আধুনিক বাংলা সাহিত্যের আকাশে প্রমথ চৌধুরী এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্করূপে দেদীপ্যমান। তিনি পাবনার হরিপুর গ্রামের এক প্রসিদ্ধ জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের জামাতা, ইন্দিরা দেবীর স্বামী, ব্যারিস্টার প্রমথ চৌধুরী বিংশ শতকের বাঙালী বুদ্ধিজীবী মহলে এক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। ইংরেজি সাহিত্যে এম. এ. ফরাসী ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন এই বিদগ্ধ মানুষটি। তার রচনা শাণিত স্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। wit ও paradox-এর অফুরন্ত ধারায় তার সাহিত্যকর্ম প্রণোদিত, “He wrote thus because he thought thus. He wrote thus because he could not write otherwise” চেস্টারটনীয় স্টাইলের আলোচনায় ক্রিস্টোফার হেলিসের এই সত্যোচ্চারণ সম্ভবতঃ ভারতীয় লেখকদের মধ্যে তার সম্পর্কেই সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য।
বিংশ শতাব্দীর নাগরিকতার ভাষ্যকার এই প্রাবন্ধিক ‘বীরবল’ ছদ্মনামেই প্রসিদ্ধ ছিলেন। তার সাহিত্য বীরবলী-সাহিত্য এবং তাঁর স্টাইল ‘বীরবলী-স্টাইল’ নামেও সুপরিচিত। প্রকৃতপক্ষে এইদিক থেকে সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী ‘বাঙালী জাতির বিদূষক’ হিসাবেও খ্যাতিমান। এ সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেছেন— “আমি যখন দেশের লোককে রসিকতাচ্ছলে কতকগুলি সত্য কথা শোনাতে মনস্থ করি তখন আমি না ভেবে চিন্তে বীরবলের নাম অবলম্বন করলুম।”
কিন্তু শুধুমাত্র বীরবল ছদ্মনামের আড়ালে হাস্য-পরিহাসে নয়, ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক, চলিত ভাষার প্রচারক, সনেটকার, ছোটোগল্পকার, প্রাবন্ধিক ইত্যাদি বিভিন্ন ভূমিকায় প্রমথ চৌধুরীর কৃতিত্ব দেখা যায়। তার ব্যক্তিগত জীবন ও সাহিত্যজীবনের অনন্যতায় মুগ্ধ হয়ে সমালোচক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় বলেছেন— “সব্যসাচী প্রমথ চৌধুরী, ‘সবুজপত্র’ তাঁর গাণ্ডীব। আর সবুজ সভার সভ্যরা পাণ্ডব সেনার দল।… রুচির ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন বররুচি, রূপের রাজ্যে তিনি ছিলেন বরপুত্র, জ্ঞানের পথে তাকে বলা যায় বরযাত্রী। রূপোর চেয়ে রূপকে, রূপের চেয়ে রুচিকে, রুচির চেয়ে ঋদ্ধিকে বড়ো মনে করতেন তিনি। তার সাহিত্য-প্রতিভায় নব্যতা ছিলো— ছিলো অনন্যতা” (‘সাহিত্য ও সাহিত্যিক’)।
বাস্তবিক, তাঁর মননের মধ্যে যেমন ছিল ফরাসী মেজাজ তেমনি তার মন ছিল ভারতীয় রসবোধে সঞ্জীবিত, আর সবার উপরে ছিল উচ্চচূড় ইন্টেলেকট্-এর দীপ্তি। তার দৃষ্টি ছিল science-এ, তাঁর নীতি “the proper study of mankind is man”; আর রীতি হল ‘of a conscious search for ordered beauty’। তাই তাঁর মধ্যে দেখা যায় ক্ল্যাসিক প্রীতির সঙ্গে নির্মোহ আধুনিকতা, কলাকৈবল্যবাদী প্রত্যয়ের সঙ্গে কলাকারের নিখুঁত প্রকাশভঙ্গি, বহুশ্রুত ভাবের সঙ্গে ভাষার চাবুক। তিনি মননশীল হয়েও জীবনরসিক।
প্রমথ চৌধুরীর রচনাসমূহ:
প্রমথ চৌধুরীর প্রথম প্রবন্ধ ‘জয়দেব’ প্রকাশিত হয় ‘সাধনা’ পত্রিকায় (১৮৯৩)। তাঁর অন্য গদ্য প্রবন্ধগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য—
(১) প্রবন্ধ গ্রন্থ : ‘তেল-নুন লক্ড়ি’ (১৯০৬), ‘বীরবলের হালখাতা’ (১৯১৭), ‘নানা কথা’ (১৯১৯), ‘আমাদের শিক্ষা’ (১৯২০), ‘দু-ইয়ার্কি’ (১৯২১), ‘বীরবলের টিপ্পনী’ (১৯২১), ‘রায়তের কথা’ (১৯২৬), ‘নানা চর্চা’ (১৯৩২), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯৩৬), ‘প্রাচীন হিন্দুস্থান’ (১৯৪০), ‘বঙ্গসাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়’ (১৯৪৪), ‘আত্মকথা’ (১৯৪৬) এবং ‘প্রাচীন বঙ্গসাহিত্যে হিন্দু-মুসলমান’ (১৯৫৩)।
(২) গল্পগ্রন্থ : ‘চার ইয়ারী কথা’ (১৯১৬), ‘আহুতি’ (১৯১৯), ‘নীললোহিত’ (১৯৩২), ‘গল্প সংকলন’ (১৯৪১)।
(৩) কাব্যগ্রন্থ : ‘সনেট পঞ্চাশৎ’ (১৯১৩) এবং ‘পদচারণা’ (১৯১৯)।
দর্শন-রাজনীতি-সংস্কৃতি ইতিহাস ভাষা ও সাহিত্য, প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ে তাঁর অবাধ বিচরণ ও পাণ্ডিত্য যেমন দেখা যায়, তেমনি আছে উপযুক্ত ভাষায় তাকে প্রকাশের চাতুর্য। তার প্রবন্ধগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য—
- (ক) প্রগতিশীল যুক্তিবাদীতা,
- (খ) মননপ্রধান চিন্তা ভাবনা
- (গ) তির্যক বাচনভঙ্গী এবং অলঙ্কারের বাকবিন্যাস,
- (ঘ) নাগরিক বৈদগ্ধ।
(৪) পত্রিকা সম্পাদনা : ‘সবুজপত্র’ (১৯১৪ খ্রীঃ) সম্পাদনার পূর্বে ‘ভারতী’ (১৯০২ খ্রীঃ) পত্রিকার মাসকাবারি লেখায় ‘বীরবল’ নামে প্রমথ চৌধুরী চলিত ভাষার সপক্ষে লিখতে শুরু করেন। তির্যক ব্যঙ্গে বলেন— “ভাষা মানুষের মুখ হতে কলমের মুখে আসে, কলমের মুখ হতে মানুষের মুখে নয়। উল্টোটা চেষ্টা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।” (বীরবলের হালখাতা‘কথার কথা’)
রবীন্দ্রনাথ প্রমথ চৌধুরীর কবিতাকে বলেছিলেন ‘ইস্পাতের ছুরি’ (চিঠিপত্র ১৫ সংখ্যক পত্র, ২২.৪.১৯১৩)। তাঁর গদ্যের মধ্যেও আছে সেই শাণিত দীপ্তি। প্রমথ চৌধুরীই বাংলা ভাষায় প্রথম প্রবন্ধ-লিখিয়ে যিনি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রণোদনায় কিম্বা দেশাত্মবোধের আবেগে কলম ধরেননি। তার অভিমত : “আমি রূপায়িত করি শুধু নিজেকে, আমার রচনার বিষয় আমি নিজে”। করুণ আবেগে আর্দ্র বাংলাদেশের জলীয় পরিবেশে তিনিই প্রথম সুস্থ শুষ্ক সতেজ মনের ভাবনা প্রকাশ করলেন, তাঁর ভাবনা ও রচনার বিস্তার বহু বিষয়স্পর্শী, কিন্তু তাঁর সমধিক কৃতিত্ব বাচন-রূপায়ণে। একথা হয়ত সত্য, যে তাঁর বাচন-বৈশিষ্ট্য অনেক সময় তাঁর মনন বা সিদ্ধান্তের উপরে স্থান নিয়েছে। তবু তাঁর মনোহারিত্ব অনস্বীকার্য। এই ধরনের কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়—
প্রমথ চৌধুরীর ভাষারীতি বা স্টাইল:
“মন্ত্র সাপকে মুগ্ধ করতে পারে কি না জানি নে, কিন্তু মানুষকে যে পারে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ গোটা ভারতবর্ষ।” (‘সবুজপত্রে মুখপত্র’)
“সুন্দরের আগমনে হীরা মালিনীর ভাঙা মালঞ্চে যেমন ফুল ফুটে উঠেছিল, ইউরোপের আগমনে আমাদের দেশে তেমনি সাহিত্যের ফুল ফুটে উঠেছে। তার ফল কি হবে সে কথা না বলতে পারলেও এই ফুল ফোটা যে বন্ধ করা উচিত নয়, এই হচ্ছে আমাদের দৃঢ় ধারণা।” (‘পূর্বোক্ত’)
“জ্ঞানের ভাণ্ডার যে ধনের ভাণ্ডার নয়, এ সত্য তো প্রত্যক্ষ, কিন্তু সমান প্রত্যক্ষ না হলেও এও সমান সত্য যে, এ যুগে যে জাতির জ্ঞানের ভাণ্ডার শূন্য, সে জাতির ধনের ভাঁড়েও ভবানী”। (‘বইপড়া’)
কখনো বা ফরাসী বাগ্ভঙ্গির অনুসরণে লেখা হয়— “কিন্তু সমালোচকেরা চক্ষের জলে বক্ষ ভাসিয়ে দিলেও বঙ্গসরস্বতী আর গোবিন্দ অধিকারীর অধিকারভুক্ত হবেন না এবং দাশরথিকেও সারথি করবেন না।”
প্রমথ চৌধুরীর অধিকাংশ প্রবন্ধের বক্তব্যই বিতর্কমূলক। হয় প্রাচীন না হয় নবীন, প্রচলিত অথবা প্রচারিত মতকে পরীক্ষা করে প্রায় তার উচ্ছেদ করাই এর লক্ষ্য। এই পরীক্ষায় আছে যুক্তি ও তর্কের বিচার, দেশী ও বিদেশী তথ্য ও তত্ত্বের বহু আলোচনা। তবে বক্তব্য বিষয় নয় “যা প্রথম থেকে পাঠকের মনকে সজাগ ও মুগ্ধ রাখে সে হচ্ছে বিচার ও আলোচনার প্রকাশের ভঙ্গি”
একথা অনস্বীকার্য, বাংলা গদ্যের চলিত রীতিকে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে প্রমথ চৌধুরী এবং তাঁর সম্পাদিত ‘সবুজপত্রে’র ভূমিকা ছিল সর্বাগ্রে। কিন্তু কেবল নেতৃত্বদানের জন্যই নয়, এক স্বতন্ত্র ভাষা রীতির স্রষ্টা রূপেও চৌধুরী মশাইয়ের অবদান ছিল অসামান্য। wit, paradox, epigram-এর দৃষ্টান্ত তার রচনায় যথেষ্ট পরিমাণে পাওয়া যায়। তাঁর ভাষারীতির মধ্যে আছে—
- (ক) আলঙ্কারিকতা ও উপমা ব্যবহারে অভিনবত্ব,
- (খ) স্পষ্টতা ও সত্যবাদিতা,
- (গ) ব্যঙ্গধর্মী বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতা,
- (ঘ) ঋজুতা ও শাণিত বাক্ভঙ্গি।
তাঁর রচনা “witty as well as satiric.” উইটের ব্যবহারে তার ভাষারীতির মধ্যে যেমন একদিকে এসেছে ইস্পাতী উজ্জ্বলতা, অন্যদিকে উপেক্ষিত সত্যের মূর্তি বলার গুণে বিমুখ পাঠকের কাছেও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ঠিক যেন চেস্টারটনের ভাষায় “Truth standing on her head to attract attention.” স্বভাবতই তাঁর প্রবন্ধে পড়ে পাঠকের মনে হয় “কথা বলাকে এখানে তিনি কথা কলায় পরিণত করেছেন” (‘বাংলা সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী’, রথীন্দ্রনাথ রায়)।
Leave a comment