বাংলা নাট্য আন্দোলনের ইতিহাসে গিরিশচন্দ্র ঘোষ এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। নাট্যকার, অভিনেতা, নট-গুরু, নাট্য পরিচালক, স্থায়ী রঙ্গমঞ্চের উদ্যোক্তা এবং অভিনয় শিক্ষকরূপে তাঁর যশস্বী ভূমিকা এখনও পর্যন্ত অতুলনীয়। তিনি ছিলেন পুরোপুরি মঞ্চের মানুষ। একাধারে প্রযোজক মঞ্চাধ্যক্ষ, অভিনেতা ও নাট্যকার। অভিনেতা হিসেবে গ্যারিকের এবং নাট্যকার হিসেবে শেকসপিয়রের সঙ্গে কেউ কেউ তার তুলনা করেছেন। নাটক লিখে অভিনয় করে তিনি সমকালের মানুষকে আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি অনধিক আশিখানি নাটক এবং কয়েকশত নাট্য সংগীতের স্রষ্টা।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের জন্ম ও কর্মজীবন:
১৮৪৪ খ্রীস্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি উত্তর কলকাতার বাগবাজারের বোসপাড়া লেনে গিরিশচন্দ্র ঘোষের জন্ম হয়। একটি ইংরেজ কোম্পানীতে কাজ করার সময় তিনি নাটক ও গানবাজনার প্রতি আকৃষ্ট হন। প্রথমে হাফ আখড়াই দলের বাঁধনদার ছিলেন। ১৮৬৭ খ্রীস্টাব্দে একটি যাত্রার দল গঠন করেন। এই সময় ‘শমিষ্ঠা’ নাটকের গীতিকার রূপে মঞ্চে স্বীকৃতিলাভ করেন। এর দুবছর পর বাগবাজারে একটি রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭১ খ্রীস্টাব্দে ন্যাশনাল থিয়েটার নামে একটি সাধারণ রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করেন। কিন্তু উদ্যোক্তাদের সঙ্গে মতভেদ হওয়ায় তিনি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার স্থাপন করেন। নাটকের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময় তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের সংস্পর্শে আসেন। তাঁর গৃহী শিষ্যরূপে দক্ষিণেশ্বরে অন্যান্য ভক্তদের কাছেও গিরিশচন্দ্রের সুপরিচিতি বাড়ে। তিনি ঠাকুরের অবর্তমানে তাঁর শিষ্যদের সঙ্কটকালে অভিভাবকের মতো হয়ে ওঠেন। শ্রীমা সারদাদেবীরও স্নেহ ও আস্থা অর্জন করেন। ঠাকুরও মাঝে মাঝে গিরিশচন্দ্রের নাটক দেখতে আসতেন। বিনোদিনী প্রমুখ বহু অভিনেত্রীকে গিরিশচন্দ্র অভিনয় শিক্ষা দিয়েছিলেন।
তার মধ্যে মঞ্চ-দায়িত্ব ছিল সদা জাগরুক, নট-প্রতিভা ছিল রচনা নৈপুণ্যের তুলনায় প্রত্যক্ষতর। প্রয়োগকুশলতার ফলেই জনরুচির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তাঁর নাটকগুলি সঞ্জীবিত হয়েছিল। বস্তুত, এই জনরুচির প্রয়োজনে নাট্য-নিরীক্ষার মধ্যে নিবিষ্ট না হয়ে তিনি মঞ্চ-সফল একাধিক নাট্যরচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। সেইসঙ্গে পূর্বসূরীদের ঐতিহ্যকেও অনুসরণ করেছিলেন। ফলে দীনবন্ধু মিত্রের সামাজিকতা, মনোমোহন বসুর গীতপ্রবণতা ও ভক্তিরস, রাজকৃষ্ণ রায়ের অভিনায়িক ছন্দ-পদ্ধতি এবং জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ইতিহাস নির্ভর স্বাদেশিকতা ইত্যাদি উপাদানগুলি তার নাটকে ব্যবহার হয়েছিল। এই সব ভাবসমূহকে নাট্যবস্তুর উপযোগী করে সাধারণ দর্শকের কাছে পরিবেশন করেছিলেন। সেইসঙ্গে সুপরিচিত কাব্য-উপন্যাসের কাহিনীগুলির (বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, দুর্গেশনন্দিনী, মধুসূদনের মেঘনাদ বধ, নবীনচন্দ্রের পলাশীর যুদ্ধ ইত্যাদি) নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। মধুসূদনের অমিত্রাক্ষর ছন্দ ভেঙ্গে নাট্যসংলাপের প্রয়োজনে ‘গৈরিশ ছন্দ’ সৃষ্টি করেছিলেন।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাট্যগ্রন্থসমূহ:
গিরিশচন্দ্র ঘোষের গীতিনাট্য:
গিরিশচন্দ্ৰ গীতিনাট্য নিয়েই নাট্য মঞ্চে প্রথম অবতীর্ণ হন। এইগুলি হল ‘আগমনী’ (১৮৭৭), ‘’অকালবোধন’ (১৮৭৭), ‘দোললীলা’, ‘মোহিনী প্রতিমা’ ইত্যাদি। এগুলি দর্শক মনোরঞ্জন করতে সমর্থ হলেও সাহিত্য সৃষ্টি হিসাবে বিশেষ সার্থক হয়ে ওঠেনি।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের পৌরাণিক নাটক:
গিরিশ প্রতিভার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি পৌরাণিক নাটকসমূহ। ‘রাবণ বধ’ (১৮৮১), ‘অভিমন্যু বধ’ (১৮৮১), ‘সীতার বনবাস’ (১৮৮১), ‘সীতার বিবাহ’ (১৮৮২), ‘লক্ষ্মণ বর্জন’ (১৮৮২), ‘রামের বনবাস’ (১৮৮২), ‘সীতাহরণ’ (১৮৮২), ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ (১৮৮২), ‘নিমাই সন্ন্যাস’ (১৮৮২), ‘চৈতন্যলীলা’ (১৮৮৪), বুদ্ধদেব চরিত’ (১৮৮৭), ‘বিল্বমঙ্গল ঠাকুর’ (১৮৮৮), ‘রূপসনাতন’ (১৮৮৮), ‘জনা’ (১৮৯৪), ‘পাণ্ডব গৌরব’ (১৯০০)।
এই নাটকগুলির বিষয়-উৎস বাঙালীর চিরকালের সমাদৃত কৃত্তিবাস, কাশীদাস, নবদ্বীপ-প্রসঙ্গ। বিচিত্র বিষয়ে পল্লবিত হলেও একটিমাত্র সামান্য লক্ষণ দ্বারা এই নাটকগুলিকে একসূত্রে বাঁধা যায়, তা হল অনন্য ‘ভক্তিরস’। যোগক্ষেম শ্রীরামকৃষ্ণদেবের প্রত্যক্ষ প্রেরণায় নাট্যকার, নাট্যমঞ্চ এবং অভিনেতারা ভক্তি ভাবাবেগে আলোড়িত হয়েছিলেন। এ সম্পর্কে সমকালের এক নাট্যকার অমৃতলাল বসু লিখেছিলেন—
“লিখিলা চৈতন্যলীলা হীরক হইল শিলা
নাট্যশালা হল তীর্থ, ভক্তমেলা থিয়েটার।”
ভক্তিরস এবং অবতারকল্প মহাপুরুষদের জীবন অবলম্বনে ভক্তিব্যাকুলতা ও ধর্মাদর্শের প্রকাশ এই নাটকগুলির মূল লক্ষণ হয়ে উঠেছে।
অবশ্য সূক্ষ্মদর্শী সমালোচক এর মধ্যে ভক্তি ও করুণরসের ভারসাম্যহীন অবস্থা লক্ষ্য করতে পারেন। পুরাণের মহিমা কতটা অক্ষুণ্ণ থেকেছে সে সম্পর্কে সংশয় জাগা অস্বাভাবিক নয়। তবে এর দর্শক সাধারণ মানুষ, এ কথা মনে রাখলে এর আবেগময়তার মূল কারণটি অনুমান করতে অসুবিধা হয় না। তাছাড়া ‘ভক্তভৈরব’ গিরিশচন্দ্রের ভক্তি বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্তি-মুক্তির কারণ এর সঙ্গে হয়েছিল।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের ইতিহাস-নির্ভর স্বদেশী নাটক:
বিংশ শতকের সূচনায় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রভাবে অন্যান্য স্বদেশপ্রেমিক মানুষের মতোই গিরিশচন্দ্র স্বদেশীভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেন একাধিক ইতিহাস-নির্ভর নাটক ; যেমন— ‘সিরাজদ্দৌলা’ (১৯০৫), ‘মীরকাশিম’ (১৯০৬), ‘ছত্রপতি শিবাজী’ (১৯০৭), ‘অশোক’ (১৯১১), ‘সংনাম’ (১৯০৪) ইত্যাদি।
এইগুলির মধ্যে ইতিহাসের তথ্য-নিষ্ঠা নয়, পরাধীনতার নাগপাশ মোচনে স্বদেশী যোদ্ধাদের কীর্তিকাহিনী প্রকাশ করাই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে স্বাদেশিক উচ্ছ্বাস, স্থান-কাল-পাত্রের অনৈতিহাসিকতা, অতিনাটকীয় ভাবাবেগ, বাস্তববোধের অভাবের ফলে সার্থক ঐতিহাসিক নাটকের বৈশিষ্ট্য থেকে এইগুলি বঞ্চিত হয়। জীবনের শেষ পর্যায়ে রচিত হয় শাস্ত ভক্তিভাবের নাটক ‘শঙ্করাচার্য’ (১৯০৯), ‘অশোক’ (১৯১১) এবং ‘তপোবন’ (১৯১১)। বাস্তবতার অভাব যেমন এখানে প্রকট, তেমনি ভক্তিধর্মের আধিক্যে ইতিহাস-রস অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। সমালোচক ড. অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবগর্ভ মন্তব্যটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়“তিনি যুগের দাবি মেটাতে গিয়ে ঐতিহাসিক নাটক লিখেছিলেন, কিন্তু বিশুদ্ধ নাটক রচনার দাবি মেটাতে পারেননি”।
গিরিশচন্দ্র ঘোষের সামাজিক নাটক:
গিরিশচন্দ্র সামাজিক সমস্যা নিয়ে বহু নাটক লিখেছিলেন। ভাইয়ের প্রতারণা নিয়ে লিখেছিলেন ‘প্রফুল্ল’ (১৮৮৯), বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে ‘হারানিধি’ (১৮৯০), ভাইদের মধ্যে বিরোধ নিয়ে ‘মায়াবসান’ (১৮৯৭), পণপ্রথা নিয়ে ‘বলিদান’ (১৯০৫), বাল্যবিধবার সমস্যা নিয়ে ‘শাস্তি কি শাস্তি’ (১৯০৮), ভাইপোর ষড়যন্ত্র নিয়ে ‘গৃহলক্ষ্মী’ (১৯১২) ইত্যাদি। শহর কলকাতার গৃহকলহ-কণ্টকিত পরিবার জীবন অথবা পতিতা পল্লীর অন্ধকার জগৎ এইসব নাটকে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার আলোকে উদ্ঘাটিত হয়েছিল। এইসব সামাজিক নাটকগুলির মধ্যে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য হল ‘প্রফুল্ল’।
‘প্রফুল্ল’ নাটক সৃষ্টির একটি ছোট্ট ইতিহাস আছে। তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’ উপন্যাসের ‘সরলা’ চরিত্রটিকে অমৃতলাল বসু নাট্যরূপ দিয়েছিলেন। স্টার থিয়েটার কর্তৃপক্ষ ‘সরলা’র অসাধারণ জনপ্রিয়তা দেখে গিরিশচন্দ্রকে সরলার অনুরূপ একটি নাটক লিখতে বলেন। ‘প্রফুল্ল’ তারই ফলশ্রুতি। একটি সচ্ছল ও সুখী একান্নবর্তী পরিবারের বিপর্যয় ও পতনই নাটকের মূল কাহিনী। রি-ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক ফেল হবার পর থেকেই শুরু হয় পরিবারের প্রধান কর্তা যোগেশের ভাগ্যবিপর্যয়। প্রফুল্ল এই ঘোষ পরিবারের মেজ বৌ। তার স্বামী রমেশের কূট চক্রান্তে ছোট ভাই সুরেশ হয় জেল আসামী। অন্যদিকে মদ্যপানের ফলে এবং রমেশ কর্তৃক জুয়াচোরের কালিমালেপনে যোগেশের চরিত্র হয় মসীলিপ্ত। একদা বিত্তশালী তার স্ত্রী জ্ঞানদা অনাহারে রাস্তায় পড়ে মৃত্যুর স্পর্শে হয় হিমশীতল। তার মা উমাসুন্দরী হন উন্মাদিনী। একমাত্র বংশধর যাদব মৃত্যুর প্রান্তসীমায় উপনীত হয়। আর ‘সাজানো বাগান’ শুকিয়ে যাওয়ার ক্ষোভে বেদনা বিমূঢ় ব্যর্থ জীবনের জ্বালায় পথে পথে হাহাকার করে বেড়ানো সুরাসক্ত যোগেশ হয়ে উঠে যেন এক ভাগ্য-বিপর্যয়ের মূর্তিমান শোকসঙ্গীত। সেক্ষেত্রে যোগেশ হয়ে ওঠেন ট্রাজেডির নায়ক।
তার জীবনের করুণ পরিণতি দেখে কেউ কেউ হয়ত এই দুঃখকে ল’সনের ভাষায় “The agonized struggle of the weak will” জনিত ট্র্যাজেডি (দ্রষ্টব্য: ‘Theory Technique of Play Writing, J. H. Lawson, 1960) বলে ভাবতে পারেন। কিন্তু ল’সনই আবার পরে সতর্ক করেছেন এই বলে যে, “But however week the will maybe it must be sufficiently strong to sustain the conflict…the precise degree of strength of will required is the strength needed to bring the action to an issue to create a change of equilibrium between the individual and the environment.” কিন্তু প্রশ্ন হল, যোগেশের চরিত্রে এই দ্বন্দ্ব এবং ‘precise degree of strength’ আছে কি? তার চরিত্রে ইচ্ছাশক্তির দৃঢ়তা নেই বরং তার মধ্যে “inefficient operation of the will”-এর চিত্রই প্রকাশিত।
ব্যাঙ্ক ফেল হওয়ার পর থেকে যোগেশ গভীর দুঃখে সেই যে মদ্যপানে আসক্ত হয়েছেন তার যেন আর বিরাম নেই। তার ভাগ্য বিপর্যয় আমাদের pity জাগায়, তার সাজানো বাগান শুকিয়ে যাওয়ার হাহাকারে আমরা অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠি একথা সত্য। কিন্তু নিকলের মতে, “Tragedy, after all, is not a thing of tears.” তাই বলা চলে, এই নাটকে ট্র্যাজেডির উপাদান সত্ত্বেও সার্থক ট্র্যাজেডি হয়ে উঠেনি। অনুরূপভাবে তাঁর ‘বলিদান’ নাটকেও “কন্যাসম্প্রদান নয়, বলিদান”—উক্তির মধ্যে পণপ্রথার যে নিদারুণ চিত্র ফুটে উঠেছে সামগ্রিকভাবে, সেখানে করুণাময়ের ব্যক্তিজীবনের ট্র্যাজেডি ছাপিয়ে গেছে।
সামাজিক নাট্যকারের দায়িত্ববোধে, ন্যাশানাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগী পুরুষরূপে এবং সর্বোপরি এক প্রথম শ্রেণীর অভিনেতারূপে গিরিশ-প্রতিভা আজও বাঙালী মনে প্রবাদপ্রতিম বিস্ময় হয়ে আছে।
Leave a comment