বাংলা ছােটোগল্পের ক্ষেত্রে সমরেশ বসু আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের উজ্জ্বলতম প্রতিভা। বাংলা ছােটোগল্পের ক্ষেত্রে সমরেশ বসুর কৃতিত্ব সবিশেষ আলােচনা করাে।
বাংলা ছােটোগল্পের ভুবনে এক অসাধারণ সাহিত্য প্রতিভা সমরেশ বসু। সাম্প্রতিক কালের বাংলা সাহিত্যের তিনি এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী: দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তীকালে বাংলা কথাসাহিত্যে যে ত্রয়ী-বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব হয়েছিল, তারা বাংলা সাহিত্যকে বঙ্কিম রবীন্দ্র-শরৎচন্দ্রের বাইরে এক নবতর শক্তি ও সামর্থ্য দান করেছিলেন সন্দেহ নেই। তবে তার পরবর্তী পর্বে বাংলা সাহিত্যে শক্তি ও সামর্থ্যের বিচারে যথার্থ স্বীকৃতিযােগ্য সাহিত্যফলক হিসাবে সমরেশ বসুর নামটি উঠে আসতেই পারে। সমরেশ এক স্বতন্ত্র ধারার লেখক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর শূন্যতাবােধ ও একাকীত্বের কণ্ডুয়ন ছেড়ে সাহিত্যজীবনের প্রথম পর্ব থেকেই তিনি নিচুতলার মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখকে গল্পের বিষয় করে সদর্থক জীবনভাবনার ও জীবনরসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি নিশ্চয়ই ঐতিহ্য-বহির্ভূত বা শিকড়বিহীন নয়। কিন্তু সমর্থ শিল্পপ্রতিভার গুণেই তিনি ঐতিহ্যের ভূমিতে দাঁড়িয়েও স্বয়ং এক নতুন ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে পেরেছেন।
সাধারণত ছােটোগল্পের মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যিকেরা আত্মপ্রকাশ করে থাকেন। কেননা ছােটোগল্পের সীমানা ছােটো, ফলে সেখানে সংক্ষিপ্ত বিস্তারে বহু চরিত্র-রচনার দায় নেই বা জীবনের ব্যাপক অর্থ-সন্ধানের পরিশ্রম নেই। বিন্যাসগত কৌশল আয়ত্ত হবার আগে তাই কথাসাহিত্যিকেরা সাধারণভাবে ছােটোগল্পের জগতকেই আত্মপ্রকাশের যােগ্য মাধ্যম হিসাবে নির্বাচন করেন। কিন্তু উপন্যাস রচনার মধ্য দিয়েই সমরেশ বসুর সাহিত্য জগতে অনুপ্রবেশ। প্রথম ছােটোগল্প সংকলন প্রকাশের আগেই তার তিনটি উপন্যাস প্রকাশিত হতে দেখি। তাঁর সাহিত্যজীবনের শুরুতেই আসে নিচুতলার মানুষজন এবং লেখকের সাম্যবাদী দর্শনের তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতা।
ছোটোগল্পের ক্ষেত্রে সমরেশের প্রতিভা অনস্বীকার্য। তবে প্রথম উপন্যাসে সমরেশ যে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন, আশ্চর্যজনক হলেও প্রথম ছােটোগল্প-সংকলন ‘মরশুমের একদিন’-এর কোনাে কোনাে গল্পে সেই দক্ষতার অভাব স্পষ্ট। পূর্বেই বলা হয়েছে, সমরেশ বসু অন্যান্য সাহিত্যিকদের মতাে প্রথমে ছােটোগল্পের কলমে হাত মশাে করেননি। উপন্যাসের মধ্যে দিয়েই তার আবির্ভাব। কিন্তু ছােটোগল্পের শিল্পকৌশলেও তিনি সমান অনায়াস। দু-একটি গল্প বাদ দিলে এই প্রথম সংকলনেই তার প্রতিভার প্রমাণ আছে।
ছােটোগল্পকার সমরেশ বসু যথার্থ আবির্ভাব ‘আদাব’ গল্পের মধ্যে দিয়ে। গল্পটি মরশুমের একদিন সংকলনের অন্তর্ভুক্ত। ‘আদাব’ গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে। এ গল্পে “প্রবল হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের হৃদয়বান ঐক্যের প্রবণতা।” সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়ংকর নারকীয় পরিবেশে আটকে পড়া দুই শ্রমজীবী মানুষ-একজন হিন্দু সুতা-মজুর ও অন্যজন এক মুসলমান মাঝি—কেমন করে দুই ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও জীবনের প্রবল আকর্ষণে হৃদয়ের মধ্যে এক নিবিড় বন্ধন অনুভব করে, তা স্পষ্ট হয়েছে এই গল্পে। দাঙ্গাকারী ধর্মান্ধ মানুষ এবং দাঙ্গা প্রতিরােধে নিয়ােজিত পুলিশবাহিনীর হৃদয়হীনতা উভয়ই অসাধারণ বর্ণনাকৌশলে ভাষা পেয়েছে এখানে। রুদ্ধশ্বাস মৃত্যুময় অন্ধকার পরিবেশে উভয়ের এই সম্প্রীতির বন্ধন যখন পুলিশের গুলিতে হঠাৎ ছিন্ন হয়ে যায়, তখন একটি বিষাদ ঘন হয়ে উঠলেও সমগ্র গল্পে আসলে বড়াে হয়ে উঠেছে শ্রমজীবী মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ জীবনলিন্সা। তাই মাঝির মৃত্যুর পরে হিন্দু মজুরটি যথার্থই অনুভব করে তার মুসলমান সঙ্গীটির মৃত্যুকালীন বেদনাটিকে— “সুতা-মজুরের বিহুল চোখে ভেসে উঠল মাঝির বুকের রক্তে তার পােলা মাইয়ার, তার বিবির জামা শাড়ি রাঙা হয়ে উঠেছে। মাঝি বলছে পারলাম না ভাই। আমার ছাওয়ালরা আর বিবি চোখের পানিতে ভাসব পরবের দিন। দুষমণরা আমারে যাইতে দিল না তাগাে কাছে।”
‘মরশুমের একদিন’ সংকলনেই রয়েছে ‘জলসা’ বা ‘গম্ভব্য’-এর মতাে রাজনৈতিক গল্প। কত বিচিত্র মানুষ তিনি দেখেছেন, তার প্রমাণ আছে সমরেশের গল্পগুলিতে। ‘কাজ নেই’ গল্পের নায়ক ফটিকর্চাদের পেশা বেওয়ারিশ গরু ধরে এনে খোঁয়াড়ে পােরা, আর ‘বিষের ঝাড়’ গল্পের নায়ক হারাধন চক্রবর্তীর পেশা গণিকা পল্লিতে যৌন ব্যাধির ওষুধ দেওয়া। আশ্চর্য এই যে, বিচিত্র চরিত্র, বিচিত্র ঘটনা, বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে নিয়ে গল্প লিখলেও সমরেশের সমস্ত গল্পই আসলে জীবনতৃষমার গল্প। সুনিশ্চিত ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়েও তার গল্পের মানুষেরা বাঁচতে চায়। ফটিকচাদ চায়, হারাধন চক্রবর্তী চায়, এমনকি ‘প্রাণ পিপাসা’ গল্পের হা-ঘরে বেশ্যা মেয়েটিও কোনােরকমে বেঁচে থাকতে চায়। এই সংকলনের শ্রেষ্ঠ গল্প সংকলনের নাম-গল্পটিই ‘মরশুমের একদিন’। নবীন হালদার অভিনেতা বা সংগীতশিল্পী হতে চেয়েছিল। কিন্তু তাকে বেছে নিতে হলে পেন্টার ও ড্রেসারের কাজ। এ সংসার কাউকে ঈন্সিত বস্তু দেয় না, এই সত্য উচ্চারিত হয় একটি নেশাগ্রস্ত চরিত্রের মুখে- “ইসটেজ বেঁকে থাকলে ওতে কেন্ট ঠাকুরকেও বাঁকা দেখা যায়। এ দুনিয়া ঢেলে না বাঁধলে চলবে না, হযা।”
সমরেশ বসু রাজনৈতিক দিক থেকে একসময় মার্কসবাদে বিশ্বাস করতেন। তীব্র শ্রেণিচেতনা এবং শ্রেণিসংগ্রামে তার বিশ্বাস ছিল। ‘জলসা’ ও ‘প্রতিরােধ’ গল্পদুটিতেও সমরেশ বসু মার্কসবাদী চেতনার শৈল্পিক প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ‘জলসা’ গল্পে দেখি জৌলুসময় জলসার বিপরীতে তীব্র শ্রমিক অসন্তোষ ও শ্রমিক ছাঁটাইয়ের করুণ পরিণতি। ‘প্রতিরােধ’ গল্পের পটভূমিতে রয়েছে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনে ভূমিহারা কৃষকের অভ্যুত্থান-প্রসঙ্গ ও নির্মম নিপীড়নের কাহিনি। তেভাগার আন্দোলনকে দমিত করতে ভয়ংকর অত্যাচার, জোতদার পীতাম্বর সা, সােনা মিএঞা, জেহারুদ্দিন প্রমুখের পুলিশি সাহায্য নিয়ে পীড়ন, মনাই দাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী রাধার বীভৎস মৃত্যু অঙ্কিত হয়েছে এই গল্পে। ‘জোয়ার ভাটা’ গল্পে দেখি বাঁচার রসদ না থাকলে কুলি কামিনরা কেমন হিংস্র হয়ে ওঠে, আবার সেই সম্ভাবনা ফিরে পেলে কেমন করে জীবনের জোয়ার আসে তাদের জীবনে।
নিম্নবিত্ত মানুষেরও আছে বেঁচে থাকার অধিকার, শ্রমের অধিকার। পরবর্তীকালে সেই অধিকার রক্ষার সংগ্রাম রূপায়িত হয়েছে তাঁর বিখ্যাত ‘কিমলিস’ গল্পে। বেচন নামক জেল ফেরত এক শ্রমিক এই গল্পের নায়ক। দেড় বছর আগে কারখানার রেশন-হরতালে সে জড়িয়ে পড়ে। প্রতিবাদী ভূমিকা নিয়ে শ্রমিকদের নেতৃত্ব দিয়ে সে কারখানা মালিকের বিষনজরে পড়ে এবং তার জেল হয়। সেই জেল-জীবন কাটিয়ে সে ফিরে আসে বস্তিতে। কিন্তু তার এই ফিরে আসা তার আত্মীয়স্বজন থেকে বস্তির বাড়িওয়ালা কেউ সহজভাবে নেয় না। বস্তির বাড়িওয়ালার সন্দেহ বেচন কমিউনিস্ট হয়ে ফিরেছে। সমস্ত বস্তিতেই তার সম্পর্কে একটা অস্বস্তি তৈরি হয়। চাকরি না থাকায় বেচনের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়, কিন্তু সে তখন ছাঁটাই হওয়া কারখানা শ্রমিকদের মার্কসবাদী তত্ত্ব বােঝাতে ব্যস্ত। কারখানা গেটে সে ছাঁটাইয়ের বিরুদ্ধে বক্তৃতা দেয়। সে সময়েই আকস্মিক আঘাত আসে তার ওপর। কারখানার সর্বহারা শ্রমিকেরা বেচনের পাশে সমবেত হয়। তার মা বাবাও ছেলের আদর্শের মর্ম অনুভব করে। সমস্ত গল্পে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্টদের স্বভাব-চরিত্র ও সক্রিয়তার অপূর্ব শিল্পরূপায়ণ ঘটাতে পেরেছেন সমরেশ।
সমরেশ বসুর দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ ‘অকালবৃষ্ট’। এই সংকলনের দুটি অসাধারণ গল্প ‘উজান’ ও ‘প্রত্যাবর্তন’। এ ছাড়া ‘ষষ্ঠ ঋতু’ গল্পসংকলনে আটটি গল্প স্থান পেয়েছে। এখানে দুটি রাজনৈতিক গল্প আছে- ‘ফটিচার’ এবং ‘ন নম্বর গলি’। ‘নিমাইয়ের দেশত্যাগ’ একটি উদ্বাস্তুসমস্যামূলক গল্প। সংকলনের একটি অসাধারণ গল্প ‘উত্তাপ’। এক দেহাতি মেয়ে দেহের উত্তাপ দিয়ে সুস্থ করে তােলে বাবুদের ছেলে হরেনকে। কিন্তু সুস্থ হবার পর যখন হরেনের মনে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে, তখন মেয়েটি প্রবল ঘৃণায় তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলে ওঠে— “আ মরণ! কেন্নোর মরণ গ।.. ই আর বাঁচবেনি দেখছি গ।”
সমরেশ বসুর ‘পশারিনী’ গল্পে উঠে এসেছে ট্রেন-হকারদের জীবন। ট্রেনে চানাচুর, ভিক্স ইত্যাদি বিক্রেতাদের মধ্যে এনেছেন নিম্নবিত্ত পরিবারের লাইসেন্সবিহীন নারী পুতুলের মা অর্থাৎ পুষ্পকে। পুষ্পকে পেশাগত কারণেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় অন্যদের সঙ্গে, আসে পুলিশি হামলা। অন্য হকারদের সঙ্গে পুষ্পকেও হাজতে যেতে হয়। কিন্তু সমস্ত সংঘর্ষ, প্রতিযােগিতা, বিচ্ছিন্নতা, অশান্তি সত্ত্বেও তাদের মধ্যে জেগে থাকে এক শ্রেণিগত ও পেশাগত সহমর্মিতা। কত বিচিত্র পেশার নিবিড় জীবনচিত্র যে রূপায়িত হয়েছে সমরেশের গল্পে, তা সত্যই বিস্ময়কর। হকার, শ্রমিক, দেহােপজীবিনী, যৌনরােগের চিকিৎসক, বহুরুপী ইত্যাদি আরাে কত কী। ‘পাড়ি’ গল্পে রূপায়িত এমন পেশার মানুষ, যারা সামান্য পয়সার বিনিময়ে দায়িত্ব নিয়ে শূকর, গোরু ইত্যাদি গঙ্গা-পার করে দেয়।
তার আরাে কয়েকটি ছােটোগল্প সংকলনের নাম- ‘আদি মধ্য অন্ত’, ‘জোয়ার ভাটা’, ‘অন্ধকারের গান’, ‘কীর্তিনাশিনী’, ‘মাসের প্রথম রবিবার’, ‘ছায়াচারিণী’, ‘মানুষ’, ‘বিদ্যুল্লতা’, ‘কামনাবাসনা’, ‘ও আপনার কাছে গেছে’, ‘বিপরীত রঙ্গ’, ‘যষ্ঠ ঋতু’, ‘ছেঁড়া তমসুক’, ‘উজান’, ‘মনােমুকুর’ ইত্যাদি।
সমরেশ বসু সম্পর্কে সাহিত্যিক দিব্যেন্দু পালিতের একটি মূল্যায়ন প্রনিধানযােগ্য—“He had the sensibility of Bibhutibhusan, the experience of Tarasankar, the questioning attributes of Manik and the uninhibitingly isolated background that made Satinath Bhaduri different.” অর্থাৎ ঐতিহ্যকে তিনি স্বীকার করেছেন। বিভূতিভূষণের স্থির আস্তিক্যবােধ তার ছিল না, কিন্তু অনুভূতির প্রগাঢ়তা ছিল নিঃসন্দেহে, সেইসঙ্গে ছিল মানুষের প্রতি নিবিড় ভালােবাসা। সতীনাথ ভাদুড়ির মতাে আপাত আকর্ষণহীন শিল্পাঞ্চলের মানুষকে তিনি উপন্যাসের বিষয় হিসাবে গ্রহণ করেছেন। তারাশঙ্করের মতাে গভীর অভিজ্ঞতাও তার ছিল এবং তার মতােই সেই অবিজ্ঞতার রূপায়ণ ঘটিয়েছেন দেশজ ভঙ্গিতেই। তারাশঙ্করের মতােই লােকজীবন ও লােককথাকে তিনি মিশ্রিত করেন বর্তমানের সঙ্গে। আবার বঙ্কিম যেভাবে দীনবন্ধুর প্রতিভাকে বিশ্লেষণ করেছিলেন, সেভাবে গভীর ও নিবিড় সামাজিক অভিজ্ঞতা ও সহানুভূতিও সম্ভবত সমরেশের সাহিত্য প্রতিভার উৎসস্থল। সহানুভূতির সার্থক সংযােজন ঘটলে কোনাে তুচ্ছ সাধারণ বা ঘৃণিত চরিত্রও কতখানি মানবিক আবেদন সৃষ্টি করতে পারে, তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত সমরেশ বসুর ছােটোগল্পগুলি। উপন্যাস ও ছােটোগল্প—উভয় শাখাতেই অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেও মনে হয়, সমরেশের বিচিত্র জীবন-অভিজ্ঞতা এবং জীবন-পিপাসা যথার্থ ভাষারূপ পেয়েছে তার ছােটোগল্পগুলিতেই।
Leave a comment