তুলসী লাহিড়ী অভিনয় জগতে একটি জনপ্রিয় ও অতি পরিচিত নাম। মঞ্চ ও চিত্রজগতে— তাঁর অভিনয় কৃতিত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রসামোদীর মনে আজও অক্ষয় হয়ে আছে। নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীও একটি স্বতন্ত্র নাম, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব। প্রথম জীবনে তিনি ছিলেন পেশায় আইনজীবী, নেশায় অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী। পরবর্তীকালে নেশা ও পেশা এক হয়ে যায়—তিনি আইন ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অভিনয়ের জগতে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। ইনিই আবার পরিণত বয়সে অভিনয়ের সঙ্গে নাট্যরচনার বাণীমন্দিরে নিজেকে সঁপে দেন। বস্তুত আক্ষরিক অর্থেই তুলসী লাহিড়ী ছিলেন বহুমুখী ব্যক্তিত্বের ও প্রতিভার অধিকারী। বাংলা নাট্য-ভাণ্ডারটিও তাঁর দানে সমৃদ্ধ হয়েছে, সন্দেহ নেই।

তুলসী লাহিড়ী জীবনবাদী নাট্যকার। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে বাঙালী মনোজীবনে এক সর্বাত্মক আলোড়নের ঢেউ লেগেছিল। তৃতীয় দশক থেকে প্রশ্ন, সংশয়, জিজ্ঞাসার ক্ষেত্রে নতুন বাঁকের সূচনা দেখা দিল। চতুর্থ দশক থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সর্বগ্রাসী তাণ্ডবের ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া, মন্বন্তর, দেশবিভাগ জনিত ভাঙ্গাগড়ার আলোড়ন মানুষের জীবনবোধ, গণ্ডী চেতনার বাইরে বাঙালী মানসিকতাকে এক ধাক্কায় একটা অস্থিরতা, অনিশ্চয়তার বিশাল প্রান্তরে উপনীত হল আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আত্মিক জীবন নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ল। নৈতিক মূল্যবোধ পালটে গেল। অর্থনৈতিক সঙ্কট পারিবারিক ও আত্মিক মূল্যবোধের ক্ষেত্রে গুরুতর পরিবর্তন ঘটালো। বস্তুতঃ যুদ্ধ, মন্বন্তর দেশবিভাগ আমাদের শান্ত ও নিরুদ্বিগ্ন জীবনে যে শোচনীয় বিপর্যয় নিয়ে এল, সেই ঝঞ্ছা-বিক্ষুব্ধ পটভূমিতে নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর আবির্ভাব।

তুলসী লাহিড়ী যুগন্ধর শিল্পী। যুগের অস্থিরতা, সংশয়, জিজ্ঞাসা তাঁর সৃষ্ট শিল্পে বাষ্ময় রূপ পেয়েছে। যুদ্ধের বিভীষিকা ও তার তীব্র প্রতিক্রিয়া, মন্বন্তরের কুৎসিত বিপর্যয়, দেশ বিভাগোত্তর বাঙালী জীবনের আর্থনীতিক-সামাজিক নৈতিক মূল্যবোধের বিক্রিয়াজনিত পরিবর্তন, দ্রুত পরিবর্তনশীল সমাজের রূপ ও রূপান্তর তাঁর নাট্য শিল্পে মূর্ত হয়ে উঠেছে এবং তাতে সেই সঙ্গে তার সমাজবোধের নিজস্ব চিন্তা ও আদর্শ সঞ্জীবিত করতে তিনি চেষ্টা করেছেন।

তুলসীবাবু গভীর জীবনসমস্যার বাষ্ময় রূপকার। জীবনের উপরিতলের ভাসমান ফেনপুঞ্জের বর্ণচ্ছটায় মুগ্ধ হয়ে সেখানেই তিনি মত্ত থাকেন নি, জীবনের গভীরে অন্তঃসায়ী মনের সন্ধানে তার শিল্পীমানস সতত চেষ্টিত। শিল্পীমানসের অতলপ্ত আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ক্ষ্যাপার মত তিনি পরশ পাথর খুঁজেছেন, চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতার আলোকে বাঞ্ছিত জীবনকে পেতে চেয়েছেন, না পাওয়ার বেদনায় আকুল হয়ে এগিয়ে চলেছেন সামনের দিকে। তাঁর প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য মানুষ, আর্থ-সমাজনীতিক ও আত্মিক সম্পদে পূর্ণ পরিপূর্ণ মানুষ। এই সাধনার কারণেই তিনি বর্তমানের ত্রুটি-বিচ্যুতির প্রতি অঙ্গুলি-নির্দেশ করেছেন, শ্লেষ-বিদ্রূপের নির্মম কষাঘাত করেছেন।

তুলসীবাবুর নাটকে যে বিদ্রূপের সুর, তা— ‘চোখের জল ফেলতে হাসি পায়’। কায়েমী স্বার্থের চক্রান্ত ও পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে চরম বিতৃষ্ণায় তিনি স্বপ্ন দেখেছেন শোষণমুক্ত সমাজের, যেখানে মনুষ্যত্বের পূর্ণ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হবে। শিল্পী তুলসী লাহিড়ী বহু বিচ্ছুরিত জীবনকে দেখেছেন। অপরাজেয় মানবাত্মার অপরিম্লান সত্যের উদ্ঘাটনে মানুষ একদিন সব ব্যর্থতা, গ্লানি, অন্ধকার থেকে উদার জ্যোতির্ময়লোকে উত্তরণ করবেই–এ বিশ্বাস তিনি রাখেন। তিনি বিশ্বাস করেন ‘It is not the historian, but the artist, who writes the real history of man’.

আমাদের জ্ঞাত তথ্যানুযায়ী তুলসী লাহিড়ী সর্বমোট তেরোটি পূর্ণাঙ্গ নাটক এবং পনেরোটি একাঙ্ক নাটক রচনা করেছেন। কাহিনী বিন্যাসের নৈপুণ্যে, চরিত্রচিত্রণের দক্ষতায়, জীবনবোধের গভীরতায় তার নাট্যসাহিত্য সমুজ্জ্বল। এক অর্থে তার নাটক উদ্দেশ্যমূলক সৃষ্টি, একটি বিশেষ তত্ত্ব ফুটিয়ে তোলার পরোক্ষ দায়িত্বও নাট্যকারের আছে। তাই নাট্যকারের সার্থকতা নির্ভর করে নাট্যকারের ঐসব সৃষ্টিবিন্যাস ও ব্যাঞ্জনাশক্তর উপর। এই বিশ্বাসের প্রকৃত শক্তি পরীক্ষা করবার জন্য বিশেষভাবে এই নাটক রচনা করেছি—’বাংলার মাটি’ নাটকের ভূমিকায় ‘উল্লিখিত নাট্যকারের এই জীবন-দর্শন নাট্যকার তুলসী লাহিড়ীর রচনাকে অনন্যসাধারণ করে তুলেছে।

অভিজ্ঞতাই তাঁর রচনার মূল উপজীব্য। “দুঃখীর ইমান” নাটকের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন “এই নাটকখানি চিন্তা ও plan করেছি যে অবস্থায় যাদের দেখে, পঞ্চাশের মন্বন্তরে তাদের অনেকেই এই হতভাগ্য দেশ থেকে চিরবিদায় নিয়ে চিরশান্তিধামে গিয়ে জুড়িয়েছে।” তাঁর আশেপাশে দেখা ঘটনা ও চরিত্র তাঁর মনে এমন ছাপ ফেলেছিল যে, তার নানা রচনায় বারেবারে তারা উকি দিয়েছে।

মন্বন্তরের পটভূমিকায় রচিত দু’খানি নাটক—‘দুঃখীর ইমান’ ও ‘ছেঁড়া তার’-এর কয়েকটি চরিত্র, নাম-ধাম ভিন্ন হলেও মূলত অভিন্ন, একটু লক্ষ্য করলেই তা বুঝা যায়। ‘দুঃখীর ইমান’ নাটকের দুর্ভিক্ষের পটভূমিকায় মনুষ্যত্বের চকিত বিদ্যুৎ ঝলক; ‘ছেঁড়া তার’-এ একই পটভূমিকায় আত্মিক অপচয়ের নিদারুণ চিত্র, ‘পথিক’ নাটকে কয়লাখনির পরিবেশে দ্বিধা, সংশয়, বন্ধন অতিক্রম করে নতুন পথিকের জয়যাত্রা; ‘লক্ষ্মীপ্রিয়ার সংসার’ নাটকে দেশবিভাগ পরবর্তী মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা ও তার ফলশ্রুতি; বাংলার মাটি’ নাটকে তখনকার সদ্য বিভক্ত পূর্ববঙ্গে হিন্দুপরিবারের সমস্যা চিত্রিত হয়েছে।

তুলসী লাহিড়ীর একাংক নাটকগুলিও বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে ও পরিবেশন-নৈপুণ্যের গুণে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। নাট্যকার এ সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণীরমুখোশ উম্মোচিত করেছেন। ‘নববর্ষ’ নাটকে সমাজব্যবস্থার চাপে নারীত্বের শোচনীয় পরিণামের চিত্র। বর্গীর অত্যাচারের পটভূমিকায় রচিত ‘নায়ক’-এ যথার্থ নেতা কিভাবে উদ্ভুত হয়, তার কথা।

‘গ্রীনরুমে’ শিল্পীজীবনের শোচনীয় পরিণামের চিত্র বিষ্মিত। ‘ওলট-পালট’-এ ভেজাল ব্যবস্থার প্রতি অমগুলি সংকেত। ‘মণিকাঞ্চন’ এ দেশনেতার মুখোস খুলে দেওয়া হয়। ‘চৌর্যানন্দ’ নাটকে সামাজিক ও নৈতিক অধঃপতনের চিত্র। ‘দেবী’ তুলসী লাহিড়ীর শ্রেষ্ঠ একাংকিকা।

তুলসীবাবুর নাটকে স্যাটায়ারের তির্যকপথে সমাজ সচেতনতার—আধুনিক সংগ্রামী মানুষের ত্রুটি-বিচ্যুতি অবক্ষয়-নৈরাশ্য, সাফল্য-ব্যর্থতা— এক কথায় যন্ত্রণাকাতর জীবনের অসামান্য শিল্পরূপের প্রকাশ। বিভিন্ন আঞ্চলিক পটভূমিকায় বিধৃত তার নাট্যকাহিনীতে পরিবেশ রচনা কৌশল লক্ষণীয়। আঞ্চলিক ভাষার সুষ্ঠু ব্যবহারে চরিত্রগুলিও যথাযথভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে। বিদেশী প্রভাব তিনি কোন কোন ক্ষেত্রে গ্রহণ করেছেন কিন্তু তাকে ১টি করণ (assimilation) দ্বারা তিনি তাকে চিরপরিচিত দেশ ও মাটির মানুষের ভাবনার ও জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন করে তুলতে পেরেছেন। এখানেই তাঁর সাফল্য ৷ The purpose of the drama is to teach us how to servive–এই সংকল্পের সার্থক প্রকাশ তুলসীবাবুর নাটকে দেখা যায়। তুলসী লাহিড়ীর নাটকের পাঠ্য ও অভিনয়ে দুই গুণই বর্তমান। এদিক থেকেও তিনি নাট্যকার হিসেবে বিশেষ একজন।