অথবা, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের ক্রমপর্যায় আলোচনা কর

উত্তর : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের [১৮৬১-১৯৪১] রচনার আশ্রয়েই বাংলা ছোটোগল্প প্রথম পূর্ণাঙ্গতা পেয়েছে; পেয়েছে শিল্পীর জীবনদৃষ্টি এক অনাবিষ্কৃত পূর্ব জগতে প্রথম প্রবেশাধিকার। রবীন্দ্রনাথের হাতেই সর্বপ্রথম বাংলা ছোটোগল্পের সার্থক প্রাণপ্রতিষ্ঠা ঘটে। তিনিই ছোটোগল্পের সার্থক সৃষ্টিকার। শুধু শিল্প সৃষ্টি হিসেবেই নয় বাঙালিগঞ্জের জীবনের আশা- আকাঙ্ক্ষার, আনন্দবেদনার, দুঃখদুর্দশার প্রতিচ্ছবি হিসেবে। গল্পগুচ্ছ বাঙালির এক উজ্জ্বল সাহিত্য সম্পদ। আমাদের এ ব্যাহত তুচ্ছ ও আপাত অকিঞ্চিৎকর জীবনের তলদেশে যে একটি অশ্রুজল ভাবঘন গোপন প্রবাহ আছে, রবীন্দ্রনাথই প্রথম আশ্চর্য স্বচ্ছ অনুভূতি ও তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে গল্পগুচ্ছ সেসব ধারণ করে বাঙালি পাঠকের দৃষ্টির সম্মুখে মেলে ধরেছেন।

যে কোনো শিল্পরীতির জন্মসূত্র জীবনের গভীর সত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত জীবনের যন্ত্রণা, ঘাতপ্রতিঘাত, গতি, সংঘর্ষ, উত্থানপতন ইত্যাদির সঙ্গে সমন্বিত হয়েই জন্ম হয় বিশেষ কালের শিল্পরীতির। সময়ের ব্যবধানে রবীন্দ্র ছোটোগল্পের শিল্পরীতির পরিবর্তন, পরিবর্ধন ঘটেছে। প্রকাশকাল এবং চরিত্র বিকাশের লক্ষণের দিক থেকে রবীন্দ্র ছোটোগল্পকে ৩টি পর্যায়ে বিন্যস্ত করা যেতে পারে-

ক. উনবিংশ শতাব্দীতে রচিত গল্পসমূহ (১৮৯১-১৯০০)

খ. বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী গল্পসমূহ (১৯০১-১৯১৩);

গ. প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর গল্পসমূহ (১৯১৪-১৯৩৩)।

ঊনবিংশ শতাব্দীর কালসীমায় রচিত গল্পের বৈশিষ্ট্য: গল্পগুচ্ছে এই পর্যায়ে রচিত গল্পই সবচেয়ে বেশি। এ পর্বের গল্পের সংখ্যা পঞ্চাশেরও বেশি। এ পর্যায়ে রচিত উল্লেখযোগ্য গল্পগুলো হচ্ছে- ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’, ‘দালিয়া’, ‘কঙ্কাল’, ‘একরাত্রি’, ‘জীবিত ও মৃত’, ‘ছুটি’, ‘সুভা’, ‘মহামায়া’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘শাস্তি’, ‘সমাপ্তি’, ‘নিশীথে’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ইত্যাদি।

প্রথম পর্বের গল্পগুলো গ্রামকেন্দ্রিক। পল্লিকেন্দ্রিক মানুষের হৃদয়সংকট, প্রকৃতি, পদ্মা তীরবর্তী এলাকা, মধ্যবিত্ত সমাজ এ গল্পে স্থান লাভ করেছে। এ পর্যায়ের গল্পগুলোতে মানুষের হৃদয়রহস্য ও মানব হৃদয়ের সঙ্গে প্রকৃতির যে নিবিড় সম্পর্ক তা দেখানো হয়েছে এ পর্যায়ের গল্পে। সমাজ সংসারের প্রতিবেশে ব্যক্তি মানুষের হৃদয় চিত্রণই অনেক গল্পে মুখ্য হয়েছে। পোস্টমাস্টার, গিন্নি, ব্যবধান, ছুটি, সুভা, একরাত্রি, সমাপ্তি এ শ্রেণির গল্প।

প্রথম পর্বের গল্পে চরিত্রের বিকাশে প্রকৃতি পালন করেছে মুখ্য ভূমিকা। ঘটনা সংঘটনে, কাহিনি সংকটে ও প্রকৃতির ভূমিকা সহায়ক হয়েছে। প্রথম পর্বের গল্পে প্রকৃতির ব্যবহার বেশি। প্রকৃতিই কোনো কোনো গল্পের চরিত্রে পরিণামদর্শী প্রকাশ ভূমিকা পালন করেছে। পোস্টমাস্টার গল্পে-

“মিট্রিট্ করিয়া প্রদীপ জ্বলিতে লাগিল এবং একস্থানে ঘরের জীর্ণ চাল ভেদ করিয়া একটি মাটির সরার উপর টপটপ করিয়া বৃষ্টির জল পড়িতে লাগিল।”- এ যেন রতনেরই অন্ত বেদনার স্বরূপ নির্দেশক।

‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ গল্পে পদ্মা নদীই যেন পরিণাম নির্দেশক ভূমিকা পালন করেছে।

“বর্ষাকাল আসিল। ক্ষুধিত পদ্মা উদ্যান গ্রাম শস্যক্ষেত্র এক এক গ্রাসে মুখে পুরিতে লাগিল।”

‘মহামায়া’, ও ‘একরাত্রি’ গল্পে প্রকৃতি তাদের প্রিয়জনের কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘নিশীতে গেয়ে প্রকৃতিই মহামায়া ও দক্ষিণাবাবুর স্ত্রীকে উদার করোয় ভুলেরতিক বিষয় পর্বের গল্পে আবেগী পরিচর্যায়, নাট্যিক পরিচর্যায় গীতিকবিতার সুরে গল্পের অবয়ব সৃষ্টি করেছেন। তিনি পরিচর্যাকে কখনো আবেগ সঞ্চারী, কখনো চিত্রকল্প বিভোর কল্পনাশ্রয়ী রূপে ব্যবহার করেছেন। তিনি এ পর্বে উপমা রূপকাদির ব্যবহার করেছেন মূলত প্রকৃতি থেকে।

এ পর্বের গল্পে সাধুরীতির ব্যবহার করেছেন। ভাষা গীতিকাব্যধর্মী, আবেগ সঞ্চারী, দীর্ঘ বাক্যে লিখিত। ক্রিয়াপদ এখানে প্রলম্বিত হয়েছে। এখানে বেশি তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন। শৈল্পিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করার জন্য তিনি বাক্যের শেষে একটি অতীত ক্রিয়াপদের ব্যবহার করেছেন।

“আমি যখন চলিতাম তখন আপনি বুঝিতাম যে, একখণ্ড হীরা নড়াইলে তাহার চারদিকে হইতে যেমন আলো ঝকমক করিয়া উঠে আমার দেহের প্রত্যেক গতিতে তেমনি সৌন্দর্যের ভঙ্গি নানা স্বাভাবিক হিল্লোলে চারদিকে ভাঙ্গিয়া পড়িত।”

বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী গল্পের বৈশিষ্ট্য: দ্বিতীয় পর্বের গল্পগুলো শহর অভিমুখী। এ সময়ে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবন ও এদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছিল। । বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ব্যক্তিজীবনের ও রাষ্ট্রিক বিরোধ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের বোধ ও চিত্তের ব্যাপক প্রসার ও রূপান্তর ঘটে। এ পর্বে রচিত উল্লেখযোগ্য গল্পসমূহ হলো ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’, ‘নষ্টনীড়’, ‘মাল্যদান’, ‘গুপ্তধন’, ‘পণরক্ষা’, কর্মফল’ ইত্যাদি।

দ্বিতীয় পর্বের গল্পের মূল শিল্প উপাদান শহরমুখী মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবন। এ পর্যায়ের গল্পে আবেগী পরিচর্যার পরিবর্তে লেখক বিশ্লেষণাত্মক পরিচর্যা বেছে নিয়েছেন মানুষের হৃদয় সংকট বুঝাতে। এসব গল্পে মনন বিশ্লেষণের দিক দৃষ্টি দিয়েছেন লেখক। এ পর্বের গল্পের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের বিস্তৃত সমাজচিন্তার বিস্তৃত রূপ বিধৃত হয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের গল্পে আবেগময়তা, গীতিধর্মিতা কম পরিলক্ষিত হয়। এ পর্বের গল্পে চরিত্রগুলো দৃপ্ত ব্যক্তিত্ব নিয়ে আত্মপ্রকাশ করতে আরম্ভ করে।

মূলত ‘নষ্টনীড়’ থেকেই যথেষ্ট মনস্তত্ত্বমূলক গল্প রচনার শুরু হয়েছে। এ গল্পের পটভূমি কলকাতা নগরী। চারুলতাই প্রথম আধুনিক নারী ছোটোগল্পে। বিংশ শতাব্দীতে নারী আবিষ্কার হতে চায়। কিন্তু তাদের স্বামীরা তাদের ঘরের অন্ধকার কক্ষে বন্দি করে রাখতে চায়। তাই ভূপতি স্ত্রী চারুলতার খোঁজখবর নেয়ার সময়টুকুও পায় না। অমল এবং চারুলতা দু’জনে দু’জনকে আবিষ্কার করেছে। এর ফলেই চারুলতার স্বামীর সাথে দেখা দেয় দাম্পত্য বিচ্ছিন্নতা। বিংশ শতাব্দীতে বিচ্ছেদ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত। এ বিচ্ছেদ আধুনিক ব্যক্তিত্বেরই লক্ষণ।

“ভূপতির সর্বনাশের মধ্যে অমল যে অকথিত সমস্যার প্রলয়াচ্ছন্নতা হঠাৎ আবিষ্কার করল, আর অমলের অকস্মাৎ অন্ত ধানের প্রেক্ষাপটে চারু যে আত্ম-আবিষ্কার করল এ দুইকে দুনৈতিক বলব কোন মূঢ়তায়।”- ভূদেব চৌধুরী।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালের গল্পসমূহের বৈশিষ্ট্য: তৃতীয় পর্বের গল্পগুলোকে টেকনিক প্রধান গল্প বলা যায়। সে নতুন টেকনিকের হিসেবে মনস্তাত্ত্বিক মূল সমস্যা এর প্রধান বিষয়বস্তু হয়েছে। তৃতীয় পর্বের গল্পগুলো নগরকেন্দ্রিক। নাগরিক জীবনের জটিলতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে সমষ্টি জীবনের বা সামাজিক মূল্যবোধের সংঘর্ষ এ পর্বের গল্পের প্রধান আশ্রয়। মূলত রবীন্দ্রনাথের মননশীল প্রজ্ঞা, আদর্শ এ পর্বের গল্পে প্রাধান্য লাভ করেছে। এ পর্বের প্রধান গল্পগুলো হলো- ‘হালদারগোষ্ঠী’, ‘হৈমন্তী’, ‘বোষ্টমী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পয়লানম্বর’, ‘রবিবার’, ‘ল্যাবরেটরি’ প্রভৃতি।

এই পর্বের গল্পে নারী চরিত্রগুলো প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে বিকাশলাভ করেছে। প্রাগ্রসর জীবনবোধ ও জাতিক আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনা রবীন্দ্রমানসকে এক নতুন জীবন জিজ্ঞাসার মুখোমুখি করেছিল তার বোধ থেকেই রবীন্দ্রনাথ রচনা করলেন এই নতুন শিল্পরীতির গল্প। বুদ্ধদেবের ভাষায় যা পৌঁছে গিয়েছিল বিপ্লবের কাছাকাছি।

রক্ষণশীল সমাজ ও ধর্ম শাসিত প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম (বোষ্টমী) নারীর প্রতি সামাজিক লাঞ্ছনা ও অবহেলার বিরুদ্ধে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী নারীর বিদ্রোহ (স্ত্রীর পত্র) গতানুগতিক প্রেম ধারণার বিরুদ্ধে আধুনিক নারী সত্তার জাগরণ (পয়লানম্বর) বিধবা নারীর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম (ল্যাবরেটরি), প্রভৃতি বহুমাত্রিক ব্যক্তিবিদ্রোহ তৃতীয় পর্বের গল্পে বিশ্ব প্রসারী জীবনবোধে উজ্জ্বল।

তৃতীয় পর্বের গল্পে প্রকৃতি প্রায় অনুপস্থিত। এখানে শিল্প উপকরণ হিসেবে এসেছে আধুনিক নাগরিক, যান্ত্রিক সভ্যতার বিভিন্ন উপাদান। ‘শেষকথা’, ‘রবিবার’, ‘ল্যাবরেটরি’ গল্পে আধুনিক মানুষের অস্তিত্ব বিজ্ঞান নির্ভরতার উপর নির্ভরশীল এ কথাই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে। ব্যক্তিত্ব বোধ এ পর্যায়ের গল্পগুলোর ঘটনাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নই এ পর্বের মানুষের মধ্যে প্রধান হয়ে দেখা দিয়েছে। বিভা, অচিরা, মোহিনী, প্রথাগত সংস্কার, নিয়মকানুন ভেঙে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।

এ পর্যায়ের গল্পে চলিত ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে। তৎসম, তদ্ভব শব্দ আশ্রিত আপাত সহজ, সংক্ষিপ্ত বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে এ পর্বের গল্পে।

“ওঁর নিজের কাজে কর্তারা ওঁকে জীনিয়াস বলত, নিখুঁত হিসাবের মাথা ছিল তাঁর। বাঙালি বলেই উপযুক্ত পারিশ্রমিক তাঁর জোটেনি।” (ল্যাবরেটরি)

শুরু থেকে অদ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ছোটোগল্পে অনন্য গৌরবের অধিকারী। রবীন্দ্র ছোটোগল্প যেমন প্রস্তাবনা, উপস্থাপনা, পরিণতি ও উপসংহার কলাকৌশলের সযত্ন প্রচেষ্টায় ভরপুর, তেমনি বিষয় ও রসস্ফুরণের দিক দিয়েও বিচিত্র। রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে ছোটোগল্পের নতুনধারার প্রবর্তন, সম্প্রসারণ ও অনুশীলনের মাধ্যমেই বাংলা সাহিত্যের আসার লাভ করল অনন্য মহিয়া। সুতরাং নতুন ছোটোগাল্পিক শিল্পরীতির সার্থক স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই।