১৯০২ খ্রি. ১১ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গের (অধুনা ‘বাংলাদেশ) ঢাকা জেলার কৃতী প্রাবন্ধিক ও মনস্বী গােপাল হালদারের জন্ম। তাঁর পিতার নাম সীতাকান্ত হালদার। তাঁর বাল্যকাল অতিবাহিত হয় নােয়াখালি শহরে ; সেখানেই তার প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। পরে কলকাতায় এসে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেন। ১৯২২ খ্রি. ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণির অনার্স সহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২৪ খ্রি. ইংরেজিতে এম. এ এবং বি. এল. পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯২৫-২৬ খ্রি. পিতার কাছে থেকে ওকালতি পেশায় নিজেকে নিযুক্ত করেন। পরে ওকালতি ছেড়ে দিয়ে ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের নিকট ভাষা বিষয়ে পূর্ববঙ্গের কথ্য ভাষাসমূহের আলােচনায় গবেষণা শুরু করেন। এই সময় তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শের বিশিষ্টতার পরিচয় দিয়ে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দেন।
পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। ‘প্রবাসী’, ‘ফরওয়ার্ড, ‘ওয়েলফেয়ার’, ‘স্বাধীনতা’, প্রভৃতি পত্রিকার গুরুতর দায়িত্বে আত্মনিয়ােগ করেন। তিনি ‘পরিচয়’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনায় ব্রতী হন এবং মােট ১৯ বছর এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন।
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের সদস্য (১৯৫২-৫৮) এবং বিধান পরিষদের সদস্য হিসেবে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯৭৬ খ্রি. সাহিত্য অ্যাকাডেমির ফেলাে নির্বাচিত হন এবং ১৯৮০ খ্রি. তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন, তার অনেকগুলি সমালােচনামূলক গ্রন্থ আছে—এগুলির মধ্যে ‘বাঙলা সাহিত্য পরিক্রমা’, (১৯৫৬), ‘ইংরেজী সাহিত্যের রূপরেখা’ (১৯৬১), ‘রুশ সাহিত্যের রূপরেখা’ (১৯৬৬) প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। তিনি ১৩ টি উপন্যাস লিখেছেন, কয়েকটি ছােটোগল্প সংকলন, রম্যরচনামূলক গ্রন্থের লেখক হিসাবেও খ্যাতি অর্জন করেছেন।
বুদ্ধিদীপ্ত উপন্যাস লেখকদের অন্যতম গােপাল হালদার লিখিত ‘একদা’ নামক রাজনৈতিক উপন্যাসটিকে অনেকেই অকুণ্ঠচিত্তে শ্রেষ্ঠত্বের শিরােপা দানে স্বীকৃত। গ্রন্থটির রচনাকাল ১৯৩৯ খ্রি. হলেও এর ঘটনাকাল ১৯৩০-৩২ খ্রি.। এর অপর দুটি খণ্ড ‘অন্যদিন’ এবং ‘আর একদিন’। সমকালীন ‘লবণ আইন অমান্য’, ‘অহিংস সত্যাগ্রহ’ এবং ‘গুপ্ত বৈপ্লবিক আন্দোালন’ গ্রন্থের পটভূমি রচনা করেছে। কাহিনির নায়ক অমিত স্বয়ং বৈপ্লবিক আন্দোলনের প্রতি আস্থাশীল না হয়েও নিরাসক্ত দৃষ্টিতে একে বিচার করে এর প্রতি শ্রদ্ধাপরায়ণ ছিল। বাংলা সাহিত্যে পরবর্তীকালে পাশ্চাত্ত্য সাহিত্যের আধুনিকতার অনুসরণ করতে গিয়ে ভার্জিনিয়া উলফ-প্রবর্তিত ‘চৈতন্য প্রবাহের ধারা’ (Stream of consciousness) আমদানি করা হয়েছিল, গােপাল হালদারের ‘একদা’ গ্রন্থে অনেক পূর্বেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এ সম্বন্ধে বলেন : “বিপ্লববাদের দার্শনিক আশ্রয় ইহা অপেক্ষা অধিক সূক্ষ্ম ও গভীরভাবে আলােচিত হইতে পারে না। কিন্তু উপন্যাসটির দার্শনিক মননশীলতাই ইহার সর্বশ্রেষ্ঠ উৎকর্ষ নহে। ইহার সহিত মানব-হৃদয়ের চঞ্চল ঘাত-প্রতিঘাত যুক্ত হইয়া ইহাকে উপন্যাসােচিত গুণে সমৃদ্ধ করিয়াছে।”
Leave a comment