ভূমিকা: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের [১৮২০-১৮৯১] হাতে বাংলা গদ্যভাষায় রূপের আবির্ভাব হয়েছিল এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় [১৮৩৮-৯৪] এর হাতে তাঁর যৌবনশ্রী ফুটে উঠেছিল। বিদ্যাসাগরীয় গদ্যরীতি-ভিত্তিভূমির উপর গড়ে উঠলো বঞ্চিমি গদ্যরীতি। তাঁর প্রথম লক্ষ্য গদ্যের ভারসাম্য অর্জন, শেষ লক্ষ্য- সরলতা ও স্পষ্টতা অর্জন। দুয়ে মিলে বক্তিমি ভাষারীতির পূর্ণতা। প্রথম লক্ষ্যে বিদ্যাসাগর প্রায় উপনীত হয়েছিলেন। সেখান থেকে যাত্রা করে শেষ লক্ষ্যে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপনীত হলেন শিল্পী-ব্যক্তিত্বের প্রয়োগে। দেখা গেল বাংলা গদ্যের প্রথম সার্থক স্টাইল, আসলে তা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ব্যক্তিত্বের ভাষারূপ। শব্দ, ক্রিয়াপদ, বিশেষণ, অলংকার ও অনুচ্ছেদ ব্যবহারে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর নিজস্বতা তাঁর চল্লিশ বছরের সাহিত্য সাধনায় বিচিত্ররূপে প্রকাশিত হয়ে বাংলা গদ্যকে সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য দিল।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর গদ্য আলোচনায় দুটি কথা সর্বদা স্মরণযোগ্য:
এক: বঞ্চিমি ভাষারীতির আদর্শ- সরলতা ও স্পষ্টতা।
দুই: তিনি বঙ্গদর্শনে উপন্যাস ও প্রবন্ধ একই সঙ্গে রচনা করেছিলেন; উভয়ের গদ্য মূলত একই।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের গদ্যে শব্দচয়নে উদারতা ও পরিমিতিবোধ যেমন লক্ষ করা যায়, তেমনই শব্দমোহ ও শ্রুতিমাধুর্যের বিপদ থেকে আত্মরক্ষাপ্রবণতাও অনায়াস লক্ষণীয়। দুরুচ্চার্য শব্দ, বৃথা অনুপ্রাস, অস্পষ্টতা ও অর্থাভাস বঙ্কিমচত্র চট্টোপাধ্যায় বর্জন করেছিলেন। বঙ্কিমি গদ্যে প্রশ্নাত্মক বাক্য ব্যবহারের দ্বারা পাঠকের ঔৎসুক্য ও সংশয় জাগ্রত রাখার কৌশল প্রায়শ লক্ষ করা যায়। সংযোজক অসমাপিকা ক্রিয়াপদের সংখ্যা হ্রাস ও সমাপিকা ক্রিয়াপদের অধিক ব্যবহারের দ্বারা বাক্যে এসেছে দ্রুততা। অন্তরঙ্গ বর্ণনাভঙ্গির দ্বারা পাঠকের সঙ্গে ব্যক্তি সম্পর্ক স্থাপন ও নাটকীয় আকস্মিকতা দ্বারা পাঠক মনকে সচকিত করা বঙ্কিমি রীতির দুটি প্রধান লক্ষণ। “বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন” প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র ভাষার এইসব বৈশিষ্ট্যের প্রতি নবীন লেখকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসে ব্যবহার করলেন, তাকে বলা যায় বর্ণনাধর্মী স্টাইল। সেদিন এটাই উপন্যাসে প্রধান অবলম্বন ছিল, কারণ চরিত্রের মনোবিশ্লেষণ সে-কালীন উপন্যাসে দেখা দেয়নি। রূপ বর্ণনা, নাটকীয় আকস্মিকতা, কৌতুক সৃষ্টি, সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর ও অন্তরঙ্গ সম্ভাষণের সাহায্যে মনোবিশ্লেষণের দায়িত্ব নির্বাহ করতে হতো। ফলে বষ্টিমি উপন্যাসে গতিবেগ, বর্ণাঢ্যতা ও নাটকীয়তা অনায়াসলক্ষণীয়।
প্রবন্ধ-গদ্যে ফরাসি এনসাইক্লোপীডিস্টদের উত্তরাধিকারী অষ্টাদশ শতকীয় ইংরেজি চিন্তামূলক গদ্য সাহিত্যের বক্তব্যসর্বস্বতা অনুসৃত হয়েছিল। তাঁর ফলে প্রবন্ধ-গদ্যে এসেছিল নৈর্ব্যক্তিকতা যুক্তিধর্মিতা, তত্ত্বপ্রতিপাদনের নিষ্ঠা ও দায়িত্ব। গদ্যরীতিতে দেখা গিয়েছিল বক্তব্য বিন্যাসকারী নিটোল অনুচ্ছেদ নির্মাণে ঝোঁক, শব্দের ব্যবহারে পরিমিতিবোধ ও নিশ্চয়াত্মক বাক্যের প্রয়োগ।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর ভাষারীতি অপরিবর্তনীয় নয়। প্রথম স্তরের (প্রাক-বঙ্গদর্শন যুগের) সংস্কৃতনির্ভর গদ্য অতিরিক্ত গুরুগাম্ভীর্য পরিহার করে দ্বিতীয় স্তরে (বঙ্গদর্শন যুগে) ক্রমশ সহজ সরল সাবলীল দেশি গদ্যে পরিণত হয়েছে। বিদ্যাসাগরী গদ্যরীতি থেকেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর যাত্রা শুরু হয়। ‘দুর্গেশনন্দিনী’, ‘কপালকুণ্ডলা’, ‘মৃণালিনী’, বিদ্যাসাগরী রীতিতে লিখিত। বঙ্গদর্শনের যুগের আরম্ভে ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে বঙ্কিমের নিজস্ব রীতি আত্মপ্রতিষ্ঠ হয়েছে। প্রথম তিনটি উপন্যাসে তৎসম শব্দের বহুল ব্যবহার, সমাসের আড়ম্বর, সংস্কৃতরীতি অনুযায়ী পদবিন্যাস ও বাক্যগঠন, বিশেষণ পদে স্ত্রী প্রত্যয়ের আধিক্য অনায়াসলক্ষণীয়। ‘বিষবৃক্ষ’, ‘চন্দ্রশেখর’, ‘রজনী’ উপন্যাসে এবং শেষের দিকের ‘সীতারাম’ উপন্যাসে বিদ্যাসাগরীয় রীতির উদাহরণ বিরল নয়। ‘চন্দ্রশেখর’, ‘রজনী’ ও ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাস এবং ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ লিখিত হয়েছে বঙ্কিমের সাহিত্য জীবনের মধ্য বিন্দুতে (১২৮০-৮২ বঙ্গাব্দে)। এখানে বঙ্কিমের কথাগদ্যের স্টাইল পূর্ণপ্রতিষ্ঠ। ‘আনন্দ মঠ’ (১৮৮২), ‘দেবীচৌধুরাণী’ (১৮৮৩), ‘সীতারাম’ (১৮৮৬০), ‘ইন্দিরা’ ও ‘রাজসিংহ’ উপন্যাসে বঙ্কিমের কথা-গদ্যের স্টাইল শিল্পসাফল্যের চরম শিখরে উন্নীত হয়েছে।
শব্দ-সম্ভার, ক্রিয়াপদ, বিশেষণ, স্ত্রীপ্রত্যয় ও অর্থালঙ্কার ব্যবহার এবং অনুচ্ছেদ রচনায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কৃতিত্ব তাঁর উপন্যাস থেকে আমরা বিচার করতে পারি। উপন্যাসে নায়িকারূপ বর্ণনা থেকে তাঁর গদ্যরীতির বিকাশ ও অগ্রগতি লক্ষ করা সম্ভব বলে মনে হয়। যেমন-
“সেই গম্ভীরনাদিবারিধি তীরে, সৈকতভূমে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে দাঁড়াইয়া অপূর্ব্ব রমণী-মূর্তি! কেশভার-অবেণীসংবদ্ধ, সংসর্পিত, রাশীকৃত আগুল্ল্ফ-লম্বিত কেশভার; তদগ্রে দেহরত্নঃ যেন চিত্রপটের উপর চিত্র দেখা যাইতেছে। অলকাবলীর প্রাচুর্য্যে মুখমণ্ডল সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ হইতেছিল না- তথাপি মেঘবিচ্ছেদনিঃসৃত চন্দ্ররশ্মির ন্যায় প্রতীত হইতেছিল। বিশাল লোচনে কটাক্ষ, অতি স্থির, অতিস্নিগ্ধ, অতি গম্ভীর অথচ জ্যোর্তিময়; সে কটাক্ষ, এই সাগরহৃদয়ে ক্রীড়াশীল চন্দ্রকিরণলেখার ন্যায় স্নিগ্ধোজ্জ্বল দীপ্তি পাইতেছিল। কেশরাশিতে স্কন্ধদেশ ও বাহুযুগল আচ্ছন্ন করিয়াছিল। স্কন্ধদেশ একেবারে অদৃশ্য; বাহুযুগলের বিমল শ্রী কিছু কিছু দেখা যাইতেছিল। রমণীদেহ একেবারে নিরাভরণ। মূর্ত্তিমধ্যে যে একটি মোহিনী শক্তি ছিল, তাহা বর্ণিতে পারা যায় না। অর্দ্ধচন্দ্রনিঃসৃত কৌমুদীবর্ণ; গনকৃষ্ণ চিকুরজাল; পরস্পরের সান্নিধ্যে কি বর্ণ, কি চিকুর, উভয়েরই যে শ্রী বিকশিত হইতেছিল, তাহা সেই গম্ভীরনাদী সাগরকূলে, সন্ধ্যালোকে না দেখিলে, তাহার মোহিনী শক্তি অনুভূত হয় না।” (কপালকুণ্ডলা: ১৮৬৬)
প্রাক্-বঙ্গদর্শন যুগের এই উদাহরণটিতে বঙ্কিমী স্টাইলের প্রথম যুগের পরিচয় ব্যক্ত হয়েছে। অন্তরঙ্গ পাঠক সম্ভাষণ, নিশ্চয়াত্মক বাক্যের পরিবর্তে প্রশ্নাত্মক বাক্যের ব্যবহারে চমক সৃষ্টি, সমাপিকা ক্রিয়াপদের আধিক্য, অসমাপিকা ক্রিয়াপদের সংখ্যাহাস; যতিচিহ্নের পর্যাপ্ত ব্যবহারের দ্বারা হ্রস্ব বাক্যগুলোর সংস্থাপন অনায়াসলক্ষণীয়। এগুলো বঙ্কিমের নিজস্বতা। আর বিদ্যাসাগরী প্রভাব লক্ষ করা যায় এসব ক্ষেত্রে- তৎসম শব্দ ও দীর্ঘ সমাসের বহুল ব্যবহারে, নামধাতু ও সংস্কৃত সন্ধির ব্যবহারে, বিশেষণে স্ত্রী প্রত্যয়ের প্রয়োগে ও বিশেষণীয় বিশেষণের ব্যবহারে।
উপমা ব্যবহারে, চিত্র নির্মাণে লেখকের স্বাতন্ত্র্য এখানে প্রকট হয়েছে। এখানে শব্দ বা উপমার আড়ম্বর নেই, সংস্কৃত রূপ বর্ণনার ঐতিহ্যানুসৃতি নেই, নারী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কোনো বর্ণনাই নেই। কুন্দ চরিত্রের আত্মবিস্মৃত সারল্য ও সর্বাঙ্গীন শান্ত ভাব প্রকাশের জন্য লেখক কুন্দর বৃহৎ নীল চক্ষু দুটির উপর সন্ধানী আলো ফেলেছেন। এই রূপ বর্ণনায় ব্যবহৃত উপমাগুলো শরীরী রূপ বর্জন করে অশরীরী ভাবকে ফুটিয়ে তুলেছে। এই গদ্য ভাষার প্রবাহও শান্ত, নিস্তরঙ্গ। বাক্যের দৈর্ঘ্য কমেছে। বিশেষণ সরল হয়েছে- কুন্দর চক্ষু দুটি ‘বৃহৎ’ ও ‘নীল’ মাত্র। সরোবর ‘স্বচ্ছ’, চন্দ্র ‘শরচ্চন্দ্র’ মাত্র। ‘চক্ষু’ ও চোখ- দুটি শব্দই ব্যবহৃত। কুন্দের সরলতা বর্ণনাকারী এই গদ্যের প্রধান গুণ-সরলতা। সরলতাই গদ্যশিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর অন্বিষ্ট।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কথাগদ্যের স্টাইল এখানে পূর্ণবিকশিত। তাঁর নিজস্বতা-লক্ষণগুলো এখানে প্রকাশিত। কৌতুক, তারল্য, সাবলীলতা, লঘুতা, দ্রুতগতি, নাট্যধর্মিতা ও চলমানতা এই গদ্যকে বিশিষ্টতা দিয়েছে। বিশ্লেষণে বিশেষণে কৌতুকে তারল্যে উচ্ছ্বলিত এই স্টাইল। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উদ্দেশ্য সাধনে সম্পূর্ণ সহায়করূপে দেখা দিয়েছেন গদ্যশিল্পী বঙ্কিম। রোহিণীর রূপের প্রধান কথা তার লীলাচঞ্চল গতিচ্ছন্দ। এই গতিচ্ছন্দ ভাষায় তরঙ্গিত হয়েছে। রোহিণীর অঙ্গসৌষ্ঠবকে ঘিরে আছে সাবলীলতা ও লঘুতা।
‘কৃষ্ণকান্তের উইলে’র কথা-গদ্য বদ্ধিমী স্টাইলের পূর্ণতা লাভ করেছে। তার প্রমাণ এখানেই পাই। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর গদ্যভাষা কী অভ্রান্ত শিল্পজ্ঞানের সঙ্গে সরল (তত্ত্বব) ও গুরুগম্ভীর (তৎসম) শব্দাবলির সমন্বয়-সাধন করতে পারে, তার প্রমাণ এই রোহিণীরূপবর্ণনা। যেমন-
“অধরে পানের রাগ, ফিতেপেড়ে-ধুতিপড়া আর কাঁধের উপর”-লিখতে লিখতে বঙ্কিমের অবদমিত কবি-প্রতিভা জেগে উঠল এবং তিনি বাক্যটি শেষ করলেন অসাধারণ শব্দাড়ম্বর ও ধ্বনিগাম্ভীর্যের মধ্যে- “চারুবিনিৰ্ম্মিতা, কালভুজঙ্গিনীতুল্যা, কুণ্ডলীকৃতা, লোলায়মানা, মনে-মোহিনী কবরী”। বঙ্কিম-প্রতিভা এখানে আমাদের সমস্ত হিসাবকে বিপর্যস্ত করে এক অসাধারণ শিল্পগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বঙ্গ-দর্শন পর্বে বঙ্কিমের কথা-গদ্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কমলাকান্তের দপ্তর। উপন্যাসের নায়িকারূপবর্ণনা থেকে উদ্ধৃত অংশে আসি দেশমাতৃকারূপবর্ণনায়। বিদ্যাসাগরী রীতিকে আশ্রয় করেই এই গদ্য রীতির উদ্ভব; এখানে বঙ্কিম-প্রতিভার স্বাক্ষর মুদ্রিত হয়েছে। ভাষায় এসেছে কাব্যগুণ ও বেগ, গাম্ভীর্য ও ধ্বনিরোল, অনুভূতি ও ব্যঞ্জনা। সবটা মিলিয়ে লেখক- ব্যক্তিত্বের দ্বারা চিহ্নিত হয়েছে। তৎসম শব্দ ও পূর্ণ ক্রিয়াপদ ব্যবহারে বঙ্কিমের নৈপুণ্য এখানে স্বপ্রকাশ।
বঙ্কিমের কথা গদ্যের শেষ পর্বের বঙ্গদর্শন-পরবর্তী পর্বের-কালসীমা দশ বছর (১৮৮২-৯৩) এই পর্বের উপন্যাস: ‘আনন্দ মঠ’ (১৮৮২), ‘দেবীচৌধুরাণী’ (১৮৮৩-৮৪), ‘সীতারাম’ (১৮৮৬-৮৭), ‘ইন্দিরা’ ‘রাজসিংহ’। কথা গদ্যের স্টাইল এখানে শিল্পসাফল্যের শীর্ষবিন্দুকে স্পর্শ করেছে। ত্রয়ী-উপন্যাসে রচনাভঙ্গিতে কিছু কিছু শৈথিল্য চোখে পড়ে, কিন্তু সংশোধিত ‘ইন্দিরা’ ও ‘রাজসিংহ’ নিখুঁত। এই পর্বে নায়িকারূপ বর্ণনা সংক্ষিপ্ত সংহত, সরল, স্পষ্ট। লেখকের ইচ্ছায় তাতে দেখা গেছে উপযুক্ত ভাব গাম্ভীর্য বা প্রয়োজনীয় কৌতুকতারল্য। ভাষা এখানে লেখকের আজ্ঞাবাহী দাসী। সরলতা ও স্পষ্টতা বজায় রেখেই তা সৌন্দর্য সৃজন করেছে। হ্রস্ব ক্রিয়াপদের ব্যবহার বেড়েছে, বিশেষণের ব্যবহার কমেছে, রূপ বর্ণনার দৈর্ঘ্য কমেছে, কাব্যগুণের স্থান দখল করেছে নাট্যগুণ। যেমন-
“জ্যোৎস্নার চিকিমিকি-ঝিকিমিকি-শুভ্র বসনের মাঝে মাঝে তেমনই হীরা, মুক্তা, মতির চিকিমিক। আবার নদীর যেমন তীরবর্তী বনচ্ছায়া, ইহারও তেমনি অন্ধকার কেশরাশি আলুলায়িত হইয়া অঙ্গের উপর পড়িয়াছে; কোঁকড়াইয়া ঘুরিয়া ঘুরিয়া, ফিরিয়া ফিরিয়া, গোছায় গোছায় কেশ পৃষ্ঠে, অংসে, বাহুতে, বক্ষে পড়িয়াছে; তার মসৃণ কোমল প্রভার উপর চাঁদের আলো খেলা করিতেছে; তাহার সুগন্ধি-চূর্ণ-গন্ধে গগন পরিপূরিত হইয়াছে, একছড়া ভূঁইফুলের গোড়ে সেই কেশরাজি সংবেষ্টন করিতেছে।” (দেবীচৌধুরাণী ১৮৮৪)
তদ্ভব শব্দ ও অনুকার শব্দের ব্যবহার, অসমাপিকা ক্রিয়াপদের পৌনঃপুনিক ব্যবহার, দেশি ইডিয়মের ব্যবহার এখানে সহজেই চোখে পড়ে। দেবী চৌধুরাণীর রূপকে উদ্বেলিত নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই রূপ পরিকল্পনায় সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় আছে। নদীর উদ্বেলতা যেন যেমন তটে সংযত এখানে তৎসম প্রধান ধ্বনিরোল সমন্বিত অলংকৃত ভাষাপ্রবাহ তেমনি বাক্যবিন্যাসতটে সংযত। এই ইমেজের স্বাতন্ত্র্য এই যে, চঞ্চল লাবণ্যপ্রবাহের মধ্যে লাবণ্যময়ীর নির্বিকারতা দেখানো হয়েছে। দেবীর সৌন্দর্যের বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত হয়েছে নদীর সঙ্গে সমধর্মিতায় ও জ্যোৎস্নালোকে নদী জলের মতো তার অঙ্গ-বিন্যস্ত অলংকারের মুহুর্মুহু দীপ্তি-বিচ্ছুরণে। এই দীপ্তি বিচ্ছুরণের বর্ণনায় লেখক অনুকার শব্দ সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন; নদীজলের চিকিমিকি, রত্নালংকারের চিকিমিকি; জলে জ্যোৎস্নায় ঝিকিমিকি, রত্নালংকারের ঝিকিমিকি। সমস্তটা মিলে আছে নাটকীয়তা; এই গুণেই বর্ণনা প্রত্যক্ষ, জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
সুতরাং বলা যায় যে, গদ্যশিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কেবল ভাষাপথিক নয়, পথিকৃৎ। কথা-গদ্য ও প্রবন্ধ-গদ্যের বিচিত্ররূপ ও ঐশ্বর্য তাঁর নিপুণ লেখনীতে উৎসারিত হয়ে বাংলা গদ্যভাষাকে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে দিয়েছে। বিদ্যাসাগরের হাত থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে যে গদ্যভাষা তিনি পেয়েছিলেন, তাতে তিনি ব্যক্তিত্ব সঞ্চার করে যৌবনশ্রী দান করেছিলেন। এ কারণেই গদ্যশিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাঙালি ও বাংলা ভাষার চিরনমস্য।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment