বাংলা নাটকের ইতিহাসে ‘নীলদর্পণ’ এর গুরুত্ব

উনিশ শতকী ঔপনিবেশিক সীমাবদ্ধতায় শৃঙ্খলিত বাঙালির পুনর্জাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ দীনবন্ধু মিত্রে [১৮৩০-১৮৭৩]। বাংলা নাটকে আধুনিকতা আনয়নে সে সময়ের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে আশ্রয় করে প্রতিবাদী ভঙ্গিতে নাটক রচনার সূত্রপাত ঘটান এই নাট্যকার। তাঁর ‘নীলদর্পণ’ (১৮৬০) নাটকটি বাঙালির ইতিহাসের একটি করুণ অধ্যায় নিয়ে রচিত বলে তা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

‘নীলদর্পণ’ নাটকের ঘটনাংশে আবর্তিত হয়েছে নীলকরদের অত্যাচার এবং অত্যাচারিত কৃষক সমাজের যন্ত্রণাক্ষুব্ধ প্রতিবাদ। ডাক বিভাগের সুপারিনটেনডেন্ট রূপে দীনবন্ধু নীল চাষিদের দুরবস্থা নিজে প্রত্যক্ষ করেছেন। ফলে তাঁর শিল্পী মানসের সঙ্গে সমকালীন নীল-আন্দোলনের ভাবাদর্শগত অন্তর্বয়ন বিচার এবং তৎকালীন বাংলার স্তরবহুল সমাজ-সত্তার শ্রেণিবিন্যাস ও শ্রেণিদ্বন্দ্বের স্বরূপ উন্মোচন করা অপরিহার্য। প্রকৃতপক্ষে, কালবিধৃত দীনবন্ধুর সৃষ্টিক্ষম প্রজ্ঞার শক্তি, সামর্থ্য এবং সীমাবদ্ধতা উনিশ শতকী মধ্যবিত্ত শ্রেণির জটিলতর মানস স্বরূপের নিগূঢ় ঐক্যে ও অন্তর্বিরোধে সম্পর্কিত। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মূল্যায়নে তাই সমসাময়িক নীলবিদ্রোহের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করা যুক্তি সিদ্ধ। সিপাহী যুদ্ধোত্তর নীলকর নির্যাতন বিরোধী সম্ভাব্য সার্বিক কৃষক বিপ্লবকে পরিপ্রেক্ষিত নির্বাচন করে দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনা করেন। সমসাময়িক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের সামগ্রিক বিবেচনায় দীনবন্ধুর এ বিষয় নির্বাচন অনন্যপূর্ব হলেও, কৃষক জীবনের সমগ্র বাস্তবতার কাহিনি নির্মাণ তাঁর লক্ষ্য ছিল না। বস্তুত তিনি বাংলার
সামন্ততান্ত্রিক শোষণকে তাঁর নাটকে ব্যবহার না করে কেবল নীলকর অত্যাচারকেই করেছেন প্রতিপাদ্য।

স্বদেশ চেতনারই রূপবন্ধ ‘নীলদর্পণ’ নাটক নাটকটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব এখানে যে, নীলদর্পণ বাংলা ভাষায় রচিত
প্রথম আর্থসামাজিক রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে জনজীবনমূল স্পর্শী সৃষ্টিকর্ম। সমাজসতর্কমূলক বাংলা নাটকের শিল্পিত ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রে এ নাটক পালন করেছে এক সুদূর সঞ্চায়ী ভূমিকা। দীনবন্ধু ‘নীলদর্পণের বিষয় ও বৃত্তে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত ও নিপীড়িত বাংলার কৃষিজীবী মানুষের সামগ্রিক জীবনানন্দ ও জীবন যন্ত্রণাকে অভিব্যঞ্জনা দান করেছেন। উনিশ শতকের নব্য সৃষ্ট স্বদেশবোধকে গ্রামীণ জীবন ও গ্রামীণ পটভূমিতে বিস্তৃত করে একই সঙ্গে নাট্যকার স্বীয় সৃষ্টিক্ষম প্রতিভা এবং সমকালীন বিদ্বৎসমাজের স্বদেশবোধের অগ্নি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। নাগরিকবৃত্ত অতিক্রম করে স্বদেশ মৃত্তিকার বৃহত্তর জীবনে শিল্পকে সংলগ্ন করার জন্য অত্যন্ত সচেতনভাবে জনজীবনমূল থেকে বিষয়বস্তু, চরিত্র এবং সংলাপ আহরণ করেছেন। তোরাপ, রাইচরণ, সাধুচরণ, রেবতী, ক্ষেত্রমনি, আদুরী, গোপীনাথ, পদীময়রানী-এরা প্রত্যেকেই যেন বাংলা পল্লি জীবনের পরিচিত ক্ষেত্র হতে আপনি এসে নাট্য কাহিনির মধ্যে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। এসব চরিত্রের ভাষা তাদের প্রাণের ভাষা হওয়ায় তারা জীবন্ত ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। নাটকের প্রথমাংশে যে ব্যক্তি নবীনমাধব ঘোষণা করে,

“গোরিব প্রজাগণের রক্ষাতে দীক্ষিত হইয়াছি, নিষ্ঠুর নীলকরের পীড়ন হইতে যদি একজন প্রজাকেও রক্ষা করিতে পারি তাহা হইলেই আপনাকে ধন্য জ্ঞান করিব।” (১/৩)

সে নবীনই নাটকের ঘটনাবৃত্তের পরিণামী মুহূর্তে ক্ষেত্রমণিকে উদ্ধার করার সময় তোরাপ যখন রোগ সাহেবকে প্রহারে ব্যস্ত তখন ক্ষমার বাণী প্রচার করে।

“তোরাপ, মারবার আবশ্যক কি, ওরা নির্দয় বল্যে আমার নির্দয় হওয়া উচিত নয়।” (৩/৩)

‘নীলদর্পণে’ যে কাহিনি ও পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়েছে ঐতিহাসিক বিবেচনায় তা মোটেই মিথ্যা কিংবা অতিরঞ্জিত নয়। ঐতিহাসিকেরাই জানিয়েছেন, যে সকল কৃষক নীল চাষ করতে অনাগ্রহ প্রকাশ করতো তাদেরকে গুলি করে বা বর্শাবিদ্ধ করে খুন করা হতো। কখনো বা ছোটো অন্ধকার গুদাম ঘরে বন্দি করে অমানুষিক নির্যাতন করা হতো। গ্রাম্য কৃষকদেরকে শায়েস্তা করার জন্য সবসময়ই একটি অস্ত্রধারী বাহিনি তৈরি থাকত। তারা ইচ্ছেমত লোককে শাস্তি দিত, লুণ্ঠন বা অগ্নিসংযোগ করতো। গৃহস্থ কন্যা কিংবা গৃহবধূরাও তাদের দ্বারা লাঞ্ছিত হতো। নীলকর ও তাদের চেলাদের অত্যাচারের বিবরণ পড়লে আজও মানুষের শরীর শিউরে ওঠে।

দীনবন্ধু মিত্র নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সমগ্র দেশকে উত্তেজিত করে তুলতে সক্ষম হন। এককথায় ভারতবর্ষের ইতিহাসে নীল আন্দোলন হলো কৃষকদের প্রথম সফল আন্দোলন। এই আন্দোলনের সূত্রে তৃণমূল পর্যায়ের চাষিরা পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ হয়ে ডঠে। কেবল তাই নয়, সেকালের বৃদ্ধিজীবী শ্রেণিকে সচেতন করে তুলতে এই আন্দোলন বিশেষ সহায়তা করে। ফলে উদীয়মান মধ্যবিত্ত সমাজও উক্ত আন্দোলনকে সমর্থন জানায়। এভাবেই দীনবন্ধু মিত্র ‘নীলদর্পণ’ রচনা করে নীলকরদের উপর বহুমুখী আঘাত হানেন। এসময় প্রথমে নীলকররা আরো বেশি হিংস্র ও পৈশাচিক হয়ে উঠলেও শেষ পর্যন্ত তাদেরকে নিরস্ত হতে হয়েছে। অসহায় প্রজাদের উপর নীলকরদের অত্যাচারের স্বরূপটি তুলে ধরাই ‘নীলদর্পণ’ নাটক রচনার প্রধান লক্ষ্য ছিল। অবশ্য এই শোষণ ও প্রতিবাদের পরিণাম তিনি উল্লেখ করেননি। তথাপি এখানে তিনি বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের যে চিত্র তুলে ধরেছেন তা অতি দ্রুত মানুষের মধ্যে প্রচার পায়। ‘নীলদর্পণ’ ইংরেজিতে অনূদিত হলে তা ইংরেজ শাসকদের টনক নাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। কলকাতার ন্যাশনাল থিয়েটারে টিকেটের বিনিময়ে নাটকটি দেখানো হয়। এই নাটকের অভিনয় দেশে অভূতপূর্ব আবেগ ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে।

‘নীলদর্পণ’ কেবল নাটক নয় একটি ঐতিহাসিক দলিল রূপে বাঙালির সম্পদ হয়ে আছে। কারণ তা সম্পূর্ণ বাস্তব পটভূমিতে সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য সামনে রেখে রচিত। এবং নাট্যকার সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নেও সফল হয়েছেন। ‘নীলদর্পণ’ এদেশের সমাজ ও সাহিত্য গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে। নাটকটি নিরপরাধ পথহারা কৃষকের সামনে আলোকের সন্ধান দিয়েছিল। এক সময় তারা দলে দলে বন্দীত্ব বরণ করেছে তবু নীলচাষে স্বীকৃত হয়নি। শেষ অবধি শোষকের বিরুদ্ধে লেলিহান আগুন জ্বালিয়ে দিতে ‘নীলদর্পণ’ বড়ো ভূমিকা রাখে। জাগ্রত কৃষকের আন্দোলনের পরিণতিতে চিরকালের মতো বঙ্গভূমি হতে নীলচাষ বিদায় নিল। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন সরকার আইন করে নীলচাষে বাধ্য করাকে নিষিদ্ধ করে। কাজেই ‘নীলদর্পণ’ নিঃসন্দেহে বাস্তব ও গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক পটভূমিতে রচিত।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।