“দ্বিতীয় বিশ্বমহাসমর যখন তার প্রচণ্ড যান্ত্রিক অগ্রগতি নিয়ে ভীষণ নর মেঘযজ্ঞে ব্যাপৃত তখন বাংলা সাহিত্যে ‘অযান্ত্রিক’ গল্প নিয়ে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মানুষ আত্মপ্রকাশ করলেন। নাম সুবোধ ঘোষ। (সেদিনের আলোছায়া-সুনির্বাচিত)।
সুবোধ ঘোষের জন্ম ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯০৯। তিনি হাজারিবাগ অঞ্চলের মানুষ। জীবনের অনেকটাই কেটেছে সেখানে। ছোটবেলা থেকে পড়াশুনাই ছিল তার প্রাণ। এঁদের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক ছিলেন বিরাট পণ্ডিত মানুষ। মহেষ ঘোষ। তিনি বেদান্তচর্চা করতেন। তার বাড়িতে ছিল বিরাট লাইব্রেরি। সেখানে অবাধ যাতায়াত ছিল তাঁর। পড়াশুনা এবং তার সঙ্গে পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বড়ানই ছিল তাঁর নেশা। পাহাড়, জঙ্গল, নদী এসব ওঁকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নেশার মত টেনেছে। বাঁধাধরা ছককাটা জীবনের বাইরে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা।
একবার বাড়ি থেকে পালিয়ে দক্ষিণেশ্বরের আদ্যাপিঠের আশ্রমে এলে উঠেছিলেন। অনেক বুঝিয়ে শেষে বাড়ি ফিরিয়ে নেওয়া গেল। আই. এস. সি পড়তে পড়তে পড়াশুনা ছেড়ে দিলেন। জীবনে অনেক কষ্ট করেছেন।
তারপর কলকাতায় চলে এলেন। শ্রী গৌরাঙ্গ প্রেসে প্রুফ রিডারের চাকরি নিয়ে। তখনো নিয়মিত তখনকার ইম্পীরিয়াল লাইব্রেরিতে (বর্তমানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি) যেতেন। পরে চাকরি নিলেন আনন্দবাজারে। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সেখানে ছিলেন।
আনন্দবাজারের কয়েকজন কর্মী লেখক ‘অনামী সঙ্গ’ নামে একটা সমাবেশ গড়ে তুলেছিল। তাতে ছিল স্বর্ণকমল ভট্টাচার্য, অরুণ মিত্র, বিনয় ঘোষ, মন্মথ নাথ সান্যাল প্রমুখ কয়েকজন। তারা প্রতি মাসের দুই রবিবারে লেন এক বন্ধুর বাড়িতে সমবেত হয়ে সাহিত্যের আলোচনা এবং নিজের লেখা পাঠ করত। সেই লেখার ভালমন্দ গুণের বিচার করা হতো। তাঁদেরই ইচ্ছা ও অনুরোধের নির্দেশে সুবোধ ঘোষ গল্প লিখতে বাধ্য হয়েছিলেন। স্বর্ণকমলবাবুর কড়া অনুরোধেই তিনি পরবর্তী দুই বৈঠকে নিজের লেখা দুটি গল্প পড়লেন ‘অযান্ত্রিক’ ও ‘ফসিল’। এর আগে তিনি ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্ব সম্বন্ধে একটি ছোট নিবন্ধ লিখেছেন।
এই দুটি গল্প লিখেই সুবোধ ঘোষ রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন। প্রথম গল্প ‘অযান্ত্রিক’ প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকার বার্ষিক সংখ্যায় এবং ‘ফসিল’ গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল। ‘অগ্রণী’ নামের একটি মাসিক পত্রিকায়। “‘ফসিল’ গল্প প্রকাশিত হবার পর পাঠকের প্রশংসার কলরোল শোনা গেল।”
বিষয়বস্তুর দিক থেকে ‘ফসিল’ কেবল নতুন নয়, সমসাময়িক। “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হওয়ার আগে কয়েকটি দেশীয় রাজ্যে প্রজাবিদ্রোহ দেখা দেয়, যার পিছনে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস এবং বামপন্থী সকলেরই সমর্থন ছিল। ঢেওকানল রাজ্যের প্রজাবিদ্রোহের উপর কবিতা লিখে তরুণ কবি শচী-রউথ-রায় সারা ভারতে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর কবিতার ইংরাজী অনুবাদের নাম ‘Boatman Boy”। ত্রিপুরী কংগ্রেসের সময় গান্ধীজী স্বয়ং রাজকোেট দেশীয় রাজ্যের সমস্যা নিয়ে জড়িয়ে পড়েছিলেন। এইরূপ পরিস্থিতিতে একটি দেশীয় রাজ্যের প্রজাদের উপর কি নিদারুণ অত্যাচার হয়, ‘ফসিল’ তার একটি চিত্র – যা বাংলা সাহিত্যের বিষয় বিন্যাসে নতুন দিগন্ত উম্মোচন করেছিল। ‘অযান্ত্রিক’ গল্পটির মধ্যেও মানুষ এবং যন্ত্রের মধ্যে যে সম্পর্ক সুবোধবাবু এঁকেছিলেন, তার পরিচয় শিল্প কারখানা সম্পর্কহীন বাঙালী পাঠকের কাছে তখনও একেবারে অজানা ছিল।” (সুধী প্রধান—ফসিল থেকে তিলাঞ্জলি –ভরা থাক)।
সুবোধ ঘোষের গল্পের বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব, প্রকাশভঙ্গির বলিষ্ঠতা, শাণিত দৃষ্টিভঙ্গি, চল্লিশের সূচনাতেই সেজন্য বিরাট সাড়া জাগাল। তাঁর প্রথম গল্প অযান্ত্রিকের (১৯৪০) নায়ক একজন ট্যাক্সি ড্রাইভার। সে ভালোবাসে তাঁর বহুদিনের জীর্ণ পুরাতন সেকেলে মোটর গাড়িকে। এই গাড়িই তার জীবনসঙ্গিনী। তার সেই ভালোবাসা যেমন প্রচণ্ড তেমনি তার বিরাগও ক্ষমাহীন। যে গাড়ি সম্পর্কে কারুর বিরূপ মন্তব্য তার অসহ্য ছিল সেই গাড়িকেই একদিন সে ওজন দরে লোহার ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিল। কোমলে কঠিনে এক অদ্ভুত গল্প৷ কিন্তু তার চেয়েও তাঁর দ্বিতীয় গল্প ‘ফসিল’ বাংলা সাহিত্যের এক ল্যাণ্ডমার্ক।
চল্লিশের দশকের পূর্বে সাধারণভাবে প্রেমচর্চাই ছিল প্রধান কিন্তু চল্লিশের দশকে প্রধান হয়ে উঠল রাজনীতি চর্চা। বিশ্ব মহাসমর এবং তার আনুষঙ্গিকের ধাক্কায় দ্রুত সংগঠিত হচ্ছিল সমাজের ভাঙন, ফলে মনোরাজ্যেও দেখা দিল আদর্শ সংঘাত। চিন্তার ঘূর্ণিপাকে অনেক কর্দম উঠেছে। সুবোধ ঘোষের মধ্যে আছে তারই সার্থক রূপায়ণ।
সুবোধ ঘোষের বহু গল্প আলোচনা করে দেখা যায় সমাজ সচেতন সৃষ্টি হিসেবে সেগুলো উল্লেখযোগ্য। তিনি বহু গল্প লিখেছেন। তার গল্প গ্রন্থের সংখ্যা পঁচিশটি। ‘ফসিল’, ‘পরশুরামের কুঠার’, ‘’জতুগৃহ’, ‘পুতুলের চিঠি’, ‘মনভ্রমরা’, ‘ভোরের মালতী’, ‘মণিকর্ণিকা’, ‘অৰ্কিড’, ‘সায়ন্তনী’, ‘নিকষিত হেম’, ‘রূপনগর’, ‘পলাশের নেশা’, ‘গ্রাম যমুনা’, নানা গল্পসংগ্রহ ইত্যাদি। এককথায় বলা যায় সুবোধ ঘোষ বাংলা ছোটগল্পে উল্লেখযোগ্য অবদানের অধিকারী। কিন্তু পরবর্তীকালে তার গল্পের এই তির্যক শানিত জীবনবোধের পরিচয় আর পাওয়া যায় না। তিনি নিজেই বলেন, “আমার সাহিত্যকর্মের সাধ আজ ঈশ্বরবিশ্বাসের নতুন প্রদীপের কাছে এসে নতুন আলোর অভিষেক খুঁজছে। তাই থমকে থাকতে হচ্ছে। যদি সেই অভিষেক পাই, তবেই রূপে গুণে ভাবে ও প্রকারে নতুন বলে বোধ হবে, এমন গল্প ও উপন্যাস লিখতে পারবো, নইলে পারবো না। …… গল্প ও উপন্যাস লেখার সাহিত্যিক কর্ম এক ধরনের রিচুয়াল তথা বিশ্বাসের তর্পণ বলে মনে হয়েছে।’ সেদিনের আলোছায়া—সুনির্বাচিত) স্বভাবতই তখন সুবোধ ঘোষের জীবনবোধে ভারত-চৈতন্য, ভারত প্রেমকথা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। গল্পে উপন্যাসে বহু বিচিত্র সৃষ্টিতে তাঁর লেখনী আর সীমাবদ্ধ নয়। সিগমণ্ড ফ্রয়েড, ভারতের আদিবাসী, অমৃত পথযাত্রী প্রভৃতি গ্রন্থাবলী তাঁর বিচিত্র জ্ঞানপিপাসার ফসল।
জীবনকে তিনি বিচিত্রভাবে উপলব্ধি করেছেন। সাংবাদিক কৌতূহলে আমাদের পরিচিত জীবনের নানা সংবাদ তাঁর গল্পে ভাষ্যরূপ লাভ করেছে। সেখানে আছে নানা প্রতারক, ঠগ, ভণ্ড, উকিল, মুন্সেফ কত মানুষ। সেগুলি অবলম্বন করে গল্প হয়েছে ঠিকই কিন্তু ফসিলের সুবোধ ঘোষকে আর পরে পাওয়া যায় না।
Leave a comment