ভূমিকা: বিজ্ঞামনস্কতা, আধুনিকতা ও বাস্তবচেতনার সুসমন্বয়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের [১৯০৮-৫৬] শিল্পবোধ যেমন সমৃদ্ধ ও পরিপুষ্ট তেমনি স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত। উপরন্ত জীবনদৃষ্টির সমগ্রতা, সুগভীর সমাজবোধ, সততা ও নিরাসক্তি চেতনা ও তাঁর শিল্পী সত্তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সমাজ ও সভ্যতার প্রতি দায়বদ্ধতা এবং জীবনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই মানিকের স্রষ্টাচৈতন্যকে রেখেছে আমৃত্যু গতিশীল, সজীব ও প্রাণবজ্ঞবং সর্বপ্রকার পরিবাগভীর অলৌকিকতা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্নতা পরিহারে তিনি যেমন ছিলেন সচেতন, তেমনি দ্বিধাহীন ও সংশয়মুক্ত। অন্তর্লোক সঞ্চারী পরমসূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি, জীবন রহস্য উন্মোচনে বৈজ্ঞানিক সুলভ সংযম ও সহনশীলতা তাঁর সৃষ্টিকর্মকে করেছে গভীর ভাব ব্যঞ্জনাময় ও বৈচিত্র্যদীপ্ত। স্বপ্নবিলাসী ছিলেন না তিনি; বরং সব ধরনের শোষণ-বঞ্চনা ও পীড়নের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই শুভ ও কল্যাণ প্রত্যাশী। সে কারণে সহজতার প্রলোভনমুক্ত সত্যসুন্দর জীবনাচার, প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যেও তাঁকে রেখেছে আপসহীন- আদর্শনিষ্ঠ।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক জীবনের বিশেষকরে গল্প রচনারকালকে স্পষ্ট দুটি পর্বে বিভক্ত করা যায়। প্রথম ১৯২৯ সাল থেকে ১৯৪৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। দ্বিতীয় ১৯৪৪ সাল থেকে পরবর্তী সাহিত্য সাধনা পর্যন্ত।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম পর্বের গল্পে ধনী দরিদ্র্যের বৈষম্য, জমিদার, মহাজন, পুঁজিপতিদের শোষণের চিত্র, দরিদ্র মানুষের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। এ পর্যায়ে ফ্লয়েডীয় লিবিডোতত্ত্বের প্রভাবের ফলে মানব মনস্তত্ত্বের বিচিত্র জটিলতা বিশ্লেষণ এবং এর রহস্য উন্মোচন করেছেন। মানুষের অন্তর্মানসে সক্রিয় লিবিডোর সর্বগ্রাসী প্রভাব, সর্বযৌনবাদে আস্থা, চেতন-অবচেতনের অস্তিত্ব, ইডিপাস ও ইলেকট্রো কমপ্লেক্স, আত্মক্ষয়ী প্রবৃত্তি প্রভৃতি তাঁর সাহিত্যে উদঘাটিত হয়েছে। আন্তর্জাগতিক কিংবা বাহ্যিক নানা ঘটনা ও সংকটের চাপে মানুষ যে মনোব্যাধিতে আক্রান্ত হতে পারে ভাও এ পর্বে উন্মোচিত হয়েছে।
মার্কসবাদে দীক্ষিত হওয়ার পরে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যে ব্যক্তি মানসের স্বরূপ সন্ধানের পরিবর্তে সামষ্টিক চেতনাকে বা সামষ্টিক মনস্তত্ত্বকে ব্যক্ত করার প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়। এ পর্যায়ের গল্পে মানিক ব্যক্তি সংকটকে যৌথ সংকটের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করে তা যৌথভাবে সমাধানের প্রয়াসকে শিল্পরূপ দিয়েছেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য রচনায় ফ্রয়েডীয় চেতনা থেকে মাকর্সবাদে উত্তরণ আসলে কোন উল্লম্ফন নয়। এটি একজন শিল্পীর স্বাভাবিক যথার্থ উত্তরণ। ফ্রয়েড কিংবা মার্কসবাদ দিয়ে মানিকের রচনাকে তাঁর শিল্পী সত্তাকে বিভক্ত করা যায় না। দুই পর্যায়ের রচনার মধ্যেই শিল্পী মানিকের পরিণতি অপরিণতি আছে।
মানিকের দুই পর্যায়ের রচনার মধ্যেই ধনী দরিদ্রের বৈষম্য, ধনীর শোষণ-নিপীড়ন, দরিদ্রের দুর্দশা লাঞ্ছনা মধ্যবিত্তের (অর্থনৈতিক) সংকট, মানবমনস্তত্ত্ব প্রভৃতি বিষয় এসেছে।
অতসীমামী: মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রথম গল্প ‘অতসীমামীতেই মানুষের দৈনন্দিন জৈবিক জীবনের বাইরে গিয়ে সৃষ্টিশীল জীবনাকাঙ্ক্ষা/প্রেরণাকে বড় করে দেখিয়েছেন। সমগ্র গল্পটির প্রেরণার মধ্যে মানবমনস্তত্ত্বের দিকটি ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু সৃষ্টিশীল জীবনাকাঙ্ক্ষা বিকাশের পথে অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টিকে নিয়ে এসেছেন এ গল্পে। গল্পটিতে দারিদ্র্যের রূপ বিষয়টিকে নিয়ে চিত্রায়িত হয়েছে। যেমন-
“যতীনমামা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, দিলে না টাকা অতসী, বললে পরশু যেতে।… দোকানদার ভাই বা কী পাজি, একপো সুজি চাইলাম দিল না। মামার বাড়ি এসে ভাগ্নেকে দেখছি খালি পেটে ফিরতে হবে। মামি স্নানমুখে বললে, সুজি দেয়নি ভালোই করেছে শুধু জল দিয়ে তো আর সুজি হয় না।”
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় সংকট দরিদ্রতাকে শিল্পী জীবনের শুরু থেকেই সাহিত্যে আনতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রথম দিকের গল্পে জাতীয় জীবনের দারিদ্র্য, দৈন্যতার কারণে
জীবনবিকাশের সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেছেন।
আত্মহত্যার অধিকার: এটি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি শ্রেষ্ঠ শিল্পসফল গল্প। লেখকের জীবনাদর্শন, শিল্পসত্তার পরিপূর্ণ বিকাশরূপ পেয়েছে এ গল্পটিতে। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র দরিদ্র নালমনির আত্মগ্লানিদগ্ধ ও অভি ত্বসংকটগ্রস্ত মনোজগৎ উন্মোচনে লেখক অসামান্য দক্ষতা ও নৈপুণ্যের স্বাক্ষর রেখেছেন। নীলমনির দারিদ্র্যের জন্য যে কষ্ট পাপানুভূতিতা আসলে তার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতারই পরিচায়ক। আমাদের সমাজে সংসারের আর্থিক উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হিসেবে পুরুষকেই বুঝানো হয়। পুরুষের দায়িত্ব সংসার সচ্ছলভাবে চালানো। এখানে নারীর কোনো ভূমিকা নেই। তাই নিজের সংসারের দারিদ্র্যের কারণে নিজেকে অক্ষম মনে করে নীলমনি। তাই মেয়ে শ্যামার অঙ্গহীন দৃষ্টিকে নীরব ধিক্কার বা ভর্ৎসনা বলে মনে হয়, বৃষ্টির মধ্যে ছেলের নিশ্চিন্ত ঘুম সে বিরক্ত হয়। তার মনে হয় ছেলেটা তাকে ব্যাঙ্গ করছে। স্ত্রী নির্ভার দৃষ্টির নির্মমতার মধ্যে সে সীমাহীন অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য ও তিরস্কারকে আবিষ্কার করে। নীলমনির মনে হয় বেঁচে থাকাটাই একটা পাপ, অন্যায় এবং অর্থহীন। “বাঁচিয়া থাকাট শুধু আজ এবং কাল নয় মুহূর্তে নিষ্প্রয়োজন।”
এর ফলে সে সকলের সাথে আক্রমণাত্মক আচরণ করে। নীলমনির মৃতবোধ আসলে তার পরাজিত জীবনবোধরেই উপলব্ধি। গল্পে মানিক ধনী দরিদ্রের বৈষম্যের চিত্রও এঁকেছেন। নীলমনির পরিবারের প্রতি সরকার বাড়ির মানুষদের আচরণ খুবই অমানবিক। রাত দুপুরে বৃষ্টিতে ভিজে সরকার বাড়ি আশ্রয় নিতে গেল তাদের ডাকাত বলে আখ্যা দেওয়া, মাটিতে শুতে দেওয়া এবং গায়ে দেওয়ার জন্য কম্বল চাইলে মেঝের কোনায় রাখা চট দেখিয়ে দেওয়া ধনী দরিদ্রের মধ্যকার দূরত্ব ও বৈষ্যমকেই চিহ্নিত করেছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বড়ো মাপের শিল্পী বলে নীলমনির হতাশা অতিক্রম করে পরিশেষে জীবনযুদ্ধে জয়ের নেশা, সংকট মোকাবিলার মানসিকতাই প্রবল হয়ে উঠেছে। অস্তিত্বের সংকট অতিক্রম করে মানুষের বেঁচে থাকার প্রবল আকাঙ্ক্ষাই শিল্পরূপ পেয়েছে:
“আলোটা নিবিয়া যাওয়ার আগে নীলমনি বাকি তামাকটুকু সাজিয়া লইল। তারপর ঠেসদিয়া আরাম করিয়া পিসো শাসটানার মতো শাঁশা করিয়া জলহীন হুঁকায় তামাক টানিতে লাগিল।” (আত্মহত্যার অধিকার)
ফাঁসি, সরীসৃপ, সমুদ্রের স্বাদ, প্রভৃতি গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যবিত্তের নানাবিধ সঙ্কটকে তুলে ধরেছেন। ‘ফাঁসি’ গল্পে একজন গৃহবধূর স্বামীর মৃত্যুদণ্ডাজ্ঞা এবং তা থেকে মুক্তির ঘটনা তার মনে কি ধরনের সামাজিক চাপ সৃষ্টি এবং মানসিক যন্ত্রণার কারণ হতে পারে তার স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে।
মধ্যবিত্ত একজন মানুষের কাছে সামাজিকতা খুব বড়ো একটা ব্যাপার। তাই এ গল্পের প্রধান চরিত্র গণপতির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ তার প্রতি রমার মনকে বিরূপ করে তুলেনি কিন্তু রমার কাছে অসহনীয় হয়েছে সমাজের নিন্দা ও কলঙ্কের বিষয় তাই সে তার স্বামীকে প্রস্তাব দেয় পরিচিত এলাকা ছাড়িয়া অপরিচিত লোকালয়ে গিয়ে বসবাস করবার জন্য। “রমা স্থিরদৃষ্টিতে চাহিয়া থাকিয়া বলিল, বুঝতে পারছ না? সবাই আমাদের ঘেন্না করবে, আমরা এখানে থাকব কী করে? “স্বামী তার প্রস্তাবে রাজী না হলে সে গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করে।
‘সরীসৃপ’ গল্পে মধ্যবিত্তের আপাত চকচকে জীবনের আড়ালে যে ক্লেদাক্ততা, পশুপ্রবৃত্তি থাকে তাই উন্মোচন করতে চেষ্টা করেছেন। মানুষের মানবিক সত্তার বিলুপ্তি ও পশুসত্তার মধ্যে যে প্রতিশোধ পরায়ণতার ভয়ংকর রূপ থাকে তারই চিত্র এঁকে মানিক বনমালী, চারু এবং পরী চরিত্রের মধ্যে দিয়ে।
‘সমুদ্রের স্বাদ’ গল্পে মধ্যবিত্তের আর্থিক সংকটের কারণে তার নানা রকম আকাঙ্ক্ষার অবদমন এবং তা থেকে সৃষ্ট মনোবিকলতার বিষয়টিই স্থান পেয়েছে। নীলার সমুদ্র দেখার বহুদিনের শখ পূরণ হয় না আর্থিক সংকটের কারণে তার মধ্যে দেখা দেয় মনোবৈকল্য।
মানিক তাঁর প্রথম পর্যায়ের গল্পে দরিদ্র মানুষের অসহায়তা, নিরুপায় অবস্থা, ধনীর শাসন-শোষণ মানসিকতা মধ্যবিত্তের জীবনের অসঙ্গতি ও অন্তঃসারশূন্যতাকে উপলব্ধি করেছেন। তাদের উপরিতলের ভদ্রতার মুখোশ উন্মোচন করে অভ্যন্তর দগ্ধতা, ক্লেদ জর্জরতাকে প্রকাশের মাধ্যমে মধ্যবিত্তের জীবনের অন্তর্গত রোগ মুক্তি এবং তাদের সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। এ পর্যায়ের গল্পে সামাজিক, রাজনৈতিক ফ্যাক্টরগুলো ততটা গুরুত্ব পায়নি। নিবিত্তের মানুষদেরও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে কিংবা উচ্চবিত্তের শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে কোনো ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী প্রয়াসকে চিত্রিত করেননি।
দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মধ্যবিত্তের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং শ্রেষ্ঠত্বের মানসিকতা বিসর্জন দিয়ে শ্রমিক মানসিকতা ধারণ করার মাধ্যমে মধ্যবিত্তের সংকট উত্তরণের সম্ভাবনাকে শিল্পীতরূপে ব্যক্ত করেছেন। ২য় পর্বের গল্পে সমকালীন সমাজবাস্তবতাকে, সংকটকে যেমন তিনি গল্পে এনেছেন তেমনি এসব সংকট থেকে উত্তরণের সামষ্টিক সংগ্রাম ও রাজনৈতিক চেতনাকেও লিপিবদ্ধ করেছেন।
‘হারানের নাত জামাই’ ১৯৪৪ পরবর্তীকালে লিখিত বিখ্যাত গল্প। ১৯৪০-৫০ এর দশকে ভারতীয় রাজনীতিতে যে সংগ্রামী চেতনা, আন্দোলন সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠেছিল তারই প্রকাশ ঘটেছে ‘হারানের নাতজামাই’ ও ‘ছোটবকুলপুরের যাত্রী’ গল্পে।
কুসংস্কারমুক্ত সামষ্টিক আন্দোলন সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি হারানের নাতজামাই গল্প। কৃষক আন্দোলনের বিষয়টি এ গল্পের বিষয়াবস্তু। জমিদার মহাজনদের বিরুদ্ধে কৃষকের আন্দোলনকে সামষ্টিক চেতনার শিল্পরূপ দিয়েছেন মানিক এ গল্পে। ভুবনমণ্ডল যিনি জোতদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে গ্রামের কৃষকদের সংঘবন্ধক বার শিরকে পুদিয়েছেন মানিক এ গ্রামের সমস্ত মানুষ তাকে রক্ষা করে। ময়নার মা, ময়নার স্বামী বলে তাকে পরিচয় দেয় পুলিশের সামনে। গল্পের শেষে দেখা যায় শুধু ভুবনমণ্ডল নয় গ্রামের প্রত্যেককে বাঁচানোর চেষ্টায় তারা সংঘবদ্ধ। পুলিশ হারানের বাড়িতে এলে গ্রামের মানুষ সবাই এসে জড়ো হয় তাকে উদ্ধার করতে জমিদার পুলিশের অন্যায় অত্যাচার রোধ করতে।
“মণ্ডলের জন্য হলে মানে বোঝা যেত, হারানের বাড়ির লোকের জন্য চারিদিকে গাঁ ভেঙে মানুষ এসেছে। মানুষের সমুদ্রের ঝড়ের উত্তাল সমুদ্রের সঙ্গে লড়া যায় না।” (হারানের নাতজামাই)
ছোটবকুলপুরের যাত্রী এ গল্পে কৃষক বিদ্রোহ ও শ্রমিক বিদ্রোহকে এনেছেন গল্পকার। সারা গল্পে সংগ্রামের প্রত্যক্ষ
চিহ্ন নেই কিন্তু পরোক্ষভাবে শ্রমিকদের প্রতিবাদ সংগ্রামের বিষয়টিই প্রধান হয়েছে। কৃষক শ্রমিকেরা যদি সংঘবদ্ধ থাকে তাহলে তাদের কিছুই করতে পারে না জমিদার পুঁজিপতিরা।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেঁড়া গল্পের বিষয় ১৯৪৬ জুলাইয়ের সংঘটিত সর্বভারতীয় ডাক ও তার ধর্মঘট। এই ধর্মযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে বোম্বেতে শ্রমিক ধর্মঘট, মাদ্রাজে শ্রমিক ও ছাত্র ধর্মঘট এবং বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। বীরেণ চরিত্রের সততা ও সরলতার পরিচয় মেলে। পারিবারিক দারিদ্র্য, সাংসারিক বিচ্ছিন্নতা সবকিছু উপেক্ষা করে সে দ্বিধাহীন চিত্তে ধর্মঘটযুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করে। তার অনুপস্থিতির সুযোগে ধর্মঘট ব্যাহত হতে পারে এই চিন্তাই তার অস্বস্তি ও অনিদ্রার কারণ হয়। “বীরেণ বলে কি জান, লড়াই চলছে তো একটা একজন কম হলে জোর তো একটু কমল? মিটিং হবে আমি নেই, পিকেটিং হবে আমি নেই… বীরেণ ছটফট করে জ্বরের রোগীর মতো।” (ছেঁড়া)
একটি সংগঠিত সংগ্রামী প্রয়াস সমাজের বিভিন্ন স্তরে যে রূপান্তরিত মূলক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তার অন্তর্গত স্বরূপকে মানিক সর্বদা তাঁর অনুসন্ধিৎসু শিল্পীসত্তা দিয়ে অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছেন।
‘একান্নবর্তী’ চালক গল্পে মধ্যবিত্তের যে পেশা সংকট, অর্থনৈতিক সংকট মধ্যবিত্ত মানসিকতার দ্বন্দ্ব, টানাপোড়েন কিন্তু গল্পের শেষে তিনি এসব সংকট উত্তরণের প্রচেষ্টা প্রয়াসকেও শিল্পরূপ দিয়েছেন। একান্নবর্তী গল্পে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের আত্মজৈবনিক উপাদানের প্রকাশ পরিলক্ষিত হয়। হীরেনের মধ্যে তারই মধ্যবিত্ত জীবনের অর্থনৈতিক সংকটের চিত্র ফুটে উঠেছে। কিন্তু এ মধ্যবিত্তের এ সংকট উৎক্রমণের পথও তিনি বাতলে দিয়েছেন। হীরেনের পরামর্শে তাদের মতো দরিদ্র কেরানিরা একত্রে সাংসারিক খরচ একত্রে করে, একত্রে রান্না করে এতে কয়লা বাঁচে, সময় বাঁচে। তারা এখন একান্নবর্তী। যে লক্ষ্মী একদা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরতে গিয়েছিল গল্পের শেষে তারই উপলব্ধি- “আজ বাঘিনীর মতো বাঁচতে শুধু সে রাজি নয়, বাঁচবেই এই তার দি।”
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার প্রথম পর্যায়ের গল্পে নানা সংকটকে সামষ্টিকভাবে না দেখে সেসব সংকট ব্যক্তি মানুষের মনে যে বিচিত্র ভাবনার সৃষ্টি করে তারই ছবি এঁকেছেন প্রধানভাবে। পরবর্তীকালে ব্যক্তি সংকটকে আলাদাভাবে না দেখে সামষ্টিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন। সামজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের সাথে ব্যক্তির সংকটের সম্পর্ক আবিষ্কার করেছেন এবং এসব সংকট মোকাবিলায় সামষ্টিক প্রতিরোধ, প্রতিবাদ প্রচেষ্টাকে শিল্পরূপ দিয়েছেন। এটা শিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্রমবিকাশ।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment