বাংলা গদ্যের উদ্ভব-ইতিহাস যেমন গতিশীল তেমনি চমকপ্রদ। এই গদ্য প্রয়োজন উদ্ভূত। এই প্রয়োজনের রূপটি বিভিন্ন রাজকার্য বাণিজ্যিক ধর্মীয় শাসনতান্ত্রিক ইত্যাদি। রচনা বা লেখার প্রাথমিক প্রয়াসও ছিল বহু ধর্ম, দেশী ও বিদেশী ভাষাভাষী বহু মন নির্ভর। স্বভাবতই বাংলা গদ্য কোন একজন ব্যক্তি বা বিশেষ কোন গোষ্ঠী উদ্যোগে গড়ে উঠেনি। এমনকি, সুবিশাল সংস্কৃত সাহিত্যের গদ্য-রচনা উজ্জ্বল ঐতিহ্য থেকেও সে ছিল দূরে, পাণ্ডিত্যের অনুভব-স্পর্শ থেকে বঞ্চিত। সে অর্থে বাংলা গদ্য সম্পূর্ণভাবে স্বয়ংজাত। তার ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলিকে সূত্রাকারে এইভাবে নিদের্শ করা যায় যেমন

(ক) রাজকার্য-ধর্মীয় বাণিজ্যিক প্রয়োজন লেখা চিঠিপত্র অনুশাসন ও দলিল-দস্তাবেজের গদ্য : এই ধরনের প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির মধ্যে উল্লেখ করা যায়, ১৫৫৫ খ্রীস্টাব্দে লেখা কোচবিহাররাজ নরনারায়ণ দেবের অহোমরাজকে লেখা পত্র (২০) লাইনের চিঠি)। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, গবেষক শেখর তুঙ্গ বাংলার বাইরে বাংলা গদ্যের চর্চা : ষোড়শ-অষ্টাদশ শতক’ (দ্রষ্টব্যঃ কলকাতা, ১৯৮৫, পৃষ্ঠা ৪৮-৫১) নিবন্ধে জানিয়েছেন, ১৫৭৬ খ্রীস্টাব্দে লেখা কাছাড়ের রাজা মেঘনারায়ণের মাইবং অনুশাসন দুটি বাংলা গদ্যে লেখা হয়েছিল—“রাজকীয় পত্র ছাড়াও ষোড়শ শতকের পূর্ব ভারতবর্ষে আর একটি দিকে বাংলা গদ্যের নিঃসংশয় প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। এটি অনুশাসন।……1576 অব্দে লিখিত জনৈক মেঘনারায়ণ দেব হাচেঙ্গ সা কর্তৃক এই অনুশাসন উত্তর কাছাড় জেলার মাইবং নামক স্থানে উৎকীর্ণিত হয়। মেঘনারায়ণ ছিলেন একজন কাছাড়ী রাজা।….অনুশাসনটি আসলে একটি নয়, দুটি; অথবা বলা যেতে পারে এটি একই অনুশাসনের দুই সংস্করণ।…কাছাড়ীরা যথেষ্ট প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা ভাষার চর্চা করে আসছে।..এই অনুশাসনটি যে বাংলা গদ্যের একটি অতি মূল্যবান দলিল ও সম্ভবত সবচেয়ে সন্দেহাতীত প্রাচীন রচনা সে বিষয়েও কোনো সন্দেহ নেই।” এছাড়াও আছে ১৭৩১ খ্রীস্টাব্দে (১১৩৮ বঙ্গাব্দ) লেখা গৌড়ীয় মহান্তগণের ‘ইস্তফাপত্র’ ও জয়পুরে প্রেরিত সভাপণ্ডিত কৃষ্ণদেব ভট্টাচার্যের ‘অজয়পত্র’ শ্রীরাধার স্বকীয়া-পরকীয়া তত্ত্ব বিচার-সংক্রান্ত দলিল, ১৭৫৫ খ্রীস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেশীয় ভাষায় শহরের বাজারে পণ্য-সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রদান ইত্যাদি।

(খ) ধর্মীয় প্রয়োজনে লেখা ‘কড়চা’ ও নিবন্ধ ও কাব্যের গদ্য : সপ্তদশ শতকে লেখা ‘কড়চা’ জাতীয় প্রশ্নোত্তরময় ছোট ছোট নিবন্ধে বৈষ্ণব সহজিয়াদের ধর্মীয় অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটে; যেমন নরোত্তমদাসের ‘দেহকড়চা’ চণ্ডীদাসের নামে প্রচারিত ‘চৈতন্যরূপ প্রাপ্তি’, রামাঞির ‘শূন্যপুরাণের’ বারোমাসী অংশ, রূপ গোস্বামীর নামে প্রচারিত ‘কারিকা’, ‘স্বরোদয়’ নামক জ্যোতিষ গ্রন্থ ইত্যাদি। এছাড়া অষ্টাদশ শতাব্দীতে লেখা ‘ভাষা পরিচ্ছেদে’র (১৭৭৪-৭৫ খ্রীস্টাব্দে) অনুবাদ, রামেশ্বর ভট্টাচার্যের ‘শিবায়ন’ কাব্যের কোন কোন স্থলে গদ্যের প্রাচীনতম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

(গ) আখ্যান-উপাখ্যান গদ্য : সপ্তদশ শতকের শেষভাগে ‘গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস’-বিষয়ক নাটকে নেপালের নেওয়ারী ভাষা প্রভাবিত বাংলা গদ্যের নিদর্শন দেখা গেছে। এছাড়া, ১৭২৭ খ্রীস্টাব্দে লেখা ‘মহারাজা বিক্রমাদিত্য চরিত্র’ নামে একটি গদ্যাংশের নমুনা ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে সংগ্রহ করে ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এর প্রতিলিপি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ পত্রিকার ২৯ খণ্ডে প্রকাশ করেছেন।

(ঘ) ধর্মপ্রচার এবং শাসনকার্যের প্রয়োজনে লেখা ইউরোপীয়দের গদ্য রচনা : ১৭৪৩ খ্রীস্টাব্দে মুদ্রিত রোমান হরফে লেখা ম্যানুয়েল দা আস্সুপসাউ এবং দোম আস্তেনিওর লেখা যথাক্রমে ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থ, ভেদ’, ‘বাঙ্গালা পোর্তুগীস শব্দকোষ’, ‘ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক সংবাদ’, ফাদার দোমিনিক দে সুজার খ্রীস্টধর্ম বিষয়ক সংলাপিকা, ফ্রান্সিস ফের্নান্দেস এবং ফাদার বার্বিয়েরের ‘কড়চা’ জাতীয় রচনা (১৭২৩ খ্রীস্টাব্দের কাছাকাছি এটি রচিত বলে Dr. S. K. De ‘History of Bengali Literature in the 19th Century, Calcutta, pp. 66-68, গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন)।

এছাড়া আছে শাসনকার্য-বিষয়ক কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থ যেমন নাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেডের ফার্সী থেকে অনুবাদগ্রন্থ ‘বিবাদার্ণবসেতু’, ‘A Grammar of the Bengali Language (1778), জোনাথান ডানকানের ইম্পে কোড-এর অনুবাদ (১৭৮৫ খ্রীঃ), বেঞ্জামিন এডমনস্টোনের ফৌজদারী দণ্ডবিধির অনুবাদ (১৭৯০ খ্রীঃ ও ১৭৯২ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত) হেনরি পিস্‌ ফর্স্টরের কর্নোয়ালিশ-কোডের (১৭৯৩ খ্রীঃ) অনুবাদ গ্রন্থ প্রভৃতি।

এই পর্যায়ে আছে, শ্রীরামপুর মিশন এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কর্ণধার উইলিয়াম কেরীর বিভিন্ন গ্রন্থরচনা ও পত্রিকা সম্পাদনা (এ সম্পর্কে সুবিস্তৃত বিবরণ পরে দেওয়া হয়েছে)।

(ঙ) সমাজচিত্র, সমাজ-সমালোচনা বা নক্সা জাতীয় রচনা: ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে খ্রীস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা হলেও সমাজচিত্রমূলক ‘উপাখ্যান হ্যানা ক্যাথেরীন ম্যুলেন্সের ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ (১৮৫২ খ্রীঃ; গ্রন্থটি ইংরাজী’ আখ্যান ‘The Week’-এর রূপান্তর) বিদেশিনী লেখিকার রচনারূপে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া টেকচঁাদ ঠাকুরের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ (১৮৫৮ খ্রীঃ), এবং কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাচার নক্সা’ (দুভাগ একত্রে ১৮৬৪ খ্ৰীঃ) ইত্যাদি গ্রন্থগুলি যেমন সমকালের সার্থক সমাজ-সমালোচনা, তেমনি বাংলা গদ্যের ‘সাধু’ ও ‘চলিত’ রূপটির বিকাশ ও বিবর্তনের রূপরেখাও বটে।

(চ) উপন্যাস-রম্যরচনা-প্রবন্ধ লেখার প্রয়োজনে গদ্য-ব্যবহার : এই ধারায় মুদ্রিত গ্রন্থের সংখ্যাই সর্বাধিক। বলা বাহুল্য, এর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ আলোচনা-সূত্রেই প্রকাশ পাবে। তবে এইটুকু বলা চলে যে, বঙ্কিমচন্দ্র থেকে আধুনিক কালের লেখকেরা পর্যন্ত সকলেই এই ধারার অন্তর্ভুক্ত। এই ধারার গদ্যরচনার প্রকৃতি ও আঙ্গিক বৈচিত্র্যময়, বিচিত্র রীতি-নির্ভর এবং নান্দনিক কলা-কৌশল প্রয়োগে সমৃদ্ধ।