উৎপল দত্তের জন্ম:

বাংলা নাটক এবং চলচ্চিত্র জগতের এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব উৎপল দত্ত। সম্পূর্ণ নাম—উৎপলরঞ্জন দত্ত, ডাক নাম শঙ্কর। পূর্ববাংলার বরিশাল শহরে (বঙ্গাব্দ ১৩৩৫, চৈত্র ১৫/১৯২৯ খ্রিঃ ২৯ মার্চ, শুক্রবার), যদিও তাঁর নিজের মতে জন্ম শিলঙে। পূর্বপুরুষের আদি নিবাস ছিল কুমিল্লা। পিতা গিরিজারঞ্জন, মা শৈলবালা। পাঁচ ভাই এবং তিন বোনের মধ্যে উৎপল ছিলেন ষষ্ঠ সন্তান।

উৎপল দত্তের শিক্ষাজীবন:

উৎপলের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় শিলঙের সেন্ট এডমন্ড স্কুলে। পিতা গিরিজারঞ্জন প্রথম জীবনে ছিলেন বঙ্গবাসী কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক। পরে চাকুরি পরিত্যাগ করে হন উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার। তাঁকে বদলি হতে হয় বারবার। ফলে তিনি বহরমপুরে বদলি হলে উৎপল দত্ত পুনরায় ভর্তি হলেন স্থানীয় একটি স্কুলে। বাড়িতে শিল্প-সংস্কৃতির পরিবেশ ছিল। বাবা এবং মেজদার মুখে শেকপিয়রের আবৃত্তি, দিদির কন্ঠে ধ্রুপদী গান শোনার অভ্যাস ছিল। উৎপল দত্ত নিজেও ছিলেন মেধাবী ছাত্র। বারবার স্কুল বদলে ক্ষতির সম্ভাবনা অনুমান করে মেজদা মিহিররঞ্জন উৎপলকে কলকাতার সেন্ট লরেন্স স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন। তাঁর নাট্যজীবনের সূত্রপাত এই সেন্ট লরেন্স স্কুল থেকে। এখান থেকে নাট্যাভিনয়ের জন্য তাকে মাঝে মাঝে যেতে হত সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে। মা শৈলবালা ও তিন ভাইবোন সহ উৎপলেরা এইসময় কলকাতার রয়েড স্ট্রীটে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু ১৯৪৩-৪৪ খ্রীস্টাব্দে যুদ্ধের কারণে সেন্ট লরেন্স স্কুলটি দমদমে উঠে যায়। ফলে আবার তার স্কুল পরিবর্তন হয়। উৎপল নবম বা দশম শ্রেণীতে সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে ভর্তি হন। একাধিকবার স্কুল বদলের ফলে তার ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফল ভালো হয় না। তবে রাজনৈতিক রচনা বিশেষত সাম্যবাদী সাহিত্যপাঠে তার আগ্রহ দেখা যায়। ১৯৪৫-৪৬-এ উৎপল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজি অনার্স ক্লাসে ভর্তি হন। সেই সময় সপরিবারে কলকাতার রাসবিহারী অ্যাভেনিউতে বসবাস করতে থাকেন। আর এর পর থেকেই তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয়। ইতিহাস-দর্শন-রাজনীতি দেশি বিদেশি সঙ্গীততত্ত্ব, নাটক এবং ধ্রুপদী সাহিত্যপাঠে মনোযোগী হন। চলচ্চিত্রে আগ্রহ জাগে, নাটক অভিনয়, প্রবন্ধ রচনা, আবৃত্তি, বিতর্কে অংশগ্রহণে তাঁর ভূমিকা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়।

উৎপল দত্তের কর্মজীবন:

১৯৪৫-৪৬ থেকে উৎপল দত্তের বৈচিত্র্যময় উজ্জ্বল কর্মজীবনের সূচনা হয়। প্রবন্ধ রচনা, নাটক-অভিনয়, নাটক রচনা, মঞ্চ প্রযোজনা, পরিচালনা, নাট্যদল সংগঠন, অভিনয় শিক্ষাদান, নাট্য অনুবাদ, চলচ্চিত্রে অভিনয়, যাত্রাপালা রচনা ও অভিনয়, বক্তৃতাদান ইত্যাদি বহুমুখী কর্মপ্রচেষ্টায় তা পরিপূর্ণতা পায় ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত। দেশী বিদেশী একাধিক নাটক-চলচ্চিত্র-যাত্রায় উৎপলের অভিনয়ে অংশগ্রহণের ঘটনা ছিল অসংখ্য; যেমন, সেন্ট জেভিয়ার্সে ছাত্র থাকাকালে তিনি অভিনয় করেন গোগোলের ‘ডায়ামন্ড কাট্স ডায়ামন্ড’ (১৪.৯.১৯৪৭) এবং দ্য রোগারিজ অফ স্ক্যাপ্যা’ (১৩.১২.’৪৮), কলেজের, বন্ধুদের সঙ্গে ‘দি অ্যামেচার শেকপিয়রিয়ানস্’ নাট্যদল গড়ে ‘রোমিও অ্যাণ্ড জুলিয়েট’, এবং ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে নির্বাচিত দৃশ্যে অভিনয় (৮.১০.৪৭), ‘রিচার্ড দ্য থার্ড’-এ রাজা-চরিত্র (২২.১২.’৪৭)। এছাড়া এই নাট্যদলের প্রযোজনায় ‘ওথেলো’ নাটকের প্রধান চরিত্র (৪.৭. ৪৮) ‘আ মিডসামার নাইটস্ ড্রিম’ এ বটম (১৩.১১.’৪৮), ‘রোমিও অ্যাণ্ড জুলিয়েট’-এ মার্কুশিও (৬.৩.’৪৯), বাংলায় ‘জুলিয়াস সিজার’-এ আধুনিক পোশাকে ব্রুটাস (১৫.৭.’৪৯), ‘টুয়েল নাইট’-এ ম্যালভোলিও (২.৯.´৪৯), নিউ এম্পায়ারে জেমস প্যারিসের ‘ডিসটিংগুইশড্ গ্যাদারিং’ এ ফেলিক্স মন্টেগু (৬.১১.´৪৯) ইত্যাদি। এইসব নাটকের অভিনয় দেখে ভারতে আগত ‘দ্য শেক্‌স্‌পিয়রিয়ানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানী’র পরিচালক জেফ্রি কেন্ডাল উৎপলকে তার দলে পেশাদার অভিনেতা রূপে যোগদানের আমন্ত্রণ করেন। এই দলে যোগ দিয়ে উৎপল দত্ত নানা ভূমিকায় অভিনয় করেন; যেমন—‘গ্যাসলাইট’-এ কনস্ট্যাবল, ‘পিগম্যালিয়ন’-এ দ্বিতীয় পথচারি, ‘শি স্টুপস্ টু কংকার’-এ স্যার চার্লস, ‘মার্চেন্ট অফ ভেনিস’-এ অ্যান্টনিও, ‘ম্যাকবেথ’-এ রস, ‘হ্যামলেট’-এ হোরেশিও, ‘ওথেলো’-য় রোডেরিগো, ‘জুলিয়াস সিজার’-এ ডিসিয়াস ব্রুটাস প্রমুখ।

উৎপল দত্ত কেবল বিদেশী নাটকে নয়, একাধিক দেশি নাটকে, যাত্রায়, চলচ্চিত্রে বিভিন্ন ভূমিকায় অভিনয় করেন। যেমন, সংক্ষেপে কয়েকটির নাম উল্লেখ করা যায়; ক্লিফোর্ড ওডেটেসের ‘ওয়েটিং ফর লেফটি’তে অ্যাগাটে কেলর, মধু বসু পরিচালিত ছায়াছবিতে মাইকেল মধুসূদন (১৪.৭.´৫০) এবং বিদ্যাসাগর নামভূমিকায় অভিনয় (২৯.৯.’৫০), ‘ডার্ক লেডি অফ দ্য সনেটস’ এবং ‘অ্যান্ড্রেক্লেস অ্যান্ড দ্য লায়ন’ (১৪.৮.৫০) নাটকে যথাক্রমে শেকসপিয়র এবং ক্যাপ্টেন চরিত্র, ইবসেনের ‘গোস্টস’ নাটকে ম্যান্ডার্স-চরিত্র (২৪.১.’৫১), ‘মেরি ওয়াইল্স্ অফ উইন্ডসর’ ফোর্ড চরিত্রে (২৪.১.´৫১)। এই সময় তিনি ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সংস্পর্শে আসেন, ‘জনতার মুখরিত সখ্যে’ অবগাহন করেন। আবার পানু পালের ‘ভাঙা বন্দরে’ অভিনয় (১৭.৪’৫১), রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটক পরিচালনা ও গোবিন্দমাণিক্য চরিত্রে অভিনয় (২.২০.৫১), গোগোলের ‘রেভিজর’ নাটক পরিচালনা, ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত ‘দলিল’ নাটকে এবং পানু পালের ‘চার্জশীট’, ‘ভোটের ভেট’ ইত্যাদি পথনাটিকায় অংশগ্রহণ করেন মঞ্চাধক্ষ্যের দায়িত্ব পালন, নাট্যদল গঠন ও অন্যান্য ভূমিকায় অংশগ্রহণেও তার কর্মপ্রচেষ্টার পরিধিটি অনুভব করা যায়; যেমন—এল. টি. জি.-তে ‘মিসেস ওয়ারেল্স্ প্রোফেশন’ নাটকে মঞ্চাধক্ষ্যর দায়িত্ব পালন, (২.৯.´৫১), ‘‘স্বাধীনতা’ পত্রিকার জন্য ইবসেনের ‘পুতুলের সংসার’ নাটক প্রযোজনা, তড়িৎ হালদার চরিত্রে অভিনয়, ‘দ্য রাশিয়ান কোয়েশ্চেন’-এ ‘সাংবাদিক’ নামে অভিনয়ের উদ্যোগ গ্রহণ, সংস্কৃতি সঙ্ঘ’ এবং ‘নবমঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা (২৭.১০.৫১), ‘ম্যাকবেথ’ নাটকে মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় (নভেম্বর, ১৯৫১), পানু পাল ও সম্প্রদায়ের ‘ভোটের ভেট’ পথনাটিকায় অংশগ্রহণ। নবপর্যায়ে ‘ওথেলো’, ‘পাশপোর্ট’ রচনা-পরিচালনা অভিনয়, ইংরেজিতে ‘আর্মস্ অ্যাণ্ড দ্য ম্যান’ নাটক প্রযোজনা (ডিসেম্বর, ১৯৫২), সাংবাদিক’ নাটকে হ্যারি চরিত্র (৬.১২.’৫২) এবং ‘সিরাজদ্দৌলা’ ছায়াছবিতে অভিনয় করেন। এছাড়া তিনি রাণী রাসমণি (১১.২.’৫৫) ‘কীর্তিগড়’ (১০.২.’৫৬), ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’ (৫.১০.’৫৬) যোগাযোগ, এবং ‘কুহক’ প্রভৃতি ছায়াছবিতে অংশ্রহণ করেন। তাঁর সাউথ পয়েন্ট স্কুলে শিক্ষকতার সূচনাও হয় এই সময়। এই স্কুলে ১৯৬০ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত চাকুরী করলেও নাটকের সর্বসময়ের কর্মী হওয়ার আগ্রহে শেষ পর্যন্ত ইস্তফা দেন। উৎপল দত্তের সৃষ্টিশীল জীবন অতঃপর নানা ধরনের নাটক রচনা পরিচালনা-নাট্যদল গঠন-নাট্যশিক্ষা অভিনয়-নাট্যপ্রবন্ধ রচনা-নাট্যবিষয়ক বক্তৃতাদান ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে বিকশিত হয়ে ওঠে।

উৎপল দত্তের রচনাসমূহ:

উৎপল দত্তের সৃষ্টিসম্ভার পাঠক ও সমালোচক মহলে বিস্ময় জাগায়ঙ্গ মাত্র চৌষট্টি বছরের জীবনসীমায় তিনি ৮২টি নাটক, ২১টি যাত্রাপালা, ১৫টি অনুবাদ নাটক এবং ১২টি প্রবন্ধগ্রন্থ রচনা করেন। এই তালিকাও সম্পূর্ণ কিনা সন্দেহ আছে। কারণ অভিনেতা-পরিচালক-সংগঠক-শিক্ষক-অনুবাদক-প্রাবন্ধিক উৎপল দত্তের বহুমুখী প্রতিভা স্মরণ করলে এই সংখ্যারও পরিবর্তন ঘটতে পারে। নাট্যকার পত্নী শোভা সেন এবং পুত্র সৌভিক রায়চৌধুরীর সম্পাদনায় মিত্র ও ঘোষ প্রকাশনার উদ্যোগে উৎপল দত্তের নাট্যসমগ্ৰ ন’টি খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এই প্রকাশনা অনুযায়ী নাট্যকারের রচনাসমূহকে কয়েকটি পর্যায়ে বিন্যস্ত করা যেতে পারে; যথা— (ক) পূর্ণাঙ্গ নাটক, (খ) ইতিহাসধর্মী নাটক, (গ) অনুবাদধর্মী নাটক, (ঘ) রাজনৈতিক নাটক, (ঙ) জীবনী নাটক, (চ) পথ নাটিকা, (ছ) যাত্রাপালা, (জ) প্রবন্ধ রচনা।

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ‘উৎপল দত্ত ফাউণ্ডেশন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এঁদের সাক্ষ্যে জানা যায় তাঁর লেখা প্রথম পূর্ণা। ঐতিহাসিক নাটক হল ‘মীরকাসিম’ (১৯৫২-৫৩) “…মীরকাসিমকে নিয়ে এই ঐতিহাসিক নাটকটিই এখনও পর্যন্ত আমাদের বিচারে উৎপল দত্ত প্রণীত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্যের নাটক”। এর পরে লেখা হয় ‘নয়া তুঘলক, (১৯৫৫, পথনাটিকা), ‘ছায়ানট’ (১৯৫৮), প্রথম প্রকাশ ফাল্গুন ১৩৬৫, ‘অঙ্গার’, (১৯৫৯), ‘ফোরী ফৌজ’ (১৯৬১), ‘চাদির কৌটো’ (১৯৬১), জন গল্সওয়ার্দির ‘The Silver Box’ অবলম্বনে রচিত এবং ১৯৫৩-তে মঞ্চস্থ ‘বিচারের বাণী’ নাটকের গ্রন্থরূপ। ‘পঙ্কতিলক’ (১৯৬১), ‘স্পেশাল ট্রেন’ (১৯৬১), ‘নীলকণ্ঠ’ (১৯৬১, দেশ, শারদীয়), ‘দ্বীপ’ (১৯৬১, এক্ষণ), ‘ঘুম নেই’ এবং ‘মে দিবস’ (১৯৬১, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ), ‘ভি. আই. পি’ (১৯৬২), ‘মধুচক্র’ (১৯৬৩ গন্ধর্ব, শারদীয়), ‘রাতের অতিথি’ (১৯৬৩, জাতীয় সাহিত্য পরিষদ) ‘মেঘ’ (১৯৬৩), ‘সংকট মুহূর্তে (১৯৬৪, গণনাট্য, শারদীয়), চৈতালি রাতের স্বপ্ন’ (১৯৬৪), ‘কল্লোল’ (১৯৬৫), ‘প্রফেসর মামলক’ (১৯৬৫, অনুবাদ নাটক), ‘গেরিলা’ (১৯৬৫), ‘সমাজতান্ত্রিক চাল’ (১৯৬৫, পথনাটিকা), জনতার কল্লোল (বঙ্গাব্দ ১৩৬২, প্রসেনিয়ম), ইতিহাসের কাঠগড়ায়’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২, নন্দন), ‘কঙ্গোর কারাগারে’ (১৯৬৫, প্রসেনিয়ম), ‘হিম্মৎবাঈ’ (১৯৬৬, এপিক থিয়েটার, ১-২ সংখ্যা), ‘মা’ (১৯৬৭, এপিক থিয়েটার, মে সংখ্যা), ‘একটি তলোয়ারের কাহিনী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৩, নন্দন, জ্যৈষ্ঠ সংখ্যা), ‘সমাধান’ (১৯৬৬), ‘গণপ্রতিনিধি’ (১৯৬৬, প্রসেনিয়ম, ডিসেম্বর), ‘লৌহমানব’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৩, চৈত্র-বৈশাখ সংখ্যা, প্রসেনিয়ম), ‘এক দেহে লীন’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৩, নন্দন, আশ্বিন সংখ্যা), ‘মৃত্যুর অতীত’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৩, প্রসেনিয়ম)। ‘নয়া জমানা’ (১৯৬৬, ভারতের ব্রেশট্ সোসাইটি), ‘থিয়েটার স্টাডি’ (১৯৬৭), ‘নয়া ইতিহাস’ (১৯৬৭), ‘দিন বদলের পালা’ (১৯৬৭), ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’ (১৯৬৭-৬৮, এপিক থিয়েটার, ৫-৬ সংখ্যা), ‘টোটা বা মহাবিদ্ৰোহ’ (১৯৬৮), ‘রক্তাক্ত ইন্দোনেশিয়া’ (১৯৬৮?), ‘রাইফেল’ (১৯৬৮, যাত্রাপালা), ‘যুদ্ধং দেহি’ (১৯৬৮), ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’ (১৯৬৮, যাত্রাপালা), ‘শোন রে মালিক’ (১৯৬৯), যাত্রাপালা, লেনিনের ডাক’ (১৯৭০), ‘জয় বাংলা’ (১৯৭০, যাত্রাপালা), ‘টিনের তলোয়ার’ (১৯৭১), ‘ঠিকানা’ (১৯৭১), ‘সূর্যশিকার’ (১৯৭১), ‘ব্যারিকেড’ (১৯৭২), ‘সন্ন্যাসীর তরবারি’ (১৯৭২, যাত্রাপালা), ‘বর্গি এল দেশে’ (১৯৭৩, এপিক থিয়েটার, বর্ষশেষ সংখ্যা), ‘হিমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ (১৯৭৩), ‘ঝড়’ (১৯৭৩, যাত্রাপালা), ‘মাও-সে-তুঙ’ (১৯৭৪, যাত্রাপালা), ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ (১৯৭৪), ‘লোহার ভীম’ (১৯৭৪, এপিক থিয়েটার, মে), ‘অস্ত্র’ (১৯৭৬, এপিক থিয়েটার, শারদ সংখ্যা), ‘লেনিন কোথায়’ (১৯৭৬), ‘এবার রাজার পালা’ (১৯৭৭, যাত্রাপালা), ‘বৈশাখির মেঘ’ (১৯৭৭, যাত্রাপালা), ‘দিন বদলের দ্বিতীয় পালা’ (১৯৭৭), ‘অরণ্যের ঘুম ভাঙছে’ (১৯৭৮), ‘তিতুমীর’ (১৯৭৮), ‘চক্রান্ত’ (১৯৭৯), ‘স্তালিন ১৯৩৪’ (১৯৭৯), ‘কালো হাত’ (১৯৭৯), ‘সাদা পোষাক’ (১৯৭৯, গণবাণী পত্রিকা), ‘দাঁড়াও পথিকবর’ (১৯৮০), ‘কুঠার’ (১৯৮০, গণবাণী), ‘স্বাধীনতার ফাঁকি’ (১৯৮১, যাত্রাপালা), অর্জুন অপেরা’ (১৯৮১, অপ্রকাশিত), ‘শ্রীমতীর বিচার’ (১৯৮২), ‘বিবিঘর’ (১৯৮২, যাত্রাপালা), ‘পেট্রোল বোমা’ (১৯৮২), ‘তিলজলার জল’ (১৯৮৩), ‘অসমাপ্ত সংলাপ” (১৯৮৩), ‘শৃঙ্খল ছাড়া’ (১৯৮৩), ‘কুশপুত্তলিকা’ (১৯৮৪, এপিক থিয়েটার ৭-৮ সংখ্যা), ‘মহাচীনের পথে’ (১৯৮৪), ‘একত্রিশে অক্টোবর’ (১৯৮৪, অপ্রকাশিত), ‘আজকের সাজাহান’ (১৯৮৫), ‘মুমূৰ্য় বাংলা’ (১৯৮৫), ‘দামামা ঐ বাজে’ (১৯৮৮, যাত্রাপালা), ‘অগ্নিশয্যা’ (১৯৮৮), ‘হমে দেখনা হ্যায়’ (১৯৮৯), দৈনিক বাজার পত্রিকা’ (১৯৮৯), ‘নীল সাদা লাল’ (১৯৮৯), ‘একলা চলো রে’ (১৯৮৯), ‘লাল দুর্গ’ (১৯৯০), ‘কিরাতপর্ব’ (১৯৯০, অপ্রকাশিত), ‘জনতার আফিম’ (১৯৯১), ‘সত্তরের দশক’ (১৯৯২, এপিক থিয়েটার), ‘ফুলবাবু’ (১৯৯৩), ‘দিল্লী বিচিত্রা’ (১৯৯৪, গণশক্তি, শারদ সংখ্যা)।

উৎপল দত্তের প্রবন্ধগ্রন্থ নাট্যপ্রবন্ধ সংকলন / গদ্যরচনা:

মননশীল প্রাবন্ধিক রূপেও উৎপল দত্তের খ্যাতি সর্বজনবিদিত। ছাত্রাবস্থায় ইন্টারমিডিয়েট ক্লাসের প্রথম বর্ষে কলেজ পত্রিকায় লেখেন দুটি প্রবন্ধ : ‘A Glance at Modern Russian Literature (1946, July) এবং বাস্তবতা ও বাংলা সাহিত্য’ (১৯৪৭, জুলাই সংখ্যা)। দ্বিতীয় বর্ষে লেখেন: “Three Bengali Novelists’ (1947, July) এবং ‘Symphony (1947, July)। এর পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজি এ্যাকাডেমির সম্পাদক রূপে ছাত্রাবস্থায় ‘The Scepticism of Bertrand Russell’ (1948) প্রবন্ধ পাঠ করেন। অভিনয়পত্রীতে প্রকাশিত হয় ‘প্রোডাকসন ম্যানিফেস্টো’ (১৯৪৯), The Statesman পত্রিকায় ‘Shakespeare and the Modern Stage (1949) প্রবন্ধ। এছাড়াও আছে চায়ের ধোঁয়া’ (১৯৬৪), ‘সংগ্রামের একদিক’ (‘দেশহিতৈষী’ পত্রিকা, শারদ সংখ্যা, ১৯৬৫) এই প্রবন্ধ রচনার জন্য উৎপল দত্তকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে ১৯৬৫ মার্চ ১৯৬৬ পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। ‘শেকসপিয়রের সমাজচেতনা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৪), ‘চীনযাত্রী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮৬), ‘স্তানিস্লাভস্কি থেকে ব্ৰোখট্ (১৯৭৩-৮১), ‘জপেন দা জপেন যা’ (১৯৭১-৮৪) ‘To wards A Revolutionary Theatre (1982), ‘গিরিশমানস’ (১৯৮৩), ‘শেকসপিয়র ও ব্রেখ্ট্’ (১৯৮৮), ‘প্রতিবিপ্লব’ (বঙ্গাব্দ, ১৪০৪, শ্রাবণ) ‘আশার ছলনে ভুলি’ (১৯৯৩), পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি, আগস্ট সংখ্যা) ইত্যাদি।

উৎপল দত্তের বক্তৃতা:

উৎপল দত্ত দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা দেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বক্তৃতাগুলি হল(১) কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিরিশ বক্তৃতা (১৬-১৯শে নভেম্বর, ১৯৮১), (২) দিল্লীতে শ্রীরাম সেন্টারে ‘What is to be done?” বক্তৃতা (১৩-১৫ই জানুয়ারি, ১৯৮৬), (৩) ল্যাঙ্কাস্টার নাট্য সম্মেলনে ভারতে থিয়েটার ও মতাদর্শ বিষয়ে বক্তৃতা (৫-৯ই এপ্রিল, ১৯৯০), (৪) সাহিত্য একাডেমির জাতীয় সেমিনারে ‘Innovation & Experimentation in Theatre’ সম্পর্কে বক্তৃতা (২০-২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯১), (৫) নাট্য একাডেমি ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে তিনটি বক্তৃতা, ‘বাংলা নাটকের আদিপর্বে ইউরোপের প্রভাব’ (২৭-২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯১), ‘মাইকেল মধুসূদন ও ইয়োরোপীয় দর্শন’ (৯-১০ই মার্চ, ১৯৯২), ‘নাট্যকার দীনবন্ধুমোহমুক্তির খতিয়ান’ (২১-২২শে সেপ্টেম্বর, ১৯৯২)।

উৎপল দত্তের নাট্যদল/যাত্রাদল গঠন অংশগ্রহণ পরিচালনা:

‘দি অ্যামেচার শেকসপিয়রিয়ানস্ জেফ্রি কেন্ডালের ‘দ্য শেকসপিয়রিয়ানা ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার কোম্পানি’তে অংশগ্রহণ, ‘কিউব’ নামে নাট্যদল তৈরী (দি অ্যামেচার শেকসপিয়রিয়ানস্’-এর নাম বদল), বিশ্বের প্রতিবাদী লিটল থিয়েটার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে নাট্যদল ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপে’র (সংক্ষেপে LTG) প্রতিষ্ঠা (১৯৫০), ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা, এল. টি. জি. র বাংলা শাখা, ‘সংস্কৃতি সঙ্ঘ’ বা ‘নবমঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা (১৯৫১), লন্ডনের এরিক এলিয়ট ও নাট্যদলের সঙ্গে যোগাযোগ, পানু পাল ও সম্প্রদায়ের পথনাটিকায় অংশগ্রহণ মির্নাভা থিয়েটারের সঙ্গে সংযোগ, ‘ভারতের ব্রেশ্ট সোসাইটি’ গঠন (১৯৬৪), সেন্সর বোর্ড এবং ন্যাশনাল ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সদস্যপদ গ্রহণ (১৯৬৪), ‘এপিক থিয়েটার’ পত্রিকা প্রকাশ (১৯৬৫), সংযুক্ত গণশিল্পী সংস্থা স্থাপন (১৯৬৫), যাত্রাজগতে—নিউ আর্য অপেরা (১৯৬৮), সত্যম্বর অপেরা (১৯৬৯), নবরঞ্জন অপেরা, ভারতী অপেরা, লোকনাট্য, শ্রীমা অপেরা ইত্যাদি দলের সঙ্গে যোগাযোগ, বিবেক নাট্য সমাজ গঠন (১৯৬৯)। পিপলস্ লিটল থিয়েটার (P.L.T.) দল গঠন (১৯.১০.১৯৭১)।

উৎপল দত্তের চলচ্চিত্রে অভিনয় ও পরিচালনা:

উৎপল দত্ত অভিনীত ও পরিচালিত বাংলা ও হিন্দী চলচ্চিত্রের সংখ্যা প্রায় দুশোর কাছাকাছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি নাম ‘মাইকেল মধুসূদন’ (১৪.৭.’৫০), ‘বিদ্যাসাগর’ (২৯.৯.৫০), ‘আন্তর্জাতিক’ (অসমাপ্ত), ‘কীর্তিগড়’ (১০.২.’৫৬), ‘মহাকবি গিরিশচন্দ্র’ (৫.১০.’৫৬), ‘যোগাযোগ’, ‘কুহক’ (১৯৫৮), ‘উত্তরমেঘ’ (১২.২.৬০), ‘দিল্লী থেকে কলকাতা’ (৭.৭.‘৬১), ‘পঙ্কতিলক’ (১৯৬১), অসমীয়া ভাষায় ‘মণিরাম দেওয়ান’, (১৯৬২), ‘সাক্ষী’ (১৯৬২), ‘কাচের স্বর্গ’ (৯.৬.৬২), ‘অবশেষে’ (১৯৬৩), ‘শেষ অঙ্ক’ (১.২.৬৩), ‘সূর্যশিখা’ (১৯৬৩), ‘মোমের আলো’ (২০.২.৬৪), ‘মেরি দত্তর ফ্ল্যাট’ (১৯৬৪), ‘শঙ্খবেলা’ (১৯৬৬), ‘মহাশ্বেতা’ (২৯.৯.’৬৭), ‘এই তীর্থ’ (১৯৬৭), ‘চৌরঙ্গী’ (২০.৯.’৬৮), ‘বিবাহ বিভ্রাট’ (১৪.২.’৬৯), ‘অপরিচিত’ (১৯৬৯), হিন্দীতে ‘ভুবন সোম’ (১৯৬৯), ‘সাত হিন্দুস্থানী’ (১৯৬৯), ইংরেজিতে ‘দ্য গুরু’ (১৯৬৯), ‘কলঙ্কিত নায়ক’ (১৯৭০), হিন্দী ‘হীরঝঞ্ঝা’, ইংরেজিতে ‘বোম্বে টকি’, ‘ঝড়’ (১৯৭৮), ‘বৈশাখী মেঘ’ (১৯৮১), ‘মা’ (১৯৮২), ইংরেজি টেলিফিল্ম পরিচালনা—’In Search of Theatre (1986)

উৎপল দত্তের দেশে-বিদেশে ভ্রমণ ও পুরস্কার লাভ:

(ক) ‘ফেরারী ফৌজ’ শ্রেষ্ঠ নাটক হিসাবে সঙ্গীত নাটক একাডেমীর পুরস্কার লাভ (১৯৬২), ‘কল্লোল’ পরিচালনার জন্য এই পুরস্কার প্রত্যাখ্যান (১৯৬৬), (এই উপলক্ষ্যে ‘দেশব্রতী’ পত্রিকার নভেম্বর সংখ্যায় ‘শাহেনশা তোমার পুরস্কার তোমার থাক’ কবিতা রচনা), (খ) ভুবন সোম ছবিতে অভিনয়ের জন্য ভরত পুরস্কার লাভ, (গ) কেন্দ্রীয় সরকার প্রদত্ত ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব প্রত্যাখান (১৯৯১)।

১৯৬৪-তে সস্ত্রীক প্যারিস-জার্মানি লন্ডন সফর; স্ট্রাটফোর্ড-অন-আভনে ভারতীয় মঞ্চে শেকসপিয়ার-বিষয়ে বক্তৃতা সেন্সর বোর্ড এবং ন্যাশনাল ফিল্ম ইনস্টিটিউটের সদস্যপদ লাভ; আমেরিকার গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনের অন্যতম পরিচালক হ্যারল্ড ক্লারম্যানের সঙ্গে থিয়েটার নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা (২.২.১৯৭৫); গুরু কেন্ডালের সঙ্গে কলকাতার কলামন্দিরে ‘ডিয়ার লায়ার’ অভিনয়; পশ্চিম জার্মানি লন্ডন প্যারিস হয়ে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে যোগদান (১৯৭৫); ভারত-চীন মৈত্রী সঙ্ঘের আমন্ত্রণে চীন ভ্রমণ (১৯৭৯), সোভিয়েট দেশে ভ্রমণ (১৯৮১); মস্কো চলচিত্র উৎসব উপলক্ষ্যে মস্কো ও লেনিনগ্রাদে গমন (১৯৮৩); বার্লিন লন্ডন-কানাডা-নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ (১৯৮৪); পূর্ব জার্মানীতে পি. এল. টি.-র অভিনয় (১৯৮৫); পূর্ব জার্মানী এথেন্স-রোম-প্যারিস-লন্ডনে অভিনয় (১৯৮৭); ‘নীচের মহল’ নাটক অভিনয়ের জন্য মস্কোয় ভারত উৎসবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ (১৯৮৭-৮৮), ল্যাঙ্কাস্টার সফর (১৯৯০) ইত্যাদি।

উৎপল দত্তের নাট্যসাহিত্যে বিষয়বৈচিত্র্য:

তার নাট্যসম্ভার বিষয়বৈচিত্র্যে স্মরণীয়। এখানে আছে—

(ক) ইতিহাসের বিষয় অবলম্বন; যেমন ‘মীরকাসিম’। আবার ভারতের গুপ্তযুগ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন স্তর তার নাটকে স্থান পেয়েছে; যেমন সূর্যশিকারে আছে গুপ্তযুগের অন্ধ রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে একালের বিজ্ঞানচেতনার সংঘর্ষের আভাস।

(খ) সন্ন্যাসীর তরবারি-টোটা বা মহাবিদ্রোহ তিতুমীর-এ আছে বণিকের মানদণ্ড থেকে রাজদণ্ড হাতে ব্রিটিশ শাসকের অত্যাচারীর ভূমিকায় দেখা দেওয়ার সময় কৃষক ও অন্যান্য শ্রেণীর মধ্যে প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের ঘটনাসমূহ।

(গ) স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র ধরা পড়েছে ফেরারী ফৌজ-জালিয়ানওয়ালাবাগ রাইফেল-বৈশাখী মেঘ-দিল্লী চলো কৃপাণ-কল্লোল-একলা চলো রে নাট্য সৃষ্টিতে।

(ঘ) দেশীয় ইতিহাসের পাশাপাশি বিদেশের ইতিহাসও তার বিষয়-অন্বেষণের ক্ষেত্র হয়েছিল; যেমন ফরাসী বিপ্লব নিয়ে লেখা হয় ‘নীল সাদা লাল’, বাডেন বিদ্রোহ নিয়ে রচিত হয় ‘শৃঙ্খল ছাড়া’, রুশ বিপ্লব ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে রূপ দেওয়া হয় ‘লেনিনের ডাক’, ‘লেনিন কোথায়’ এবং ‘স্তালিন ১৯৩৪’-এ। ‘অজেয় ভিয়েতনাম’ এবং ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’য় ভিয়েতনাম এবং কিউবার সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মরণপণ সংগ্রামের দৃশ্য ধরা পড়ে।

(ঙ) ফ্যাসিবাদের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত হয় ‘ব্যারিকেডে’।

(চ) ‘লাল দুর্গ’ নাটকে সোশ্যালিজমের সাময়িক বিপর্যয় রূপায়িত হয়।

(ছ) বর্ণবিদ্বেষের অত্যাচার প্রকাশ পায় ‘মানুষের অধিকারে’তে। (জ) যুদ্ধ ব্যবসায়ে রাষ্ট্রনেতাদের কদর্য মুনাফাবৃত্তির স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয় ‘যুদ্ধং দেহি’ নাটকে।

(ঝ) পুঁজিবাদী সমাজে মানুষের মৃত্যুর পরেও যে শোষণের নিবৃত্তি ঘটে না, মৃতদেহকে মূলধনে পরিণত করা হয়, এই ধরনের ভয়াবহ সত্যকথা বিবৃত হয় ‘মৃত্যুর অতীত’ নামক শ্লেষাত্মক একাঙ্ক নাটিকায়।

(ঞ) আবার অতি তুচ্ছ ঘটনাও তাঁর নাটকে স্থান পেয়েছে ; যেমন কলকাতার এক গলির ম্যানহোলের মুখ খুলে পয়ঃপ্রণালী সাফ করতে গিয়ে কর্পোরেশনের এক কর্মী বালক মহারাজের গ্যাসে দমবন্ধ অবস্থায় মৃত্যুর চিত্র ধরা পড়েছে ‘নীলকণ্ঠ’ নাটকে।

(ট) ভারতবর্ষে কংগ্রেসী শাসকের স্বৈরাচার, জরুরী অবস্থা ঘোষণার সমকালে অন্ধকার ও আতঙ্কের পরিবেশ মূর্ত হয়ে ওঠে ‘ব্যারিকেড দুঃস্বপ্নের নগরী-বর্গি এল দেশে অর্জুন অপেরা মুমূর্ধ নগরী এবার রাজার পালা-সীমান্ত অস্ত্র-তুরূপের তাস’ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক ঘটনা-নির্ভর নাটক ও যাত্রাপালায়।

(ঠ) ১৯৮৩ সালে চিলির পটভূমিকায় মেহনতি মানুষের লড়াকু ঐক্যের ও সংগ্রামের ছবি মূর্ত হয় ‘অসমাপ্ত সংলাপ’ এবং ‘মালোপাড়ার মা’-তে।

(ড) নাট্যজগতে শোষণ, বঞ্চনা এবং চলচ্চিত্র জগতের অন্তর্জগও তাঁর একাধিক নাটকের বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে; যেমন ‘ছায়ানট-টিনের তলোয়ার-থিয়েটার স্টাডি’।

(ঢ) মানসিক রোগী এক লেখকের (সমরেশ সান্যাল) কল্পনায় একের পর এক লোককে খুন করার কাহিনী ‘মেঘ’।

(ণ) সমাজের তথাকথিত সম্ভ্রান্ত পদাধিকারীদের স্বরূপ উন্মোচনের রহস্যময় কাহিনী ‘রাতের অতিথি’।

(ত) একাধিক ইংরেজি বা অন্য বিদেশী ভাষায় লেখা নাটক থেকে অনুবাদ অথবা অন্য নাটকের ভাব অবলম্বনে লেখা হয়— ‘বিচারের বাণী’ (জন গলট্ওয়ার্দির ‘The Silver Box’), ‘চঁাদির কৌটো’ (প্রেমচন্দের হিন্দী অনুবাদের তথ্য ঋণ স্বীকার), ‘ভি. আই. পি.’ (কাউফম্যান ও হার্টের ‘The Man who came to Dinner’), ‘মধুচক্র’ (জর্জ বার্নার্ড শ’র Mrs. Warren’s Profession’), ‘হিম্মৎবাঈ’ (বারটোল্ট ব্রেশ্ট-এর ‘Die Mutter Und ihre Kinder’) ‘প্রোফেসর মামলক’ (জার্মান নাট্যকার ফ্রিডরিশ ভোলফের ‘Pro fessor Mumlock’) ‘সূর্যশিকার’ (ব্রেখটের ‘গ্যালিলেওর জীবন’ এবং পিটার শ্যাফারের ‘The Royal hunt of the Sun’) ‘সমাধান’ (মূল জার্মান থেকে ১৯৩০-এ লেখা ব্রেখটের ‘ডি মাসনামে’ নাটকের অনুবাদ), ‘ব্যারিকেড’ (উৎস প্রেরণা ইয়ান পেটার্সেন রচিত ১৯৩৩-এর বার্লিনের রোজনামতা ‘ঊনসেরে স্ট্রামে’— ‘আমাদের রাস্তা’), বাংলা ছাড়ো’ (উৎস—দারিও ফো-র Accidental Death of an Anarchist’)।

(থ) অনেক সময় শ্রমিক আন্দোলনের প্রত্যক্ষ বিষয় পথনাটিকার আশ্রয়ে প্রকাশ করা হয়; যেমন ১৯৬১-তে হিন্দমোটর কোম্পানীর হরতাল ও শ্রমিক সংগ্রাম উপলক্ষ্যে লেখা হয় ‘স্পেশাল ট্রেন’। এছাড়া, ফলতা, চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর প্রভৃতি অঞ্চলে প্রচণ্ড শীতে, উন্মুক্ত প্রান্তরে হাজার হাজার দর্শকদের সামনে অভিনীত হয় ‘থিয়েটার স্টাডি’, ‘সমাজতান্ত্রিক চাল’ (খাদ্য আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত), ‘ঘুম নেই’, ‘মে দিবস’ (গোর্কির ‘মা’ উপন্যাস অনুসরণে), ‘দ্বীপ’ ইত্যাদি নাটকসমূহ।

(দ) ধর্মসঙ্ঘের সঙ্গে বিচিত্র সম্পর্কে বিভিন্ন পেশার মানুষ কিভাবে জড়িয়ে যায়—পুলিশ অফিসার-সংবাদপত্র রিপোর্টার মিউনিসিপ্যাল ইন্সপেক্টর-অধ্যাপক গবেষক-বুদ্ধিজীবীর একাংশ, কুটিল চক্রান্তর জালে কিভাবে জড়িয়ে যায় দেশের সাধারণ মানুষ, তার পরিচয় আছে ‘জনতার আফিম’ নাটকে।

উৎপল দত্তের কয়েকটি নাটকের আলোচনা:

উৎপল দত্ত মুখ্যত রাজনৈতিক নাট্যকার রূপে সুপরিচিত। তাঁর কাছে “নাটক মানে সংগ্রাম, নাটক সংগ্রামের হাতিয়ার”। আবার, ‘মানুষকে শিল্পের মাধ্যমে আনন্দ দাও, কিন্তু তার মধ্য দিয়েই তাকে মার্কসবাদ, লেনিনবাদে দীক্ষিত করো, উদ্বুদ্ধ করো’ (উদ্ধৃত, ‘উৎপল দত্ত নাটকসমগ্র’ ভূমিকা, মিত্র ও ঘোষ, পৃষ্ঠা ১১)। এই মতাদর্শগত দায়বদ্ধতা তাঁর রচিত সমস্ত রকমের নাটক-যাত্রাপালা ও পথনাটিকায় অভিব্যক্ত। এই দায়বদ্ধতার কারণেই তিনি লিট্ল থিয়েটার গ্রুপ থেকে পিপলস্ লিট্ল থিয়েটার দল গঠন করেন। তাঁর ভাষায়, “কেননা ততদিনে মনে হয়েছে পিপল্স কথাটা সর্বত্র জুড়ে দেওয়া উচিত….আমাদের যেটা মতবাদ, মতাদর্শ এখন অনেক পাল্টে গেছে। আগে পিপলস কথাটা না নিয়ে এলে আমাদের উদ্দেশ্যই পরিষ্কার হচ্ছে না দর্শকের কাছে” (উদ্ধৃত, পূর্বোক্ত)। সেইজন্য কেউ কেউ (অনুনয় চট্টোপাধ্যায়) এল. টি. জি. পর্বের নাটকগুলিকে ‘পরীক্ষামূলক’ (ভূমিকায় উদ্ধৃত), এবং পি. এল. টি. পর্বের নাটক-যাত্রা ইত্যাদির মধ্যে ‘মতাদর্শের বা মতবাদের বিস্তর পরিবর্তন’ লক্ষ্য করেছেন।

এই ধরনের বাংলা নাট্যশালার মোড় ফেরানো একটি নাটক হল ‘অঙ্গার’। বড়াধেমো, চিনাকুড়ি, কোলব্রুকের খনি অঞ্চলে দুর্ঘটনাসমূহের ভিত্তিতে রচিত হয়। নাটকটির প্রথমে নাম ছিল ‘কালো হীরে’। এই নাটক দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন বিদগ্ধ সাহিত্যিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তাঁর দিনলিপি ‘ঝিলিমিলি’তে (১৮, ২. ১৯৬০) লিখেছিলেন “অঙ্গার দেখে এলাম। এ ধরনের নাটক বাংলাদেশে আছে বলে মনে হয় না। অন্য ভাষায় আছে নাকি? নাট্যমঞ্চের সাজসরঞ্জাম যাকে Production ও Stage craft বলে, চমৎকার। শেষ দৃশ্যটি অপূর্ব।” প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতার নাম ব্যবহার করে লেখা হয় ‘ফেরারী ফৌজ’, ভারতবর্ষের সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের কাহিনী। এর পরে স্বাধীনতা লাভের অব্যবহিত সময়কালে উচ্চবিত্ত বাঙালির জীবনযাপনে ‘হাঁসজারু’ (প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কিস্তৃত ভাব) প্রবণতার পরিচয় পেয়ে উৎপল দত্ত তীব্র ব্যঙ্গে বিদ্ধ করে লিখেছিলেন ‘চঁাদির কৌটো’ এবং ‘‘বিচারের বাণী’ নামে দুটি প্রহসন। নাটক দুটি মুন্সী প্রেমচঁাদ এবং জন গলওয়ার্দির নাটকের দ্বারা প্রভাবিত। কাউফম্যান ও হার্টের ‘The Man who came to Dinner’ অবলম্বনে লেখা হয় হাস্যরসাত্মক নাটক ‘ভি. আই. পি.’ (পুরুষোত্তম)। তবে এই নাটক বিশেষ মঞ্চসফল হয়নি। ‘কল্লোল’ নাটক যুদ্ধজাহাজ ‘খাইবার’ এবং ১৯৪৬-এর নৌবিদ্রোহের ঘটনা নিয়ে মূর্ত হয়। ব্রিটিশ শাসকের দমননীতি এবং ভারতের অহিংসবাদীদের সমর্থনে নৌবিদ্রোহ দমনের ইতিহাস কলঙ্কিত। এখানে বিপ্লবের অপরাজেয় রূপটি প্রকাশিত। এই নাটকের জন্য উৎপল দত্তকে কারাবরণ করতে হয়। বাজারি সংবাদপত্রগুলিও নাটকটির সম্পর্কে বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়। তবু আলোকচিত্রশিল্পী তাপস সেনের পোস্টারে ‘কল্লোল চলছে চলবে’ ক্ৰমশঃ এক আন্দোলনের চেহারা নেয়। শ্রীসত্যজিৎ রায় স্বয়ং এর নেতৃত্ব দেন।

রাজনীতির বিষয়রূপে ফ্যাসিবাদ, বর্ণবিদ্বেষ, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থান বিভিন্ন দেশে মুক্তি সংগ্রামের বিবরণ উৎপল দত্তের বেশ কয়েকটি নাট্য কাহিনীর আশ্রয় হয়ে ওঠে; যেমন ফ্রিডরিশ্ ভোল্ফের অন্যতম রচনা ‘প্রোফেসর মামলক’কে সচেতন ভাবে অনুসরণ করে ঐ একই নামে নাটক লিখেছিলেন উৎপল দত্ত। ইহুদী নিধনের নির্মম ঘটনাবলী এর উপজীব্য। ১৯৩২ সালে জার্মানীতে হিটলারের বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং দেশত্যাগের বিবরণ দিয়ে পরিচালক লিখেছিলেন: “ধনিক শ্রেণীর একনায়কত্বের উপর প্রথমে থাকে গণতন্ত্রের প্রলেপ। ক্রমে সংঘর্ষ ঘর্ষণে তা উঠে যায়। বেরিয়ে পড়ে নগ্ন সশস্ত্র রূপ ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ”। অনুরূপভাবে, ১৯৩১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালবামা রাজ্যের স্কটস্বরো মামলায় শ্বেতা। মানুষেরা কিভাবে কালো মানুষদের প্রতি ঘৃণা ও নির্যাতন করত, তারও নির্মম চিত্র নাট্যকার প্রকাশ করেন ‘মানুষের অধিকারে’ নাটকে। মার্কিনী আগ্রাসনের প্রেক্ষাপটে লেখা হয় ‘অজেয় ভিয়েতনাম। ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে জুনের মধ্যে ‘একাধারে বিদেশী ফৌজ, দেশী প্রতিক্রিয়াশীল শ্বেত ফৌজ এবং দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে লেনিন ও স্তালিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি, সোভিয়েট শ্রমিকশ্রেণী ও জনগণের অসমসাহসিক সংগ্রাম ও জন্মলাভ’-এর কাহিনী প্রকাশ করা হয়েছে ‘লেনিনের ডাক’ নাটকে। কুবার তরোয়ানা শহরে ১৯৫৮ সালে ইস্টারে চে ফিদেলপন্থী অভ্যুত্থানের এক রুদ্ধশ্বাস বিবরণ— ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’। ‘রক্তাক্ত ইন্দোনেশিয়ায় দেখা গেছে ছয়ের দশকের শেষভাগে ডাচ উপনিবেশ অধ্যুষিত অঞ্চলে উদ্ভূত জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। উগ্র জাতীয়তাবাদী বামপন্থী-অতি বাম ও দক্ষিণপন্থী স্বৈরাচারের মধ্যে অবিরাম সংঘর্ষের এক দমবন্ধ শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশ। তার মধ্যে কঠোর রাষ্ট্রনিপীড়ন চলেছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা হয় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মুক্তিসংগ্রামের কাহিনী ‘ঠিকানা’ নাটক। এটি সামরিক বাহিনীর কারাগারে আসন্ন মৃত্যুর সম্মুখীন কিছু আপাত-সাধারণ অথচ অনন্য সাধারণ মানুষের মরণজয়ী আত্মদানের বাহুল্য-বর্জিত নাট্যবিবরণ। অতীতকাল থেকেই ‘যুদ্ধ-ব্যবসা’ ছিল রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতা ও প্রভুত্ব-অর্জনের জন্য অন্যতম উপায়স্বরূপ। ‘হিম্মৎবাঈ’ নাটকে দেখা যায় শাহেনশাহ আওরংজেবের রাজত্বকালের দ্বিতীয়ার্ধে রোহিলাখণ্ডে হিন্দুরাজা আদিত্যসিংহের সঙ্গে যুদ্ধ হয়। নাটকের অন্যতম চরিত্র রিসালদার যুদ্ধ সম্পর্কে যে ব্যাখ্যা দেয়, তা সর্বকালের রাষ্ট্রশক্তির মূল কথা “…অবশ্য যুদ্ধও একটা ব্যবসা। গোড়ায় অসুবিধে হয়। কিন্তু একবার ফেঁদে বসলে ফুলে ফেঁপে ওঠে। তখন সবাই শাস্তির ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। জুয়াড়ি পাশা খেলোয়াড়ের মতন তখন খেলা থামাতে ভয় পায়, থামলেই যে গুণাগার দিতে হবে। অবশ্য যতক্ষণ না আরম্ভ হচ্ছে ততক্ষণই সবাই যুদ্ধকে ভয় পায়, নতুন জিনিস কিনা”। এই নাটক রচনার অন্তরালে ব্রেখটের (‘Die Mutter Und ihre Kinder নাটকের প্রেরণা অনুভব করা যায়। রূপক নাটক ‘যুদ্ধং দেহি’তে আছে তীব্র ব্যঙ্গের কষাঘাতে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতের মূল কারণ নির্দেশ, যুদ্ধ ব্যবসায় রাষ্ট্রনেতাদের কদর্য মুনাফাবৃত্তির স্বরূপ উদঘাটন।

উৎপল দত্তের একাধিক নাটকে অতীত বা সমকালীন ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রশক্তির দ্বন্দ্ব, শোষণ-নিপীড়নের চিত্র স্পষ্ট হয়। এ ধরনের এক উল্লেখযোগ্য নাটক ‘সূর্যশিকার’। সমালোচকদের মতে, এই নাটক ব্রেখটের ‘গ্যালিলেওর জীবন’ প্রভাবিত। নামকরণেও আছে পিটার শ্যাফারের ‘The Royal Hunt of the Sun’ নাটকের অনুরণন। এখানে সমুদ্রগুপ্ত রাষ্ট্রশক্তির প্রতিভূ– বুদ্ধিজীবী সমাজ, ধর্মসংঘ ও সেনাশক্তি, এই তিনের সংযোগে তিনি তার শক্তি সংহত করেছেন। তাঁর প্রতিনিধি হয়গ্রীবের মধ্যে ঘটেছে তার প্রকাশ। বিপরীতভাবে, এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ দানা বেঁধেছে বিজ্ঞান শিক্ষক কলহন, বৌদ্ধবাদী এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রয়াসে, যার কেন্দ্রীভূত রূপ হল ইন্দ্রাণী। এই ইন্দ্রাণীর সংস্পর্শে মনুষ্যত্ব, বিবেকবোধ ফিরে পেয়েছে হয়গ্রীব। সে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছে : “এত…এত শক্তি তোমাদের? কোথেকে পাও? কী করে পেলে বল না গো? অস্ত্র-সেনা ক্ষমতা নিয়ে কই আমি তো এমন হাসিমুখে মরতে পারি না! এমন গভীর শান্তি তো আমি জীবনে পেলাম না!” নাটকের শেষে এই প্রতিরোধের রূপটি সংবাদ আকারে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে : মধুকরিকার “ছেলে বীরক ইন্দ্রাণীর পুঁথি নিয়ে চলে গেছে দেশান্তরে”। ইংরেজ-রাজত্বের সমকালের নৌবিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা হয় ‘কল্লোল’ নাটক। এখানে বিপ্লবী শার্দূল সিংয়ের আপোষহীন বিপ্লবীর ভূমিকার পাশাপাশি দেখানো হয় বিপ্লবের কাজে নারীর সতীত্বের সংস্কার বা স্বামীর কাছে স্ত্রীর (লক্ষ্মীবাঈ) প্রশ্নহীন আত্মসমর্পণের অন্যায় নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিরোধশক্তি। এই প্রতিরোধের আশ্রয় স্বয়ং শার্দুলের মা কৃষ্ণাবাঈ। সে নিজেই তার ছেলেকে তীব্র ভাষায় প্রশ্ন করেছে“স্ত্রীর ইজ্জত বাঁচাবার জন্য ছিলি তুই এখানে?…. খেতে দিয়েছিস আমাদের? তোর মাইনের টাকাও পাঠায়নি আমাদের কাছে। তখন কে দেখেছে আমাদের?” শোভা সেন তাঁর স্মৃতিকথায় বলেছিলেন : “এমন চরিত্রের তুলনা কোথায়? এ সংগ্রামী মেয়েরা গতানুগতিক সতীপনার পরাকাষ্ঠা নয়, এরা বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে গেছে আত্মসম্মান বজায় রেখে।….এ চরিত্রে অভিনয় করে আমি ধন্য হয়েছি” (“দ্রষ্টব্য : উৎপল দত্ত নাটক সমগ্র” পূর্বোক্ত, ভূমিকা, পৃষ্ঠা vii)। এখানে দেখা যায়, সমাজের অমর্যাদা (লক্ষ্মীবাঈকে সুভাষের বউ হওয়ার জন্য শার্দুলের অসতী ভাবা) ও অনধিকারের প্রশ্নে দুই প্রজন্মের নারীর (কৃষ্ণাবাঈ এবং লক্ষ্মীবাঈ) মধ্যে পরস্পর-নির্ভরতা এবং সহমর্মিতা বোধের দৃষ্টান্তদান। এই দুই চরিত্র নাট্যকারের নারী-ভাবনার এক নতুন দিক-নির্দেশক।

এই নারীভাবনার আর একটি দিক প্রকাশ পেয়েছে ‘টিনের তলোয়ার’-এ। এখানে একদা অভিনেতা, পরে অভিনয় শিক্ষকে পরিণত বেণীমাধব টিনের তরবারি বেচার কাজে যুক্ত ময়নাকে অভিনেত্রী ও ভদ্রমহিলা করে কার্যত অন্যের শয্যাসঙ্গিনী করে তুলেছেন। এইভাবে নারী অভিনয় জগতে এক পণ্যে পরিণত হয়েছে। তাই প্রথমে বসুন্ধরা : “মেয়েটাকে বেচে দিলেন বাবু”, পরে ময়না স্বয়ং প্রতিবাদে ফেটে পড়েছে “ভিখিরি যখন ছিলাম, তখন তরবারি বেচে পেট চালাতাম। এখন এমন ভদ্রমহিলা বানিয়েছ, বাবু, যে বেশ্যাবৃত্তি ছাড়া আর পথ নেই। কেন তুলে এনেছিলে রাস্তা থেকে? জবাব দাও। কেন রাস্তা থেকে তুলে এনে আমায় এই অপমান করলে?” এই নাটকে বার্নাড শ’র ‘পিগম্যালিয়ন’-এ প্রোফেসর হিগিন্স্-এর এলাইজা জুলিট্লকে অভিনয় শেখানোর অনুষ। যথাক্রমে বেণীমাধব ও ময়নার চরিত্রে ছায়াপাত হয়েছে।

ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বাধীনতা সংগ্রামের এক উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত ‘তিতুমীর’। ভারত ইতিহাসে তিতুমীর এক বিতর্কিত চরিত্র। ওয়াহাবি আন্দোলন ও মুসলিম মৌলবাদ তাঁকে কেন্দ্র করে দানা বাঁধে। তবু হিন্দু জমিদারের শোষণ ও ইসলামধর্ম বিরোধী বিভিন্ন ফতোয়ার বিরুদ্ধে গরীব হিন্দু-মুসলিম প্রজাদের মিলিত সংগ্রাম তিতুমীরের নেতৃত্বে প্রসারিত হয়। মীর নিসার আলি নামে এক সর্বত্যাগী ফকিরের আদর্শে নাট্যকার তিতুমীরকে ব্রিটিশ বিরোধী প্রজাবিদ্রোহের প্রবর্তকের সম্মান দেন। তিতুমীরের কাহিনী নিয়ে বহু গাথা-পাঁচালি সৃষ্টি হয়; যেমন উৎপল দত্তের নাটকে জনৈক সাজন গাজিকে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়। পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায়ের মুসলমান প্রজাদের দাড়ি রাখার জন্য আড়াই টাকা কর ধার্য করেন। ক্ষুব্ধ সাজন গাজি গান বাঁধে“নামাজ পড়ে দিবা-রাতি / কি তোমার করিল খেতি/কেন কল্লে দাড়ির জরিপানা” ইত্যাদি। তিতুমীর নারকেলবেড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা গড়ে ব্রিটিশ ফৌজের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর অন্তিম পরিণতির দৃশ্য নাটকে জেনারেল পাইরনের সংলাপে মূর্ত হয় “তিতুমীরের মৃতদেহ থেকে মুণ্ডটি কেটে দাড়ি ধরে লটকে সেটাকে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে কলকাতা এইরকম স্থির হয়েছে। সেখানে ঐভাবে ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে কলকাতার বড় বড় রাস্তায় ঘোরানো হবে।” শাসক ইংরেজের এই নির্মম রূপটি নাট্যকারের নিজস্ব সৃষ্টি। তাঁর ‘টোটা’ (সম্পাদিত হয়ে পরে নাম হয় ‘মহাবিদ্রোহ’) নাটকে ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের চিত্র ধরা পড়েছে হিরা সিং-এর সংলাপে।

সিপাহীদের আত্মত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করা হয় এইভাবে “….গলা কাটা আর মুণ্ড কাটার জন্য এ লড়াই নয়। মারতে বাধ্য হলে আমরা নিশ্চয়ই মারব, কিন্তু রক্তপাত নিয়ে গর্ব করে ফিরিঙ্গি ফৌজ, ওটা হিন্দুস্তানের গরীবের ধাতে নেই।…. আমরা লড়ছি একটা আদর্শ নিয়ে, একটা স্বপ্ন দেখে। ….স্বাধীনতার লড়াইয়ে তুমি শুধু লড়াইটা দেখ স্বাধীনতাটা দেখতে পাও না।” এই আত্মত্যাগের পরিচয় দিতে গিয়েই লেখা হয় ‘কৃপাণ’—ভারতবর্ষের এক অবহেলিত সশস্ত্র সংগ্রামের কাহিনী। এখানে আছে, ২৩ নম্বর সশস্ত্র ভারতীয় অশ্বারোহী বাহিনীর ঘটনাসমূহ। চীনের মাটিতে ইংরেজসহ সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলি নরমাংসের ভোজে একত্র হয়েছে। এই ভোজসভায় ব্রিটিশ শাসকের হুকুমে ভারতীয় সেনাবাহিনী যোগ দিতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে আমেরিকায় শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারে শিখরা সম্মিলিত ভাবে হিন্দুস্তান গদর পার্টি প্রতিষ্ঠা করে। এই পার্টির সদস্য হয়ে শিখেরা দেশে ফিরে আসে সশস্ত্র বিপ্লবের শপথ নিয়ে। এই দলের নেতারা ২৩নং ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে বিপ্লববাদ প্রচার করেন। এর নেতৃত্বে ছিলেন রাসবিহারী বসু, বাঘা যতীন প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। কংগ্রেসের ব্রিটিশ তোষণের দিকটি এ নাটকে উদঘাটিত। কৃপাল এবং বলভদ্র নামে দুই বন্ধুর সাক্ষাৎকারে শেষ দৃশ্যটি নাটকীয় এবং হত্যা ঘটনায় মর্মাস্তিক হয়ে ওঠে। কৃপাল লন্ডন থেকে ফিরে কুড়ি বছর জেলে থাকা বলভদ্রের সঙ্গে। সাক্ষাৎ করে। পুরনো বন্ধুরা সব মরে গেছে বলে যখন ঠাট্টা করে সেইসময় বলভদ্র বলে“.. আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় তারাই বেঁচে আছে এবং থাকবে। এবং তুমিই একটি চলন্ত শবদেহ। (শাস্তভাবে কৃপাণ বসিয়ে দেয় কৃপালের পেটে এবং তারপর বুকে। তারপর কৃপালের সুটেই হাত মোছে, ছোরার হাতল মোছে) এই জন্যেই তো আমার বেঁচে থাকার দরকার ছিল”। বিপ্লবীর এই ঘৃণাই নাটকটিকে স্বতন্ত্র মর্যাদা দেয়।

উৎপল দত্তের ‘ব্যারিকেড-দুঃস্বপ্নের নগরী এবার রাজার পালা’ রাজনৈতিক ‘ত্রয়ী’ রূপে চিহ্নিত। ইয়ান পেটার্সেনের লেখা ১৯৩৩ সালে বার্লিনের রোজনামচা ‘উনসেরে স্ট্রাসে’—‘আমাদের রাস্তা’, ‘ব্যারিকেড’ নাটকের মূল অবলম্বন। হত্যা ও রহস্যের আবরণে ফ্যাসিবাদের অভ্যুত্থান ও সর্বগ্রাসী ভয়ঙ্করতা এই নাটকের উপজীব্য বিষয়। এর পটভূমি জার্মানী হলেও নাটকটি ছিল প্রধানত পশ্চিমবঙ্গে। বাহাত্তর সালের রাজনৈতিক পরিবেশের দৃশ্যরূপ। এই সময়টি (জরুরী অবস্থা) নির্বাচনের নামে প্রহসন, ইন্দিরা গান্ধী ও তার বশংবদ সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমলে ফ্যাশিস্ত আদলে বিরোধীদের উপর দমন নিপীড়ন নীতি, পোষা গুণ্ডাবাহিনী দিয়ে হেমন্ত বসু, বিচারপতি প্রমুখের হত্যা ইত্যাদি বিভিন্ন ঘটনায় কলঙ্কিত। এখানে ফ্যাশিস্ত শক্তির স্বরূপ উদঘাটনে কার্যত বার্লিন আর পশ্চিমবঙ্গ একাকার হয়ে গেছে। সমকালের সাড়া জাগানো আর একটি নাটক ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’। এই নাটকের নায়ক কলকাতা শহর। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রনেতারা এই শহরের নাম দিয়েছিলেন ‘মিছিল নগরী’, কখনও বলেছেন ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’। এই শহর শাসকদের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তাই নিপীড়নের কেন্দ্র হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল এই রাজ্য এবং রাজধানী কলকাতাকে। একদিকে রাজনৈতিক সন্ত্রাসের চূড়ান্ত পরিস্থিতি, অন্যদিকে প্রশাসন-শাসকদল-বিত্তবান শ্রেণী-তথাকথিত জাতীয়তাবাদী পত্র-পত্রিকা-লুম্পেন যুবক ভাড়াটে খুনীরা এই সময় একত্রভাবে এই রাজ্যে এক অবাধ নৈরাজ্যের পরিবেশ তৈরী করেছিল। কাশীপুর-বারাসাত-বেলেঘাটায় গণহত্যা, জেলের মধ্যে, থানার মধ্যে নির্বিচার হত্যা, অণিমা পোদ্দারের মতো মহিলাদের উপর দৈহিক অত্যাচার, হেমস্ত বসু হত্যা, শত সহস্র কম্যুনিস্টদের ঘর-বাড়ি-পাড়া-রাজ্যছাড়া করা হয়। জীবন জীবিকার আন্দোলন নিষিদ্ধ করে, গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে, অলিতে গলিতে খুন, সন্ত্রাস ও মৃতদেহের স্তূপ সৃষ্টি করে, প্রতিবাদী সংস্কৃতির কণ্ঠরোধ করে ফ্যাসীবাদী শাসকগোষ্ঠী এই ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ তৈরী করেন। তবু নাটকটিতে উত্তরণের ইঙ্গিত আছে এর গানে—“কলকাতা আমার প্রিয়ার নাম”। শোনা যায়, নাটকটি মোট চোেদ্দবার আক্রান্ত হয়েছিল। এবার রাজার পালা’ প্রাক্-স্বাধীনতা পর্বে ১৯৪৬ সালের উত্তরবঙ্গের এক স্বাধীন দেশীয় রাজ্যের পটভূমিতে রচিত হয়। যাত্রা দলের ননী অধিকারীর মুখে ব্রিটিশ সরকারের দ্বারা নিষিদ্ধ ‘নীলকুঠি’ পালার একটি গান দিয়ে নাটকটির সূচনা। নাট্যকারের বক্তব্য, শ্রেণীসমাজে রাজা বদলের পালা চলতেই থাকবে, পুতুল রাজারা থাকবে, কিন্তু পুঁজিবাদ রাজ্য চালাবে। এই নাটক রচনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব হল, জার্মানীতে হিটলারের অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে ব্রেখট যেমন লিখেছিলেন ‘Der Authaltsame Aufstiegdes Arturo Ui (‘The Resistable Rise of Arturo We’) নাটক, তেমনি ভারতবর্ষে ‘জরুরী অবস্থা’র সময় ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরতন্ত্রী স্বরূপ স্মরণ করে উৎপল দত্ত এই নাটক রচনা করেছিলেন।

উৎপল দত্তের কয়েকটি নাটকের মধ্যে রাজনীতির ‘শ্রেণীসত্য’ সরাসরি আত্মপ্রকাশ করে; যেমন দারিও ফো-র ‘Accedental Death of an Anarchist’ অবলম্বনে লেখা হয় ‘বাংলা ছাড়ো’। নাটকটি পশ্চিমবঙ্গে সত্তরের দশকে সন্ত্রাসের পটভূমিতে রচিত হয়। প্রধান উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক শক্তি সি. পি. এমকে বাংলা ছাড়া করার প্রচেষ্টায় নকশালপন্থীদের প্রশাসন-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-বিচার-ব্যবস্থা-অভ্যন্তরের মানুষ সকলকে নির্বিচারে হত্যার দৃষ্টাত্তদান। নাটকের মূল প্রতীকী চরিত্রটির নামও ছিল উন্মাদ। একই রকম বৈশিষ্ট্যে ‘লৌহমানব-স্তালিন-১৯৩৪’, ‘লেনিনের ডাক’, ‘শৃঙ্খল ছাড়া’, ‘লেনিন কোথায়’, ‘জনতার আফিস’ প্রভৃতি নাটকে মার্কসবাদ কেবল কাহিনীর অবলম্বন নয়, সরাসরি বিষয়রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। তবে নাট্যকার উৎপল দত্তের অনন্যতা দেখা গেছে, প্রথমত শ্রেণীসংগ্রামের রাজনীতির সদর্থক রূপায়ণে। দ্বিতীয়ত, পার্টির প্রতি অন্ধ আনুগত্য না দেখিয়ে জনগণকেন্দ্রিক রাজনীতির সত্য অনুধাবনে। এ সম্পর্কে তাঁর ঋজু বলিষ্ঠ স্বীকারোক্তিটি স্মরণ করা যায় : “… রাজনৈতিক নাটককে এরকম নেতিবাদ থেকে রক্ষা করার একমাত্র পথ হচ্ছে মার্কস্বাদে দীক্ষা, পার্টির নিকটে থাকা, প্রতি মুহূর্তে শ্রেণীসংগ্রামের বর্তমান স্তর ও শক্তি বিন্যাস অধ্যয়ন করা, কোন্ রাজনীতিটা এই মুহূর্তে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন সেটা বোঝা” (উদ্ধৃত, ‘উৎপল দত্ত নাটক সমগ্র’ পূর্বোক্ত, ভূমিকা-অংশ, পৃষ্ঠা [৮])। তাঁর ‘থিয়েটার স্টাডি’ নাটকটি এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যায়। এর বিষয়বস্তু আন্তর্জাতিক কেন্দ্রীয় কমিটির চিঠি নিয়ে মস্কো থেকে একটি দল মার্কসবাদী রাজনীতির মতাদর্শ প্রচারের জন্য চীনের মুকডেন শহরে যায়। কিন্তু এই মার্কসবাদী তত্ত্ব জনগণের মধ্যে প্রয়োগ করতে গিয়ে একজন সৎ তাত্ত্বিক বিপ্লবী আপন বিবেক ও আবেগের স্রোতে ভেসে গিয়ে ব্যর্থ হয়। তার জন্যই পার্টি সংগঠন বিপন্ন হয়। এই নাটকটি মার্কসবাদী শিক্ষার এক অসামান্য দলিল হয়ে উঠেছে।

উৎপল দত্তের নাটকে যাত্রার আঙ্গিক ও কলাকৌশল:

প্রতিভাধর ও সুপণ্ডিত হয়েও নাট্যকার উৎপল দত্ত কখনই নাটকের নব নব পরীক্ষা নিরীক্ষায় কালক্ষেপ করেন নি। এর কারণ সম্ভবত, মার্কসীয় গণবিপ্লবের বিষয়টিকে সাধারণ দর্শকের কাছে প্রকাশ করাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য, নাটকীয় কালোয়াতিতে কোন আগ্রহ ছিল না। এ সম্পর্কে সুধী সমালোচক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি স্মরণ করা যায়“নাটকের গঠনে উৎপলবাবু কোনোদিনই কোনো মৌলিক পরীক্ষা বা উদ্ভাবনের পথে যাননি। বরং তা সে বক্তব্যের দাবিতেই হোক বা নিতান্তই নাটকীয় দ্বন্দ্বসংঘাতের আকর্ষণেই হোক, যে বিষয়ই তিনি যখন গ্রহণ করেছেন, তাকে সাজিয়ে নিয়েছেন কোনো পরিচিত থিয়েটারি কাঠামোর আদলে।” (দ্রষ্টব্য : ‘উৎপল দত্ত নাটক সমগ্র’, খণ্ড পূর্বোক্ত ভূমিকা, পৃষ্ঠা xvi)। উৎপল দত্তের নাটকের বড় বৈশিষ্ট্য, বক্তব্যের মধ্যে স্বচ্ছতা, ঋজু-দৃপ্ত ভঙ্গী এবং প্রায় সর্বক্ষেত্রে জনগণ, তথা সাধারণ দর্শকের সঙ্গে আত্মিক সংযোগ রক্ষা। খুব সম্ভবত এই কারণে ব্রেখটের এপিক থিয়েটার এবং যাত্রাপালার আঙ্গিক তিনি সচেতন ভাবে তার নাটকে প্রয়োগ করেছেন। এ সম্পর্কে তার মনোভাব জানা যায় একটি সাক্ষাৎকারে “আমার এই থিয়েটার যাত্রার কোনো রকমফের নয়, বরং এক সম্পূর্ণ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র শিল্পরূপই। তবুও বলতে পারি, এই থিয়েটারে আমি নিয়ে এসেছি সেই উত্তেজনার খানিকটা যা আমি জনসাধারণের নিকট সান্নিধ্যে দাঁড়িয়ে অনুভব করেছি এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই সেই অভিজ্ঞতা থেকে এক ভিন্ন মনোভাব আয়ত্ত করেছি। আমি ক্রমশই আরো বেশি করে এমন এক থিয়েটারের প্রয়োজন অনুভব করছি যা হবে একাধারে গণগামী ও ঊর্দ্ধগামী; যে কুসংস্কারমতে অতিসূক্ষ্মের স্বাদ আহরণ করতে জনগণকে ঊর্দ্ধগামী হতে হবে, সেই কুসংস্কারকেও আমি অস্বীকার করি”।

উৎপল দত্তের নাট্যরীতির বৈশিষ্ট্য:

এই মনোভাব স্মরণে রেখে বলা যায়, তাঁর নাট্যরীতির বৈশিষ্ট্যগুলি হল সংক্ষেপে

(১) ‘গণগামী অভিনয়রীতির উপাদান’ প্রকাশ করা। 

(২) নাটকের গঠনে যাত্রার অভিঘাত, যাত্রার অনুসরণে গতিময়তা ও সারল্য নাটকের ‘ফর্মে’ নিয়ে আসা।

(৩) খণ্ডদৃশ্যে সুতীব্র নাট্যাবেগ সৃষ্টির পন্থা উদ্ভাবন। 

(৪) নাটকে বিশেষ কাহিনী ও চরিত্র সৃষ্টি করে নগরলৌকিক বা ‘আরবান ফোক’ সংস্কৃতিকে প্রকাশ করা (যেমন ‘টিনের তলোয়ার’)। এটি তাঁর এক প্রিয় উপস্থাপন রীতি। লক্ষ্য করা যায়, উৎপল দত্ত ‘চায়ের ধোঁয়া’ রচনায় ‘শেকসপিয়র ও ইবসেন, ‘শেকসপিয়র ও ব্রেশ্ট’ (১৯৮৮) ‘জপেন দা জপেন যা’ (১৯৭১-৮৪) প্রভৃতি গদ্য রচনাতেও এর প্রয়োগ করেছেন।

(৫) আধুনিক কবিতার পংক্তি ব্যবহার করে অনেক সময় ছন্দোবন্ধ বাক্যকল্পে সংলাপ সৃষ্টি করা হয়েছে; যেমন— ”দুঃস্বপ্নের নগরী’ নাটকের শেষে আছে কবিতার ব্যবহার

“….কলকাতা মানে না ক্ষণিকের অন্ধকার,

সে দেখেছে আগামী দিনের পূর্বালী রং, 

এক বুক ঘৃণা নিয়ে ঊষার প্রতীক্ষা তার,

অত্যাচারীর শেষ ঘণ্টা বাজবে ঢং ঢং।”

(৬) ‘থ্রিলার’ বা রহস্যকাহিনীর প্রতি উৎপল দত্তের আকর্ষণ ছিল। তাঁর প্রেরণাদাতা নাট্যকার বারটোল্ট ব্রেখটেরও ছিল। উৎপল দত্তের ‘মেঘ’ (যার বিজ্ঞাপনই ছিল ‘একটি নিখুঁত খুনের কাহিনী’), ‘লেনিনের ডাক’ (গোয়েন্দা হিচককের রীতিতে বিশ্লেষি সেনাবাহিনী- মিলিশিয়া- আইনব্যবস্থার সমবায়িক প্রকাশে এক জটিল তদস্তমূলক আখ্যান), ‘রক্তাক্ত ‘ইন্দোনেশিয়া’ রাজনৈতিক থ্রিলার এবং ‘চেম্বার ড্রামা’র মিশ্র (রেজিনাল্ড রোজের ‘Twelve Angry Men’ নাটক) আঙ্গিকে লেখা এক দমবন্ধ সন্ত্রাসের পরিবেশ রচনা। ‘ক্রুশবিদ্ধ কুবা’—চলচ্চিত্রের ‘ফেড-ইন-ফেড-আউট’ রীতিতে ধরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ঘটা এক পোলেটিক্যাল থ্রিলার। ডিটেকটিভ কাহিনী ও মামলার ছকে সত্য উদঘাটনের শিল্পকৌশল ‘ব্যারিকেড’ নাটকেও দেখা যায়।

(৭) আলোচনার রীতিতে নাটক রচনার সূচনা করেন উৎপল দত্ত। তার ‘থিয়েটার স্টাডি’ নাটকটি “মার্কসবাদী শিক্ষার এক অসামান্য দলিল” (দ্রষ্টব্য : উৎপল দত্ত নাটকসমগ্র’, ভূমিকা, দেবেশ চক্রবর্তী, পৃষ্ঠা ৫৭৫)।

(৮) একই অভিনেতার ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন চরিত্রের অভিনয় করা, অভিনয় করতে করতে চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মতামত ব্যক্ত করা,–এই জাতীয় ব্রেশ্ট নাট্যরীতির প্রয়োগ তাঁর নাটকে দেখা যায়। নাট্য সমস্যা মীমাংসার দায়িত্ব দর্শকের উপর ছেড়ে দেওয়া, দর্শককে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টাও তার নাটকে প্রায়শঃই চোখে পড়ে। এইভাবে ‘কনটেন্ট’ ও ‘ফর্মের অপূর্ব সমন্বয় ও পরীক্ষা করেছেন উৎপল দত্ত।

(৯) রাজনীতির বিষয়কে অবলম্বন করে যাত্রানাটকের জগতে নতুন যুগ এনেছিল‌ ‘রাইফেল’। তিনি প্রায় একুশটি যাত্রাপালার রূপকার। গ্রামে-গঞ্জে প্রত্যক্ত অঞ্চলের দর্শক রুচির পরিবর্তনে এই যাত্রাগুলি একসময় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিল। অনুরূপভাবে চুঁচুড়া কোর্টের সামনে কৃষক জমায়েতে খাদ্য আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা ‘সমাজতান্ত্রিক চাল’ নাটক মঞ্চস্থ করা হয়। হিন্দমোটর কোম্পানীর হরতাল ও শ্রমিক সংগ্রাম উপলক্ষ্যে লেখা হয় ‘স্পেশাল ট্রেন’। এইভাবে পথনাটিকা রচনা ও অভিনয়ের মাধ্যমে বাংলার আপামর দর্শকসাধারণকে প্রত্যক্ষভাবে নাট্যসংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করার ক্ষেত্রে উৎপল দত্ত প্রায় ‘পথিকৃৎ’-এর ভূমিকা পালন করেছিলেন।

শ্রেণীশত্রুর সুরক্ষিত দুর্গের ভিত ধ্বসিয়ে দিতে একের পর এক নাটক-যাত্রাপালার মাধ্যমে রাজনৈতিক বিদ্যুদীপ্তি ছড়িয়ে কালবৈশাখী ঝড়ের মতো আছড়ে পড়েছেন উৎপল দত্ত। প্রয়োজন বুঝেই ‘পদ্মভূষণ’ খেতাব ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছেন। জনতার প্রয়োজন পাশে এসে দাঁড়িয়ে তাদের সচেতন করার জন্যেই পোস্টার নাটক, রাজনৈতিক প্রচারধর্মী বাস্তব নাটক সৃষ্টি করেছেন। তাই বাংলা নাট্যজগতে তাঁর পৃথক ভূমিকা অবশ্যই উল্লেখের দাবি রাখে।