আধুনিক বাংলা কবিতার সার্থকতম পথিকৃৎ বুদ্ধদেব বসু ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লায় (অধুনা বাংলাদেশ) জন্মগ্রহণ করেন। এদের আদি নিবাস ছিল ঢাকা বিক্রমপুরে। নােয়াখালি এবং ঢাকাতেই তার বাল্য, কৈশাের ও যৌবনের প্রথমাংশ অতিবাহিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র থাকার সময়ই তার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র ছিলেন এবং ইংরেজি সাহিত্যে কৃতিত্বের সঙ্গে এম-এ পাশ করেন।

ছাত্রাবস্থাতেই তিনি ঢাকা শহরে আধুনিক বাংলা কাব্যের আন্দোলন গড়ে তােলেন এবং সেই কাব্য আন্দোলনের পটভূমিই ছিল তাঁর ‘Meet nurse for a Poetic Child.’ সেদিনকার তরুণ কবিগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে রুচি ও শালীনতার প্রশ্নে অভিযােগ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল, এবং রক্ষণশীল সাহিত্যিক গােষ্ঠী তাদের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করেছিলেন। এই রক্ষণশীল সাহিত্যিক গােষ্ঠীর আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য আধুনিক কবিগােষ্ঠী হলেও তাদের দলনেতা বুদ্ধদেব বসুই ছিলেন বিতর্কের মুখ্য লক্ষ্যস্থল।

বুদ্ধদেব বসু অতঃপর সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় সৃষ্টি-উদ্যমের পরিচয় দিতে থাকেন ; একের পর রচনা করেন গল্প-উপন্যাস-কবিতা। সাহিত্যের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শের প্রশ্নে সেদিন যে বিতর্ক শুরু হয়েছিল, তার জবাব দিয়ে গিয়ে আধুনিক কবিগােষ্ঠীর তরুণদের সেদিন নৃতনভাবে সৃষ্টি-উদ্যমের পরিচয় দিতে হয়। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তারা তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন- সাহিত্যসম্ভার সৃষ্টি করে তােলেন। বুদ্ধদেব বসু সেদিন পত্রিকা সম্পাদনার ভার নিয়ে নূতন কবিদের প্রতিভার পরিপােষকতার দায়িত্ব নেন। প্রথমে ‘প্রগতি’ পত্রিকা, পরে ‘কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব তুলে নিতে হয় তাকে—তীক্ষ বিদ্রুপ ও তীব্র সমালােচনা সত্ত্বেও তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন সৈনিকের নিষ্ঠায় এবং দীর্ঘকাল ধরে এভাবে কবিতা বিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার স্মরণীয় কীর্তিস্তমভ প্রােথিত করেছেন।

বুদ্ধদেব বসু প্রথমে একটি কলেজে অধ্যাপনার আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হন, পরে অবশ্য অনেক বড়াে বড়াে কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে অধ্যাপনার দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। তিনি আমেরিকা ও ইউরােপে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য বিষয়ে বক্তৃতা দানের জন্য আমন্ত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিও লাভ করেন। তিনি শেষজীবনে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন ; এদেশে তুলনামূলক সাহিত্যের আলােচনার অন্যতম পুরােধা ছিলেন তিনি। সুলেখিকা প্রতিভা বসু ছিলেন তাঁর সুযােগ্য সহধর্মিণী ; কবি বুদ্ধদেবের সৃজনী প্রতিভায় প্রতিভা বসুর অবদান যে বিস্তর, তা স্বয়ং কবি বুদ্ধদেবের স্বীকৃতিতে জানা যায়।

১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘তপস্বী’ ও ‘তরঙ্গিণী’ নাট্যসৃষ্টির জন্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার লাভ করেন এবং ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ উপাধিতে সম্মানিত হন। তিনি একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার এবং বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের পর বুদ্ধদেব বসুর মতাে এমন বৈচিত্র্যধর্মী গতিশীল সাহিত্যপ্রতিভা নিয়ে আবির্ভূত হতে আর দেখা যায়নি। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মার্চ কবি দেহত্যাগ করেন।

বুদ্ধদেব বসুর কাব্যগ্রন্থ

বুদ্ধদেব বসুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মর্মবাণী’ প্রকাশিত হয় ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে, কবির মাত্র তখন সতেরাে বছর বয়স। এর পর তিনি আমৃত্যু অনেকগুলি কাব্য রচনা করেন। তাঁর কাব্যগুলি কালানুক্রমিকক্ৰমে সন্নিবেশিত হল- ‘মর্মবাণী’ (১৯২৪), ‘বন্দীর বন্দনা’ (১৯৩०)’, ‘একটি কথা’ (১৯৩২), ‘পৃথিবীর পথে’ (১৯৩৩), ‘কঙ্কাবতী’ (১৯৩৭), ‘আমি চল হে’ (১৯৩৭), ‘পরিক্রমা’ (১৯৩৮), ‘নতুন পাতা’ (১৯৪০), ‘এক পয়সায় একটি’ (১৯৪২), ‘২২ ‘শে শ্রাবণ’ (১৯৪২), ‘দময়ন্তী’ (১৯৪৩), ‘রূপান্তর’ (১৯৪৪), ‘দ্রৌপদীর শাড়ি’ (১৯৪৮), ‘শীতের প্রার্থনা : বসন্তের উত্তর’ (১৯৫৫), ‘যে আঁধার আলাের অধিক’ (১৯৫৮), ‘মরচে পড়া পেরেকের গান’ (১৯৬৬), ‘একদিন : চিরদিন’ (১৯৭১), ‘স্বাগত বিদায়’ (১৯৭১), ‘সংক্রান্তি ; প্রায়শ্চিত্ত : ইক্কাকু সেন্নিন’ (১৯৭৩)।

এ ছাড়া অনুবাদের কবি হিসেবেও তিনি উল্লেখযােগ্য কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। কালিদাসের মেঘদূত (১৯৫৭), শার্ল বােদলেয়ার: তাঁর কবিতা (১৯৬১), হােণ্ডার্লিনের কবিতা (১৯৬৭) প্রভৃতি বুদ্ধদেব বসুর উল্লেখযােগ্য অনুবাদ-সৃষ্টি। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলন গ্রন্থের ভূমিকায় এবং কবিতা পত্রিকার সম্পাদকীয় রচনায় তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার যে বৈশিষ্ট্য ও গতিপ্রকৃতির পরিচয় দিয়েছেন, তা আধুনিক বাংলা কবিতার দিক্‌-দর্শক হিসেবে আজও গৃহীত। বুদ্ধদেব বসুর কবি ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে গিয়ে ড. দীপ্তি ত্রিপাঠী লিখেছেন, “আধুনিক বাংলা কাব্য-আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বুদ্ধদেব বসু।…প্রগতি পত্রিকায় তিনি আধুনিক কাব্য-যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত করেছিলেন এবং বাধাবিঘ্ন সত্ত্বেও আজও নৈষ্ঠিক ঋত্বিকের মতাে সে-অগ্নি রক্ষা করে চলেছেন। অজস্র কবিতা তিনি রচনা করেছেন, একমাত্র কবিতার জন্যই বিশ বছরের অধিককাল পত্রিকা প্রকাশ করে চলেছেন ও কাব্য আলােচনার মাধ্যমে আধুনিক বহু কবিকেই রসিক সমাজে পরিচিত করেছেন এবং সহৃদয়-সংবাদী পাঠকগােষ্ঠী সৃজন করেছেন।”