ভূমিকা: সুদূর প্রাচীনকালেও সংস্কৃত, লাতিন, ইতালীয়, ফরাসি ইত্যাদি ভাষায় টেল বা আখ্যান রচিত হয়েছে। মানুষের গল্প শোনার আগ্রহ তো চিরন্তন। কিন্তু প্রাচীন আখ্যান ও আধুনিক কালের ছোটগল্প স্বরূপধর্মের দিক থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। উপন্যাসের বিকাশ একটা নির্দিষ্ট পরিণতির স্তরে পৌছার পরেই ছোটগল্পের উদ্ভব হয় এবং এডগ্যার অ্যালান পো, মৌপসা, চেখভ ও হেনরি প্রমুখ শিল্পীদের চর্চায় এটি আঙ্গিকগত উৎকর্ষ লাভ করে।

বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব: যন্ত্রযুগ প্রবর্তনের ফলে মানুষের মনে যে আঘাত সংঘাত ও বেদনার দোল লাগল তা প্রকাশিত হলো ছোটগল্পে। ধনতান্ত্রিক যুগে ফরাসি দেশের মানস বিপ্লবের ফলে বুর্জোয়া শ্রেণির জীবনের খণ্ড খণ্ড অংশ নিয়ে ছোটগল্প রচিত হতো। নতুন মধ্য শ্রেণির বিলাশ ও বিকাশের অবধারিত দ্বন্দ্ব শিল্পমাধ্যম রূপে ছোটগল্পের উৎপত্তি ও বিকাশে সহায়ক হয়েছে। বাংলা ছোটগল্প সৃষ্টির উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয় উনিশ শতকের শেষের দিকে। প্রায় ইউরোপের সমকালেই বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের আবির্ভাব ঘটেছে।

বাংলা ছোটগল্পের বিকাশে রবীন্দ্রনাথ: রবীন্দ্রনাথের পূর্বে ছোটগল্পের সূত্রপাত হলেও তাতে উৎকর্ষের
নিদর্শন ছিল না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৬১-১৯৪১) ই বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক ছোটগল্পকার। তিনি বাংলা ছোটগল্পের শুধু জনকই নন, প্রাণ প্রতিষ্ঠাতাও। তার প্রথম গল্প ভিখারিনী ১৮৭৪ সালে প্রকাশিত হয়। এরপর ১৮৮৪-৮৫ তে ঘাটের কথা, রাজপথের গল্পগুলো প্রকাশিত হলেও ১৮৯০ সালে হিতবাদী পত্রিকায় প্রকাশিত দেনা পাওনা গল্পটিই রবীন্দ্রনাথের তথা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোট গল্প।

গল্পগুচ্ছ: গল্পগুচ্ছে সংকলিত রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের সংখ্যা আশিটি। অবশ্য ‘সে’ ‘তিন সঙ্গী’ ‘মুকুট’ ও আদি রচনা ‘ভিখারিণী’ এতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সখ্যত্যক জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে গল্প রচনা শুরু করলেও তার স্বীয় বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল যে সকল ছোটগল্প ১৮৯১ সালে সেগুলোর সূত্রপাত হয়। তিনি জমিদারি তদারকি উপলক্ষ্যে কুষ্টিয়া, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁর বিভিন্ন অঞ্চল ও নদীতে ঘুরতে গিয়ে এদেশের প্রকৃতি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত হন। এ পরিচয় ও অভিজ্ঞতার চিহ্ন আছে অধিকাংশ ছোটগল্পে।

বিষয়বস্তুর দিকে লক্ষ্য করলে রবীন্দনা গল্পে প্রেম, সামাজিক জীবনের সম্পর্ক, প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের সম্পর্ক ও অতি প্রাকৃতের স্পর্শ- এ কয়েকটি শ্রেণিবিভাগ পরিলক্ষিত হয়। তার বিপুল সৃষ্টিকে আমরা নিম্নোক্তভাবে সাজাতে পারি।

প্রথমত, প্রেমের গল্প- একরাত্রি, সমাপ্তি, শাস্তি, নষ্টনীড়, স্ত্রীরূপ ইত্যাদি।

দ্বিতীয়ত, সামাজিক জীবনের সম্পর্ক- মেঘ ও রৌদ্র, দেনাপাওনা, হৈমন্তী, ছুটি, পোষ্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা, ইত্যাদি।
তৃতীয়ত, প্রকৃতির সঙ্গে মানবমনের সম্পর্ক- অতিথি, শুভা প্রভৃতি গল্পে।
চতুর্থত, অতিপ্রাকৃতের স্পর্শ-ক্ষুধিত পাষাণ, জীবিত ও মৃত, কঙ্কাল প্রভৃতি গল্পে।

প্রতিটি গল্পের মেজাজ অবিমিশ্র নয়, তাদের মধ্যে বিবিধ বৈচিত্র্য আছে। তবে রবীন্দ্রগল্পের প্রধান উপাদান হচ্ছে গ্রাম্য জীবন ও প্রকৃতি। ‘তিন সঙ্গী’ নামক সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলোতে হাল আমলের নাগরিক জীবন অঙ্কিত হয়েছে। তাঁর ছোট গল্পগুলো কাব্যধর্মী, পরিমিত, পরিপাট্য, অবলীলাকৃত শোভা গল্পগুলোর প্রাণধর্ম। শিল্পীর সংযম ও আবেগ এখানে পাশাপাশি বিদ্যমান। ভাষাবিদ আবদুল হাই মন্তব্য করেছেন, “রবীন্দ্রনাথ যদি আর কিছু নাও লিখিতেন তবু এক গল্পগুচ্ছই বাংলা সাহিত্যের আসরে তাহাকে অমর করিয়া রাখিত।”

রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে শক্তিশালী গল্প লেখকদের জোরালো একটি সমাবেশ ঘটেছিল। তাদের মধ্যে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছাড়াও আরো প্রমুখ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়: প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (১৮৭৩-১৯৩২) রবীন্দ্রযুগে ছোটগল্প রচনায় সার্থকতা লাভ করেছেন। কৌতুকপূর্ণ বিচিত্র ঘটনার মনোকাহিনি রচনায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। হালকা কথার সরসে তিনি প্লটের কাহিনি শোনাতেন। সে কাহিনি শুনে বিদগ্ধ পাঠক থেকে সাধারণ শ্রোতা পর্যন্ত সকলেই মুগ্ধ হতেন” ১৯০০ থেকে ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ত্রিশ বছরাধিক কাল ধরে শতাধিক ছোটগল্প তিনি রচনা করেছেন। নবকথা, ‘ষোড়শী’, ‘গল্পাঞ্জলি’, ‘গল্পবীথি’, ‘পত্রপুষ্প’ গহনার বাক্স, হতাশ প্রেমিক, বিলাসিনী, নতুন বই এসব গল্পগ্রন্থের মাধ্যমেই গল্পকার হিসেবে তার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।

প্রমথ চৌধুরী: প্রমথ চৌধুরী বাংলা ছোটগল্পের জগতে একটি অনন্য নাম। তিনি কিছুটা দক্ষতা দেখিয়েছিলেন গল্প রচনার ক্ষেত্রে। তিনি ফরাসি সাহিত্যের রসজ্ঞ হিসেবে ছিলেন স্বতন্ত্র রুচি ও মেজাজের অধিকারী। চার ইয়ারী কথা, আহুতি ইত্যাদি তার গল্পগ্রন্থ।

কাজী নজরুল ইসলাম: কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) মূলত কবি ছিলেন। তবে কথাসাহিত্যিক হিসেবেও যথেষ্ট নিজস্বতা দেখিয়েছেন। ‘ব্যথার দান’, ‘রিক্তের বেদন’ ও শিউলীমালা গ্রন্থে তার গল্পগুলো সংগৃহীত।

বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়: বাংলা ছোটগল্পের সার্থক রূপকার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় (১৮৯৯-১৯৭৯)। বৈতরণী তীরে, বনফুলের গল্প বাহুল্য, বিন্দুবিসর্গ, অদৃশ্যলোকে ইত্যাদি তার গল্পগ্রন্থ।

শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তিনি কিছু ছোটগল্প লিখেছেন, যেগুলোতে দরদি মনের পরিচয় পাওয়া যায়। মহেশ, অভাগীর স্বর্গ, পরেশ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য ছোটগল্প।

অন্যান্য ছোটগল্পকার: আধুনিক গল্প লেখকদের মধ্যে প্রবোধকুমার সান্যাল, বুদ্ধদেব বসু, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, যে ছোটগল্পের যাত্রা রবীন্দ্রনাথের হাতে শুরু হয়েছিল, তা রবীন্দ্রযুগ উত্তর রবীন্দ্রযুগ ও লেখকদের হাতে বিকশিত ও বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ হয়েছে। এ ছোটগল্পের ফলে বাংলা সাহিত্য পৃথিবীর যেকোনো দেশের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যের সঙ্গে সমকক্ষতার দাবি করতে পারে।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।