলেন। এই নাটকগুলি হল—কল্কী অবতাব (১৮৯৫) বিরহ (১৮৯৭) ব্র্যহস্পর্শ (১৯০০) প্রায়শ্চিত্ত (১৯০২) পুর্নজন্ম (১৯১১) উল্লেখ্য। তিনি হাসির গানের নিষ্কলঙ্ক রাজা হয়েও প্রহসন রচনায় শিল্প সমৃদ্ধির দিক দিয়ে সার্থক হতে পারেন নি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পৌরাণিক নাটক :
যদিও তার প্রতিভা পৌরাণিক নাটকের প্রতিভা নয় তথাপি তার পূর্বগামী নাট্যকারদের পথ অনুসরণ করেই এবং বিদ্রুেত প্রবাসে থাকাকালীন সেক্সপীয়র নাট্যকারদের কিঞ্চিৎ প্রভাবে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তার ‘পাষাণী’, (১৯০০), ‘সীতা (১৯০৮), ভীষ্ম (১৯১৪) এই তিনখানি পৌরাণিক নাটক পুরাতন ইতিবৃত্তকে নতুন করে আমাদের কাছে দীপ্যমান হয়ে উঠল। এই তিনটি নাটকের ঘটনা সংস্থাপণে ও চরিত্র রূপায়ণে তিনি কিছুটা মৌলিক শক্তির পরিচয় দিয়েছেন কিন্তু নাট্য চরিত্র তো উপন্যাস এর চরিত্র নয়। সুতরাং ঘনীভূত নাট্যরস পরিবেশনে শিথিলতা থাকলে তা দর্শক মহলে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। তবে তার সীতা নাটকখানি শিশির কুমার ভাদুড়ীর অসাধারণ সার্থক অভিনয়ে কিছুকাল দর্শক সমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। পুরাণের কাহিনীকে পৌরাণিক করে রেখে আধুনিক মনস্ক শিল্পরসজ্ঞের পরিচয় প্রমাণ করতে যে সংহত নাট্য শক্তির প্রয়োজন তা হয়তো দ্বিজেন্দ্রলাল যথাযথভাবে প্রয়োগ করতে পারেননি।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক :
এই সবকিছু পটভূমি করা নিজ নাট্য প্রতিভার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তার নাট্য প্রতিভাকে নতুন পাদপীঠ আলোকে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তার নাট্য শক্তির খ্যাতি জনপ্রিয়তা প্রভৃতি সমস্ত গুণই নির্ভর করছে তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলির উপর। ঐতিহাসিক নাটক তাকে প্রত্যক্ষভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল একটি বিশেষ ঐতিহাসিক চেতনা। অপরদিকে পরোক্ষে তাঁকে সাহায্য করেছিল সমসাময়িক যুগের স্বাদেশীকতা আন্দোলন। শিক্ষিত বাঙালীমাত্রেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আধুনিক শিক্ষার আঙিনায় যে নব জীবনের দীক্ষা নিয়েছিলেন তারই পরিপ্রেক্ষিতে সেই যুগেরই একটি প্রবহমান ধারা ঐতিহাসিক তথ্য ও চেতনা। আর এই অন্যান্যদের চেয়ে চেতনার মধ্যে একটি মহৎ মানবিক উপলব্ধি স্পন্দন শোনা গিয়েছিল। ইনি স্বতন্ত্রধর্মী দেশ ও জাতীর বন্ধন দশা থেকে মুক্তি এবং সর্বাঙ্গীণ স্বাধীনতার মনুষ্য সচেতন ব্যক্তি মাত্রেরই এক চিরকালের দাবী। এই স্বাধীনতা পিপাসা ও জাতীয় চেতনার অকুণ্ঠিত ও অনিবার্য শিল্পরূপ দ্বিজেন্দ্রলালের নাট্য মঞ্জুরী। মধুসূদন ও গিরীশ চন্দ্রের মধ্যে আমরা স্বদেশী চেতনার একটি আবেগঘন পরিবেশকে পেতে পারতাম কিন্তু ইতিহাস ও নাটক উভয়কে এক বৃত্তে সুদৃঢ় করতে গিয়ে জাতীয় চেতনার ব্যক্তিত্ব প্রাধান্যকে তাঁরা বিস্তৃত হয়েছেন। অলৌকিকতা অবাস্তকতা ও ইতিহাস বোধের কিছু অভাব তাঁদের নাটকগুলিকে বিড়ম্বিত করেছে। সে দিক থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় যতদূর সম্ভব ইতিহাসের খুঁটিনাটি রক্ষা করেও নাট্যরসকে এক অসাধারণ সমন্বতিতে উত্তীর্ণ করেছেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটকে হিন্দু ও মুঘল যুগের সমন্বয় :
তার ইতিহাস নিঃসৃত কাহিনী মূলত আহৃত হয়েছে। মুঘল যুগ এবং হিন্দু যুগের ইতিবৃত্ত থেকে (মোঘল রাজপুতের বা হিন্দুর সংঘাত দ্বন্দ্ব ও আত্মপ্রতিষ্ঠানকে আকাঙ্ক্ষাকে কেন্দ্র করেই তার ঐতিহাসিক নাটকগুলি উপস্থিত হয়েছে। হিন্দু যুগের ইতিহাস যেমন ত্যাগ তিতিক্ষা, আত্মসমর্পণ, প্রেস ভক্তি কৃচ্ছ সাধনা, আত্মকলহই পারস্পরিক অনৈক্য ও অবিচ্ছেদ্য ভাবনা)। অন্য দিকে তেমনি মোঘলদের মধ্যে অবিশ্বাস্য স্বজন রক্তে হোলি খেলা, ষড়যন্ত্র, ভাতৃ হনন, পিতৃদ্রোহিতা, ব্যভিচারী রাজবিলাস ও কুৎসিত সিংহাসন পিপাসা ইতিহাসের একটু অনন্ত তথ্যের আকর থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁর মনমতো রস সংগ্রহ করেছিলেন, তার বেশীর ভাগ নাটকেই মোঘল রাজপুতের সংঘর্ষ উত্থান পতন এবং রাজপুত বীরত্বের প্রতি আকর্ষণই দ্বিজেন্দ্রলাল এর মূলধন হয়ে উঠেছিল। তার আবেগ কল্পনার তুরঙ্গ গতি, ভাষার যাদুকরী মোহ এই ঐতিহাসিক নাটকগুলোকে অনেকখানি কাব্যময় করে তুলেছে, তথাপি সেই স্বদেশবোধের উষ্ণ পরিমণ্ডলে তার বক্তব্যের তীক্ষ্ণতা চরিত্র সৃষ্টির নৈপুণ্য নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। তার নাটক এক সময় এত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত মানসিক ভাবে যেন কিছুটা ম্লান হয়ে গিয়েছিলেন। কেবল অকারণ তত্ত্ব বা সাংকেতিকতা বা দার্শনিকতার আমদানী করে নাটকের বক্তব্য বিষয় ও তার সক্রিয় গতিকে প্রতিহত করেননি। নাটক তার কাহিনী ও চরিত্রকে অবলম্বন করে নাট্যকারের ভাব শক্তির সাহায্য নিয়ে বিপুলভাবে গতিমুখর হয়ে উঠেছেন) প্রতাপসিংহ (১৯০৫) দুর্গাদাস (১৯০৫) নুরজাহান (১৯০৮) মেবার পতন (১৯০৮) শাজাহান (১৯০৯) চন্দ্রগুপ্ত (১৯১১) সিংহল বিজয় (১৯১৫) প্রভৃতি নাটক এক সময় রঙ্গমঞ্চে অসাধারণ দার্শনিক আকর্ষণ করেছিল। ইতিহাসের কিংখাপ বিধৃত অস্ত্রনয় তার উন্মুক্ত ঝংকার ষড়যন্ত্রের মদির নেশায় এক অসাধারণ। নাট্যরসের যে রোমাঞ্চিত আছে দ্বিজেন্দ্রলাল তাঁর অন্তর দৃষ্টি দিয়ে যে রহস্যময় উপাদানটি আবিষ্কার করেছিলেন ইতিহাসের পাথরের তলায় কিংবা ঐতিহাসিকদের দলিলের দস্তাবেজে ও পুঁথির অঞ্জালে জীবনের জয়ধ্বনী মুমূর্ষু হয়ে পড়েছিল বা নাট্যকারের সহানুভূতির ছোঁয়া একেবারে আধুনিক জটিলতা সংকুল জীবনের খোলা হাটে অনুপ্রবেশ করেছে।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিভিন্ন নাটকের রূপ :
তার জাতীয়তাবাদ চেতনা বা ভারতীয় চেতনার সঙ্গে এক হয়ে গেছে তার নাট্য চেতনা আবার এই চৈতন্যই যখন ব্যক্তি চেতনার সঙ্গে সংঘাতে বা সৌদে লিপ্ত হয় তখন মানব চেতনার আর এক রূপ তিনি তাঁর নাটকে তুলে ধরেছেন। তার স্বদেশ চেতনা তাঁর মানব চেতনারই বা কখনো কখনো বিশ্ব চেতনারই আর এক অভিনব রূপ মেবার পতন নাটকে এই কথাটাই তিনি সোচ্চার কণ্ঠে বলেছেন। এক ক্ষুদ্র রাজ্যের রাণা প্রতাপ সিংহ এক আপসহীন মনোবল দুর্নিবার সংকল্প কঠোর অধ্যবসায় ও জাতীয় প্রেম বাৎসল করে নিজ অস্তিত্ব অক্ষুণ্ণ রেখেছেন। প্রতাপসিংহ নাটকে তিনি এই কথাটাই জোরালোভাবে বলেছেন দুর্গাদাসে পাই অসমনীয় দৃঢ় চরিত্র নির্লোভ মানবিকতা ও স্বদেশ বোধের এক বিরলতম দৃষ্টান্ত। শাজাহান নাটকে এক পারিবারিক লোভাতুর নির্লজ্জ আত্মসংহাতকে কেন্দ্র করে জীবনের মূল্যবোধ ধ্বসে যাওয়ার ট্র্যাজেডি মূল্যায়িত হয়েছে। পিতা পুত্র ভ্রাতা চিরন্তন বিশ্বাস হারিয়ে কোন বিষাক্ত ঘটনা বর্তের শিকার হল তার করুণ ক্রন্দন এই নাটকে নূরজাহান নাটকে নারীর স্বভাব ধর্মের সঙ্গে তার বিষাক্ত ক্ষমতালিপ্সার যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে এক বিষাদ ঘন পরিণতির চিত্র হয়ে উঠেছে। নারীর গতিরেখা কতদূর সীমাবদ্ধ হলে সংসার ও সমাজের মঙ্গল শঙ্খ ধ্বনি কেমন রবে বাদিত হবে তার একটি বাস্তব চিত্র এখানে পরিলক্ষিত।
উপসংহারঃ একথা স্মরণীয় যে দ্বিজেন্দ্রলাল যে বিরাট মানচিত্র নিয়ে তার ঐতিহাসিক নাটকগুলি রচনা করেছিলেন তাঁর মধ্যে শেক্সপীয়রের প্রত্যক্ষত পরোক্ষ প্রভাব অনিবার্য ধারায় এসে গেছে। যদিও শেক্সপীয়রের সেই অসাধারণ মানব চরিত্র জ্ঞান তাঁর অসহায় নিয়তি নিহিত রূপ এবং কাল পরিমাপহীন নিখিল মানবআত্মার অন্তর্ভেদী হাহাকার তাঁর নাটকে পরিতৃপ্ত হবে না। তথাপি আমাদের বাঙালী জীবনের সীমিত পরিসরের আনাচে কানাচে যে টুকরো ইতিহাস ইতঃস্তত বিক্ষিপ্ত তা আবেগ দৃপ্ত মানবিক রসের সংমিশ্রণে কেমন শিল্পরসে পরিণত হতে পারে তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। ইতিহাসের মর্মর পাথরে শাজাহান নূরজাহানের স্নেহ প্রেম হিংসা কলহের নিরন্তর সংঘাতে এক নীরব সাক্ষী হয়ে থাকে। জমাট বাঁধা অশ্রু বেদনাই তার ঐতিহাসিক নাটকের এক সামগ্রিক মূল্যায়ন। এদিক দিয়ে বাংলা নাট্য সাহিত্যের নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
Leave a comment