গদ্যের মধ্য দিয়েই একটা জাতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের যথার্থ সংবাদ পাওয়া যায়, কিন্তু শুধু কাব্যে কবিতা মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। তাই গদ্যকে বলা হয়েছে লেখক প্রতিভার ‘নিকষ-পাথর’। এই গদ্য রচনার মধ্য দিয়েই লেখকের যথার্থ প্রতিভা ধরা পড়ে। বিভিন্ন মনীষীর আর্বিভাবে বাংলা গদ্যে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লাভ করে ছিল। এমনই দুজন গদ্যে এক নিবন্ধকারের আবির্ভাব হল যাঁরা বাংলা মননশীল গদ্য সাহিত্যের দিকপাল বলে গণ্য হবার যোগ্য। তাঁরা হলেন অক্ষয়কুমার দত্ত ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে বাংলা গদ্যভাষার নিজস্ব প্রকৃতগত সৌন্দর্য প্রথম পরিস্ফুট হয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের রচনায়। গদ্য রচনায় তিনিই প্রথম পথ দেখিয়েছিলেন। সেই পথেই অক্ষয়কুমার কিংবা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পথচলা অনেকটা সম্ভব হয়েছিল। রামমোহন পর্বে অর্থাৎ রাজা রামমোহন রায় হতে রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত বাংলা প্রবন্ধ যেরূপ ও রীতি করে লেখা হয়েছিল অক্ষয় কুমার হতে তার সেইরূপ ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হয়। অক্ষয় কুমারের পূববর্তী প্রবন্ধকার গণের রচনা হইতে তাহার রচনার মধ্যে কয়েকটি বিশেষ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

  • 1. উল্লেখযোগ্য যে অক্ষয়কুমার হতেই প্রবন্ধে বিষয় বস্তুর বৈচিত্র্যসাধন পরিলক্ষিত হয়। তিনিই প্রথম বিজ্ঞান ইতিহাস জীবনচরিত রাজনীতি সমাজ দর্শন প্রভৃতি বিষয় অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা করে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ক্ষেত্রে বিষয়বস্তুর বিস্তার ও বৈচিত্র্যসাধন করেন।

  • 2. তাঁর পূর্বে প্রবন্ধ বিশেষভাবে বাদ প্রতিবাদমূলক বা সংলাপাত্মক আকারে রচিত হত। অক্ষয় কুমার হতেই যথার্থভাবে একোক্তিমূলক প্রবন্ধ রচনার সূত্রপাত হয়।

  • 3. বিভিন্ন ভাষায় পণ্ডিত— অক্ষয় কুমার একজন চিন্তাশীল ননীষী তত্ত্বানুসন্ধানকারী গবেষক এবং তর্ক নিপুণ লেখক ছিলেন। সংস্কৃত, ফার্সী ও ইংরেজী ভাষায় তিনি সুদক্ষ ছিলেন এবং ইহা ব্যতীত গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু ও জার্মান ভাষাতেও তার অল্প বিস্তর অধিকার ছিল।

  • 4. বিদ্বান ব্যক্তি— অক্ষয় কুমার সর্বজনোবিদিত’ ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা সম্পাদক ছিলেন বরং তাঁর সকল প্রবন্ধই এই পত্রিকার মাধ্যমে প্রচারিত হয়। তিনি অসাধারণ অনুধ্যান শীল পণ্ডিত ছিলেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য উৎস সাহিত্যের সঙ্গে তার গভীর পরিচয় ঘটে। একদিকে তিনি যেমন ইলিয়াড, এলিড, জয়সের Scientific Dialogue প্রভৃতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে তেমনি প্রাচীন ভারতীয় শাস্ত্র সমূহ নখদর্পণ ছিল।

অক্ষয়কুমারের রচনাবলী :

বাংলা গদ্যের ইতিহাসে অক্ষয়কুমার দত্ত একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী দর্শন ও জ্ঞান বিজ্ঞানের সাধনায় মগ্ন থেকে অক্ষয়কুমার বুদ্ধিজীবী বাঙালী মানসের এক আশ্চর্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। বুদ্ধি ও আত্মপ্রত্যয় সিদ্ধ বিবেক ছাড়া তিনি আর কারও দাসত্ব করেননি। এমনকি ঈশ্বরেরও না। এই সময় মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক পদে নিয়োগ করেন। এর ফলে তিনি নানাবিধ জ্ঞান বিজ্ঞান ও দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধ রচনায় সুযোগ পেলেন। সেই প্রবন্ধগুলি পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। অক্ষয়কুমার অনেকগুলি পাঠ্যশ্রেণীর পুস্তিকা শিখেছিলেন যেমন—(ক) ভূগোল (১৮৪১) (খ) চারপাঠ (তিন খণ্ড ১৮৫৩-৫৯) (গ) পদার্থবিদ্যা (১৮৫৬) (ঘ) ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১ম খণ্ড ১৮৭০, ২য় খণ্ড ১৮৮৩) (ঙ) বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার (১ম ও ২য় খণ্ড)।

গ্রন্থগুলি মূলত বৈজ্ঞানিক বিষয় নিয়ে ছাত্রদের জন্য রচিত তাঁর ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ গ্রন্থটি ‘The Constitution of man (1828) অবলম্বনে রচিত হয়েছিল এবং তার ‘ধর্মনীতি’ (১৮৫৬) গ্রন্থটিও কুম্বের Moral Philosophy অবলম্বনে রচিত—এতে তিনি জড়জীবন ও ঈশ্বরতত্ত্বের সমন্বয় সাধন করেছেন। অক্ষয়কুমারের কোন রচনাই ঠিক সৃষ্টিশীল সাহিত্যের পর্যায়ে পড়েনা। কিন্তু জ্ঞানচর্চার বাহনরূপে তাঁর হাতে বাঙলা গদ্য এখন সরলতা এবং প্রঞ্জলতা লাভ করেছে যে আধুনিক শিক্ষিত মানুষের শিক্ষা দ্বারা লভ্য সকল বিদ্যাই এই ভাষায় আলোচনা করা সম্ভব।

অক্ষয় কুমারের প্রবন্ধ রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পাইয়াছে তার ভাষায়। ভাষার তেজস্বিতা ও সেই অনুপাতে প্রাঞ্জলতা গুণে সমৃদ্ধ হয়ে তার রচনার ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে কোথাও অস্পষ্ট বা দুর্বুদ্ধি হয় নাই। তিনি বহু পারিভাষিক শব্দ উদ্ভাবন করে তাঁর বহুবিধ রচনার মাধ্যমে তাহা ব্যাপকভাবে প্রচার এবং ব্যবহার করিয়াছেন।

বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধকার হিসাবে খ্যাতিমান হলেও অক্ষয় কুমার প্রথমে কাব্য রচনা দ্বারাই তিনি সাহিত্য জীবনের সূত্রপাত করেন। পরবর্তীকালে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও নির্দেশে এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রেরণায় তিনি বাংলা প্রবন্ধ রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।

অক্ষয় কুমারের “বাহ্যবস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার” (১ম ভাগ—১৮৫১, ২য় ভাগ—১৮৫৩) নামক গ্রন্থটি বিখ্যাত লেখক জর্জ কুম্বের – The constitution of man Considered in Relation to external objects –গ্রন্থ অবলম্বনে লেখা। এই গ্রন্থের প্রথম ভাগে আমিষ ভক্ষণের বিপক্ষে বিবিধ যুক্তি প্রদর্শন করে নিরামিষ ভোজনের শ্রেণীত্ব বা বৈধতা সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার এই বক্তব্য জর্জকুর্শ্ব প্রচারিত মতের বিরোধী। তাঁহার এই একই গ্রন্থের ২য় ভাগে মদ্যপানের অবৈধতা বা অনিষ্টকারীতার বিষয় উল্লেখ করে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন।

বাহ্যবস্তুর সঙ্গে মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ বিচার গ্রন্থটির পরিপূরক। হিসাবে তার পরবর্তী রচনা “ধর্মনীতি” পুস্তকটির উল্লেখ করা যায়। ধর্মনীতির কোন প্রবন্ধ হিন্দু রক্ষণশীল সমাজে বিশেষ সমাজের লাভ করে নি। কারণ অক্ষয়কুমার তার রচনায় বহু বিবাহ, বাল্য বিবাহের অপকারিতা, বিধবা বিবাহ ও অসবর্ণ বিবাহের আবশ্যকতা সম্পর্কে যুক্তি তথ্যের ভিত্তিতে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। প্রচলিত দেশাচারের প্রতি এরূপ তীব্র বিরুদ্ধাচারণ তাঁর নির্ভীক ব্যক্তিত্ব ও প্রজাতিশীল মহোভাবেরই পরিচয় বহন করে।

“ধর্মোন্নতি সংশাধন বিষয়ক প্রস্তাব” (১৮৫৫) নামক প্রবন্ধ পুস্তিকায় যুক্তিবাদী অক্ষয় কুমার জ্ঞান বিজ্ঞানের যথাযথ অনুশীলন অর্থাৎ বিশুদ্ধ জ্ঞানই একমাত্র ধর্ম বলে প্রমাণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন।

অক্ষয়কুমার প্রণীত তিন খণ্ডে সম্পূর্ণ “চারুপাট” (১ম ১৮৫৩, ২য় ১৮৫৪, ৩য় ১৮৫৯) তার অতি জনপ্রিয় প্রবন্ধের সংকলন গ্রন্থ। চারুপাঠের প্রবন্ধ সমূহ বিভিন্ন বিষয়ক যেমন— বারি বিজ্ঞান, জ্যোতিষ, প্রাণীবিদ্যা পদার্থ বিদ্যা উদ্ভিদবিদ্যা শারীরিক স্বাস্থ্য বিধান প্রভৃতি সম্পর্কে লিখিত। প্রতিটি প্রবন্ধেই সংক্ষিপ্ত ও সরস এবং ওজস্বী জ্ঞানগর্ভ।

বৈজ্ঞানিক বুদ্ধির আলোকেই প্রধানত অক্ষয় কুমারের মানসিক চেতনা পরিপুষ্ট হয়েছে। তার বিজ্ঞান বুদ্ধিসর্বস্ব রচনা যেমন রস-সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। তেমনি একথা স্বীকার্য যে বৈজ্ঞানিক যুক্তি তর্ক বা বাগবৈদগ্ধ্যের বাহুল্য হেতু তাঁর প্রবন্ধ বিশুদ্ধ সাহিত্য রস গুণ মণ্ডিত হয় নাই।

অক্ষয় কুমার সাহিত্য গুণবর্জিত শুষ্ক জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধই অধিক রচনা করেছেন। তার রসাত্মক প্রবন্ধের সংখ্যা সেই পরিমাণে অল্প। তাঁর শিল্প রসিক মনের সম্যক পরিচয় প্রধানত তার ‘স্বপ্নদর্শন’ পর্যায়ের প্রবন্ধ গুলিতেই সমধিক প্রকাশ পেয়েছে। এই পর্যয়ের তিনটি বিশিষ্ট প্রবন্ধ হল অর্থাৎ ‘বিদ্যা-বিষয়ক’, ‘কীৰ্তি-বিষয়ক’ ও ‘ন্যায়-বিষয়ক’। তাদের মধ্যে কীর্তি বিষয়ক প্রবন্ধটি তীক্ষ্ণ শ্লেষ প্রধান রচনা। ‘কীর্তি বিষয়ক প্রবন্ধটিতে লেখকের বক্তব্য রূপকের মাধ্যমে বিধৃতি হয়েছে। এই প্রবন্ধটির ভাষাত্তি সরস ও প্রসাদগুণ মণ্ডিত।

অক্ষয় কুমার প্রণীত ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ (১ম ১৮৭০, ২য় ১৮৮৩) গ্রন্থটি সুপ্রসিদ্ধ ইংরাজ লেখক হেরেন হেম্যান উইলসনের গ্রন্থ অনুসরণে লিখিত। এই গ্রন্থে যেমন অক্ষয় কুমারের অনুসন্ধিৎসা সার গ্রহীতা ও সত্য নিষ্ঠার পরিচয় আছে তেমনি এতে তার প্রখর বিদ্যাবুদ্ধি বিচার, উপন্যাস চাতুর্য অসামান্য শাস্ত্রজ্ঞান এবং গভীর স্বদেশী প্রেম ও স্বাজাত্যবোধের পরিচয় লাভ করা যায়।

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত অক্ষয়কুমারের বহু প্রবন্ধই অদ্যাপি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। নাই। তার মৃত্যুর বহুকাল পরে কতকগুলি প্রবন্ধ একত্র সংকলিত হয়ো “প্রাচীন হিন্দুদিগের সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্য বিস্তার নামে (১৯০১) প্রকাশিত হয় ঋগ্বেদ সংহিতা, বিবিধ পুরাণ, রামায়ণ মহাভারত প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থগুলির বহুতর অংশে সমুদ্র যাত্রা ও হিন্দু বণিক ও বাণিজ্য সম্পর্কিত প্রসঙ্গ আছে। মূল গ্রন্থ সমূহ হতে প্রমাণপঞ্জী উল্লেখ করে তিনি ভিন্ন প্রবন্ধে এ সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছেন।

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত অথচ গ্রন্থাকারে অমুদ্রিত অক্ষয় কুমারের কয়েকটি রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যামূলক প্রবন্ধেরও সাক্ষ্য পাওয়া যায়। “কলিকাতার বর্তমান দুরবস্থা” “বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা” “পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা বর্ণন” প্রভৃতি বিষয়ক প্রবন্ধগুলি এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায়।

“বিধবা বিবাহের যৌক্তিকতা”–নামক প্রবন্ধে তিনি সংস্কারযুক্ত মনোভাব নিয়ে বিধবা বিবাহের সপক্ষে বিবিধ যুক্তি তর্কের অবতারণা করেন।

অক্ষয় কুমার প্রণীত—পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা” নামক প্রবন্ধটি নীলকর চা-কর প্রভৃতি ভূস্বামীদিগের নিষ্ঠুর অত্যাচার অবলম্বন করে লেখা হয়েছে। অক্ষয় কুমার তার প্রবন্ধের কোন অংশে নির্মল অত্যাচারকারী অমানুষ নীলকর সাহেবদের নিষ্ঠুর কর্মপ্রকৃতির প্রতি তীব্র শ্লেষ ও বিদ্রুপ সহকারে বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করেছেন।

অক্ষয়কুমার প্রধানত গুরুগম্ভীর জ্ঞানগর্ভ তথ্যনিষ্ঠ প্রবন্ধেরই খ্যাতিমান লেখক হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। বিজ্ঞান নিষ্ঠ বিষয় গৌরবের জন্যই তার বক্তব্য ও বাক্যরীতি ততোধিক সহজ ও রসসম্মত হয় নাই। বাংলা সাহিত্যে ইংরাজী সাহিত্যের আদর্শে প্রবন্ধ রচনার এথম সার্থক প্রয়াস অক্ষয় কুমারের মধ্যেই লক্ষ্য করা যায়। প্রবন্ধের সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি তার রচনায় সর্বপ্রথম পূর্ণ পরিস্ফুর্তি লাভ করেছে। অতএব অক্ষয় কুমার হতেই আধুনিক বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের যথার্থ বিকাশ শুরু হয়।