শেকসপিয়ার তার সমকালীন নাট্যকার ক্রিস্টোফার মার্লোর বহু নাটক থেকে ভাব আহরণ করে যেমন এলিজাবেথীয় যুগের বিশ্ববন্দিত নাট্যকাররূপে নন্দিত হয়েছেন, দীনবন্ধু মিত্র তেমনি অগ্রবর্তী মধুসূদনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও মাইকেলী যুগের শ্রেষ্ঠ নাট্যকার রূপে হয়েছেন বন্দিত। এক মহাকাব্যোচিত মহিমা ও দেশবিদেশের ধ্রুপদী পৌরাণিক ভাবাসঙ্গের নেপথ্য থেকে মধুসূদন জীবনকে দেখেছেন। আর দীনবন্ধু জীবনকে দেখেছেন গ্রাম বাংলার সহজ বিকীর্ণতায়, নির্মোকহীন জনতার ভাঙ্গাচোরা মুখের কথায় এবং জীবন ও হাস্যরসিকের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিক্ষেপে। কোন ধার করা কৃত্রিম উপাদান নয়, বাংলার জীবনসম্ভূত অমৃত ধারাতেই তাঁর নাটক অভিসিঞ্চিত। তাঁর নাটকেই প্রথম পাওয়া যায় জীবনের উচ্চতর বায়ুমণ্ডলের পরিবর্তে বাংলার ধূলিমাটির স্পর্শস্বাদ। বাংলাদেশে তিনিই প্রথম ব্যাপকতম জনতার জীবন ভাষ্যকার।
দীনবন্ধু মিত্রের জন্ম ও কর্মজীবন:
নদীয়া জেলার চৌবেড়িয়া গ্রামে দীনবন্ধুর জন্ম হয় ১৮৩০ খ্রীস্টাব্দের ১লা নভেম্বর। পিতৃদত্ত নাম ছিল গন্ধর্বনারায়ণ। ঈশ্বরগুপ্তের প্রেরণায় ‘সংবাদপ্রভাকর’ পত্রিকায় কবিতাচর্চার মধ্য দিয়ে প্রথম সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। হিন্দু কলেজে পড়াশুনো করেন। তারপরে পোস্টমাস্টারের চাকরি নিয়ে প্রথমে পাটনা, পরে বিহার, উড়িষ্যা ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে বদলি হন। সেইসময় নীলকর সাহেবদের অত্যাচার সম্পর্কে তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়।
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যগ্রন্থসমূহ:
‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০), ‘নবীন তপস্বিনী’ (১৮৬৩), ‘কমলে কামিনী’ (১৮৭৩)।
প্রহসন : ‘সধবার একাদশী’ (১৮৬৬), ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ (১৮৬৬), ‘লীলাবতী’ (১৮৬৭), ‘জামাইবারিক’ (১৮৭২)।
১৮৬০ সালে দীনবন্ধুর প্রথম নাটক ও বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর গ্রন্থ ‘নীলদর্পণ’-এর বিপ্লবী আবির্ভাব। এই নাটকে শক্তিমদমত্ত অত্যাচারী নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহবাণী রুদ্রকণ্ঠে ঘোষিত। এর প্রভাব সমসাময়িককালেই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। এই নাটক শোষণ আর অত্যাচারের বিরুদ্ধে রক্তের অক্ষরে লেখা মেহনতী মানুষের নিত্যকালের প্রতিবাদ। এর কাহিনী মুক্তিকামী জনগণের চিরকালীন জীবনচিত্র। হ্যারিয়েট বিচার স্টো-র লেখা ‘Uncle Tom’s Cabin’ আমেরিকার কাফ্রীদের দাসত্ব মোচনে গ্রহণ করেছিল এক বৈপ্লবিক ভূমিকা। অন্যদিকে দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণ’ও যথার্থই বাংলার ‘Uncle Tom’s Cabin’, শুধু জীবনের আবেগ মুক্তির নয়, নাটকটি মনুষ্যত্ব বিরোধী শোষণ মুক্তিরও দুঃসাহসিক বাণীরূপ। চরিত্র সৃষ্টিতেও ‘নীলদর্পণ’ নিঃসঙ্গ।
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যসাহিত্যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
ঢাকায় থাকাকালীন ১৮৬০ খ্রীস্টাব্দে দীনবন্ধুর ‘নীলদর্পণে’র প্রথম প্রকাশ (২রা আশ্বিন, ১৮৭২ শকাব্দ)। নাট্যকারের নাম না থাকায় “নীলকর বিষধর-দংশন-কাতর-প্রজানিকর ক্ষেমঙ্করেণ কেনচিৎ পথিকেনাভি প্রণীতং” নামে শ্রীরামচন্দ্র ভৌমিকের বাংলা যন্ত্রে ঐ গ্রন্থ মুদ্রিত হয়। ১৮৬১ সালে দীনবন্ধুর বাল্য শিক্ষক পাদরি জেমস্ লঙের নামে “NIL DURPAN’ বা ‘The Indigo Plant in and Mirror – A native নামে জনৈক ব্যক্তি অনুবাদ করেন। গ্রন্থের মুদ্রাকর C. H. Manuel-এর বিরুদ্ধে ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকার সম্পাদক মামলা করেন। বিচারে লঙের কারাবাস ও ম্যানুয়েলের জরিমানা হয়। অনুবাদক রূপে মধুসূদন দত্তের নামটিই প্রচলিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে অধ্যাপক তপোবিজয় ঘোষ ‘নীল’ বইতে অজানা তথ্য-প্রমাণে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘নীলদর্পণে’র ইংরেজী অনুবাদক কখনই মধুসূদন নন। সিপাহী বিদ্রোহের ঠিক তিন বছর পরে ‘নীলদর্পণ’ প্রকাশিত হয়। একথা নিঃসন্দেহ সিপাহী বিদ্রোহের প্রকাশ হঠাৎ ঘটলেই তার প্রস্তুতি যে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু সেই বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা ব্যাপকভাবে ইংরেজ রাজপুরুষদের সচেতন করেনি। তার প্রমাণ, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে সাঁওতাল ও নীল বিদ্রোহ ঘটেছিল। ১৭৮৯ খ্রীঃ ২৯শে অক্টোবরের ঘোষণাপত্র থেকে জানা যায়। Louis Bonnaud নামে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ থেকে আগত এক ফরাসির তালডাঙ্গা ও গোন্দলপাড়ার প্রতিষ্ঠিত নীলকুঠির মাধ্যমে এ দেশে প্রথম নীলচাষের আমদানি হয়। পরে একাধিক নীলকরের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রদেশে নীলকুঠি স্থাপিত হয়।
সতীশচন্দ্র মিত্রের গ্রন্থে উল্লিখিত আছে Bengal Indigo Co. নদীয়া ও যশোহরে সবচেয়ে বড় ‘কানসারণ’ ছিল এবং তার অধীনে চারটি প্রধান ‘কানসারণ’ ছিল। মোল্লাহাটি কুঠির সংখ্যা ছিল ১৭। এখানেই বেঙ্গল ইনডিগো কোম্পানীর প্রবল প্রতাপান্বিত Mr. R. T. Larmour থাকতেন। ১৮৬০ খ্রীঃ প্রথম দিকে জেমস কারলঙ্ মোল্লাহাটি ‘কানসারণে’ আসেন। এই কুঠির অত্যাচারের ঘটনা নিয়েই দীনবন্ধু ‘নীলদর্পণ’ লেখেন। বারাসাতের ম্যাজিস্ট্রেট স্যার এসলি ইডেনের রায়ে নীলচাষ রায়তের ইচ্ছাধীন বলে স্বীকৃত হয়। সেই আইনে আশ্বস্ত হয়ে ১৮৫৯ খ্রীস্টাব্দে যশোহর-চৌগাছার বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও নদীয়ার গুয়াতেলী গ্রামের দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ কৃষক নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় শিশির কুমার ঘোষ এই ধর্মঘটে সহায়তা করেন। এই দিগম্বর বিশ্বাসের পরিবারই ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মূল কাহিনীর অবলম্বন হয়ে ওঠে।
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যসাহিত্যে সমকালের ঘটনাসমূহ:
নীল বিদ্রোহের সময় Mr. Cookburnes Case, Mr. White’s Case, Mr. Mear’s Case, Mr. MacArthur’s Case ইত্যাদি অত্যাচারী নীলকরদের কুকর্মের ঘটনাসমূহ প্রচারিত হয়। বলপ্রয়োগে নীলকুঠিতে ধরে নিয়ে যাওয়া, অন্ধকারে গুদাম ঘরে অনাহারে আটকে রাখা, সশস্ত্র লাঠিয়াল ও সড়কিওয়ালা পাঠিয়ে দরিদ্র কৃষকের লাঙ্গল গরু ছিনিয়ে নেওয়া ইত্যাদি সমস্ত ঘটনার উল্লেখ এইসব মামলায় আছে। নদীয়ার কৃষক পরিবারের কন্যা সুন্দরী হরমণিকে হরণ করার প্রসঙ্গ ক্ষেত্রমণির মাধ্যমে রূপায়িত হয়েছে। রোগসাহেব সেখানে আর্চিবলড হিল্সের প্রত্যক্ষ রূপ মাত্র। এ সম্পর্কে হেমেন্দ্রকুমার দাশগুপ্ত লিখেছেন : “Indeed Khetramani of the drama was none but Harimani, a peasant girl of Nadia in flesh and blood known as one of the beauties of Krishnagar who was carried to the Kulchikatta factory in charge of Archibald Hills, the Chota Saheb, where the girl was kept in his bedroom till late hours of the night and the kind magistrate of Amaranagar was no other person than Mr. W. J. Herschell, grandson of the great astronomer.” (The Indigo Stage’, II 1956, P. 92)।
নীল আন্দোলনের ‘বোধ’কে অনুভব করার মত সংবেদী মানুষের সেদিন অভাব ছিল না। Champbell লিখেছেন— “It was an unwhole some system, but long went on without any serious outbreak.” (Champbell, Sir George, Memories of My Indian Carrier -p, 104 ) লর্ড Canning লিখেছেন একটি চিঠিতে— “I assure you that for about a week it caused me more anxiety than I have had since they days of Delhi, and form that day I felt that a shot fired in anger or fear by one foolish planter might put every factory in lower Bengal in flames.” অথচ ভাবতে আশ্চর্য লাগে রামমোহন, দ্বারকানাথের মতো ব্যক্তিরা নীল-আন্দোলনকে সমর্থন করা দূরে থাকুক তার বিপক্ষে নীরব ছিলেন বা বিরোধিতা করেছিলেন। রামমোহন মহামতি অথচ তিনিই লর্ড বেন্টিঙ্কের কাছে লেখা একটা চিঠিতে বলেছেন: “বাংলাদেশে নীলচাষগুলির উৎকর্ষ দেখে তাঁর একথা ধারণা হয়েছে যে নীলচাষীরা অন্যান্য চাষীর তুলনায় অনেক বেশি বিত্তবান।”
দীনবন্ধু মিত্রের নাট্যসাহিত্যে চরিত্রসৃষ্টি:
জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টিতে দীনবন্ধুর অসামান্য দক্ষতা প্রসঙ্গে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র বলেছেন – “দীনবন্ধু অনেক সময়েই শিক্ষিত ভাস্কর বা চিত্রকরের ন্যায় জীবিত আদর্শ সম্মুখে রাখিয়া চরিত্রগুলি গড়িতেন। সামাজিক বৃক্ষে সামাজিক বানর সমারূঢ় দেখিলেই অমনিই তুলি ধরিয়া তাহার লেজশুদ্ধ আঁকিয়া লইতেন।”
বাংলা সাহিত্যে ‘তোরাপ’ ও ‘রাইচরণের’ মত কৃষক, পদী ময়রানীর মতো কুটনী এবং আদুরীর মতো ঝি আর একটিও সৃষ্টি হয় নি। এর কারণ, তিনি বিশ্বজনীন ভাবলোকের ক্লাস্ত মুসাফির ছিলেন না। প্রত্যক্ষ বিষয়ের সঙ্গে নিবিড় সহানুভূতি ও বিস্ময়কর অভিজ্ঞতাই তাঁর বাস্তবমুখী চেতনার মৌল উৎস। অঙ্কিত চরিত্রের মুখে নিঁখুত ভাষা প্রয়োগেও তিনি সিদ্ধহস্ত ছিলেন। আর্টের ভাষা বা ভদ্রতার ভাষা ব্যবহার এখানে অসঙ্গত।
বঙ্কিমের সারগর্ভ মন্তব্য এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য : “তাহার গ্রন্থে যে রুচির দোষ দেখিতে পাওয়া যায় তাহার প্রবলা, দুর্দমনীয়া সহানুভূতিই তাহার কারণ। কিছু বাদসাধ দিবার তাঁহার শক্তি ছিল না। তোরাপের সৃষ্টিকালে তোরাপ যে ভাষায় রাগ প্রকাশ করে, তাহা বাদ দিতে পারিতেন না, রুচির মুখ রক্ষা করিতে গেলে ছেঁড়া তোরাপ, কাটা আদুরী আমরা পাইতাম।”
তবে একথা ঠিক, ভদ্রমধ্যবিত্ত চরিত্রাঙ্কনে দীনবন্ধু কিছুটা অসফল। এর কারণ, ১৮৫৮ থেকে ১৮৬২ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলা গদ্যরীতি ছিল অনিশ্চিত। একদিকে ছিল নিতান্ত অসাধু সাধুভাষার জের, অন্যদিকে একান্ত অচল চলতি ভাষার প্রচার। এই বিপরীতগামী প্রকৃতির ঘূর্ণাবর্তে পড়ে দীনবন্ধুর আবির্ভাবের সময় বাংলা গদ্যের সমস্যা জটিল রূপ ধারণ করেছিল।
‘নীলদর্পণ’ ট্র্যাজিক, কিন্তু ট্র্যাজেডি নয়। ট্র্যাজেডির মূলে যে সূক্ষ্ম ভাবকল্পনা থাকে, যা কেবল বাইরের ঘটনারূপ বা দৈবনির্ভর নয়, অন্তরের পরস্পর দ্বন্দ্ব-প্রবণ প্রবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত—‘নীলদর্পণ’-এ তা অনুপস্থিত। মানবহৃদয়ের যে বেদনা এতে চিত্রিত, তার মৌল উদ্দীপনা অন্তর্জগতের ঘাত-প্রতিঘাতের নয়, অনিবার্য ঘটনার দ্রুত আক্রমণের সঙ্গে অসহায় মানুষের নিদারুণ সংঘর্ষের পরিণতি। সৌভাগ্যের ঝাড়লন্ঠন কিভাবে মৃত্যুপাথরের উপর ভেঙ্গে পড়ে চুরমার হয়ে যায় তার অসহায় দৃশ্য। স্তূপীকৃত মৃত্যু, উন্মাদ ও আত্মহত্যার বীভৎস সমাবেশে দীনবন্ধু শোককে বিলাসের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন। তবু, এইসব ত্রুটি সত্ত্বেও বাংলা সাহিত্যে ‘নীলদর্পণ’ এক শাশ্বত সম্পদ ঃ “a possession for ever.” জনৈক মার্কিন সমালোচক ‘Uncle Tom’s Cabin’ সম্বন্ধে যা বলেছেন তা ‘নীলদর্পণ’ সম্পর্কেও প্রযোজ্য হতে পারে : “It has some amount of literary greatness, if not artistic skill”.
দীনবন্ধু মিত্রের অন্যান্য নাটক:
দীনবন্ধুর পরবর্তী নাটকগুলি হল—’নবীন তপম্বিনী’, ‘সধবার একাদশী’, ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’, ‘লীলাবতী’, ‘জামাই বারিক’ ও ‘কমলে কামিনী’। সৌভাগ্যক্রমে এইগুলির মধ্যে আর ট্রাজিডির পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। এইগুলি হাস্যরসাত্মক এবং প্রহসন জাতীয়। শেকসপিয়রের প্রথম যুগের কমেডি “Merry Wives of Wind sor”, “Comedy of Errors” প্রভৃতি নাটকের মতো অজস্র উদ্ভাসিত হাস্যরসই এই নাটকগুলির সম্পদ।
এই মধ্যে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য প্রহসনধর্মী নাটক হল ‘সধবার একাদশী’। তিন অঙ্কে বিন্যস্ত ‘সধবার একাদশী’র বিষয়বস্তু আত্ম-সামালোচনা; তার সমকালীন ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ নাটকের বিষয়বস্তু ছিল পর সমালোচনা। হিন্দু কলেজের ছাত্র, কৃষ্ণনগরে দীর্ঘকাল বসবাসী দীনবন্ধু (সেখানে আরো যারা প্রতিবেশী ছিলেন রামলোচন ঘোষ, উমেশচন্দ্র দত্ত, মাধবচন্দ্র মল্লিক ও রামতনু লাহিড়ী) সে যুগের সর্ববিধ আধুনিক প্রবণতার সঙ্গে একাত্ম ছিলেন। নাটকের শুরু কঁাকুড়গাছি নকুলেশ্বরের উদ্যানে, শেষ— – কাশারী পাড়ায় অটলবিহারীর বৈঠকে। প্রসঙ্গত স্মরণীয় ছিল, উত্তর কলকাতার এই বিশিষ্ট অঞ্চল অনতি-পরবর্তী লেখক গিরীশচন্দ্রেরও বহু নাট্য-চরিত্রের বিচরণভূমি। দীনবন্ধুর নাটকে কোনও সংশোধনের ইশারা নেই, কারণ নাট্যকারের মুখ্য লক্ষ্য ছিল আনন্দদান, শিক্ষাদান নয়। কিন্তু এই ধরনের নাটকে শোধনী মনোভঙ্গী যে একেবারে থাকে না তা নয়ঃ “Society punishes by laughter the individual’s deviation from social norms.” কিন্তু দীনবন্ধু এখানে তুলে ধরেছেন পরিপূর্ণ জীবন ; তার লোভ-মিথ্যাচার ভণ্ডামী-ধূর্ততা। তিনি দেখিয়েছেন এক প্রতিভাবান, যথার্থ জ্ঞানী ও যোগ্য লোক—যে পারিবারিক জীবনে, বা সামাজিক জীবনে কোনরূপ স্বীকৃতি পায়নি। এই ব্যর্থ নিস্ফল নৈরাশ্য-পীড়িত শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দ্বিধা শূন্য উচ্চহাসিই এই নাটকের প্রাণ। ‘সধবার একাদশী’ তাই যেমন দারুণভাবে সমসাময়িক, তেমনি কালাতীত। নিমচঁাদ সেই যুগের ব্যর্থ শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একক প্রতিনিধি। প্লুটাসের মত শুধু হাসিয়েই তিনি ক্ষান্ত হননি; টেরেন্সের মত ভাবুকের ভাবনাকেও জাগাতে চেয়েছেন। তাই তাঁর নাটকে ঘটনা পরিকল্পিত হয়নি, উৎকলিত হয়েছে। বাস্তব জীবনের নির্বাচিত অংশ তুলে নেওয়া হয়েছে।
নাটকে নিমে দত্ত নায়ক হয়েও নায়ক নয়। গল্পকে সে টেনে নিয়ে যাচ্ছে না, নিয়ে চলেছে। অটল। অথচ সমগ্র প্লটের কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। নানা ঘটনার ওপর তারই মন্তব্য আমাদের আগ্রহকে ধরে রাখে, উল্লসিত ও উচ্চকিত করে। আবার নিমচঁাদ অটলের ইয়ার বটে, কিন্তু ভোলার মতো সে নির্বোধ ইয়ারকি মারে না। সে মাতাল এবং উচ্ছৃঙ্খল হলেও তার গভীর অনাসক্তি ও সূক্ষ্ম আভিজাত্যবোধে তাকে পাপকাজে ইন্ধন জোগায় না। সে পুণ্যাত্মা নয়, নীতিনিষ্ঠ নয়, কিন্তু ইন্দ্রিয়পরায়ণতায় তার আসক্তি নেই। তাঁর নিজেকে নিয়ে ব্যঙ্গ শরত্চন্দ্রের ষোড়শীর নায়ক জীবনানন্দকে মনে পড়িয়ে দেয়। বস্তুত, সাহিত্যের ব্যক্তি বাস্তবের ব্যক্তির হুবহু রূপায়ণ নয়। সে বহুর রূপ আত্মস্থ ক’রে হয় অনন্যরূপী।
দীনবন্ধু ‘বিয়ে পাগলা বুড়ো’ নাটক তিন অঙ্কে বিন্যস্ত। প্রথমদিকে স্থূল বাহ্যজীবনকে প্রাধান্যদান, তারপর আচরণ বা আবরণ ছেড়ে ব্যক্তিস্বরূপকে ধরবার চেষ্টা এ নাটকে করা যায়। ষাট বছরের বুড়ো রাজীবের পনেরো বছরের বয়স্কা বিধবা কন্যা আছে। কিন্তু সে পুনর্বিবাহে উৎসুক। আর সে কারণেই ব্যঙ্গ তুঙ্গে উঠেছে। অবশ্য পণ্ডিত রামগতি ন্যায়রত্ন গ্রাম্য বালকদের নিয়ে রাজীবের সঙ্গে রঙ্গরস অবতারণাকে সমর্থন করেননি, ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ও মন্তব্য করেছিল: “morally improbable and has no existence in real life.” মধুসূদনের প্রাচীনপন্থীদের প্রতি বিদ্রূপের যে উৎকৃষ্ট Satire ভক্তপ্রসাদের মধ্যে লক্ষণীয়, এখানে তার পরিবর্তে রাজীব বুড়োকে ঝাটার বাড়ী মারার মধ্যে গ্রাম্যতার পরিচয়টাই যেন বেশি প্রকট হয়ে ওঠে।
‘জামাইবারিক’ নাটকটিও যতখানি কমেডি, ততখানি প্রহসন নয়। চরিত্রগুলি চড়া রঙে আঁকা, ঘটনাগুলি নানা মজাদার অনুষ্ঠানে পূর্ণ, সংলাপ অনেক ক্ষেত্রেই এতই দুর্বার হয়ে উঠেছে যে সে যুগের সমালোচকেরাও বরদাস্ত করতে পারেননি। সম্ভবত এই নাটক রচনার মূলে রামনারায়ণের ‘উভয়সংকট’ নাটকের পরোক্ষ প্রেরণা ছিল। সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশে এবং নির্মল হাস্যরস সৃষ্টিতে দীনবন্ধু মিত্র বাংলা নাটকে দোসরহীন ব্যক্তিত্ব।
Leave a comment