বাংলা গদ্যের বিকাশে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা কর।
ভূমিকা: যুক্তিতর্কের বাহন বলেই গদ্যের বিকাশ ঘটে পদ্যের বহু পরে। ধর্ম মতের প্রচার ও সমাজ সংস্কারের প্রয়াস বাংলা গদ্যকে একটা নির্দিষ্ট রূপ দিতে সাহায্য করেছে। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের (১৮০০) ছাত্রদের জন্য পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রয়াস থেকে বাংলা গদ্যের তিনটি রীতির সূচনা হয়- কথ্য, সাধু এবং সংস্কৃতানুসারী। তার আগেও যে গদ্য ছিল না এমন নয়। সে গদ্যের নমুনা আছে প্রাচীন চিঠিপত্রে, দলিল-দস্তাবেজে, বৈষ্ণবীয় কড়চায় এবং খ্রিষ্টীয় ধর্ম বিষয়ক রচনাতে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের [১৮২০-৯১] আগে বাংলা গদ্যের ভাষা গঠন হয়ে থাকলেও শিল্পরসমণ্ডিত সাহিত্যিক গদ্য সৃষ্টি হয় তাঁর হাতেই। তাই, বলা হয়ে থাকে বাংলা গদ্য যে সাহিত্যের উপযুক্ত বাহন হয়ে দাঁড়িয়েছে এর প্রথম কৃতিত্ব বিদ্যাসাগরের। সেকালের “শ্রীহাদহীন বাংলা ভাষাকে সংযত ও সুবিন্যস্ত করে শিল্পরূপ দান করেছিলেন।””
বিদ্যাসাগর ও তাঁর রচনাবলি: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের (১৮২০-১৮৯১) প্রধান রচনাবলির তালিকাটি এরকম: ‘বাংলার ইতিহাস’ (১৮৪৮), ‘জীবন চরিত’ (১৮৪৯), ‘বোধোদয়’ (১৮৫১), ‘শকুন্তলা’ (১৮৫৪), ‘কথামালা’ (১৮৫৬), ‘সীতার বনবাস’ (১৮৬০), ‘ভ্রান্তিবিলাস’ (১৮৬৯)। পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে বিচার বিতর্কমূলক রচনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫৫), ‘বহুবিবাহ রহিত হওয়া উচিত কি না এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৭১-৭৩) ‘সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্যশাস্ত্র বিষয়ক প্রস্তাব’ (১৮৫১)। বিদ্রূপাত্মক বেনামী রচনা-‘অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩), ‘আবার অতি অল্প হইল’ (১৮৭৩)। বিদ্যাসাগর মহাশয়ের মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয় ‘প্রভাবতী সম্ভাষণ’ ও স্বরচিত জীবনী-‘বিদ্যাসাগর চরিত্র’।
তাঁর সময়ের সামাজিক পটভূমি: বিদ্যাসাগরের অধিকাংশ রচনাই উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে লিখিত। বিগত শতাব্দীর প্রথমার্ধের সামাজিক ইতিহাস নানা বিপরীত শক্তির সংঘাতে আলোড়িত। ইউরোপীয় সভ্যতার স্পর্শে তখন আমাদের বহুকালের ঘুমন্তচিত্তে একটা নতুন চেতনা, নতুন আলোড়ন হচ্ছিল, কিন্তু এই চেতনা সংগঠিত ও সংহত হয়ে উঠতে পারেনি। নবোদ্ভূত জীবনচেতনা জাতীয় জীবনে ধীরে ধীরে স্থায়ীভাবে যখন সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্বীকৃত হয়েছে তখনই দেখা দিয়েছে সর্বাত্মকভাবে আধুনিক সাহিত্য সংস্কৃতি গড়ে তোলার প্রয়াস। এই শতকের দ্বিতীয় অর্ধ নতুন সৃষ্টির কাল, নবযুগের পরিচ্ছন্ন, সুস্পষ্ট লক্ষণ এই সময়ের সাহিত্যকৃতিতে সমুজ্জ্বলভাবে ফুটে উঠেছে। বিদ্যাসাগর আট বছর বয়সে কোলকাতায় আসেন এবং ১৮৪১ সালে তাঁর ছাত্রজীবন শেষ হয়। অর্থাৎ কোলকাতাকে কেন্দ্র করে বাংলা দেশে নবযুগের অভ্যুদয়ের কালটিই বিদ্যাসাগরের জীবনেরও প্রস্তুতিপর্ব। তাঁর কর্মজীবনে প্রবেশের পর থেকে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রগতিশীল কর্মধারায় তিনিই ছিলেন অন্যতম অগ্রনায়ক।
বাংলার ইতিহাসের এই পর্ব সম্পর্কে শিবনাথ শাস্ত্রী বলেছেন, “এক্ষণে আমরা বঙ্গ সমাজের ইতিবৃত্তের যে যুগে প্রবেশ করিতেছি, তাহার প্রধান পুরুষ পণ্ডিতপ্রবর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। এককালে রামমোহন রায় যেমন শিক্ষিত ও অগ্রসর ব্যক্তিগণের অগ্রণী ও আদর্শ পুরুষরূপে দণ্ডায়মান ছিলেন এবং তাঁহার পদভরে বঙ্গসমাজ কাঁপিয়া গিয়াছিল, এই যুগে বিদ্যাসাগর মহাশয় সেই স্থান অধিকার করিয়াছিলেন।”
বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী বাংলা গদ্য ব্যবহারোপযোগী হওয়া সত্ত্বেও দূরান্বয়, ছেদ চিহ্নের অল্পতা, বাক্যের ভারসাম্যহীনতা ও সংযোজক অব্যয়ের সাহায্যে বিরুদ্ধ ভাবের একাধিক বাক্যের সংযোজন সে গদ্যরীতিকে রসহীন করে রেখেছিল। যদিও পূর্বে মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার গদ্যের মধ্যে অনেকখানি সাহিত্যরস সঞ্চার করতে পেরেছিলেন, রামমোহন এনেছিলেন কিছুটা প্রাঞ্জলতা। বিদ্যাসাগরের ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ (১৮৪৭) প্রকাশিত হলে বাংলা গদ্যের নতুন যুগের সূচনা হয়। ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ থেকে বিদ্যাসাগরের গদ্য দুটি ধারায় প্রবাহিত হয়েছে একটি ধারা ‘শকুন্তলা’ হয়ে ‘ভ্রান্তিবিলাস’ ও ‘বিদ্যাসাগরের চরিতে’র মধ্য দিয়ে বেনামী রচনায় এসে পৌঁছেছে। অন্যটি মহাভারতের অনুবাদের মাধ্যমে সীতার বনবাস ও রামের রাজ্যভিষেকে রূপ নিয়েছে।
বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য ও বৈচিত্র্য:
ক. বিদ্যাসাগর বাক্যাংশের অর্থজ্ঞাপকতা অনুযায়ী বিরাম চিহ্নের যথাযথ প্রয়োগ নির্দেশ করে তিনিই প্রথম বাংলা গদ্যের নিজস্ব রূপটি আবিষ্কার করেন। যেমন-
“রাজা, তদীয় আদেশ অনুসারে, আসন পরিগ্রহ করিয়া, কিয়ৎক্ষণ পরে, পুনরায় নিবেদন করিলেন, মহাশয়! ভৃত্যের প্রতি কি আজ্ঞা হয়।” (বেতালপঞ্চবিংশতি: উপক্রমণিকা অংশ)
খ. বিদ্যাসাগর গদ্যের অন্তর্নিহিত ছন্দকে আবিষ্কার করে সুষম বাক্য গঠনরীতি প্রবর্তন করেন। বাক্যগঠনরীতির সুষমা তাঁর রচনাকে লালিত্য ও নমনীয়তা দান করে। ফলে বাংলা গদ্য হয়ে ওঠে সুশ্রাব্য, সরস, ছন্দোময়। তাঁর গদ্যের ধ্বনিময়তা ও ছন্দস্রোতের উদাহরণ ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’ থেকে দেওয়া যেতে পারে-
“বারণসী নগরীতে,/প্রতাপমুকুট নামে, এক প্রবল প্রতাপ/নরপতি ছিলেন।/তাঁহার মহাদেবী নামে/প্রেয়সী মহিষীও বজ্রমুকুট নামে/হৃদয়নন্দন/নন্দন ছিল।/একদিন রাজকুমার,/একমাত্র অমাত্য পুত্রকে/সমভিব্যাহারে লইয়া,/ মৃগয়ায়/ গমন করিলেন।”/ (বেতালপঞ্চবিংশতি; প্রথম উপাখ্যান)
গ. বিদ্যাসাগরই প্রথম বাংলা গদ্যের পদবিন্যাসরীতি বিশুদ্ধভাবে নির্ধারণ ও প্রয়োগ করেন। যেমন-
“বাছা! শুনিলাম, আজ তোমার বড় অসুখ হয়েছিল; এখন কেমন আছ, কিছু উপশম হয়েছে? শকুন্তলা কহিলেন, হাঁ পিসি! আজ বড় অসুখ হয়েছিল; এখন অনেক ভাল আছি।” (শকুন্তলা)
ঘ. বিদ্যাসাগরের আগে বাংলা গদ্যে গুরুগম্ভীর শব্দের বহুল ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু বিদ্যাসাগর কাহিনি বা গল্প বলার উপযোগী গদ্য ব্যবহার করেন। প্রথমদিকে তিনি দীর্ঘ বাক্য ব্যবহার করলেও পরবর্তী সময়ে তাঁর বাক্য ব্যবহার ছোটো হয়ে আসে; ফলে ভাষা পরিণত হয় ভাবের বাহনে। এ সময়ে তাঁর রচনাতে ছোটো ছোটো সংলাপ ও কথ্যভাষার
প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। যেমন-
“ধীবর কহিল, “আরে চৌকিদার! আমি চোর নহি, আমায় মার কেন? আমি কেমন করিয়া এই আঙটি পাইলাম, বলিতেছি। এই বলিয়া, সে কহিল, আমি ধীবর জাতি, মাছ ধরিয়া, বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্বাহ করি। নগরপাল শুনিয়া কোপাবিষ্ট হইয়া কহিল, মর বেটা, আমি তোর জাতিকূল জিজ্ঞাসিতেছি নাকি?” (শকুন্তলা; ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ)
ঙ. বিষয় অনুসারে ভাবগম্ভীর বা লঘুচপল গদ্যভঙ্গির ব্যবহার দেখিয়ে তিনি বাংলা গদ্যের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছিলেন। যেমন-
“যমুনাতীরে জয়স্থল নামে এক নগর আছে। তথায়, কেশব নামে এক পরম ধাৰ্ম্মিক ব্রাহ্মণ ছিলেন। এ ব্রাহ্মণের মধুমালতী নামে এক পরম সুন্দরী দুহিতা ছিল। কালক্রমে মধুমালতী বিবাহযোগ্য হইলে, তাহার পিতা, ভ্রাতা, উভয়ে উপযুক্ত পাত্রের অন্বেষণে তৎপর হইলেন।” (বেতালপঞ্চবিংশতি; দ্বিতীয় উপাখ্যান)
চ. বিদ্যাসাগরের গদ্য অনেক ক্ষেত্রেই অলঙ্কৃত। তাঁর রচনাতে গদ্যের অন্তর্নিহিত ছন্দ এবং অনুপ্রাসের ব্যবহার সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়। তাছাড়া গদ্যে প্রবাদ-প্রবচনের ব্যবহার করে তিনি ভাষাকে সমৃদ্ধ, সরস ও আকর্ষণীয় করে তুলেছেন।
ছ. বিদ্যাসাগর এক অর্থে একাধিক শব্দের ব্যবহার করে শব্দের পুনরুক্তি পরিহার করতে চেষ্টা করেছেন। যেমন-
১ নৃপতি, মহারাজ, রাজা, ভূপাল, নরপতি।
২ বারবনিতা, বারনারী, বারযোষিৎ, বারাঙ্গনা।
৩ তপস্বী, তাপস, যোগী, সন্ন্যাসী।
অনেক সময়ে সমার্থক বিভিন্ন শব্দ স্বতন্ত্র তাৎপর্যমণ্ডিত হয়েই প্রযুক্ত হয়েছে। শুধু পুনরুক্তি পরিহারের প্রয়োজনেই তা নির্ধারিত হয়নি।
জ. বিদ্যাসাগর তদ্ভব ক্রিয়াপদের স্থলে প্রায়ই তৎসম ভাববচন সংবলিত উক্ত ক্রিয়াপদ ব্যবহার করেছেন। যেমন- গেলেন স্থলে “গমন করিলেন।” হারিয়েছে স্থলে “হরণ করিয়াছে।” আনিতে স্থলে “আনয়ন করিতে।” এইরূপ যুক্ত ক্রিয়াপদের ব্যবহারে ভাষা কিছু ভারী হলেও বাক্যের ওজস্বিতা ও মাধুর্য যে বেড়েছে তা স্বীকার্য ‘ইয়া’ প্রত্যায়ান্ত অসমাপিকার পরিবর্তে ‘প্রযুক্ত’, ‘পূর্বক’, ‘পুরঃস্বর’, ‘অন্তর’ প্রভৃতি যুক্ত ভাবচরণের অত্যধিক ব্যবহার সেকালের লেখায় ছিল বিদ্যাসাগরের লেখায়ও আছে এবং বঙ্কিমচন্দ্রের লেখাতেও বিরল নয়।
ঝ. ওজস্বিতা বিদ্যাসাগরের গদ্যের একটি বড়ো গুণ। ‘বিধবা বিবাহ’ দ্বিতীয় পুস্তকের উপসংহার অংশ এর একটি উজ্জ্বল নিদর্শন। বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতি একই কেন্দ্রবিন্দুতে স্থির ছিল না। ‘সীতার বনবাস’ তাঁর গুরুভার রচনা। তত্ত্বব শব্দ ও ক্রিয়াপদের ব্যবহার ‘বেতালপঞ্চবিংশতি’তে কখনো কখনো দেখা দিয়েছে। লালিত্য ও প্রাঞ্জলতার সমাবেশ ‘শকুন্ত লার’ বিশেষ গুণ। ‘ভ্রান্তিবিলাসের’ রচনারীতি তাঁর আখ্যানসমূহের মধ্যে সবচেয়ে লঘু: তদ্ভব শব্দ ও ক্রিয়াপদের প্রাচুর্যে এখানে চোখে পড়বার মতো। বেনামীতে লেখা বইগুলোয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রীতির পরিচয় পাওয়া যায়। তৎসম শব্দের প্রয়োগ অপেক্ষাকৃত কম, দেশি ও বিদেশি শব্দের ভিড় বেশি।
ঞ. বিদ্যাসাগরের গদ্যরীতির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘চারিত্র পূজা’ (১৩০২) পুস্তিকায় উল্লেখ করেন-“বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী ছিলেন। তৎপূর্বে বাংলায় গদ্য সাহিত্যের সূচনা হইয়াছিল। কিন্তু তিনিই সর্বপ্রথমে বাংলা গদ্যে কলানৈপুণ্যের অবতারণা করেন।… বাংলা ভাষাকে পূর্ব প্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বর হইতে মুক্ত করিয়া, তাহার পদগুলোর মধ্যে অংশযোজনার সুনিয়ম স্থাপন করিয়া, বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবলমাত্র সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন তাহা নহে, তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন।”
ট. বিদ্যাসাগরের শেষের রচনাগুলোতে বাক্যগঠন এবং পদবিন্যাসরীতি আরো সহজ হয়ে পড়ে। শব্দ ব্যবহারের লেখকের সংস্কারমুক্তি লক্ষণীয়। ইংরেজি ও তদ্ভব শব্দের অনায়াস ব্যবহার সহজেই চোখে পড়ে। বাক্যের স্বচ্ছন্দ গতি ও সাবলীলতা লক্ষণীয়। যেমন-
“প্রথমবার কলিকাতা আসিবার সময়, সিয়ালাখালায় বাঁধারাস্তায় উঠিয়া, বাটনাবাটা শিলের মত একখানি প্রস্তর রাস্তার ধারে পোতা দেখিতে পাইলাম। কৌতূহলবিষ্ট হইয়া পিতৃদেবকে জিজ্ঞাসিলাম বাবা রাস্তার ধারে শিল পোতা আছে কেন। তিনি আমার জিজ্ঞাসা শুনিয়া হাসিমুখে কহিলেন, ও শিল নয়, উহার নাম মাইল স্টোন।” (বিদ্যাসাগর চরিত)
বিষয় অনুসারে ভাষারীতির প্রবর্তনা বিদ্যাসাগরের হাতে সার্থকতা লাভ করেছে। বাংলা ভাষাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংহত করে এতে সহজ গতি ও কর্মদক্ষতা দান করেছেন। বিদ্যাসাগরের বাংলা সহজ বলেই তা সবার গ্রাহ্য ও সর্ববিষয়ে প্রকাশক্ষম। কমা, সেমিকোলন ইত্যাদি ছেদচিহ্নের সাহায্যে বিদ্যাসাগর ভাষার গতির মধ্যে অনতিলক্ষ্য ছন্দস্রোত সৃষ্টি করেন। ফলে ভাষা হিসেবে বাংলা সর্বসাধারণের উপযোগী হয়ে উঠে।
‘ব্রজবিলাস’, ‘রত্নপরীক্ষা’ ও অন্যান্য বেনামি রচনার ভাষাও কথ্য ভাষারীতির মতো হালকা রূপ ফুটে উঠেছে। এ ধরনের ভাষায় এমন একটি রসিকতা ও ব্যঙ্গবিদ্রূপের প্রখরতা বিদ্যমান যা বিদ্যাসাগরকে আমাদের কাছের মানুষ করে তুলেছে। এগুলোতে যুক্তির ধার যেমন তীক্ষ্ণ, তেমনি পরিহাসের তীব্রতাও উপভোগ্য। সাহিত্যের ভাষা হিসেবে সরল ও সহজরীতির ভাষাও গৃহীত হতে পারে- এসব রচনা তারই প্রমাণ। ‘আবার অতি অল্প হইল’ গ্রন্থের ভাষা:
“খুড়কে কত লোকে কত গালি দেয়, কত উপহাস, কত তিরস্কার করে। তাতে খুড়র মনে বিকার মাত্র জন্মে না; কিন্তু আমি তার জন্য পরিহাসচ্ছলে, দুই একটি উপদেশ দিয়াছিলাম, খুড়র তাহা নিতান্ত অসহ্য হইয়াছে।”
বাংলাভাষার মাধ্যমে সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার দায়িত্ব গ্রহণ করে উপযুক্ত পাঠ্যপুস্তক রচনার প্রয়োজন তিনি অনুভব করেন। এটাই তাঁর বাংলাভাষাচর্চার মুখ্য প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু পূর্ববর্তীকালের পাঠ্যপুস্তক রচয়িতার রচনার সঙ্গে বিদ্যাসাগরের মৌলিক পার্থক্য আছে। প্রথমত তিনি রচনার বিষয়বস্তু আহরণ করেছেন সংস্কৃত ও ইংরেজি সাহিত্যের চিরায়ত গ্রন্থ থেকে ও তত্ত্বের পরিবর্তে উচ্চতর সাহিত্যরস পরিবেশনই তাঁর উদ্দেশ্য। দ্বিতীয়ত, তিনি সংগৃহীত বিষয়বস্তু স্বাধীনভাবে, নিজের কল্পনাশক্তির মাধ্যমে পুনর্গঠিত করে নিজস্ব ভঙ্গিতে পরিবেশন করেছেন। তাই তাঁর কোনো রচনাকেই ঠিক অনুবাদ বলা চলে না। ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’, শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অব এরর্স্’ অবলম্বনে রচিত ‘ভ্রান্তিবিলাস’ ইত্যাদি রচনাকে মৌলিক সৃষ্টি বলাই সঙ্গত। কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম্’ নাটক অবলম্বনে রচিত বিদ্যাসাগরের শকুন্তলার এই উদ্ধৃত অংশে নারী চরিত্রগুলোর কথোপকথনের প্রাণবন্ত চলিত ভাষাশ্রয়ী বাভঙ্গি, সখীদের হাস্যপরিহাস এবং তাদের পারস্পরিক প্রীতির সম্পর্ক অপূর্ব মাধুর্য ও স্নিগ্ধ সৌন্দর্যে প্রকাশিত হয়েছে।
“উভয়ের এইরূপ কথোপকথন হইতেছে, ইত্যবসরে প্রিয়ংবদা হাস্যমুখে অনসূয়াকে কহিলেন, অনুসূয়ে! কি জন্য শকুন্তলা সৰ্ব্বদাই বনতোষিণীকে উৎসুক নয়নে নিরীক্ষণ করে জান? অনুসূয়া কহিলেন, না সখি! জানি না; কি বল দেখি। প্রিয়ংবদা কহিলেন এই মনে করিয়া যে, বনতোষিণী যেমন সহকারের সহিত সমাগতা হইয়াছে, আমিও যেন সেইরূপ আপন অনুরূপ রস পাই। শকুন্তলা কহিলেন, এটি তোমার আপনার মনের কথা।”
অতএব, উপর্যুক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে বলা যায় যে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই বাংলা গদ্যের যথার্থ শিল্পী। কারণ, বাংলা গদ্যের যা কিছু গুণ, অর্থব্যক্তি, প্রসাদগুণ, ওজস্বিতা, গাঢ়বদ্ধতা, কোমলতা, মাধুর্যতা, ভাবানুসারে বাক্যের ব্যবহার গদ্যের অন্তর্নিহিত ছন্দ প্রভৃতি তাঁর রচনায় দৃষ্ট হয়। শুধু ‘শকুন্তলা’ সীতার বনবাস, বেতালপঞ্চবিংশতি, ভ্রান্তিবিলাস গ্রন্থই নয় সামাজিক সমস্যামূলক রচনা, প্রশ্নোত্তর বিষয়ক প্রভৃতি রচনাতে তাঁর পরিচয় ফুটে উঠেছে। তাই বলা যায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরই বাংলা গদ্যের একটি রাজপথ তৈরি করে দিয়েছিলেন, সে পথে পরবর্তীকালে বহুতর পদাতিকের আগমন হয়েছে। বাংলা পরিণত গদ্যরীতির উন্নয়নে তার প্রভাব অনস্বীকার্য। কেবল সৃষ্টিক্ষমতা নয়, সেই সঙ্গে তার সহজাত শিল্প প্রতিভার সংযোগ সাধন হয়েছিল বলেই বিদ্যাসাগরের পক্ষে বাংলা গদ্যের জনক ও সার্থক শিল্পী হওয়া সম্ভবপর হয়েছিল।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment