গ্রাম্য পাঠশালায় বিঘাকালির অঙ্ক কষতে কষতে এক বালকের মনে জেগেছিল এই ‘জ্যোতির্ময়’ প্রশ্ন—“আচ্ছা পৃথিবীটার কালি কত? ওটা কত বড়? উহার শেষ সীমাই বা কোথায়?” এই বালক অক্ষয়কুমার দত্ত, জ্ঞানতপস্যার বিশ্লেষণবোধে যিনি এই জড় জগৎকে নির্লিপ্তভাবে দেখার অভিজ্ঞতা আয়ত্ত করেছিলেন। ১৮২০ খ্রীস্টাব্দের ১৫ই জুলাই (কোনো মতে, ১৮ই মে) বর্ধমান জেলার চূর্ণী গ্রামে (‘সংসদ বাংলা সাহিত্যসঙ্গী’, শিশির দাস) মতান্তরে নবদ্বীপের কাছে চুপি গ্রামে ‘বঙ্গ অভিধান’, প্রথম সংস্করণ, বইমেলা ১৯৯৯ যোগনাথ মুখোপাধ্যায়) অক্ষয়কুমারের জন্ম হয়। পিতা—পীতাম্বর দত্ত, মা— দয়াময়ী। অল্প বয়সেই পিতৃবিয়োগ হয়। কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারীতে ন’ বছর বয়সে তার শিক্ষা শুরু হয়। কিন্তু আর্থিক কারণে বেশি দিন ছাত্র হতে পারেন নি। কিন্তু স্বীয় উদ্যোগে অধ্যয়নে ও বিজ্ঞানচর্চায় বিশেষভাবে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। অক্ষয়কুমার ঈশ্বর গুপ্ত, বিদ্যাসাগর এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তিন স্বনামধন্য ব্যক্তির সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্য, সমকালে প্রচলিত। যাবতীয় বিজ্ঞানবিষয়, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, উচ্চাঙ্গের গণিত ইত্যাদি বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হন। গ্রীক, ল্যাটিন, হিব্রু, জার্মান, ফার্সী, সংস্কৃত প্রভৃতি ভাষাগুলি আয়ত্ত করার জন্য চেষ্টা করেন। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের উদ্যোগে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেন। তত্ত্ববোধিনী সভার সভ্য মনোনীত হন। ১৮৪০ খ্রীস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার শিক্ষকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দের ২৮শে মে তিনি লোকান্তরিত হন।

বিদ্যাসাগরের সঙ্গে অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পর্ক :

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। খুব সম্ভবতঃ তার সংস্পর্শে এসেই অক্ষয়কুমার ঈশ্বরচিত্তায় কিছুটা অজ্ঞেয়বাদী হয়ে ওঠেন। ধর্মচর্চার চেয়ে সাহিত্য ও বিজ্ঞানচর্চায় তিনি অধিক মনঃসংযোগ করেন। বাস্তববাদী চিন্তাধারার জন্য ভক্তিবাদী দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে তার মানসিক দূরত্ব গড়ে ওঠে। ক্ষুব্ধ, হতাশ মহর্ষি বলে ওঠেন“আমি কোথায় আর তিনি কোথায়? আমি খুঁজিতেছি ঈশ্বরের সহিত আমার কি সম্বন্ধ, আর তিনি খুঁজিতেছেন বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির কি সম্বন্ধ আকাশ-পাতাল প্রভেদ” (দ্রষ্টব্য : ‘আত্মজীবনী’, দেবেন্দ্রনাথ)। অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ বিষয়ক প্রস্তাব তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশ করেন। অন্যদিকে বিদ্যাসাগর প্রথম দিকে অক্ষয়কুমারের রচনা পরিমার্জনার কাজে সাহায্য করেন। নর্মাল স্কুলের প্রধান শিক্ষকের পদে অক্ষয়কুমারের নাম সুপারিশ করেন বিদ্যাসাগর। শিক্ষা বিভাগের অধ্যক্ষকে লিখেছিলেন : “Babu Akshay Kumar Dutta is one of the very best Bengali writers of the time. His Knowledge of the English Language is very respectable and well acquainted with the art of teaching”. (দ্রষ্টব্য : “অক্ষয়কুমার দত্ত’’, ‘বঙ্গ অভিধান’ যোগনাথ মুখোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৩)। এর ফলে অক্ষয়কুমার তত্ত্ববোধিনীর ষাট টাকা বেতনের সম্পাদক থেকে নর্মাল স্কুলের দেড়শ টাকা বেতনের প্রধান শিক্ষকের পদে উন্নীত হন। তবে অসুস্থতার জন্য তিন বছরের বেশি এই কাজ করতে পারেন নি। সেইসময় পুনরায় বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে তত্ত্ববোধিনী সভা থেকে অক্ষয়কুমারকে পঁচিশ টাকা পেনসন দানের ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এই সৎ ও আদর্শবাদী লেখক তাঁর লেখা বইগুলি থেকে অর্থ আদায় হলে স্বেচ্ছায় পেনসন নেওয়া বন্ধ করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অক্ষয়কুমার বিদ্যাসাগরের সকল প্রকার সমাজ সংস্কারমূলক কাজের সমর্থক ছিলেন।

অক্ষয়কুমার দত্তের গদ্যরচনার সূত্রপাত ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রেরণায়। তাঁর রচনায় হৃদয়গ্রাহিতা, মাধুর্য ও সৌন্দর্য লক্ষ্য করে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। একাধিকক্রমে বারো বৎসর (১৮৪৩-১৮৫৫) অক্ষয়কুমার এই পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। এই পত্রিকায় তাঁর স্মরণীয় কীর্তিসমূহ প্রকাশিত হয়।

অক্ষয়কুমার দত্তের রচনাসমূহ

“অনঙ্গমোহন কাব্য’ আনন্দমোহন (১৮৩৪), ‘ভূগোল’ (১৮৪১), ‘পদার্থবিদ্যা’ (১৮৫৬), ‘চারুপাঠ’— তিনখণ্ড (১৮৫৩, ১৮৫৪, ১৮৫৯)। প্রবন্ধসমূহ— ‘বাহ্য বস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ প্রথম ভাগ (১৮৫১), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৫৩) ঃ উৎস— জর্জকুম্ব—’Constitution of Man’, ‘ধর্মনীতি (১৮৫৬)—জর্জ কুম্বের ‘Moral Phi losophy’, ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায় প্রথম ভাগ (১৮৭০), দ্বিতীয় ভাগ (১৮৮৩) : উৎস–হোরেস হেম্যান উইলসনের ‘The Religious sects of the Hindoos’। এছাড়া ‘ডেভিড হেয়ার সাহেবের নাম স্মরণার্থ তৃতীয় সাম্বৎসরিক সভায় বক্তৃতা’ (১৮৪৫)।

অক্ষয়কুমার দত্তের প্রধান পরিচয় প্রাবন্ধিক বা গ্রন্থকার রূপে। সংবাদ প্রভাকর, বিদ্যাদর্শন, দিগ্‌দর্শন, তত্ত্ববোধিনী ইত্যাদি একাধিক পত্রিকার সঙ্গে ছিল তাঁর সংযোগ। প্রথম জীবনে ছিলেন কবিযশঃপ্রার্থী, পুরোনো ধারায় ‘অনঙ্গমোহন’ নামে পদ্যবন্ধে একখানি রূপকথা কাহিনীর রচয়িতা। পরে ‘বিদ্যাদর্শন’ নামে একটি মাসিকপত্রে নীতি ও ইতিহাস এবং বিজ্ঞান’ প্রভৃতি বহুবিদ্যার বৃদ্ধি নিমিত্ত নানাপ্রকার রচনা প্রকাশ করেন। তাঁর গ্রন্থসৃষ্টির মৌল উদ্দেশ্য—(১) তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার শিক্ষকের দায়িত্ববোধে ছাত্রদের জন্য পুস্তক-রচনা। (২) ধর্মনীতি-সমাজ এবং প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানের দ্বারা বুদ্ধিমান মানুষের জন্য চিন্তাচর্চা। একথা ঠিক, অক্ষয়কুমারের রচনা মুখ্যতঃ প্রবন্ধধর্মী। সেখানে কল্পনাপ্রবণ গদ্যের বিকাশ ততটা দেখা যায় না। একমাত্র চারুপাঠের ‘স্বপ্নদর্শন’ রচনাটি এর ব্যতিক্রম। ‘বিদ্যাবিষয়ক’, ‘কীর্তিবিষয়ক’ ও ‘ন্যায়বিষয়ক’ এই তিন পর্যায়ে রচনাটি বিভক্ত। এর প্রেরণা ছিল ইংরেজী লেখক Addison-এর ‘ভিশন অফ মির্জা’ (‘Vision of Mirza’)।

অক্ষয়কুমার ছিলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানের উপাসক, তত্ত্বের অনুসন্ধানী বুদ্ধিমান মানুষ। যুক্তিবাদী, প্রত্যক্ষতাপ্রবণ এবং উপযোগবাদী। সমকালীন বিশ্বমানসিকতা তার মধ্যে সংকলিত হয়েছিল। অগস্ত্য কৌৎ-এর প্রত্যক্ষতাবাদ ও মানবতার আদর্শ, বেন্থাম-মিলের হিতবাদ বা উপযোগাত্মকতা এমন কী হার্বার্ট স্পেনসরের সংশয় বা অজ্ঞেয়তা পর্যন্ত তাঁর চিত্তে প্রতিফলিত হয়েছিল। ধর্ম, নীতি, সমাজ এবং সমসাময়িক অন্যান্য প্রশ্নগুলিকে তিনি প্রত্যক্ষতা ও উপযোগের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন, এমন কী প্রার্থনার যৌক্তিকতাকেও তিনি গাণিতিক অভ্রান্ততায় অস্বীকার করেছিলেন। তাঁর মতে কৃষক শস্যলাভ করে পরিশ্রমে, জগদীশ্বরের কাছে প্রার্থনার দ্বারা নয়। অতএব সমীকরণটি হবে এইরকম

পরিশ্রম = শস্য

পরিশ্রম = প্রার্থনা = শস্য

অতএব, প্রার্থনা = 0

দেবেন্দ্রনাথের ভক্তি ও আধ্যাত্মিকতা থেকে তিনি ছিলেন বহুদুরে অবস্থিত, তিনি বলেছিলেন—“অখিল সংসারই আমাদের ধর্মশাস্ত্র। বিশুদ্ধ জ্ঞানই আমাদের আচার্য, ভাস্কর ও আর্যভট্ট এবং নিউটন ও লাপ্লাস যে কিছু যথার্থ বিষয় উদ্ভাবন করিয়াছেন, তাহাও আমাদের শাস্ত্র। গৌতম ও কণাদ এবং বেকন ও বেদান্ত যে কোন প্রকৃত তত্ত্ব প্রকাশ করিয়াছেন, তাহাও আমাদের শাস্ত্র।” ব্রাহ্ম ধর্মকে তিনি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বমূলক ‘ডীজ্‌ম্‌’ গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট হয়েছিলেন। একথা ঠিক, অক্ষয়কুমারের ‘বাহ্যবস্তু’ বা অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থগুলির বিষয়বস্তু মৌলিক নয়। স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত ফ্রেনোলজিস্ট জর্জ কুম্ব বা ভারততত্ত্ববিদ হোরেস হেম্যান উইলসনের গ্রন্থগুলি তাঁর প্রবন্ধ রচনার উৎস ছিল। তবু দেখা যায়, এগুলি নিছক তর্জমা নয়, বা বিদেশীগ্রন্থের ছবহু অনুবাদ নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, উইলসনের গ্রন্থে একুশটি বৈষ্ণব, আঠারোটি শৈব এবং ছয়টি শাক্ত সম্প্রদায়ের নাম মিলিয়ে মোট পঁয়তাল্লিশটি ধর্মসম্প্রদায়ের কথা আছে। সেখানে অক্ষয়কুমারের ‘ধর্মনীতি’ গ্রন্থে, নিরানব্বইটি বৈষ্ণবশাখা, পাঁচটি শৈব এবং চব্বিশটি শাক্ত মিলিয়ে মোট একশো বিরাশিটি সম্প্রদায়ের বিবরণ আছে। ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি। তার বিরল পাণ্ডিত্যের নিদর্শন। এর প্রথম খণ্ডে আছে ‘শব্দবিদ্যা’ বা তুলনামূলক ভাষা-বিজ্ঞান, দ্বিতীয় খণ্ডে আছে প্রাচীন ভারতীয় ধর্ম-দর্শন-সাহিত্য-বিষয়ক প্রবন্ধ। অক্ষয়কুমারের সম্পাদনায় ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা ঊনবিংশ শতকে বাঙালী মনীষার দিক-নির্দেশক হয়ে ওঠে।

অক্ষয়কুমার বাংলা ভাষায় প্রথম জ্ঞান-বিজ্ঞানের সক্ষম আলোচয়িতা। সেইসূত্রে কিছু পরিভাষাও তিনি প্রস্তুত করেছিলেন। তার মধ্যে বৈজ্ঞানিক পরিভাষাও কিছু আছে। তাঁর রচনায় বাঙালীর নৈয়ায়িক, প্রতীচীর গৌড়ীরীতি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী এই তিনের সমন্বয় ঘটেছিল। বস্তুত, তাঁর রচনা সকলের জন্য নয়, প্রাপ্তমনস্কদেরই কেবল পাঠ্য হতে পারে। অভিজ্ঞতার সঙ্গে বুদ্ধির, বিশ্লেষণের সঙ্গে প্রজ্ঞার আশ্চর্য সমন্বয় ঘটেছিল তার রচনায়। সে রচনায় প্রসাদগুণ না থাক পাণ্ডিত্য ছিল, কল্পনার দ্বারা অভিষিক্ত না হলেও মননের ধ্রুপদী বিন্যাস সেখানে অস্পষ্ট নয়। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব মনীষীদের সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক সংযোগ : তাঁর শয়নশিখরে থাকতো ডারউইন ও নিউটনের প্রতিকৃতি, ঘরের দেওয়ালে থাকতো জ্যোতিষ্ক-লেখা গগনপট, নরকঙ্কাল এবং পশুপঞ্জর (জাস্টিস সারদাচরণ মিত্রের ভাদ্র ১৩১২ বঙ্গাব্দের ‘বঙ্গদর্শনে’ প্রদত্ত বিবরণ)। ধর্মতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞান পর্যন্ত যে দীর্ঘপ্রকার জ্ঞানভূমির মধ্যে ছিল তাঁর অনায়াস স্বচ্ছন্দ পদচারণা, বাঙালী পাঠককে হাত ধরে সেই জ্ঞানজগতের সিংহদ্বারে তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাই তাঁর কাছে আধুনিক ভারতবাসীর ঋণ অপরিশোধ্য।

দেবেন্দ্রনাথ ও অক্ষয়কুমারের মানসিকতা এবং গদ্যরীতির তুলনামূলক আলোচনা :

পিতামহর মৃত্যুতে কিশোর দেবেন্দ্রনাথ হন বিপর্যস্ত। সেই সময় হৃদয় ও চৈতন্যের এক চরম মুহূর্তে ঈশা বাস্যমিদং সৰ্ব্বং যৎ কিঞ্চ জগত্যাং জগৎ’ ইত্যাদি শ্লোকে লেখা ঈশোপনিষদের একখানি ছাপা পুঁথির ছেঁড়া পাতা তাঁকে সন্ধান দেয় তার জীবন-সমস্যা সমাধানের পথনির্দেশ,— জগৎ ও জীবনকে ঈশ্বরবোধের আবেগে দেখার ব্যক্তি-দৃষ্টি। অন্যদিকে গ্রাম্য পাঠশালায় ‘বিঘাকালির অঙ্ক কষতে গিয়ে বালক অক্ষয়কুমারের চিত্তকে অধিকার করেছিল এক বিশ্লেষণের নির্দেশ – “আচ্ছা, পৃথিবীটার কালি কত? ওটা কত বড়? উহার শেষ সীমাই বা কোথায়?” এই জিজ্ঞাসা আজীবন এবং সমাধানহীন রূপে দেখা দেয় তার জীবনে। প্রকৃতপক্ষে জগৎ এবং জীবন সম্পর্কে সীমাহীন কৌতূহল উভয়ের রচনাতেই লক্ষণীয়। কিন্তু একজনের মধ্যে দেখা যায় প্রবল হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ, দ্বিতীয়জনের মধ্যে আছে চিত্তবৃত্তির বিকাশ। তাই প্রথমজনের অনুসন্ধানের পথ যেখানে সংশ্লেষণের, সেখানে অন্যজন মূলতঃ বিশ্লেষণে বিশ্বাসী।

মানসিকতা বিচারেও পার্থক্য দেখা যায়। দেবেন্দ্রনাথ এবং অক্ষয়কুমার দুজনের মধ্যেই ছিল জগৎ এবং জীবন সম্পর্কিত কৌতূহল এবং প্রখর জিজ্ঞাসা। তাই সংজ্ঞা অথবা প্রজ্ঞায় আলোকিত তাঁদের রচনাবলী। তত্ত্ববোধিনী সভা ও পত্রিকা, ধর্ম এবং কর্মজীবনের সূত্রে দুজনেই অনেকখানি যেন পরস্পরের অংশী ও সঙ্গী। সেকালীন শ্রেষ্ঠ প্রতিভা রামমোহনের কাছে উভয়েই ঋণী। তবু তাঁকে গ্রহণে এবং ব্যবহারে, বাচনে অথবা লেখনের সমতায় উভয়ের মনোভঙ্গীর মধ্যে লক্ষ করা যায় যেন এক অসেতুসম্ভব মানস-ব্যবধান। রামমোহনের কাছে দেবেন্দ্রনাথের শিক্ষালাভ—স্ববিশ্বাসের একনিষ্ঠ অনুসরণ; যেমন প্রতিমাপূজা বা পৌত্তলিকতার বিরোধিতা, ঈশ্বরের সর্বশক্তিমত্তায় আস্থা, উপনিষদের অনুবাদ বা প্রচার প্রভৃতি কাজের প্রেরণা। কিন্তু অক্ষয়কুমার রামমোহনের শাস্ত্র-নিষ্ঠা, কিংবা উপনিষদ্ বেদাস্ত-তন্ত্রের প্রতি বিশ্বাস সম্পর্কে ছিলেন নিঃস্পৃহ, বরং তার যুক্তিসিদ্ধ আত্মপ্রত্যয় ভঙ্গী ছিল তার কাছে কাম্য। রচনা বিচারেও দেখা যায় দেবেন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত সাধনা ও ভক্তিপথের যাত্রী। তাই যদিও তৎকালীন বাঙালীর চিত্তজাগরণের সঙ্গে তাঁর সংযোগ ঐতিহাসিক সত্য, তবু যে নির্জনলোকে তিনি আত্মসমাহিত, সেই সুদূর লোক থেকে তার কণ্ঠে যেন দৈববাণীর মত উচ্চরিত হয় বিনম্র স্বীকারোক্তি— “তিনি আমার উপাস্য, আমি তাহার উপাসক, তিনি আমার প্রভু, আমি তাঁহার ভৃত্য, তিনি আমার পিতা, আমি তাঁহার পুত্র, এই ভাবই আমার নেতা।” ধর্মসংক্রান্ত হলেও এক রোমান্টিক আত্মগৌরবী ব্যক্তিত্বের ছায়া তাঁর রচনায় অনুপেক্ষণীয়। তাই নিরীশ্বরবাদী Hume, প্রকৃতিবাদী Mettrie অথবা জড়বাদী Bacon, Locke-এর রচনায় শাস্তি না পেয়ে অবশেষে মহানির্বাণতন্ত্র বা উপনিষদের প্রিয় শ্লোকগুচ্ছে, হাফিজের বয়েৎ, আমিয়েলের অন্তরময় রোজনামচায় তার মানস-বিচরণ শুরু হয়।

বিপরীতভাবে অক্ষয়কুমার ছিলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানের উপাসক, তত্ত্বজ্ঞানী বুদ্ধিমান মানুষ। যুক্তিবাদী, প্রত্যক্ষতাপ্রবণ, এবং উপযোগোৎসুক। সমকালীন বিশ্বমানসিকতাকে অধিকার করবার প্রবণতায় তিনি ছিলেন একাগ্র। সেইজন্য কৌৎ-এর প্রত্যক্ষবাদ ও মানবতার আদর্শ, বেন্থাম-মিলের হিতবাদ বা উপযোগাত্মকতা, এমন কি, হার্বার্ট স্পেন্সারের সংশয় বা অজ্ঞেয়তার প্রতিফলন পর্যন্ত তার রচনায় দেখা যায়। তার ধর্মপ্রবৃত্তি ছিল বুদ্ধিবৃত্তি দ্বারা চালিত। ধর্ম তার কাছে ছিল নীতিপালন। সুখী হওয়ার জন্য তিনি বুঝেছিলেন, ভক্তি নয় বিশ্বনিয়মের অনুগত হওয়া প্রয়োজন“সমুদয় মনোবৃত্তির প্রয়োজন রক্ষা করিয়া এবং বুদ্ধিবৃত্তি ও ধর্মপ্রবৃত্তির প্রাধান্য স্বীকার করিয়া তদনুযায়ী ব্যবহার করিলে সুখী ও স্বচ্ছন্দ থাকা যায়।”

দেবেন্দ্রনাথের প্রধান পরিচয়, তিনি ছিলেন ব্রাহ্মধর্মের অন্যতম প্রবক্তা রূপে। ধর্মব্যাখ্যার জন্যেই তার স্বীকৃতিলাভ। তবু, বাংলাভাষার প্রতি তার আন্তরিক অনুরাগ সচেতন বাঙালী পাঠকের অদ্ভুত অজানা নয়। যেমন, (ক) বাল্যবয়সেই এ্যাংলো ইন্ডিয়ান হিন্দু এ্যাসোসিয়েশন বিতর্কসভায় বাংলার প্রচলন, (খ) পনেরো বছর বয়সে ‘সর্বতত্ত্ব দীপিকা’ সভায় মাতৃভাষাকে গুরুত্বদান, (গ) তত্ত্ববোধিনী’ সভা ও পত্রিকায় সম্পূর্ণভাবে বাংলাভাষাকে প্রাধান্যদান ইত্যাদি তার কয়েকটি মহতী কীর্তি। তাঁর নিজস্ব সংযোজন অধিকাংশতই বক্তৃতা, বিষয়-ব্রহ্মসমাজে আচরণীয় ধর্ম। যেমন মাঘোৎসব উপলক্ষে বক্তৃতা-সঙ্কলন (১৮৮৭ শকাব্দ)।

অক্ষয়কুমারের প্রধান পরিচয় প্রাবন্ধিক বা গ্রন্থকর্তা নামে ‘সংবাদ প্রভাকর’, ‘বিদ্যাদর্শন’, ‘দিগ্‌দর্শন’ এবং ‘তত্ত্ববোধিনী’ ইত্যাদি একাধিক পত্রিকার সঙ্গে তার বিভিন্ন সময়ে সংযোগ ছিল। প্রথমজীবনে ছিলেন কবিযশঃপ্রার্থী, পুরোনো ধারায় ‘অনঙ্গমোহন’ নামে পদ্য বন্ধে এক রূপকথাধর্মী কাহিনীর রচয়িতা। ঈশ্বর গুপ্তের উৎসাহে গদ্য লেখায় হাতে খড়ি হয়। তারপর ‘বিদ্যাদর্শন’ পত্রিকার “নীতি ও ইতিহাস এবং বিজ্ঞান প্রভৃতি বহুবিদ্যার” পরিবেশে পরিচয় লাভ ঘটে। তার গ্রন্থসৃষ্টির মৌল উদ্দেশ্য—তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার শিক্ষকের দায়িত্ব পালন এবং প্রত্যক্ষ বিজ্ঞানের দ্বারা বুদ্ধিমান মানুষের যুক্তিবাদী চিন্তাচর্চা।

একথা অনস্বীকার্য যে, তাঁর রচিত গ্রন্থগুলির বিষয়বস্তু মৌলিক নয়। তাঁর ‘বাহ্যবস্তু’ এবং ‘ধর্মতত্ত্ব’ গ্রন্থের অবলম্বন ছিল স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত ফ্রেনোলজিষ্ট জর্জ কুম্বের “Essays on the Constitution of Man and its Relation to External Object” (১৮২৮) ও ‘Moral Philosophy’. তবু অক্ষয়কুমারের রচনা তর্জমা নয়, বিদেশী রচনা হয়ে উঠেছিল তাঁর আত্মচিন্তা প্রকাশের সূত্রমাত্র।

গদ্যের দৃষ্টান্ত : দেবেন্দ্রনাথের রচনার অন্যতম বিশেষত্ব, প্রাঞ্জলতা ও ছন্দহিল্লোল। বস্তুত, তার লেখা অক্ষয়কুমারের তুলনায় সরল এবং বিদ্যাসাগরের চেয়ে খুব কম ছন্দান্বিত নয়। তাঁর আত্মতত্ত্ববিদ্যা’ অক্ষয়কুমারের ‘বাহ্য বস্তুর সহিত মানব প্রকৃতির সম্বন্ধ’ এবং বিদ্যাসাগরের ‘বোধোদয়’ প্রায় একই সময়ে প্রকাশিত। তুলনা করলেই বোঝা যায় এর উৎকর্ষ ও সৌন্দর্যগুণ।

আত্মতত্ত্ববিদ্যা : “… আমি কিছুই হইলাম না, কেবল সূর্য-চন্দ্র গ্রহ-নক্ষত্র প্রভৃতি বাহ্যবস্তু সকলেই বস্তু হইল। এ বিবেচনা নাই যে, আমি যদি না থাকিতাম, তবে কোথায় বা সূর্য কোথায় বা চন্দ্র, কোথায় বা গ্রহনক্ষত্র, কোথায় বা এই জগৎ!” এখানে লক্ষণীয় (১) প্রতিপক্ষের (সম্ভবত অক্ষয়কুমার) প্রতি একটি গুপ্ত ব্যঙ্গ, (২) সুকঠিন তত্ত্বকে স্বগত ভাবাবেগে প্রকাশের রোমান্টিক লাবণ্য এবং (৩) ভাষা-ভঙ্গিমায় ছন্দের দোলন (cadence) সঞ্চার।

তার ‘ব্রাহ্মধর্ম গ্রন্থ’ উপনিষদের অবিকল শ্লোক সংগ্রহ ও অনুবাদ নয়, সঙ্কলন-কর্তার অনুশীলনবদ্ধ কোনও দার্শনিক তত্ত্বও নয়। বরং এটি তার এক মগ্নমুহূর্তের সৃষ্টি“যিনি সত্যের প্রাণ, যিনি সত্যের আলোেক তাঁহা হইতেই এই জীবন্ত সত্যসকল আমার হৃদয়ে অবতীর্ণ হইয়াছে।” ধর্মতত্ত্ব ব্যাখ্যার মধ্যে এ ধরনের এক অন্তর্মুখী অথচ সৌন্দর্যমগ্ন কণ্ঠস্বর সংযোজনে তাঁর রচনায় শিল্পীর গাবলী প্রকাশ পেয়েছে।

অন্যদিকে, ১৮৪১ খ্রীস্টাব্দে অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর প্রথম গদ্যরচনার যে সমাসবদ্ধ ভাষা ব্যবহার করেছিলেন তা এইরকমঃ- “এ ভাষার এ প্রকার প্রচুর গ্রন্থ দৃষ্ট হয় না যে, তদ্বারা বালকদিগকে সুচারুরূপে শিক্ষা প্রদান করা যায়। এই সুযোগযুক্ত সময়ে যদি এই অকিঞ্চন হইতে কিঞ্চিৎ দেশের উপকার সম্ভবে, এই মানস করিয়া চন্দ্রসুধালোভী উদ্বাহু বামনের ন্যায় দীর্ঘ আশায় আসক্ত হইয়া বহু ক্লেশে বহু ইংরাজী গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃত করিয়া বালকদিগের বোধগম্য অথচ সুশিক্ষাযোগ্য এই ভূগোল পুস্তক প্রস্তুত করিয়াছি”

এই ভাষায় গ্রন্থকারের দায়িত্ব ও সমাজবোধ, যুক্তিশৃঙ্খলা ও নিরাবেগ দৃষ্টিভঙ্গীর প্রকাশ ঘটেছে।