ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদ যখন নাট্যরচনায় ব্রতী হন, বাংলা নাট্যসাহিত্য তখন বিশেষ অপরিণত নয়। বাংলা নাটকের সূচনা ১৭৯৫ খ্রীস্টাব্দে হেরাসিম লেবেডফের উদ্যোগে। লেবেডফের কথা বাদ দিলেও হরচন্দ্র ঘােষের ‘ভানুমতি চিত্তবিলাস’-এর সময়কাল ১৮৫২। ক্ষীরােদপ্রসাদের প্রথম নাটক ‘ফুলশয্যা’ রচিত হয় ১৮৯৪। অর্থাৎ হরচন্দ্র ঘােষ থেকে সূচনা ধরলেও বাংলা নাট্যসাহিত্য তখন ৪২ বছরের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ। মধুসূদন, দীনবন্ধু, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, অমৃতলাল বসু, রাজকৃষ্ণ রায় প্রমুখ প্রখ্যাত নাট্যকারগণ বাংলা নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ ও পরিণত করেছেন। গিরিশচন্দ্রের অতুল প্রতিভাও প্রায় অর্ধশত নাট্যরচনা দ্বারা বাংলা রঙ্গমঞ্চে প্লাবন এনেছে। এমনকি ক্ষীরােদপ্রসাদের সমকালে দ্বিজেন্দ্রলাল ও রবীন্দ্রনাথও বাংলা নাটকে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করেছেন। বাংলা নাটকের এই প্রেক্ষাপটেই ক্ষীরােদপ্রসাদ বিদ্যাবিনােদের নাট্যপ্রতিভা বিচার করা প্রয়ােজন।

ক্ষীরােদপ্রসাদের নাটকের সংখ্যা প্রায় ৪৭। অর্থাৎ নাট্যসাহিত্যে তার দানও সংখ্যাগত দিক থেকে অপ্রচুর নয়। তবে স্বীকার করতে হবে, গিরিশচন্দ্র, দ্বিজেন্দ্রলাল বা পূর্বযুগের মধুসূদন, দীনবন্ধুর তুলনাতেও ক্ষীরােদপ্রসাদের নাটকের গুণগত মান উন্নত নয়। নাট্যগুণের দিক থেকে ‘নরনারায়ণ’, ‘আলমগীর’, বা ‘আলিবাবা’র মতাে অঙ্গুলিমেয় কয়েকটি নাটকের নামই কেবল উল্লেখ করার যােগ্য।

গিরিশচন্দ্র-দ্বিজেন্দ্রলাল-ক্ষীরােদপ্রসাদের নাট্যরচনার কালটিকে স্মরণে রাখলে বাংলা নাট্যজগতে আরাে একটি উল্লেখযােগ্য ঐতিহাসিক ঘটনার কথা স্মরণে রাখা দরকার। সেটা হল ১৮৭৬-এর নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইন। এই আইনের ফলশ্রুতিতেই এই যুগের নাটক তৎকালীন সময়ের সংকট থেকে মুখ ফিরিয়ে পুরাণ-ইতিহাস-রঙ্গব্যঙ্গ প্রভৃতি আপাতনিরীহ বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়। গিরিশচন্দ্র কিছুটা সামাজিক সমস্যামূলক নাটক লিখলেও এবং দ্বিজেন্দ্রলালও প্রহসনগুলিকে কিছুটা সমযুগের সমাজকে স্পর্শ করলেও ক্ষীরােদপ্রসাদ সামাজিক বিষয়ে নাট্যরচনায় উৎসাহী হলেন না। ঐতিহাসিক, পৌরাণিক বা রঙ্গনাট্য গীতিনাট্যতেই তার প্রতিভা ও শক্তি নিঃশেষিত হয়েছে।

ক্ষীরােদপ্রসাদ রূপকথাধর্মী কয়েকটি গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন। নাটকের মধ্যে ঘটনার যে রকম বাস্তবতা এবং সম্ভাব্যতা বিদ্যমান থাকা আবশ্যক, এই সব নাটকে তা নেই। চরিত্র-সংঘর্ষের দ্বারা এবং ভাব ও ক্রিয়ার দ্বন্দ্বের সাহায্যে যে নাটকীয় রসের বিকাশ হয়, এই নাটকগুলিতে তাও অনুপস্থিত। একপ্রকার কল্পময়,স্বপ্নাচ্ছন্ন, রােমান্টিক রসে দর্শক-শ্রোতাকে আবিষ্ট করাই নাটকগুলির লক্ষ্য। এই শ্রেণীর নাটক লিখে ক্ষীরােদপ্রসাদ খ্যাতি অর্জন করলেও তার পূর্বেই এই রকম নাটকের প্রবর্তন হয়েছিল। গিরিশচন্দ্র ‘আবুহােসেন’ প্রভৃতি নাটক লিখে এই শ্রেণীর নাটকের সূচনা করেছিলেন।

‘আলিবাবা’ (১৮৯৭) মত জনপ্রিয় এবং সর্ব-সমাদৃত গীতিনাট্য খুব কমই আছে। আরব্য রজনীর কাহিনী অবলম্বনে এই নাটকটির মধ্যে এক অতিরহস্যময় কাহিনীর রঙ্গরসের উচ্ছল স্রোত লক্ষণীয়। নাটকের প্রধান চরিত্র মর্জিনা। মর্জিনার রঙ্গব্যঙ্গ, নৃত্যগীতই নাটকে প্রাণরস সঞ্চার করেছে। ‘বেদৌরা’ এবং ‘আলাদিন’ উদ্ভট এবং অসম্ভব ঘটনাশ্রিত রূপকথার কাহিনী অবলম্বনে রচিত। ‘বেদৌরা’তে (১৯০৩) খালেদানরাজের পুত্র কমরলজামান এবং চীনরাজকন্যা বেদৌরা কি ভাবে অপ্সর-অপ্সরার তৎপরতায় মিলিত হল তার উপা বর্ণিত হয়েছে। পরােপকারী হাস্যময় চরিত্র মার্জমান বিশেষ সরস হয়েছে। ‘আলাদিন’ নাটকে আরব্য উপন্যাসের প্রসিদ্ধ গল্পটিকে রূপায়িত করা হয়েছে। এছাড়া ‘বরুণা’ (১৯০৮), ‘ভূতের বেগার’ (১৯০৮), ‘বাসন্তী’ (১৯০৮) নাটকেও অপ্সর-অঙ্সরার সহায়তায় রঘুবর ও জয়ার মিলন ঘটেছে। নাটকের ঘটনা সামাজিক পটভূমিকায় স্থাপিত হয়েছে।

‘কিন্নরী’র (১৯১৮) বিষয়বস্তুর উপর উর্বশী-পুরুরবার কাহিনীর প্রভাব রয়েছে বলে মনে হয়। কাহিনীর সংযােগস্থল এক রােমান্টিক, কল্পময়, আবেশভরা জগতে। নাটকখানি রঙ্গমঞ্চে বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। ক্ষীরােদপ্রসাদ আরব-পারস্য-তুরস্ক প্রভৃতি দেশের কাহিনী নিয়ে আরও কয়েকটি নাটক লিখেছিলেন; যথা- ‘জুলিয়া’ (১৩০৬), ‘সপ্তম প্রতিমা’ (১৩০৯), ‘দৌলতে দুনিয়া’ (১৩১৫), ‘পলিন’ (১৩১৭), ‘মিডিয়া’, ‘রূপের ডালি’ (১৩২০), ও ‘বাদশাজাদী’ (১৩২২)।

‘জুলিয়া’ (১৯০০) বােগদাদের স্বনামখ্যাত কালিফ ন্যায়পরায়ণ, সত্যনিষ্ঠ হারুণ-অল-রসিদের অনুপম মহত্ববিষয়ক একটি আখ্যানের উপর ভিত্তি করে রচিত হয়েছে। প্রবল প্রতাপান্বিত বাদশাহের পক্ষে নিজের স্ত্রীকে অন্যের হাতে তুলে দেওয়া সহজ উদারতার পরিচায়ক নয়। কালিফ প্রেমের মহাশক্তি হৃদয়ঙ্গম করে সেই অসাধারণ উদারতার দ্বারা নিজের চরিত্রকে ভূষিত করেছেন।

‘পলিন’-এর (১৯১১) মধ্যে ঘটনার অসঙ্গতি ও অস্বাভাবিকতা অত্যন্ত বিরক্তিকর হয়েছে। নীলপাহাড় থেকে হারেমের দিকে লক্ষ্য করেছেন বলে যে সুলতান ক্রুদ্ধ হয়ে সিস্তান রাজ্যের বিরুদ্ধে উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন, তিনিই আবার সিস্তানরাজকে সমাদরে আহ্বান করে তার কন্যাকে দেখিয়ে দিলেন।

‘মিডিয়া’ (১৯১২) নাটকখানির কিছুটা অভিনবত্ব আছে। সুলতান মনসূরের চরিত্রের মধ্যে বিশিষ্টতার ভাব ফুটেছে। মনসূর দুর্দান্ত-অত্যাচারী, অথচ প্রেমের সন্ধানে বিভাের ও ভ্রাম্যমান।

ক্ষীরােদপ্রসাদ কয়েকখানি পৌরাণিক নাটক লিখেছিলেন। যথা- ‘বুবাহন’ (১৩০৬), ‘সাবিত্রী’ (১৩০৯), ‘উলুপী’ (১৩১৩), ‘ভীষ্ম’ (১৩২০), ‘মন্দাকিনী’ (১৩২৮), ও ‘নরনারায়ণ’ (১৩৩৩)।

ক্ষীরােদপ্রসাদের ভাষা সাধারণত সরল ও অনাড়ম্বর, কিন্তু ‘সাবিত্রী’ (১৯০২) নাটকের ভাষা দুরূহ সংস্কৃত শব্দে পরিপূর্ণ। ভাষার মধ্যে প্রকৃতি বর্ণনা এবং কবিত্ব সৃষ্টি করার প্রয়াস সুস্পষ্ট। সংলাপ অত্যন্ত দীর্ঘ, এবং শব্দের গম্ভীর আড়ম্বরে নাটকের গতি রুদ্ধ।

দ্বিজেন্দ্রলাল যখন ‘ভীষ্ম’ নাটক লিখেছিলেন, তখন ক্ষীরােদপ্রসাদও তাঁর ‘ভীষ্ম’ (১৯১৩) প্রকাশ করেন। দ্বিজেন্দ্রলালের নাটকখানি ক্ষীরােদপ্রসাদের নাটক অপেক্ষা অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ হলেও ক্ষীরােদপ্রসাদের নাটকটিই জনপ্রিয় হয়েছিল। ক্ষীরােদপ্রসাদের নাটকের মধ্যে তীব্র হৃদয়াবেগ ও চাঞ্চল্যকর ভাবদ্বন্দ্ব লক্ষ করা যায় না। কাহিনীর অতিরিক্ত দীর্ঘতা একঘেয়ে ও ক্লান্তিকর। নাটকের কথােপকথন স্থানে স্থানে গদ্যে এবং কোথাও বা অমিত্রাক্ষর ছন্দে ব্যক্ত হয়েছে। ভীষ্মের প্রতি অম্বার দুর্দম অনুরাগ প্রদর্শন করা হয় নি। সুতরাং ভীষ্মের প্রত্যাখ্যান তাঁকে কিভাবে এতখানি প্রতিহিংসাময়ী করে তুলল তার যথাযথ যুক্তি পাওয়া যায় না।

গিরিশচন্দ্র যেমন অপৌরাণিক চরিত্র নিয়ে ভক্তিমূলক নাটক লিখেছিলেন, ‘রঞ্জাবতী’ এবং ‘রামানুজ’ সেই ধরনের নাটক। ‘রঞ্জাবতী’ এবং ‘রামানুজ-এর মধ্যে ক্ষীণ ঐতিহাসিক সূত্র থাকলেও ভক্তিরস উদ্দীপনাই নাটক দুখানির অন্তিম লক্ষ্য। ধর্মমঙ্গল কাহিনী থেকে কিছু উপাদান সংগ্রহ করে ‘রঞ্জাবতী’ রচিত হয়েছে। কিন্তু নাটকের মধ্যে কল্পনা উদ্দামভাবে প্রশ্রয়লাভ করেছে। ‘কর্ণসেন’ এবং ‘কালুডােম’ নাটকে যথাক্রমে নয়ন সেন এবং দলু সর্দার হয়েছে। রঞ্জাবতীর পুত্র-ধর্মমঙ্গল কাব্যের নায়ক লাউসেনের উল্লেখ নাটকে নেই। এখানে রঞ্জাবতীর পুত্রের নাম হয়েছে সূর্যসেন। নাটকের মধ্যে নিয়ন্তা দেবতা মদনমােহন, ধর্মঠাকুর নন। ধর্মানন্দের আধ্যাত্মিক উক্তিগুলি নিতান্ত নিরর্থক ও প্রভাব-বর্জিত। মাঝে মাঝে চরিত্রগুলিকে অবিশ্বাস্য উপায়ে অসম্ভব স্থানে সমাবেশ করা হয়েছে। দলু, লক্ষ্মী প্রভৃতি ডােম ডােমিনীগণের চরিত্রই বীরত্বে, মহত্বে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল হয়েছে।

‘রামানুজ’ (১৯১৬) নাটকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ প্রবর্তক ধর্মনেতার ধর্মজীবন বর্ণিত হয়েছে। এই নাটকটি আদ্যস্ত ধর্মলীলায় পরিপূর্ণ এবং এখানে মানব ও দেবতার ভেদাভেদ অবলুপ্ত হয়ে গেছে। পৌরাণিক নাটকের বিষয়বস্তু পুরাণের সুপ্রচলিত কাহিনী থেকেই গ্রহণ করা হয়। কিন্তু যেহেতু নাটক পুরাণ নয় সেহেতু কোন সুস্পষ্ট ভাবাদর্শ অনুসরণ করে অবিচ্ছিন্ন নাট্য পরিবেশের মাধ্যমে ঘটনা ও চরিত্রের রসােত্তীর্ণ নাট্য-পরিণতি দেখানােই নাট্যকারের কাজ। ‘নরনারায়ণ’ নাটকের প্রস্তাবনায় আমরা দেখলাম নাটকের ভাবাদর্শের আভাস

দৈব কিংবা পুরুষকার

নিদান বিধান কোন রাজার

কর্ম সাক্ষী বিজয়-লক্ষ্মী

কোন মহানে করে বরণ ?

অর্থাৎ দৈব ও পুরুষকারের দ্বন্দ্বই নাটকে উপস্থাপিত। নাটকের আরম্ভ হয়েছে কর্ণের ব্রহ্মশাপ-প্রাপ্তি থেকে এবং নাটকের সমাপ্তি কর্ণের প্রাণােৎসর্গে। সুতরাং কর্ণই যে নাটকের নায়ক এবং এই চরিত্র অবলম্বন করেই দৈব ও পুরুষকারের দ্বন্দ্ব তাও বােঝা গেল। অথচ কর্ণের নামে নাটকের নামকরণ হয় নি। পৌরাণিক জগতে মানুষের ক্রিয়াকর্ম, ভাব ও আকাঙ্ক্ষার মূলে এক দৈবশক্তির অলঙ্ঘ্য বিধান বিরাজ করছে।

কিন্তু নরনারায়ণের মহিমার প্রতি বিশ্বাসী হয়েও তাদের প্রধান বিরােধী শক্তি কর্ণকেই বা অশ্রদ্ধা করা যায় কি ভাবে? কর্মবীর, উদার, দানশীল, সত্যসন্ধ—পুরুষকারের সর্বশ্রেষ্ঠ দৃষ্টান্ত। অথচ তার এ পরাজয় ও দুঃখভােগ কেন? মহাভারতে যাই থাকুক না কেন, কর্ণের অপাপবিদ্ধ জীবনের করুণতম পরিণতি দেখে আমাদের সমস্ত মনুষ্যত্ববােধ বিদ্রোহ করে।

নাটকের সূচনাতেই নিয়তির চক্রান্ত শুরু হতে দেখি। কর্ণের সযত্ন অস্ত্রশিক্ষা ও কঠোর সংকল্প ব্যর্থ করার জন্যই যেন ব্রহ্মশাপ। কর্ণের দ্বিতীয় অভিশাপ প্রাপ্তি গুরু পরশুরামের কাছ থেকে। কর্ণ ভাবলেন, অভিশাপ নিষ্ফল, কারণ তিনি সূতপুত্র। অলক্ষ্য নিয়তি ক্রুর হাসি হাসলেন। কর্ণের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তিনি গভীরভাবে বিষ্ণুভক্ত—কিন্তু তার তীব্র বিদ্বেষ অর্জুন ও কৃষ্ণের বিরুদ্ধে। কর্ণের আসল আত্মদ্বন্দ্ব শুরু হল তখন থেকে যখন তিনি কৃষ্ণের কাছেই আত্ম-পরিচয় প্রাপ্ত হলেন। তার আজন্মপােযিত সঙ্কল্প ও অভিমান একটি নিষ্ঠুর আঘাতে যেন চৌচির হয়ে গেল। যে অর্জুনকে বধ করার জন্য তিনি চিরকাল কঠোর সঙ্কল্প পােষণ করে এসেছেন সেই অর্জুনকে ভ্রাতা জেনে এক মুহূর্তেই সদ্যোজাত ভ্রাতৃস্নেহ সেই সঙ্কল্পের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হল। ব্রাহ্মণ ও গুরুর অভিশাপে তিনি আর অবধ্য নন। কবচ-কুণডল হীন হয়ে তিনি সহজেই অস্ত্রভেদ্য হয়ে পড়েছেন। কর্ণের একাল্পী অস্ত্র ঘটোৎকচের বিরুদ্ধে নিক্ষিপ্ত হল এবং অর্জুনের প্রতি প্রযুক্ত সমস্ত অস্ত্র ব্যর্থ হল। অবশেষে দৈবের জয় সিদ্ধ হল। কবচকুণ্ডলহীন, ভগ্নরথ মহাবীর অন্তিম মুহূর্তে দেবতার চরণে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। কিন্তু দেবতার জয়ে উল্লসিত না হয়ে মানুষের পরাজয়ে আমাদের হৃদয় সীমাহীন বেদনায় হাহাকার করে উঠল।

ঐতিহাসিক নাটকের পূর্ণতা আমরা দ্বিজেন্দ্রলালে দেখেছি। ক্ষীরােদপ্রসাদ দ্বিজেন্দ্রলালের সমসাময়িক নাট্যকার। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে যে দেশাত্মবােধক নাটকাবলীর প্রণয়ন হয়েছিল তার সূচনা ক্ষীরােদপ্রসাদের প্রতাপাদিত্য নাটকেই ঘটেছিল। প্রতাপাদিত্য নাটক হিসেবে খুব উৎকৃষ্ট নয় তবে জাতীয় ভাবের প্রথম প্রবর্তকের গৌরব নাটকটির অবশ্য প্রাপ্য। ‘পদ্মিনী’, ‘চাদবিবি’, ‘পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’, ‘বঙ্গে রাঠোর’ প্রভৃতি নাটকেও স্বদেশী ভাবােদ্দীপনাই নাটকের উদ্দেশ্যরূপে গ্রহণ করা হয়েছে। সুতরাং স্বাধীনতাব্রতী, মুক্তি সাধক নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলালের পাশেই আমরা ক্ষীরােদপ্রসাদের স্থান বলতে পারি।

ক্ষীরােদপ্রসাদ যে ঐতিহাসিক নাটকগুলি লিখেছিলেন সেগুলিও যথাক্রমে ‘প্রতাপাদিত্য’, পলাশীর প্রায়শ্চিত্ত’, ‘পদ্মিনী (১৩১৩), ‘অশােক’ (১৩১৪), চাদবিবি’ (১৩১৪), ‘বাঙ্গালার মসনদ’ (১৩১৭), ‘আলমগীর’ (১৩৩৮) এবং ‘বিদুরথ’ (১৩২৯)।

‘প্রতাপাদিত্য’ (১৯০৩) দেশাত্মবােধক নাটক হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করলেও এখানে স্বদেশপ্রাণতার যথার্থ ও যথেষ্ট প্রকাশ ঘটে নি। কোনাে কোনাে স্থানে সংলাপের মধ্যে স্বদেশানুরাগ ব্যক্ত হয়েছে ঠিকই কিন্তু দেশের জন্য একাগ্র সাধনা বা আত্মত্যাগ নাটকের মধ্যে ফুটে ওঠে নি। প্রতাপাদিত্যের পতনে কোনাে ট্র্যাজেডি হয় নি বরং হঠাৎ যেন তার পরাজয় এবং পতন ঘটেছে। বলে মনে হয়। প্রতাপাদিত্য বাংলার লুপ্ত স্বাধীনতা উদ্ধার করেছেন ঠিকই কিন্তু তার চরিত্র আমাদের মন আকৃষ্ট করতে পারে না। সাহসী বীর হলেও মানবত্বের দুর্লভ গুণে ভূষিত নন। স্নেহময়, ক্ষমাশীল খুল্লতাতের প্রতি তার অকারণ সন্দেহ এবং বিদ্বেষ তার চরিত্রকে হীন করেছে। এবং অবশেষে যখন তিনি তাঁরই অভ্যর্থনায় উদ্যত খুল্লতাতকে হত্যা করে সিংহাসনে বসলেন তখন তিনি ক্ষমার অযােগ্য হয়ে উঠলেন। প্রতাপাদিত্যের এই কুৎসিত কাজের জন্য তার পরিণতি আমাদের হৃদয়কে তেমন বিষন্ন করে তােলে না।

‘পদ্মিনী’ (১৯০৬) নাটকের নামও যথার্থ হয় নি। দুই একবার পদ্মিনীকে দেখা গেলেও তার চরিত্রের অভিব্যক্তি নাটকের মধ্যে নেই। নাটকের মধ্যে জটিলতা সৃষ্টির এবং ট্র্যাজেডির কোনটির কারণই তিনি নন।

‘চাদবিবি’ (১৯০৭) ঐতিহাসিক নাটক বটে কিন্তু ঐতিহাসিক কোনাে বিরাট ঘটনা অবলম্বন করে কাহিনী রসপূর্ণ হয়ে ওঠে নি। ঐতিহাসিক নাটকে যে দেশাত্মবােধ ও ভাবােদ্দীপনা থাকে এই নাটকে সেটিও বিরল।

‘অশােক’ (১৯০৮) নাটকে অশােককে জোর করে ঐতিহাসিক নাটক বলতে হয়, কারণ নাটকের মধ্যে ইতিহাস খুব কম আছে। নাটকের নাম ‘অশােক’। অথচ অশােককে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। তার চরিত্রের কোনাে বৈশিষ্ট্যই ফুটে ওঠে নি। বীতশােক, ধুন্ধুমার ও চিত্রা—এই তিনটি চরিত্রই বার বার আনাগােনা করেছে। চরিত্র-সমাবেশের অসংলগ্নতা এবং সংলাপের দুর্বলতার জন্য নাটকটির কোনাে প্রভাব মনে রেখাপাত করে না।

‘আলমগীর’ (১৯২১) ক্ষীরােদ প্রসাদের নাট্যপ্রতিভার বিজয় বৈজয়ন্তী। শিশিরকুমার ভাদুড়ীর অসাধারণ অভিনয় নৈপুণ্যে নাটকটি বঙ্গবাসীর মনে অশ্নানভাবে অঙ্কিত হয়ে রয়েছে। ঔরংজীবের দ্বন্দ্বময় চরিত্র ক্ষীরােদপ্রসাদের আগে দ্বিজেন্দ্রলাল তার প্রসিদ্ধ ‘দুর্গাদাস’ এবং ‘সাজাহান’ নাটক দুটির মধ্যে অঙ্কিত করেছিলেন। রাজসিংহ রূপকুমারীর কাহিনী নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘রাজসিংহ’ রচনা করেছিলেন। তাই ক্ষীরােদপ্রসাদকে বিশেষ সতর্ক হয়ে নিজের স্বাতন্ত্র। প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছিল। ক্ষীরােদপ্রসাদের আলমগীর এক অপূর্ব চরিত্র। আলমগীর প্রচণ্ড ক্ষমতাশালী আবার নিতান্ত দুর্বল। তিনি আপনক্রিয়া এবং দুষ্ক্রিয়ার করুণ সমালােচক, তাঁর দৃষ্টি সঞ্চারণশীল এবং কল্পনাময়। কোনাে কোনাে স্থানে তার বাক্য অ-প্রকৃতিস্থের অসংলগ্ন প্রলাপের মত মনে হয়।

গিরিশচন্দ্র এবং দ্বিজেন্দ্রলালের মত ক্ষীরােদপ্রসাদ ঐতিহাসিক নাটক লিখতে গিয়ে ইতিহাসকে খুব বিশ্বস্তভাবে অনুসরণ করেন নি। অনেক জায়গাতেই তিনি নিজের প্রয়ােজনানুযায়ী কল্পনাশ্রয়ী হয়ে অভিনব ঘটনা এবং চরিত্র সমাবেশ ঘটিয়েছেন। দু-একটি ঐতিহাসিক চরিত্র নিয়ে সম্পূর্ণ কল্পিত কাহিনীর উপর ভিত্তি করে তিনি কয়েকটি নাটক রচনা করেছিলেন। যেমন- রঘুবীর, খাজাহান, আহেরিয়া ও বঙ্গে রাঠোর।

‘রঘুবীর’ (১৯০৩) গদ্য ও পদ্যে রচিত। গদ্য সংলাপ স্বচ্ছ ও সরস, কিন্তু পদ্য সংলাপ দীর্ঘ এবং আবেগহীন। ভীল রঘুবীরের মধ্যে গিরিশচন্দ্রের ভক্তিরসাত্মক চরিত্রগুলির মত ধর্মদ্বন্দ্বের অভিব্যক্তি ঘটেছে।

‘খাজাহান’ (১৯১২)-এর মধ্যে কিছু ঐতিহাসিক চরিত্র আছে, কিন্তু কাহিনী সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসুত। নাটকের মধ্যে ঘটনাসংঘর্ষ এবং দ্রুত ভাব-পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নাটকীয় রস জমানাের অতি দুর্বল এবং হাস্যজনক চেষ্টা হয়েছে। শেষ দৃশ্যে নারায়ণ এবং খাঁজাহানের মৃত্যু ও সােফিয়ার সহমরণের আয়ােজন দেখিয়ে করুণরস সৃষ্টি করার একটা নিষ্ফল প্রয়াস করা হয়েছে।

‘আহেরিয়া’ (১৯১৫) অপেক্ষাকৃত উষ্ট নাটক। মিলনান্তক এই নাটকে মূলরাজের চরিত্রই সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য মূলরাজের মধ্যে ভাদ্বন্দ্ব বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয়। তিনি তনুরায়কে হত্যা করেছিলেন বটে, কিন্তু নাটকের মধ্যে তাকে মহাশক্তিশালী, উদার এবং অটুট সংকল্পনিষ্ঠ দেখতে পাই। নির্বংশ হওয়া সত্ত্বেও তিনি সঙ্কল্প ত্যাগ করেন নি। অবশেষে তার চিরশত্র, পুত্রহস্তা দেবরায়কে সিংহাসনে বসিয়ে তিনি মহত্বের পরিচয় দেখালেন, অন্যান্য চরিত্রগুলি অপরিস্ফুট এবং অনুল্লেখ্য।

ক্ষীয়মান পাঠান রাজত্বের শেষ সময়কার অবস্থার উপর ভিত্তি করে ‘বঙ্গে রাঠোর’ (১৯১৭) রচিত নাটকের মধ্যে জাতিধর্মের বিভেদের প্রতি নজর দেওয়া হয় নি। কলিবেগম অবাধে হিন্দু পরিবারে গৃহীত হল; জৈনুঙ্গিন কৃষ্ণপ্রেমে মাতােয়ারা হয়ে পড়ল, এবং রতিলাল ধর্মত্যাগ করা সত্ত্বেও কারাে কাছে স্নেহ ও সম্মান হারাল না।