ইংরেজ-শাসিত ভারতবর্ষের নতুন রাজধানী এবং বাঙলার নতুন সংস্কৃতিকেন্দ্ররূপে কলিকাতা নগরী অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষদিকেই সুগঠিত হয়ে ওঠে। ক্রমে কলিকাতার য়ুরােপীয় অধিবাসীদের জীবনযাত্রা-পদ্ধতি, আমােদপ্রমােদ এবং সাংস্কৃতিক তানুষ্ঠানগুলির প্রভাবে কলিকাতায় জনসমাজে রুচি পরিবর্তনের সূচনা হয়। য়ুরােপীয় পাড়াগুলিতে রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করে ইংরেজি নাটক অভিনয়ের আয়ােজন করা হত—প্রাচীন কলিকাতার ইতিহাসে এরূপ তথ্য পাওয়া যায়। তখনকার দিনে শহরের অভিজাত পরিবারগুলির সঙ্গে এখানকার ইংরেজদের সামাজিক সম্পর্ক এবং মেলামেশার সুযােগ ছিল প্রায় অবারিত। ইংরেজদের নাট্যানুষ্ঠানে আমােদ-প্রমােদে বাঙালী নাগরিকদের মনে পাশ্চাত্ত্য ধরনের নাট্যকলা এবং অভিনয় রীতির প্রতি আগ্রহ জেগেছিল এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। পাশ্চাত্ত্য প্রথায় স্টেজ বেঁধে নাটক অভিনয়ের প্রচেষ্টা থেকে ধীরে ধীরে নতুন যুগের নাট্য সাহিত্যের শাখাটি বিকশিত হয়ে উঠেছে। তাই বাঙলা রঙ্গমঞ্চের কাহিনী এবং নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। রঙ্গমঞ্চের চাহিদাই লেখকদের নাটক রচনার প্রধান প্রেরণা।

কিন্তু এ বিষয়ে বাঙালীদের উদ্যোগ আয়ােজন শুরু হবার বহুপূর্বে একজন বিদেশি বাঙলা রঙ্গমঞ্চ স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তার নাম গেরাসিম লেবেডফ। লেবেডফ ছিলেন রুশ দেশের মানুষ। ১৭৯৭ খ্রীষ্টাব্দে তিনি কলিকাতায় আসেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতির মর্মগ্রহণের জন্য তিনি বিভিন্ন ভারতীয় ভাষা শেখেন। তাঁর ভাষা শিক্ষক গােলকনাথ দাসের সহায়তায়। লেবেডফ ‘দি ডিসগাইস এবং ‘লাভ ইজ দি বেস্ট ডক্টর’ নামে দুটি নাটক বাঙলায় অনুবাদ করেন। অনুবাদ সম্পূর্ণ হলে লেবেডফ অভিনয়ের জন্য বিপুল পরিশ্রমে ডােমতলায় (বর্তমান এজরা স্ট্রীট) একটি বৃহৎ রঙ্গমঞ্চ গড়ে তােলেন। দেশীয় অভিনেতৃবৃন্দের সহায়তায় ১৭৯৫ খ্রীষ্টাব্দের ২৭শে নভেম্বর এবং ১৭৯৬ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে নাটক দুটি অভিনীত হয়। লেবেডফ-এর অস্থায়ী থিয়েটারটির নাম ছিল বেঙ্গল থিয়েটার। সমসাময়িক তথ্য থেকে জানা যায়, এই অভিনয় বিপুল জনসমাদর লাভ করেছিল। সাধারণ মানুষের মধ্যে পাশ্চাত্ত্য ধরনের অভিনয় দেখার আগ্রহ তখনই কি রকম তীব্রভাবে জেগে উঠেছিল লেবেডফের থিয়েটারের ব্যবসায়িক সাফল্যে তার একটা আভাস পাওয়া যায়। কিন্তু কোন বাঙালী নাট্যকলারসিক লেবেডফকে অনুসরণ করতে এগিয়ে আসেন নি। ফলে তার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা আমাদের নাট্যসাহিত্য ও নাট্যমঞ্চ সংগঠনের ইতিহাসে ধারাবাহিকতাহীন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়ে রইলাে। সর্বসাধারণের জন্য সাধারণ রঙ্গমঞ্চ স্থাপিত হয়েছে এই ঘটনার পরে, ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে। ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ ই বাঙালীদের উদ্যোগে সংগঠিত প্রথম সাধারণ রঙ্গমঞ্চ।

উনবিংশ শতাব্দীর পূর্বার্ধে নাট্যচর্চা প্রধানতঃ শহরের ধনী-অভিজাত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮৩১ খ্রীষ্টাব্দে প্রসন্নকুমার ঠাকুর নারিকেলডাঙার বাগানবাড়িতে রঙ্গমঞ্চ প্রস্তুত করান। ১৮৩৫ সালে শ্যামবাজার অঞ্চলে নবীন বসু একটি রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করেন। কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘বিদ্যোৎসাহিনী রঙ্গমঞ্চ’ (১৮৫৭), রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহের ‘বেলগাছিয়া নাট্যশালা’ (১৮৫৮), যতীন্দ্রমােহন ঠাকুরের ‘পাথুরিয়াঘাটা রঙ্গনাট্যালয়’ (১৮৬৫) এবং জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাট্যশালার কথাও এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। নবীন বসুর থিয়েটারে প্রথম বাঙলা নাটক অভিনয়ের আয়ােজন হয় এবং কতকটা নিয়মিতভাবেই এখানে অভিনয় হত। অন্যান্য থিয়েটারগুলিতে নিয়মিতভাবে অভিনয় না হলেও আমাদের অভিনয়-চর্চার প্রথম যুগে এই থিয়েটারগুলির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এইসব থিয়েটারে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকার ছিল না, অভিজাত পরিবারগুলির আমােদ-প্রমােদের কেন্দ্র ছিল এই সখের থিয়েটারগুলি। কিন্তু সখের থিয়েটারের উদ্যোক্তারাই লেখকদের অনুপ্রেরিত করে নাটক রচনা করাতেন এবং তাদের পৃষ্ঠপােষকতায় বাঙলাদেশে একটি সম্ভাবনাপূর্ণ শিল্পকলার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। রামনারায়ণ তর্করত্ন, মধুসূদন বা দীনবন্ধুর মতাে নাট্যকার সকলেই এইসব শৌখীন অভিনয় চর্চার সঙ্গে যুক্ত থেকে নাট্যকাররূপে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন।

মধুসূদনের পূর্ব পর্যন্ত বাঙলা নাটকের ইতিহাস প্রধানতঃ অনুবাদমূলক রচনার ইতিহাস। এর পূর্বের অধিকাংশ নাটকই সংস্কৃত বা ইংরেজী নাটকের দ্বারা স্থলভাবে প্রভাবিত। হরচন্দ্র ঘােষ প্রথম শেক্সপীয়রের নাটক বাঙলায় অনুবাদ করেন। তাঁর ‘ভানুমতী চিত্তবিলাস’ (১৮৫৩) ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’-এর অনুবাদ এবং ‘চারুমুখ চিত্তহরা’ রােমিও অ্যাণ্ড জুলিএট’-এর অনুবাদ। সংস্কৃত নাটক প্রথম অনুবাদ করেন বিশ্বনাথ ন্যায়রত্ন। ‘প্রবােধচন্দ্রিকা’ নামক এই নাটকের রচনাকাল ১২৪৬ বঙ্গাব্দ।

তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ বাঙলা সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ মৌলিক নাটক। অর্জুন-কর্তৃক সুভদ্রা-হরণের আখ্যান এই নাটকের বিষয়বস্তু। তারাচরণ সংস্কৃত ও পাশ্চাত্ত্য নাটকের আঙ্গিক- সম্পর্কে পূর্ণভাবে অবহিত ছিলেন। পৌরাণিক বিষয়বস্তু অবলম্বন করলেও তিনি পাশ্চাত্ত্য নাটকের আঙ্গিক অনুসরণ করতেই চেষ্টা করেছেন। এই নাটকের প্রস্তাবনা বা ভূমিকা অংশে তিনি আঙ্গিক সম্পর্কে যে আলােচনা করেছেন তা থেকে নাট্য-আঙ্গিক-সম্পর্কে তাঁর সচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ‘ভদ্রার্জুন’ প্রকাশিত হয় ১৮৫২ খ্রীষ্টাব্দে। এই বৎসরেই প্রকাশিত হয় যােগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্তের ‘কীর্তিবিলাস’ নাটক। তারাচরণ পাশ্চাত্ত্য নাট্যরীতি-অনুসরণের চেষ্টা করেছিলেন বাইরের গঠনের দিক থেকে আর যােগেন্দ্রচন্দ্র পাশ্চাত্তের অনুসরণে নাটকের রসবস্তুতে অভিনবত্ব আনলেন। ভারতবর্ষে ট্র্যাজিডি বা বিয়ােগান্ত কাহিনী রচনা নিষিদ্ধ ছিল। সংস্কৃত-কাব্য-নাটক বা কথাসাহিত্যে কোথাও বিয়ােগান্ত কাহিনী নেই। কিন্তু পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে, বিশেষতঃ পাশ্চাত্ত্য নাট্য- সাহিত্যে নিয়তি-পীড়িত, দুঃখাহত মানুষের দৃপ্ত পৌরুষকে ট্র্যাজিডিগুলিতে বিষাদ ও করুণ রসে সিঞ্চিত করে প্রকাশ করা হয়েছে। ভারতবর্ষীয় প্রথার বিরুদ্ধাচরণ করে যােগেন্দ্রচন্দ্র ‘কীর্তিবিলাস’ নাটকে একটি বিয়ােগান্ত আখ্যানকেই নাট্যরূপ দিয়েছেন। তিনি বাইরের রূপায়ণের দিক থেকে সংস্কৃত নাটকের আদর্শ অনুযায়ী নান্দী, সূত্রধার প্রভৃতি নাটকে স্থান দিয়েছেন, কিন্তু করুণ-রসাত্মক বিয়ােগান্ত নাট্যকাহিনী রচনা করে নতুন রসবস্তু সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। তারাচরণ বা যােগেন্দ্রচন্দ্র কেউই খুব বড়াে শিল্পী ছিলেন না, তাদের রচনাকে যথার্থতঃ রসােত্তীর্ণও বলা চলে না। কিন্তু বাঙলা নাটকে পাশ্চত্ত রীতি প্রবর্তনের দিক থেকে তাদের কাজের একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে।

প্রাক্-মধুসূদন যুগের সর্বাধিক খ্যাতিমান এবং শ্রেষ্ঠতম নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্ন (১৮২২- ৮৬)। শৌখীন অভিনয়-চর্চায় আমাদের দেশে নতুন একটি শিল্প-শাখার প্রবর্তন হয়েছিল তা পরিপুষ্ট হয়েছে রামনারায়ণের নাটকগুলির দ্বারা। তিনি প্রথম যুগের রঙ্গমঞ্চগুলির চাহিদা অনুযায়ী নাটক রচনা করে দিয়ে অভিনয় কলার বিকাশে সর্বাধিক সহায়তা করেছে। তার প্রধান রচনাবলীর তালিকাটি নিম্নরূপ- ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ (১৮৫৪), ‘নবনাটক’ (১৮৬৬), ‘বুঝিণী হরণ (১৮৭১), ‘কংসবধ’ (১৮৭৫), ‘ধর্মবিজয়’ (১৮৭৫) এবং অনুবাদমূলক রচনা ‘বেণীসংহার’ (১৮৫৭), ‘রত্নাবলী’ (১৮৫৮), ‘অভিজ্ঞানশকুন্তল’ (১৮৬০), ‘মালতীমাধব’ (১৮৬৭)। মধুসূদনের প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ খ্রীষ্টাব্দে। সুতরাং প্রকাশকালের বিচারে একমাত্র ‘কুশীনকুলসর্বস্ব’ ও অনুবাদমূলক রচনার মধ্যে ‘বেণীসংহার’ ও ‘রত্নাবলী’ ভিন্ন রামনারায়ণের সব নাটকই মধুসূদনের আবির্ভাবের পরবর্তী রচনা। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য, বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে রামনারায়ণের ‘রত্নাবলী’ নাটকের রিহার্সাল দেখেই মধুসূদন বাঙলা নাটকের দৈন্য সম্পর্কে অবহিত হন এবং ক্ষুব্ধচিত্তে বাঙলা নাটকের দৈন্য-মােচনের প্রতিজ্ঞা করেন। এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতে গিয়েই তিনি শর্মিষ্ঠা রচনা করেন। রামনারায়ণ এবং মধুসূদনের মধ্যে সঠিকভাবে কোন কালগত সীমারেখা টানা যায় না। সময়ের হিশেবে দুজন সমসাময়িক। কিন্তু মধুসূদন নাটক রচনা আরম্ভ করার পূর্ব পর্যন্ত রামনারায়ণই ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী নাট্যকার। তার রচনাবলীর দ্বারা নাট্যরসিকদের রসরুচি নিয়ন্ত্রিত হত। মধুসূদনের আবির্ভাবের পরেও বেশ কিছুদিন রামনারায়ণের প্রভাব অক্ষুন্ন ছিল। ১৮৬৬ খ্রীষ্টাব্দে জোড়াসাঁকোর নাট্যশালা পরিচালকদের অনুরােধেই তিনি বহুবিবাহ প্রথা-সম্পর্কে ‘নবনাটক’ রচনা করেন।

রামনারায়ণের রচনাবলীর তালিকাটির প্রতি লক্ষ্য করলে প্রথমেই বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যের কথা মনে হয়। বিশেষভাবে তার প্রথম মৌলিক রচনা ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকে তিনি একটি সমসাময়িক সামাজিক সমস্যাকে নাট্যবিষয়রূপে গ্রহণ করে বাঙলা নাটককে বাঙালী জীবনের সঙ্গে যুক্ত করে দেন ও অনুবাদ-নির্ভরতা বা পৌরাণিক কাহিনীর অনুবৃত্তি থেকে বাঙলা নাটককে উদ্ধার করেন। কৌলিন্যপ্রথা এবং বহুবিবাহ প্রথাকে ব্যঙ্গ করা এবং তার কুফল দেখানােই ছিল এই নাটক রচনার উদ্দেশ্য। রংপুরের কুণ্ডী গ্রামের জমিদার কালীচন্দ্র রায়চৌধুরী সাময়িকপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, কৌলীন্যপ্রথার নারীর দুর্গতি-সম্বন্ধে যিনি ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নামে সর্বোৎকৃষ্ট নাটক রচনা করতে পারবেন, তাকে তিনি ৫০ টাকা পুরস্কার দেবেন। এই বিজ্ঞাপন অনুযায়ীই রামনারায়ণ তর্করত্ন ‘কুলীনকুলসৰ্ব্বস্ব’ রচনা করেন। সংস্কৃত নাটকের ধরনে প্রথমে নান্দী প্রস্তাবনা আছে, কাহিনী সাধারণ নাটকের মত ধারাবাহিক রূপে উপস্থাপিত হয়নি। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন দৃশ্যে বিভক্ত, প্লট নেই, শুধু ক্ষীণ সূত্রে কয়েকটি কৌতুকাবহ ব্যঙ্গচিত্র গ্রথিত হয়েছে। নায়ক নায়িকা রূপেও কাউকে চিহ্নিত করা যায় না। ‘মৃচ্ছকটিকে’র শকারের অনুকরণে অভয়চন্দ্রের ভূমিকা পরিকল্পিত। নাটকটির বিভিন্ন দৃশ্যে এক একটি কৌতুকাবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তীক্ষ্ণ বিদ্রুপ করা হয়েছে। কিন্তু সমগ্র নাটকটি আদ্যন্তযুক্ত অখণ্ড আকার লাভ করে নি। নাট্য-আঙ্গিক-সম্পর্কে রামনারায়ণের বিশেষ কিছু ধারণা ছিল না; রচনাটিকে একটি অখণ্ড পূর্ণাঙ্গ নাটক না বলে বিচ্ছিন্ন দৃশ্যসমষ্টি বা নকশা জাতীয় রচনা বলাই সমীচীন।

রামনারায়ণের পূর্ণাঙ্গ সামাজিক নাটক ‘নব নাটক (১৮৬৬) সম্পূর্ণ নাম বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথা বিষয়ক ‘নবনাটক’ জোড়াসাঁকো নাট্যশালার প্রধান কর্মকর্তা জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘােষিত পুরস্কার পেয়েছিল। দ্বিতীয় স্ত্রীর ঈর্ষায় এক জমিদারের প্রথমা স্ত্রীর ও তার গর্ভজাত পুত্রের ওপর অত্যাচার এবং ওষুধ খাইয়ে জমিদারের প্রথমা স্ত্রী ও পুত্রকে হত্যা নাটকটির বিষয়বস্তু। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির রঙ্গমঞ্চে নাটকটি সাফল্যের সঙ্গে বহুবার অভিনীত হয়েছে। ‘নব নাটক’ ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ -এর মত প্লটহীন না হলেও তার গ্রন্থনা নাট্যগুণবর্জিত, উদ্দেশ্যকে অত্যন্ত প্রকট করতে গিয়ে স্বাভাবিকতা ও সঙ্গতিকে নষ্ট করা হয়েছে। রামনারায়ণ কয়েকটি ছােট প্রহসনও রচনা করেছিলেন- ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’, ‘উভয় সঙ্কট’ ও ‘চক্ষুদান’। ‘উভয় সঙ্কটে’ বহু বিবাহের দোষ এবং চক্ষুদানে স্ত্রীর কৌশলে স্বামীর লাম্পট্য-ব্যাধির চিকিৎসা প্রদর্শিত হয়েছে।

রামনারায়ণ পর্যন্ত নাটক রচনার যে ইতিহাস পাওয়া যায় তাতে উন্নত শিল্পগুণ সমন্বিত রচনার নিদর্শন একটিও নেই, প্রত্যক্ষ ঘটনা-আশ্রিত এবং ঘটনা ও চরিত্রের পারস্পরিক অচ্ছেদ্য সংযােগে সংহত নাট্যকাহিনী নির্মাণের শিল্পকৌশল এই নাট্যকারেরা জানতেন না। বাঙলা নাটকের নির্মীয়মান পর্বে এই নাট্যকারেরা নিজেদের সাধ্যমত নাটক রচনা করে অভিনয় কলা-বিকাশে সহায়তা করেছেন এবং এই কারণে তাদের রচনাবলীর ঐতিহাসিক মর্যাদা অবশ্যই স্বীকার্য। কিন্তু মধুসূদনের আগে বাঙলা নাটকের ক্ষেত্রে সত্যকার সৃষ্টিশীল প্রতিভার আবির্ভাব হয় নি। মধুসূদনই সব অক্ষম চেষ্টার অবসান ঘটিয়ে বাঙলা নাটকে উন্নত শিল্পাদর্শ প্রতিষ্ঠিত করে দেন।

মধুসূদন তাঁর ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ নাটক (১৮৬০), ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক (১৮৬১) এবং দুটি প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ (১৮৬০) ও ‘বুড় শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০) প্রভৃতি রচনায় প্রথম বাঙলা নাটকের শিল্পরূপ উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেন। নাটকের বিভিন্ন দৃশ্য যােজনায় একটি সামগ্রিক কাহিনীর পটভূমিতে চরিত্রগুলির ক্রমপরিণতির যুক্তিসঙ্গত চিত্রণ এবং সমগ্র নাটকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে আবর্তিত জীবনাবেগ ফুটিয়ে তােলার সক্ষমতায় মধুসূদনই প্রথম বাঙলা ভাষায় ইয়ােরােপীয় নাট্যশিল্পের সফল প্রয়ােগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। কৃষ্ণকুমারী নাটক’ বাঙলা নাট্য-সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্র্যাজেডি। তার প্রহসনগুলিতে সমকালীন বাস্তব জীবনের রূপ যেভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে তা তুলনাহীন। দীনবন্ধু মিত্র মধুসূদনকেই অনুসরণ করেছিলেন। তাঁর ‘নীল দর্পণং নাটকং’ (১৮৬৬), ‘নবীন তপস্বিনী নাটক’ (১৮৭০), ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬), ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬০), ‘জামাই বারিক’ (১৮৭৫) ইত্যাদি নাটক ও প্রহসনে জীবনকে তিনি যেরূপ প্রত্যক্ষ বাস্তবতায় ফুটিয়ে তুলেছেন তা সত্যই বাঙলা নাট্যসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে। ‘নীলদর্পণে’র তােরাপ, ক্ষেত্রমণি এবং ‘সধবার একাদশী’র নিমচাদ অবিস্মরণীয় চরিত্র। তবে দীনবন্ধু জীবনের অভিজ্ঞতার ওপরই নির্ভর করেছেন, তার মর্মরহস্য উন্মােচনের প্রতিভা ও শিল্পদক্ষতা তার ছিল না। নাটকের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব দান কিছু নেই, মধুসূদনের পথেই অগ্রসর হয়েছেন।