ভূমিকা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭ মে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫এ বৈশাখ) কলকাঅর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাতা সারদা দেবী। বিশ্বকবি অভিধায় সম্ভাষিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্প রচয়িতা এবং বাংলা ছোটগল্পের শ্রেষ্ঠ শিল্পী। তাঁর লেখনীতেই বাংলা ছোটগল্পের উদ্ভব, বিকাশ ও সমৃদ্ধি ঘটেছে। তাঁর ছোটগল্প বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলোর সমতুল্য। ১২৮৪ বঙ্গাব্দে মাত্র ষোলো বছর বয়সে “ভিখারিণী” গল্প রচনার মাধ্যমে ছোটগল্প লেখক হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটে। এর পর থেকে জীবনের প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত দীর্ঘ চৌষট্টি বছরে তিনি অখণ্ড ‘গল্পগুচ্ছে’ সংকলিত ৯৫টি ছোটগল্প রচনা করেছেন। এর বাইরেও ‘সে’, ‘গল্পসল্প’ এবং ‘লিপিকা’ গ্রন্থে রয়েছে তাঁর আরো গল্প সংকলিত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত সর্বশেষ গল্পটির নাম “মুসলমানীর গল্প”। পারিবারিক জমিদারি তদারকির সূত্রে কুষ্টিয়ার শিলাইদহে বসবাসের কালই রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্প রচনার স্বর্ণযুগ।

আয়তনের ক্ষুদ্রতাই ছোটগল্পের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। গীতিকবিতার মতো ছোটগল্পের সর্বপ্রকার বাহুল্যবর্জিত সংহতরূপে একটি নির্দিষ্ট সুনির্বাচিত সীমায় জীবনের সুখ, দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সমস্যা যন্ত্রণার একটিমাত্র দিক, জীবনের খণ্ডাংশ বিদ্যুতের মতোই মুহূর্তে জীবন্ত দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে, বিন্দুতে সিন্দুর স্বাদের মতোই জীবনের একাংশের চকিত স্ফুরণেই মানবজীবনের অপরিমেয়তা আভাসিত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সোনারতরী কাব্যের’ ‘বর্ষাযাপন’ নামক কবিতায় ছোটগল্প সম্পর্কে যে মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন তাতে ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। যেমন-

ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা, ছোট ছোট দুঃখ কথা

নিতান্তই সহজ সরল,

সহস্র বিস্মৃতি রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি

তারি দু-চারটি অশ্রুজল।

নাহি বর্ণনায় ছটা ঘটনার ঘনঘটা

নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ

অন্তরে অতৃপ্তি রবে সঙ্গে করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ।

রবীন্দ্রনাথের গল্পের পট: আমাদের বৈচিত্র্যহীন ঘটনার সংঘাত বর্জিত, শান্ত, নিস্তরঙ্গ জীবন ছোটগল্প রচনার বিশেষ উপযোগী, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের আগে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্প রচনার কোনো সার্থক প্রয়াস আমরা পাইনি। রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের শিল্পকলার সূত্রপাত করেন এবং তিনিই তাঁর অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ শিল্পী। ১৮৯০ সালে ‘হিতবাদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘দেনাপাওনা’ গল্পটিই রবীন্দ্রনাথের তথা বাংলা সাহিত্যের সার্থক ছোটগল্প।

জমিদারি তত্ত্বাবধানের সূত্রে বাংলাদেশের পল্লি জীবনের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে রবীন্দ্রনাথ মানবজীবনের সুখদুঃখের বিচিত্র ও বহুমুখী ধারার যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন, কবির শ্রেষ্ঠ ছোটগল্পগুলো তারই ফসল। পল্লিজীবনের যে অভিজ্ঞতা তাঁর ছোটগল্প সৃষ্টিপ্রেরণাকে উদ্বেলিত ও তার মূলে প্রাণরস সিঞ্চিত করেছে, সে সম্বন্ধে তিনি নিজেই বলেছেন- “বাঙলা দেশের নদীতে নদীতে গ্রামে গ্রামে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছি: এর নতুনত্ব চলন্ত বৈচিত্র্যের নতুনত্ব। শুধু তাই নয়, পরিচয় অপরিচয়ে মেলামেশা করছিল মনের মধ্যে।… ক্ষণে ক্ষণে যতটুকু গোচরে এসেছিল তার চেয়ে অনেকখানি প্রবেশ করছিল মনের অন্দর মহলে আপন বিচিত্র রূপ নিয়ে। সেই নিরন্তর জানাশোনার অভ্যর্থনা পাচ্ছিলুম অন্তঃকরণে, যে উদ্‌দ্বোধন এসেছিল তা স্পষ্ট বুঝা যাবে ছোটগল্পের নিরন্তর ধারায়।”

তাঁর ছোটগল্পগুলো সংখ্যায় এবং বৈচিত্র্যে এত বেশি যে এদের শ্রেণিবিন্যাসে নানা মতভেদ তৈরি হয়েছে। নিচে তাঁর প্রধান গল্পগুলোকে একটা যুক্তিসম্মত প্রণালিতে শ্রেণিবন্ধ করা হয়েছে।

রবীন্দ্রগল্পের শ্রেণিবিভাগ

ক. সমস্যা সমস্যামূলক গল্প: দেনা-পাওনা, রামকানাই-এর নির্বুদ্ধিতা, অনধিকার প্রবেশ, সমস্যাপূরণ, মানভঞ্জন, ত্যাগ, বিচারক, নষ্টনীড়, স্ত্রীর পত্র, হৈমন্তী, ভাইফোঁটা, নামঞ্জুর গল্প, পাত্র ও পাত্রী, পয়লা নম্বর ইত্যাদি।

খ. পারিবারিক সম্পর্কমূলক গল্প: কাবুলিওয়ালা, ঠাকুরদা, শান্তি, দর্পহরণ, ব্যবধান, মধ্যবর্তিনী, দান-প্রতিদান, ব্যবধান, খাতা, রাসমণির ছেলে, দিদি, হালদার গোষ্ঠী ইত্যাদি।

গ. জীবন ও প্রকৃতি-সম্পর্কিত গল্প: অতিথি, একরাত্রি, পোস্টমাস্টার, সুভা, সমাপ্তি, ছুটি ইত্যাদি।

ঘ. রোমান্স ও অতিপ্রাকৃত গল্প: দুরাশা, মণিহারা, ক্ষুধিত পাষাণ, দালিয়া, জয়-পরাজয়, মহামায়া ইত্যাদি।

ঙ. রাজনৈতিক চেতনাযুক্ত: রাজটীকা, দুর্বুদ্ধি, মেঘ ও রৌদ্র ইত্যাদি।

চ. বিবিধ-জাতীয় গল্প: কঙ্কাল, গুপ্তধন, ডিটেকটিভ, প্রায়শ্চিত্ত, নিশীথে, গিন্নি ইত্যাদি।

সাধারণ সুখ-দুঃখের কাহিনি: রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের অফুরন্ত বিষয়বৈচিত্র্য সহ দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর কিছুসংখ্যক গল্পে সাধারণ সুখদুঃখের ধারায় পল্লির জীবনযাত্রা ও আমাদের দৈনন্দিন জীবনের আবেগস্বচ্ছতা বিচিত্র হয়েছে, ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ব্যবধান’, ‘শান্তি’, ‘দিদি’, ‘রাসমণির ছেলে’, ‘পণরক্ষা’, ‘দান-প্রতিদান’, ‘ছুটি’, ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’ ইত্যাদি এই জাতীয় গল্প। ‘হালদারগোষ্ঠী’, ‘ঠাকুরদা’, ‘সম্পত্তি স ‘স্বর্ণমৃগ’ ইত্যাদি গল্পে আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক প্রচলিত ধারায় ব্যতিক্রম ঘটলে যে বিপর্যয় ও বিচিত্র ঘাতপ্রতিঘাত সৃষ্ট হয়, তারই আলেখ্য পাই। কতকগুলো গল্পে সমাজ সমালোচনা করুণ্য ও শেষের তীক্ষ্ণতায় প্রকাশিত: ‘দেনা-পাওনা, যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ,
হৈমন্তী, স্ত্রীর পত্র, পয়লা নম্বর পাত্র-পাত্রী ইত্যাদি।

প্রেমের গল্প: রবীন্দ্রনাথের প্রেমের গল্পগুলো বাংলাসাহিত্যের অতুলনীয় সম্পদ। প্রেমের নিগূঢ় আবেগ, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঘাতপ্রতিঘাত, তার বিচিত্র ও রহস্যময় বিকাশ, প্রতিহত প্রেমের গভীর বিপদ, প্রেমের মধ্য দিয়ে মানবাত্মার আকুতির ব্যঞ্জনা, প্রেমের সংকীর্ণ, জটিল, স্বার্থপরতার দিক এ সমস্তই তাঁর ‘একরাত্রি, মহামায়া, সমাপ্তি, দৃষ্টিদান, মাল্যদান, মধ্যবর্তিনী, শাস্তি, প্রায়শ্চিত্ত, মানভঞ্জন, দুরাশা, অধ্যাপক, শেষের রাত্রি’ ইত্যাদি গল্পগুলোতে আশ্চর্য কাব্যব্যঞ্জনায় প্রাকৃতিক প্রতিবেশের অর্থগূঢ় চিত্রণে ইঙ্গিতময়তায় রূপায়িত হয়েছে।

ছোটগল্প সাম্প্রতিকতম প্রবণতা: রবীন্দ্রনাথের কোনো কোনো গল্পের ব্যাপ্তি এবং আবেদনের সামগ্রিকতাহেতু অনেকেই এদের ছোটগল্প হওয়া সত্ত্বেও প্রায় উপন্যাসের মর্যাদা দিয়ে থাকেন। এগুলো মূলত প্রেমসম্পর্কিত হলেও আসলে সমাজসমস্যামূলক। এ জাতীয় গল্পের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘নষ্টনীড়’। গল্পটি সম্বন্ধে অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, “সবচেয়ে জ্বলন্ত ‘নষ্টনীড়ে’র অগ্নিবর্ণ জিজ্ঞাসা। বাঙলা সাহিত্যে এমন দুঃসাহসিক গল্প এর আগে কখনো লেখা হয়নি। সম্পর্কের বিধি-নিষেধ ভেঙে নিজের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে যে হৃদয়ঘাতী দুরন্ত প্রেম এসে চারুর জীবনের উপস্থিত হয়েছে- অথচ যার সমাধান কোথাও নেই, তার পরিণদি গ্রিক ট্র্যাজেডির মহৎ-যন্ত্রণায় আমাদের অভিভূত করে।… মহান ট্র্যাজেডি, মহৎ উপন্যাসের এক অঞ্জলি স্বাদ আমরা ‘নষ্টনাড়ে’ লাভ করি। পরম সাহসী বক্তব্য, অসামান্য সমাপ্তি। কোথাও মেলাবার চেষ্টা নেই, সমাধানহীন সমাধানের কোনো নিরর্থক নির্দেশ দেওয়ার প্রয়াসও নেই।… বক্তব্য এবং রীতিতে, বলা অনাবশ্যক, ‘নষ্টনীড়’ বাঙলা সাহিত্যে প্রচলিত সমস্ত কোডের বাইরে; আধুনিক রবীন্দ্রনাথের হাতে গল্পটি আধুনিকতম। একমাত্র এই গল্পটি দিয়েই তিনি গল্পকার-রূপে স্মরণীয় হ’য়ে থাকতে পারতেন।”

‘স্ত্রীর পত্র’ বা ‘পলাতকা’ ইত্যাদি গল্পের মধ্যেও নারীর বিদ্রোহ সচেতন মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়।

রবীন্দ্রনাথের অতিপ্রাকৃত রসাশ্রিত ছোটগল্পগুলোর মধ্যে ‘ক্ষুধিত পাষাণ, নিশীথে, মণিহারা’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কবি এই সকল রচনায় নিপুণ কৌশল ব্যঞ্জনাময়, সুব্ধ ইঙ্গিতে, কল্পনার বিচিত্র বর্ণবিলাসে বাস্তবজীবনের সঙ্গে অতিপ্রাকৃতের বিচিত্র সমন্বয় সাধন করেছেন। ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি সম্বন্ধে অধ্যাপক পরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন- “স্বপ্ন ও মায়া দিয়ে গড়া যে উপলব্ধি আমাদের মনে অতিপ্রাকৃতের বোধকে সঞ্চারিত করে, তার যথাযথ পরিবেশন রবীন্দ্রনাথ অনন্যসাধারণ সার্থকতার পরিচয় দিয়েছেন বলেই ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ গল্পটি বিশ্বসাহিত্যেও মর্যাদার আসনের অধিকারী। এর ভাষার ধ্বনি, ব্যঞ্জনা ও সাঙ্কেতিকতা এক অলৌকিক সুরের মায়াজাল সৃষ্টি ক’রে পাঠকের সাধারণ বোধ-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে দেয়।” রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের রচনা ‘রবিবার’, ‘শেৎকথা’, ‘ল্যাবরেটরি’ প্রভৃতি গল্পে আধুনিক জীবন-সমস্যার উপস্থাপনায় কোথাও বিশ্লেষণ-নৈপুণ্য ও বাগুদির শাণিত দীপ্তি বিস্ময়কর হলেও সেখানে সঞ্জীব প্রাণের কোনো স্পর্শ পাওয়া যায় না।

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য: রবীন্দ্রনাথের রসনিটোল ছোটগল্পগুলো বাংলাসাহিত্যের ঐশ্বর্য। তিনিই বাংলাসাহিত্যে এই শিল্পকলার গৌরবময় ঐতিহ্যের ভিত্তিটা নির্মাণ করে যান, পরবর্তীকালের ছোটগল্প-লেখকেরা তাঁর পদচিহ্নিত পদই অনুসরণ করেছেন। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কবির ছোটগল্প প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমাদের এই ব্যাহত তুচ্ছ ও অকিঞ্চিৎকর জীবনের তলদেশে যে একটি অশ্রুসজল, ভাবমন গোপন প্রবাহ আছে, রবীন্দ্রনাথ আশ্চর্য স্বচ্ছ অনুভূতি ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে সেগুলোকে আবিষ্কার করিয়া পাঠকের বিস্মিত মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে মেলিয়া ধরিয়াছেন ।… আমাদের যে আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলো বহির্জীবনে বাধা পাইয়া, বাহ্যবিকাশের দিকে প্রতিহত হইয়া অন্ত রের মধ্যে মুকুলিত হয় ও সেখানে গোপন মধুচক্র রচনা করে, রবীন্দ্রনাথ নিজ ছোটগল্পগুলোর মধ্যে তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হইবার অবসর দিয়াছে।”

পরিশেষে বলা যায় যে, বাংলা ছোটগল্পের জনক রবীন্দ্রনাথের সুদৃঢ় পদচারণায় ছোটগল্পের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। তারই দেওয়া সংজ্ঞা ও অনুকরণে বাংলা ছোটগল্প নবতর বিবর্তনের পথ পরিক্রমায় প্রবাহিত হলেও বারবার ফিরে তাকাতে হয় রবীন্দ্রনাথের দিকে।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।