বাংলা নাটক ও রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসের আধুনিক পর্বে এক অবিস্মরণীয় নাম উৎপল দত্ত। গিরিশচন্দ্রের পর বাংলা নাট্য ইতিহাসে উৎপল দত্তের মধ্যেই দেখা যায় নট, নাট্য পরিচালক ও নাট্যকার প্রতিভার অতুলনীয় সমন্বয়।

ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বাংলা নাটককে যেভাবে সমাজ পরিবর্তনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করেছিল, বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে যার পরিচয় আমরা পেয়েছি, তাকেই আরাে অগ্রসর ও শিল্পসম্মত রূপ দান করেছিলেন উৎপল দত্ত।

উৎপল দত্তের জন্ম ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে। পিতা গিরিজারঞ্জন ছিলেন কলকাতার বঙ্গবাসী। কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। উৎপল দত্ত ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজি অনার্স নিয়ে বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছাত্রজীবনে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে পৃথিবীখ্যাত নাট্য ব্যক্তিত্ব জিওফ্রে ক্যান্ডাল ভারতে নাট্যপ্রযােজনা করতে এলে উৎপল দত্ত সেই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন নাট্যদলে অভিনয়ের সুযােগ পান। তখন থেকেই নাটক উৎপল দত্তের চেতনার সঙ্গে ওতপ্রাত হয়ে যায়। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘে যােগ দেন। এরপর তিনি গণনাট্য সংঘের পরিবর্তে ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ (এল টি জি)-এর ব্যানারে ইংরেজি নাটক করতে শুরু করেন। পরে এল টি জি বাংলা নাটক প্রযােজনা করতে থাকে। ১৯৬৯ থেকে উৎপল দত্ত স্থাপন করে ‘পিপলস লিটল থিয়েটার’ (পি এল টি)।

বাংলা রাজনৈতিক নাটকের ইতিহাস সুপ্রাচীন। নীলদর্পণ থেকেই এই রাজনৈতিক নাটকের সূচনা। কিন্তু উৎপল দত্তকে বলতে হয় অবিমিশ্র রাজনৈতিক নাট্যকার। তাঁর সমস্ত নাটকের মধ্যেই থাকে সচেতন উদ্দেশ্য। পূর্ণাঙ্গ, একাঙ্ক, পথনাটক ইত্যাদি মিলে উৎপল দত্তের নাটকের সংখ্যা প্রায় সন্তরটি। বিষয়বস্তুর দিক থেকেও নাটকগুলি বিচিত্র, কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সর্বত্রই সেখানে অতন্দ্র থেকেছে। মৌলিক এই নাটকগুলি ছাড়াও আছে অসংখ্য অনুবাদ নাটক। আরাে উল্লেখ্য, রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে উৎপল দত্ত কখনও শিল্পসৃষ্টির অজুহাতে বা শাসক শক্তির কোপদৃষ্টি থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোনাে অস্পষ্টতা বা অবরণের আশ্রয় নেন নি। তার বক্তব্য স্পষ্ট, সুবােধ্য এবং অকুতােভয়।

উৎপল দত্তের অজস্র নাটকগুলির মধ্যে বক্তব্যের শক্তিতে এবং নাট্য উপস্থাপনার সাহসিকতার কয়েকটি সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। যেমন—‘অঙ্গার’, ‘কল্লোল’, ‘ফেরারী ফৌজ’, ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’, ‘টিনের তলােয়ার’ ইত্যাদি।

উৎপল দত্তের প্রথম নিজস্ব নাটক ‘ছায়ানট’ প্রথম অভিনীত হয়েছিল ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু ‘ছায়ানট’ তেমন সাফল্য পায় নি। কিন্তু পরবর্তী নাটক ‘অঙ্গার’-ই উৎপল্ল দত্তকে নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক হিসাবে শক্তির পূর্ণ প্রকাশ ঘটালাে বলা চলে। কয়লাখনির শ্রমিকদের জীবন, মুনাফাবাজ মালিকদের লােভের কারণে কয়লাখাদে শ্রমিকদের বিপন্নতার এক জ্বলন্ত চিত্র উঠে আসে তাঁর এই মঞ্চসফল নাটকে। ‘অঙ্গার’ মিনার্ভা মঞ্চে প্রথম অভিনীত হয়েছিল ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে।

‘অঙ্গারে’র পর উৎপল দত্তের উল্লেখযােগ্য নাটক ‘ফেরারী ফৌজ’। পূর্ব বাংলার সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন এই নাটকের বিষয়বস্তু। কিন্তু ব্রিটিশ শাসনকালে বাংলার বিপ্লবীদের কার্যকলাপ এ নাটকের বিষয় হলেও স্বাধীন ভারতের ছয়ের দশকের পীড়নমূলক শাসনচিত্রই এখানে প্রতিবিম্বিত হয়েছে। কমিউনিস্টদের ওপর সে সময় স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার যে দমনপীড়ন চালাচ্ছিল তা আসলে ব্রিটিশ শাসককেও লজ্জা দিত। মিনার্ভা মঞ্চে ‘ফেরারী ফৌজ’ অভিনীত হয়েছিল ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে।

এর পরবর্তী উল্লেখযােগ্য নাটকের নাম ‘কল্লোল’। এটিও মিনার্ভায় মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে। এই নাটকের প্রেরণা ছিল ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক একদা নিষিদ্ধ শাহদাৎ আলির লেখা ‘নৌবিদ্রোহ’ পুস্তিকা। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের নৌবিদ্রোহ এই নাটকের পটভূমি। একটি সাধারণ অর্থনৈতিক আন্দোলন কীভাবে রাজনৈতিক আন্দোলনে প্রসারিত হয়ে গেল, তার অসাধারণ নাট্যরূপ ‘কল্লোলে’ পাওয়া যাবে।

‘টিনের তলোয়ার’ (১৯৭১) নাটকের বিষয় উনিশ শতকের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী নাট্য প্রচেষ্টার ঐতিহাসিক পর্ব। বাংলা সাধারণ রঙ্গমঞ্চের শতবার্ষিকী উপলক্ষে নাটকটি লিখিত। মনে রাখতে হবে, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকারের নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন রাজদ্রোহ প্রচারের অপরাধে বাংলা নাটকের কণ্ঠরােধ করতে চেয়েছে। অর্থাৎ নাট্যকর্মীদের কৃত্রিম অভিনয়ের অস্ত্রেই (টিনের তৈরি নকল তলােয়ার) সেদিন সন্ত্রস্ত হয়েছিল ঔপনিবেশিক সরকার। ধনী পােষিত, নেশাগ্রস্ত হিসাবে ধিকৃত সে যুগের নাট্যশিক্ষক ও নাট্যকর্মীদের বৈপ্লবিক ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়েছে ‘টিনের তলােয়ার’ নাটকে।

হিটলারের নাৎসী বাহিনীর বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের জীবনপণ ব্যারিকেড গড়ার ইতিহাসকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে উৎপল দত্তের ‘ব্যারিকেড’ (১৯৭২) নাটক। নাৎসীদের সন্ত্রাসে সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ থেকে বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত তাদের বিবেক ও মানবতাকে চাপা দিয়ে কীভাবে হিটলারী আদর্শের প্রচারে বাধ্য হয়, সেই আত্মপ্রবঞ্চনার ইতিহাস উঠে এসেছে এ নাটকে।

এছাড়াও উৎপল দত্তের আরও কয়েকটি উল্লেখযােগ্য নাটক হল ‘তীর’ (বিষয়-আদিবাসী বিদ্রোহ), ‘তিতুমীর’ (বিষয়—তিতুমীরের বিদ্রোহ), ‘দাঁড়াও পথিকবর’ (মধুসূদনের জীবন বিষয়ক), ‘টোটা’ (সিপাহি বিদ্রোহ বিষয়ক), ‘জনতার আফিম’ (সাস্প্রদায়িক ধর্মচেতনার বিরুদ্ধে) ইত্যাদি।

সাতের দশকের ভারত তথা বাংলার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে লেখা ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ (১৯৭৪) উৎপল দত্তের সাহসী রাজনৈতিক নাট্যপ্রযােজনার আর এক দৃষ্টান্ত। কলকাতার বুকে সরকার পরিচালিত সন্ত্রাসের দিনলিপিই ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ নাটকের বিষয়।

মার্কসবাদী আদর্শে বিশ্বাসী উৎপল দত্ত চিরকাল শােষিত বঞ্চিত মানুষের সংগ্রামে নিজেকে যুক্ত করেছেন তার নাটক ও নাট্য প্রযােজনার মধ্য দিয়ে। তার সমস্ত নাটকের কেন্দ্রীয় বিষয় সংগ্রামী মানুষের কাহিনি। তার বিদ্রোহী নাট্যসত্তা রাজতন্ত্র, সামন্ততন্ত্র, ধনতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, ফ্যাসিবাদ, ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমৃত্যু মানুষের সংগ্রামী পরিচয়কে তুলে ধরেছে। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে উৎপল দত্তের জীবনাবসান বাংলার প্রগতিবাদী নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে এক অপূরণীয় ক্ষতি সন্দেহ নেই।