“মধুসূদন শুধু বাঙলা কাব্যের পথিকৃৎ নহেন, বাঙলা নাটকেরও তিনিই প্রথম শিল্পী।” মধুসূদনের প্রহসন ও নাটকগুলির আলােচনা প্রসঙ্গে এই উক্তির যথার্থতা প্রতিপাদন কর।

বাল্যকালেই মধুসূদন মহাকাব্য রচনা করবার স্বপ্ন দেখতেন এবং ছাত্রজীবনেই ইংরেজি কবিতা রচনায় হাত পাকিয়েছিলেন। বঙ্গভূমিতে তার কর্মজীবন শুরু হবার পুর্বেই মাদ্রাজ-প্রবাসকালেই তিনি ইংরেজিতে আখ্যায়িকা কাব্যও রচনা করেছিলেন। অতএব ভবিষ্যতে কবি হবার প্রস্তুতি নিয়েই তিনি তার সাহিত্য সাধনা শুরু করেছিলেন এবং কার্যতঃ তিনি বাঙলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি ও একমাত্র মহাকাব্য-রচয়িতার মর্যাদায়ও ভূষিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া বাঙলা সাহিত্যে নতুন ছন্দ এবং বহু নতুন কাব্যরীতি বা বিষয়েরও প্রথম প্রবর্তন করে তিনি বাংলা কাব্যের প্রথম পথিকৃৎ-এর দুর্লভ সম্মানও অর্জন করেছিলেন। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাসে, আকস্মিকভাবে এক প্রতিকূল অবস্থার মুখােমুখী হয়ে তাকে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয় যে তিনিই বাঙলা নাট্যসাহিত্যের দৈন্য মােচন করবেন। এবং তারই ফলােৎপত্তি-রূপে তিনি বাঙলা ভাষায় তার প্রথম রচনা প্রকাশ করেন ‘শমিষ্ঠা’ নাটক-রূপে। একথা কারাে অবিদিত নয় যে, বেলগাছিয়া নাট্যশালায় রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটক দর্শনের প্রতিক্রিয়াতেই মধুসূদন সুস্থ সবল বাংলা নাটক রচনার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। এটি ছাড়া আরাে কয়েকটি নাটক-প্রহসন রচনার মধ্য দিয়ে মধুসূদন যে বাঙলা ভাষায় শিল্পসম্মত মৌলিক নাটক রচনার পথ প্রদর্শন করেন, এটিই অতঃপর বাংলা সাহিত্যে আদর্শরূপে গৃহীত হয়।

মধুসূদন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সাহিত্যিক। সাহিত্যক্ষেত্রে রুচির পরিবর্তন তার পূর্বেই সূচিত হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু মৌলিক শিল্প-বস্তু সৃষ্টির শক্তি তার পূর্ববর্তী অপর কোন লেখকের ছিল না। মধুসূদন বিশেষভাবে কবিতা এবং নাটকের ক্ষেত্রে তার প্রতিভার শক্তি প্রয়ােগ করেন। মেঘনাদবধ কাব্যে যেমন তিনি আধুনিক কাব্যধারার সার্থক সূচনা করেছিলেন, নাটকের ক্ষেত্রেও তেমনি তারই রচনায় বাঙলা নাটকের উন্নত আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকাশের কালানুক্রমে তার নাটকগুলির নাম— ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০), ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ (১৮৬০) ‘বুড়াে শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০) এবং ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১)। জীবনের শেষ অধ্যায়ে অসুস্থ ও অর্থাভাবে পীড়িত মধুসূদন বেঙ্গল থিয়েটারের কর্তৃপক্ষের অনুরােধে দুটি নাটক রচনায় হাত দেন। ‘মায়াকানন’ তিনি সম্পূর্ণ করতে পেরেছিলেন, অপর নাটক বিষ না ধনুর্গুণ অসমাপ্ত থেকে যায়। ‘মায়াকানন’ কবির মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ খ্রীষ্টাব্দে। এই রচনায় নাট্যকার মধুসূদনের শক্তির কোনও পরিচয়ই নেই। শ্রেণী বিচারে ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ এবং ‘বুড়াে শালিকের ঘাড়ে রো’-কে ঠিক নাটক বলা চলে না, এই দুটি প্রহসন জাতীয় রচনা। মাত্র তিন বছরে মধুসূদন তিনখানি পূর্ণাঙ্গ নাটক এবং দুখানি প্রহসন রচনা করেন।

মধুসূদনের পূর্বে খ্যাতিমান নাট্যকার ছিলেন রামনারায়ণ তর্করত্ন। রামনারায়ণের অধিকাংশ রচনাই সংস্কৃত থেকে অনুবাদ। ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ নামের মৌলিক নাটকটির জন্যই তিনি প্রচুর জনসমাদর লাভ করেন। এই নাটক বা যােগেন্দ্রচন্দ্র গুপ্তের কীর্তিবিলাস’ এবং তারাচরণ শিকদারের ‘ভদ্রার্জুন’ মধুসূদনের পূর্বে রচিত। এর যে কোন একটি বিশ্লেষণ করলে প্রথমেই মনে হয় নাটকের গঠনশৈলী-সম্পর্কে ঐসব লেখকদের কোন পরিচ্ছন্ন ধারণাই ছিল না। পূর্বাপর অসম্পৃক্তভাবে কতকগুলি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং আকস্মিকভাবে আবির্ভূত কতগুলি চরিত্রের সংলাপ-সমষ্টিই তারা রচনা করেছেন। মধুসূদন বাংলা নাটকের এই হীনদশা দেখে পীড়িত মন নিয়েই নাটক রচনায় অগ্রসর হয়েছিলেন। পাশ্চাত্ত্য নাটকের উন্নত আদর্শ-অনুসরণই যে বাংলা নাটকের উন্নতির একমাত্র উপায় এ বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ধারণা পােষণ করতেন। সমসাময়িক কালে বন্ধুবান্ধবদের কাছে লেখা চিঠিতে মধুসূদন বহু স্থানে বাঙলা নাটকের সম্ভাব্য রূপ-সম্পর্কে আলােচনা করেছেন। এইসব তথ্য থেকে বােঝা যায় নাট্যশিল্প বিষয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা এবং স্পষ্ট ধারণা নিয়েই তিনি বাঙলা ভাষায় নাটক রচনা করতে অগ্রসর হয়েছিলেন।

নাটক রচনার প্রধান সমস্যা বর্ণনীয় বিষয়কে প্রত্যক্ষবৎ করে তােলা। এক-একটি নাট্য- পরিস্থিতির পটে নানামুখী প্রবণতাসম্পন্ন চরিত্রগুলিকে উপস্থাপন করে dramatic action সৃষ্টি ভিন্ন রচনায় নাটকীয়তা পরিস্ফুট হয় না। পরােক্ষ বিবৃতির পরিবর্তে নাট্যক্রিয়া বা action-ই নাট্যরসের প্রধান অবলম্বন। মধুসুদনেই প্রথম এই শিল্পকৌশল-বিষয়ে সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। অবশ্য তিনি প্রথম নাটকেই পূর্ণসিদ্ধি অর্জন করতে পারেন নি। পরীক্ষা নিরীক্ষার পথেই তাকে সাফল্যের দিকে অগ্রসর হতে হয়েছে। মধুসূদনের প্রথম নাটক শর্মিষ্ঠাকে পরীক্ষামূলক রচনাই বলা যায়। ‘শর্মিষ্ঠা’য় মহাভারতের আদিপর্বের শর্মিষ্ঠা-যযাতি-দেবযানীর প্রেমের কাহিনী ব্যবহার করা হয়েছে। এই ত্রিভুজ প্রেমের কাহিনী ঈর্ষা ও কাম বৃত্তির বিরােধে নাট্যরসের প্রভূত সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এর রূপায়ণে মধুসূদন সর্বত্র বলিষ্ঠ নাট্যকল্পনার পরিচয় দিতে পারেন নি। মনে হয় তখনকার প্রথা অনুযায়ী এবং রঙ্গমঞ্চের কর্তাদের রুচির মান রক্ষার জন্যই তিনি এই নাটকে মুখ্যত সংস্কৃত নাট্যরীতিই অনুসরণ করেছেন। এই নাটকের মূল ঘটনার কোনটিই প্রত্যক্ষভাবে দেখানাে হয়নি, নেপথ্যে সংঘটিত ঘটনাগুলি রঙ্গমঞ্চে দীর্ঘ বর্ণনাত্মক সংলাপে বিবৃত হয়েছে। সংলাপ-রচনাতেও মধুসূদন এই নাটকে সংস্কৃত নাটকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

মধুসূদনের দ্বিতীয় নাটক পদ্মাবতী অপেক্ষাকৃত উন্নত রচনা। এই নাটকটির ভিত্তি গ্রীক পুরাণের একটি বিখ্যাত গল্প। সেই কাহিনীতে হেরা, আথেনে এবং আফ্রোদিতে এই তিন দেবীর মধ্যে একটি সােনার আপেলের অধিকার নিয়ে বিরােধ এবং প্যারিস-এর মধ্যস্থতায় আফ্রোদিতের জয়লাভ ও পরবর্তী স্তরে তিন দেবীর মধ্যে ঈর্ষা ও দ্বন্দ্বের যে জটিলতা দেখা যায়, মধুসূদন কৌশলে সেই কাহিনী ভারতীয় পুরাণের দেবদেবী চরিত্র অবলম্বনে বিবৃত করেছেন। গ্রীক পুরাণের দেবীত্রয় মধুসূদনের রচনায় শচী, রতি ও মুরজার রূপ ধারণ করেছে। প্যারিস ও হেলেন হয়েছে ইন্দ্রনীল ও পদ্মাবতী ‘পদ্মাবতী’ নাটকে ‘শর্মিষ্ঠা’র তুলনায় প্রত্যক্ষ ঘটনা এবং নাট্যক্রিয়া অনেক বেশি, অবশ্য সমস্ত ঘটনার গতি নিয়ন্ত্রিত হয়েছে নেপথ্যের দৈবশক্তি দ্বারা। অনেক সমালােচকের মতে এর ফলে নাট্যকাহিনী স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে। শর্মিষ্ঠার তুলনায় ‘পদ্মাবতী’ গঠনের দিক থেকে অনেক শিথিলবদ্ধ এবং অবিন্যস্ত। কিন্তু এই নাটকে সংলাপের ভাষা অনেক স্বচ্ছন্দ এবং নাটকীয় গুণসম্পন্ন এই নাটকেই মধুসূদন সর্বপ্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন। Dramatic action সৃষ্টিই নাটকের প্রধানতম গুণ, এইদিক থেকে বহু ত্রুটি সত্ত্বেও ‘পদ্মাবতী’কে ‘শর্মিষ্ঠা’র তুলনায় উন্নততর রচনা বলা যায়। ঘটনার পরােক্ষ বিবৃতি মধুসূদন ‘পদ্মাবতী’তে সতর্কভাবে পরিহার করেছেন।

মধুসূদনের শ্রেষ্ঠ ট্র্যাজেডি-নাটক কৃষ্ণকুমারী। কৃষ্ণকুমারী উদয়পুরের রাজা ভীমসিংহের কন্যা। অপরূপ সুন্দরী কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করবার প্রস্তাব আসে জয়পুরের রাজা জগৎসিংহের কাছ থেকে। জগৎসিংহের রক্ষিতা বিলাসবতী এই বিয়ে বন্ধ করতে উদ্যোগী হয়। বিলাসবতীর দূতী মদনিকার কৌশলে কৃষ্ণকুমারী মানসিংহের প্রতি আকৃষ্ঠ হলেন। ভীমসিংহ স্থির করেছিলেন জগৎসিংহের হাতেই কন্যা সমর্পণ করবেন, কিন্তু মানসিংহ কৃষ্ণকুমারীকে বিয়ে করতে আগ্রহী জেনে তিনি মহাসঙ্কটে পড়লেন। উদয়পুরের শত্রু মহারাষ্ট্রপতি এবং মােগল শক্তি মানসিংহের সমর্থক। জয়সিংহ এবং মানসিংহ—উভয় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীই স্থির করলেন কৃষ্ণকুমারীকে না পেলে উদয়পুর আক্রমণ করবেন। ভীমসিংহের মন্ত্রী কৃষ্ণাকে হত্যা করতে পরামর্শ দিলেন, কৃষ্ণার মৃত্যুই এই সঙ্কট থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। দুঃসহ মানসিক দ্বন্দ্বে ভীমসিংহ উন্মাদগ্রস্ত হলেন। ভীমসিংহের ভ্রাতা বলেন্দ্র কৃষ্ণাকে হত্যা করবেন স্থির করলেন, কিন্তু তার আগে কৃষ্ণা আত্মহত্যা করল। এই কাহিনী রাজস্থানের ইতিহাস থেকে সংগৃহীত। ইতিহাস-অবলম্বনে এই-ই প্রথম বাঙলায় নাটক লেখা হল। পৌরাণিক কাহিনীর অলৌকিক, দৈবশাসিত বাতাবরণের পরিবর্তে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে মধুসূদন দ্বন্দ্বময় বাস্তবতার ওপর নির্ভর করেছেন। ‘শর্মিষ্ঠা’ এবং ‘পদ্মাবতী’র তুলনায় এ কাহিনী অনেক বলিষ্ঠ। কৃষ্ণকুমারী, ভীমসিংহ এবং সমগ্র উদয়পুর বাইরের দুটি প্রবল শক্তির আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে—সমস্ত নাটকে এই অসহায়তাবােধ এবং বিপদের ছায়া প্রলম্বিত। স্বদেশের বিপদ দূর করার জন্য কৃষ্ণার আত্মহত্যার ঘটনায় নাটকটিতে ট্র্যাজেডি ঘনীভূত হয়। এই বিষাদান্ত পরিণাম কৃষ্ণার নিজের কোন দুর্বলতার জন্য না ঘটায় হয়তাে বা কিছুটা আকস্মিক এবং যুক্তিক্রম- বিবর্জিত, তবুও দেশরক্ষার জন্য এই আত্মােৎসর্গে কৃষ্ণকুমারী যথার্থ ট্র্যাজেডির নায়িকার মর্যাদা লাভ করে। গ্রীক নাট্যকার ইউরিপিদে-এর ইফেগেনিয়ার কিছু প্রভাব কৃষ্ণকুমারীর বলিদানে অনুভব করা যায়। নারীচরিত্রগুলির মধ্যে মনিকা উল্লেখযােগ্য। ধনদাসের নিগ্রহের পর তার প্রতি করুণা, এই নারী ভূমিকাটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে বিলাসবতী ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকের বসন্তসেনার অনুকরণ হলেও একেবারে বৈশিষ্ট্যবর্জিত নয় গ্রীক নাটকের অনুকরণে অশরীরী পদ্মিনীর আবির্ভাব নাট্যরসকে ঘনীভূত হতে দেয়নি।

‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের একটি উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য মধুসূদনের দেশাত্মবােধের প্রকাশ। ভীমসিংহের এই আক্ষেপে আমরা যেন সে যুগের ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালীর মনের কথা প্রতিধ্বনিত হতে শুনি ও (দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়িয়া) ভগবত, এ ভারতভূমির কি আর সে শ্ৰী আছে! এদেশের পূর্বকালীন বৃত্তান্ত সকল স্মরণ হলাে, আমরা যে মনুষ্য, কোনমতেই ত এ বিশ্বাস হয় না। ‘কৃষ্ণকুমারী’ই বাঙলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ট্রাজেডি। ‘কৃষ্ণকুমারী’তে পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্তর উত্তীর্ণ হয়ে যথার্থ নাটকীয় রসবস্তু-সৃষ্টিতে প্রশ্নাতীত সাফল্য অর্জন করেছেন মধুসূদন।

উনবিংশ শতাব্দীর বাঙলা নাট্যসাহিত্যের একটি বিশিষ্ট শাখা প্রহসন। বাঙলা প্রহসন বাঙলাদেশের লেখকদের নিজস্ব সৃষ্টি, এই জাতীয় রচনা পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যে দেখা যায় না। নানাবিধ সামাজিক সমস্যা এবং প্রাচীনপন্থী ও নব্য সমাজের মানুষদের চারিত্রিক অসঙ্গতিই প্রহসনের বিষয়। উনবিংশ শতাব্দীর গদ্যসাহিত্যে যে ব্যঙ্গাত্মক নকশা জাতীয় রচনার প্রাদুর্ভাব ঘটেছিল,মনে হয় নাটকের আঙ্গিকে সেই জাতীয় বিষয় উপস্থাপনের চেষ্টা থেকেই প্রহসনের জন্ম হয়েছে। মধুসূদন নব্য বাঙলার আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত যুবকদের চারিত্রিক ভ্রষ্টতার ব্যঙ্গচিত্র এঁকেছিলেন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনে। এই প্রহসনের নায়ক নববাবু এবং নববাবুর ইয়ারবন্ধুদের জ্ঞানতরঙ্গিণী সভার কৌতুককর ব্যঙ্গচিত্র সংস্কার-মুক্তির নামে নব্যবঙ্গের পাশ্চাত্ত্য প্রেমিকদের উৎকট ব্যভিচারের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়েছে।

মধুসূদনের দ্বিতীয় প্রহসন ‘বুড়াে শালিকের ঘাড়ে রোঁ’-তে আক্রমণের লক্ষ্য ধর্মের ভেকধারী প্রাচীনপন্থীদের লাম্পট্য। অত্যাচারী, কৃপণ জমিদার ভক্তপ্রসাদ সর্বদা ধর্মনিষ্ঠার বুলি আওড়ান, কিন্তু ইন্দ্রিয়াসক্তির বেলায় জাতিবিচার করেন না। মুসলমান প্রজা হানিফের সুন্দরী স্ত্রী ফতেমার প্রতি ভক্তপ্রসাদের আসক্তি এবং শেষ পর্যন্ত হানিফের হাতে প্রহার ভােগ ও অর্থদণ্ড দ্বারা অব্যাহতি লাভের এই কাহিনীতে মধুসূদন উৎকৃষ্ট হাস্যরস সৃষ্টি করেছেন। এই প্রহসনে সবচেয়ে লক্ষণীয় বিষয় চরিত্র-অঙ্কনে অসামান্য দক্ষতা। হানিফ, ফতেমা, গদাধর প্রভৃতি সাধারণ গ্রাম্য মানুষের চরিত্র মধুসূদনের হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। সংলাপ-রচনার দক্ষতাই এই সাফল্যের হেতু। গ্রামের হিন্দু-মুসলমান চাষীদের মুখের ভাষা মধুসূদন অনায়াসে ব্যবহার করেছেন। মধুসূদন এই প্রসঙ্গে চরিত্রগুলির মুখে কাব্যিক আলংকারিক ভাষার পরিবর্তে স্বাভাবিক কথ্যভাষা ব্যবহারের সংকল্প প্রকাশ করেছেনঃ “I shall endeavour to create characters who speak as nature suggests and not mouth mere poetry.” পরবর্তী নাট্যকারদের মধ্যে একমাত্র দীনবন্ধুর রচনাতেই এর সঙ্গে তুলনাযােগ্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। ‘বুড়াে শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনটি ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’র তুলনায় অনেক পরিণত রচনা। অর্থলােভ, কৃপণতা ও লালসা নায়ক ভক্তপ্রসাদের মনে যে বিচিত্র দ্বিধাতরঙ্গ সৃষ্টি করেছিল, ভূমিকাটিতে তার বাস্তব রসােজ্জ্বল চিত্রণ আমাদের মুগ্ধ করে। প্রহসন হলেও ‘বুড়াে শালিকের ঘাড়ে রো’তে কাহিনী এবং চরিত্রের পরিকল্পনার অখণ্ডতা এবং হাস্যকরুণ পরিস্থিতির মধ্যে মানুষের অসহায়তার চিত্র হাস্যরসকেও গভীর করে তুলেছে।

মধুসূদনের নাট্যরচনার কাল নিতান্তই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু মৌলিক প্রতিভার শক্তি ছিল বলেই তিনি এই সামান্য দু-তিন বছরের মধ্যে বাঙলা নাটক-প্রহসনের ক্ষেত্রে একটি উচ্চ আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন পৌরাণিক প্রসঙ্গের ব্যবহার বা বাস্তব জীবন-সমস্যানির্ভরতা— নাট্যকারের প্রবণতা যেরকমই হােক না কেন, রচনাশৈলী-বিষয়ে উন্নততর শিল্পচেতনা না থাকলে কোন বিষয়ই রসপরিণাম লাভ করতে পারে না বাঙলা নাটকের ক্ষেত্রে উপযুক্ত রচনাশৈলী উদ্ভাবনই মধুসূদনের প্রধান কৃতিত্ব বাঙলা নাটক প্রহসনের পরবর্তী ধারা মধুসূদন-নির্দেশিত পথে অগ্রসর হয়েই শিল্পগত সিদ্ধিতে পেঁৗছেছে। পরবর্তীকালের সমস্ত প্রহসন এবং কোনও কোনও নাটক মধুসূদনের প্রহসন দুটির প্রভাব অতিক্রম করতে পারেনি। “মধুসুদন স্বভাবতঃ ছিলেন কবিপ্রকৃতি, অতএব অতিসঙ্গত কারণেই নাটক রচনাকে তার স্বভাবধর্মের অনুগামী বলে মনে করা চলে না। বাংলা নাটকের দুর্গতি লক্ষ্য করেই তার আবেগপ্রবণ মন আকস্মিকভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে এবং তারই প্রত্যক্ষ প্রতিক্রিয়ায় তার নাটক সৃষ্টি। অতএব এই নাটকে তার প্রতিভার যথার্থ পরিচয় খুঁজে পাওয়া যাবে না, বস্তুতঃ আধুনিক নাট্যরীতির প্রবর্তক হলেও তাই মধুসূদনের নাটকগুলি সার্থকতামণ্ডিত হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু মধুসূদন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য- উভয় রীতির নাটকের সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন বলেই নাটকের রূপ, রীতি-আদি বহিরঙ্গীয় উপকরণ বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। তাই তার পক্ষে আধুনিক রীতির অর্থাৎ পাশ্চাত্ত্য রীতির নাটক রচনা দুঃসাধ্য ছিল না। বস্তুতঃ মধুসূদন পাশ্চান্ত্য আদর্শে বাঙলা নাটক রচনা করে একটা পথরেখা তৈরি করে দিয়েছিলেন, যার অনুসরণে পরবর্তীকালে অনেকেই বহু সার্থক নাটক রচনা করে গেছেন। মধুসূদন নাটকে সবই করেছিলেন, শুধু প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি।” (সমগ্র বাঙলা সাহিত্যের পরিচয়, দ্বিতীয় খণ্ড)।