সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার পূর্বে কলকাতায় যে কয়টি সখের নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলির মধ্যে চারটি নাট্যশালার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলি যথাক্রমে পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়, শোভাবাজার প্রাইভেট থিয়েট্রিকাল সোসাইটি, জোড়াসাঁকে নাট্যশালা এবং বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়। বাংলা নাটক ও নাট্যশালার ইতিহাসে এগুলির ভূমিকা বিশেষভাবে স্মরণীয়।
বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই মনোমোহন এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হন এবং তারই রামাভিষেক নাটকের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে এই নাট্যশালার সূচনা হয়। বঙ্গবাজার বঙ্গ নাট্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তখনকার দিনের খ্যাতনামা অভিনেতা বলদেব ধর ও চুনিলাল বসু। এঁরা দুজনেই পাথুরিয়াঘাটা নাট্যশালায় নিয়মিতভাবে অভিনয় করতেন। ১৮৬৭ খ্রীঃ ৫ই জানুয়ারী গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাসভবনে ‘নবনাটক’-এর অভিনয় উপলক্ষে একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বলদেব ধর ও চুনিলাল বসু প্রতিজ্ঞা করেন যে তাঁরা একটি পৃথক সখের রঙ্গমঞ্চ স্থাপন করবেন। শেষ পর্যন্ত এদের দুজনের আন্তরিক প্রচেষ্ঠায় এবং কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতায় বহুবাজারে বিশ্বনাথ মতিলাল গলিতে গোবিন্দচন্দ্র সরকারের বাড়িতে একটি সখের নাট্যশালা প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নাট্যশালাই ‘বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়’ নামে প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিল। এই নাট্যালয়ের সম্পাদক ছিলেন প্রতাপচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। ঐ নাট্যালয়ের জন্য ভালো একখানি নাটকের সন্ধান করতে গিয়ে এঁরা মনোমোহন বসুর কাছে আসেন এবং তাঁকে একখানি নাটক লিখে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। মনোমোহনও এদের প্রস্তাবে সম্মত হন। এদিকে রঙ্গমঞ্চের ব্যবস্থাদি প্রায় সম্পূর্ণ। ইতিমধ্যেই চুনিলাল বসুর মাতুল গোবিন্দচন্দ্র সরকার তাঁর অট্টালিকা সংলগ্ন বিস্তীর্ণ জমি ছেড়ে দিয়েছেন রঙ্গমঞ্চের ব্যবস্থার জন্য। তাঁরই কনিষ্ঠ ভ্রাতা গোপালচন্দ্র সরকার নাটকের মহড়ার জন্য তাঁরা বৈঠকখানাটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। সমস্ত দিকের ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ, অথচ নাটক প্রস্তুত হয়নি তখনো।
মনোমোহন উদ্যোক্তাদের আগ্রহাতিশয্যে তাঁর পূর্বের লেখা একখানি নাটক তাদের অভিনয়ের জন্য দিলেন। এই নাটকটির নাম ‘রামাভিষেক’ বা রামের অধিবাস’। মনোমোহন তাঁর স্বগ্রাম ছোট জাগুলিয়ার যুবকবৃন্দের অভিনয়ের জন্য এই নাটকখানি রচনা করেছিলেন। কিন্তু উড়িষ্যায় দুর্ভিক্ষ(১৮৬৬) দেখা দেওয়ায় সেখানে অভিনয়ের বরাদ্দ টাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়; ফলে তখন নাটকটি অভিনীত হয়নি।
‘রামাভিষেক’ নাটকটির প্রথম অভিনয় হয় ১৮৩৮ খ্রীঃ দূর্গাপূজার ঠিক পরেই বহুবাজার বঙ্গনাট্যশালায়। প্রথম রাত্রির অভিনয়ে দশরথের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কৌশল্যা ও লক্ষ্মণের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন যথাক্রমে চুনিলাল বসু ও বলদেব ধর। এঁরা তিনজনেই সেকালে অভিনেতা হিসাবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মনোমোহন নিজে সমস্ত দৃশ্যপটের পরিকল্পনা করে দেন এবং তাঁরই পরিকল্পনা মত মঞ্চসজ্জার কাজ সম্পন্ন হয়। এই নাটকের দ্বিতীয় দিনের অভিনয় দেখে প্রীত হয়ে জনৈক দর্শক ‘ন্যাশানাল পেপার’ পত্রিকায় (২৫শে অক্টোবর, ১৮৬৮) একটি পত্র প্রকাশ করেন, এই পত্রটি থেকে এই নাটকের অভিনয়ের গুণাগুণ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায়।
বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়ের অভিনেতাবর্গ ২৫নং বিশ্বনাথ মতিলাল লেন সংলগ্ন একটি খোলা জমিতে স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ স্থাপনের পরিকল্পনা করেন। ১৮৭৪খ্রী ১৭ই জানুয়ারী এরা নবনির্মিত রঙ্গ মঞ্চ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। মনোমোহন বসুর ‘সতী’ নাটক অভিনীত হয়। ‘সতী’ নাটক রচনার মূলে যে এঁদের উৎসাহ প্রধানভাবে কার্যকর হয়েছিল, এতে কোন সন্দেহ নেই। ‘সতী’ নাটকের অভিনয়ে চুনিলাল বসু একই সঙ্গে দক্ষ ও শিবের ভূমিকায় অভিনয় করে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। মঞ্চসজ্জায় অভিনবত্বও সেকালে নাট্যমোদীগণের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এই অভিনয়ের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছিল মধ্যস্থ পত্রিকায় (মাঘ, ১২০০), অমৃত বাজার পত্রিকায় (২২শে জানুয়ারী, ১৮৭৪), সোমপ্রকাশ পত্রিকায় (৩০শে মার্চ ১৮৭৪) এবং সাধারণী পত্রিকায় (২৪শে ফাল্গুন, ১২০০)।
মনোমোহনের পরবর্তী রচনা ‘হরিশচন্দ্র’ নাটক প্রথম মঞ্চস্থ হয় বহুবাজার নাট্যালয়ে। এই সময় হিন্দু মেলাকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবোধের আদর্শ দেশব্যাপী বিস্তৃতি লাভ করেছিল, মনোমোহনের এই নাটকে তার সুষ্পষ্ট প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। এই নাটকের অভিনয়ে চুনিলাল বসু হরিশচন্দ্রের ভূমিকায় এবং প্রতাপচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বিশ্বামিত্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। মনোমোহনের প্রথম যুগের নাটকগুলি রচনায় এই নাট্যালয়ের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা নাটকের অভিনয় শিল্পের দিক থেকে এঁরা কতকগুলি বিশেষ মৌলিকতা ও অভিনবত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। একই নাটকে পরস্পর বিপরীত ভাবের দুটি চরিত্রে একই অভিনেতা অভিনয় করে অভিনয় কুশলতা প্রদর্শন করেছেন এবং বাংলা নাটকের অভিনয়ে এমনটি আর ইতিপূর্বে দেখা যায়নি।
এই নাট্যসমাজের অভিনয় বৈশিষ্ট্য আর একদিক থেকে মনোমোহনকে অনুপ্রাণিত করেছিল— তা’ হল হাস্যরসাত্মক চরিত্র সৃষ্টি। চুনিলাল বসুর অগ্রজ মতিলাল বসু এই রঙ্গমঞ্চে নিয়মিতভাবে অভিনয় করতেন এবং হাস্যরসাত্মক চরিত্রে রূপদান করতেন। তাঁর অভিনয় বৈশিষ্ট্যে মুগ্ধ হয়ে মনোমোহন এই ধরনের চরিত্রে গভীরতা ও জটিলতা সৃষ্টির আগ্রহ প্রকাশ করেন।
অনেকে মনে করেন, মনোমোহন বসু তাঁর বিভিন্ন নাটকের হাস্যরসাত্মক চরিত্রগুলি বিশেষতঃ ‘সতী’ নাটকের শাস্তে পাগলা, হরিশচন্দ্র নাটকের পাতঞ্জল অনেকটা যেন তাঁকে দেখেই রচনা করেছেন। বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়কে মনোমোহনের নাট্য রচনার ভিত্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র বলে অভিহিত করা যেতে পারে। এই নাট্যালয়েরই কর্তৃপক্ষের উৎসাহে তিনি পরপর কয়েকটি নাটক রচনা করেন এবং এঁদেরই অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি তাঁর এই নাটকগুলির মঞ্চ সাফল্য সম্বন্ধে নিঃসংশয় হন। তিনি তাঁর নাটকগুলির অভিনয়ের সময় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপস্থিত থাকতেন। তাঁর নাটকের যে সকল অংশ দর্শকদের যথাযথভাবে তৃপ্তি সাধনে সক্ষম হচ্ছে না বলে তিনি মনে করতেন, সেগুলি তিনি পরিবর্তন করে দিতেন। মনোমোহন যে তাঁর নাটকগুলির অংশবিশেষ পরিবর্তন করতেন, তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর নাটকগুলির বিভিন্ন সংস্করণের ‘নাট্যকারের নিবেদন অংশ থেকে। কেবল তিনি সংলাপের পরিবর্তন করেননি কোন কোন ক্ষেত্রে নাট্য-ক্রিয়ায়ও পরিবর্তন সাধন করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে তাঁর প্রথম দিককার নাটকগুলি বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়ে বারংবার অভিনীত হওয়ার জন্যই রঙ্গমঞ্চের অভিনয় দেখে তিনি দর্শকদের চাহিদা বুঝতে পেরেছেন এবং সেই অনুযায়ী তাঁর নাটকগুলির পরিণতি অঙ্কন করেছেন। ‘সতী’ নাটকের বিয়োগান্ত পরিণতির পরিবর্তে মিলনান্ত পরিণতি সম্বলিত ক্রোড়পত্র সংযোজনের এটিও অন্যতম কারণ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে।
বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়ের কুশলী অভিনেতৃবর্গের অভিনয় বৈশিষ্ট্য দেখে তিনি তাঁর নাটক রচনার মূল আদর্শটি ঠিক করে নিতে পেরেছিলেন। এই কারণেও তিনি এই নাট্যসমাজের নিকট বিশেষভাবে ঋণী। এই বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয় মনোমোহনের নাটক রচনার কেবল প্রেরণাস্থল নয়, প্রতিষ্ঠাভূমিও বটে। বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে এই রঙ্গালয়ের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
Leave a comment