এই প্রসঙ্গে প্রথম অধ্যায়ের ‘প্যারীচাঁদ মিত্রের রচনার মূল্য-বিচার’ সম্পর্কিত প্রবন্ধটিও দ্রষ্টব্য ও আলােচ্য।

প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল’ প্রকাশের পূর্বে বা সমকালে যে সব কাহিনী বাঙলা গদ্যে রচিত হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই অনুবাদাশ্রয়ী, রােমান্স উপাখ্যান কিংবা উপকথামূলক। ‘আরব্য উপন্যাস’, ‘হাতেমতাই’, ‘লায়লা মজনু’, ‘চাহার-দরবেশ’, ‘গােলে-বকাওলি’ প্রভৃতি নিম্নমানের কাহিনীগুলি সাধারণ পাঠকদের গল্পতৃষ্ণাকে তৃপ্ত করত। এই সমস্ত রচনা ইংরেজি প্রভাবসঞ্জাত আধুনিক সাহিত্যরুচি ও রসবােধের সংস্পর্শবর্জিত। বিদ্যাসাগরের ‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’, তারাশঙ্কর তর্করত্নের ‘কাদম্বরী’ (১৮৫৪) সংস্কৃত সাহিত্যের অনুকরণে রচিত। তারাশংকরের আর একটি আখ্যায়িকা ‘রাসেলাস’ (১৮৫৭) ইংরেজির অনুবাদ। হ্যানা ক্যাথারিন ম্যালেন্স-এর ‘করুণা ও ফুলমণির বিবরণে’ (১৮৫২) উপন্যাসের কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু খ্রীষ্টধর্মের মাহাত্ম্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকে সর্বগ্রাসী প্রাধান্য দেওয়ার ফলে রচনাটির সমস্ত উপন্যাসােচিত গুণ গৌণ হয়ে গেছে। তাছাড়া ‘করুণা ও ফুলমণির বিবরণ’ বাঙলা উপন্যাসের ঐতিহ্যে কোনও প্রভাবই ফেলেনি।

ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নববাবুবিলাসে’র (১৮২৩ খ্রীঃ) ব্যঙ্গবিদ্রুপাত্মক সামাজিক নকশায়ই বাঙলা উপন্যাসের আবির্ভাবের পটভূমি প্রস্তুত হয়েছিল। প্যারীচাঁদ মিত্র তাঁর বন্ধু রাধানাথ শিকদারের সহযােগিতায় বিশেষভাবে নারীসমাজের শিক্ষার জন্য ১৮৫৪ খ্রীষ্টাব্দে ‘মাসিক পত্রিকা’ প্রকাশ করেছিলেন। তারা কথ্যভাষার রীতিতে বাক্য রচনা, প্রচুর তদ্ভব ও চলিত ফারসী শব্দের ব্যবহারে গদ্যভাষার দুঃসাহসিক পরীক্ষার উদাহরণ স্থাপন করলেন।

‘আলালের ঘরের দুলালে’র কিছু অংশ প্রথমে ‘মাসিক পত্রিকায়’ই প্রকাশিত হয়েছিল, পরে ১৮৫৮ খ্রীষ্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। প্যারীচাদ অন্যান্য রচনার মত এই রচনাটিও ‘টেকচাঁদ ঠাকুরে’র ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল। ধনী বিষয়ী বাবুরামবাবুর পুত্র মতিলাল কুসঙ্গে পড়ে এবং শিক্ষা বিষয়ে পিতার অবহেলার জন্য অধঃপাতে যায়। পিতার মৃত্যুর পর সে বিষয়-সম্পত্তির অধিকারী হয়, কিন্তু উচ্ছলতায় সমস্তই নষ্ট করে। তারপর দুঃখে পড়ে তার হৃদয়-মন পরিবর্তিত হয়, সততা ও ধর্মনিষ্ঠার মূল্য বােঝে, ‘আলালের ঘরের দুলালে’র মূল কাহিনী এই। উপন্যাসে সে যুগের সামাজিক পরিবেশ বাস্তব ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। তবে উপন্যাসে কাহিনীর সুসম্বন্ধ রূপ ফোটেনি, এমন অনেক ঘটনা স্থান পেয়েছে যারা মূল বিষয়বস্তুর বিকাশে ও চরিত্রের পরিণতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নয়। নায়কের ব্যক্তিত্বও পূর্ণরুপে চিত্রিত হয় নি, নারী চরিত্রগুলি কাহিনীর পক্ষে অনেকটাই অবাস্তব। ঔপন্যাসিক যে চরিত্রের সাহায্যে নৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন, সেই বরদাপ্রসাদ ও তার শিষ্য এবং মতিলালের ছােটভাই রামলাল নিষ্প্রাণ, তাদের মধ্যে রক্ত-মাংসের মানুষের বাস্তবতা বিন্দুমাত্র আভাসিত হয় নি। মতিলালের পরিবর্তনও বিশ্বাসযােগ্যভাবে রূপায়িত হয় নি। ‘আলালের ঘরের দুলালে’র কোনও চরিত্রেরই অন্তর্লোকের পরিচয় উঘাটিত হয় নি।

ধুরন্ধর উকিল বটলর এবং তার কর্মচারী, অসৎ কুটিল ও অর্থলােভী বাঞ্ছারাম, ধনী সম্তানদের তােষামােদকারী বক্রেশ্বর—এই চরিত্রগুলি বাস্তব ও জীবন্ত। মােকাজান মিঞ বা ঠকচাচাই ‘আলালের ঘরের দুলালে’র অবিস্মরণীয় চরিত্র। ঠকচাচা তার ধূর্ততা ও বৈষয়িক বুদ্ধি নিয়ে প্রাণময় বাস্তবতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এই প্রতারক মিথ্যাচারপটু মানুষটি তার বৈষয়িক জীবননীতিকে অকুষ্ঠিতচিত্তে প্রকাশ করে- “দুনিয়াদারি করিতে গেলে ভালা বুরা দুই চাই দুনিয়া সাচ্চা নয়, মুই একা সাচ্চা হয়ে কি করবাে?” জাল করার অপরাধে ঠকচাচা ও তার কুকর্মের সঙ্গী বাহুল্যের দ্বীপান্তর দণ্ড হয়, জাহাজে করে যাবার সময় সে এই আক্ষেপ করে- “মােদের নসিব বড় বুরা, মােরা একেবারে মেটি হলুম, ফিকির কিছু বেরােয় না, মাের শির থেকে মতলব পেলিয়ে গেছে, মােকান রিগেল, বিবির সাতেবি মােলাকৎ হল না, মাের বড় ডর তেনা বি পেন্টে সাদি করে।” আমরা অনুভব করি, তার এই আক্ষেপ একদিকে যেমন কৌতুকাবহ, অন্যদিকে তেমনি লেখকের সহানুভূতিসিক্ত।

বঙ্কিমচন্দ্র যথার্থই বলেছেন, প্যারীচাদই প্রথম ইংরেজি বা সংস্কৃত সাহিত্যের ওপর নির্ভর না করে বাস্তব জীবনের পরিবেশ থেকেই বিষয়বস্তু সংগ্রহ করে বাঙলা উপন্যাসে নতুন পথ প্রবর্তন করেছেন। মৌলিক কাহিনী সৃষ্টিতে তার সাফল্য অনস্বীকার্য। তার বর্ণনা ও ভাষাও বাস্তবনিষ্ঠ। বাঙলা সামাজিক উপন্যাসে আলালের ঘরের দুলালের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। ইংরেজিতে নভেল বা উপন্যাস বলতে যা বােঝায়, আলালের ঘরের দুলাল তার আদর্শকে সর্বপ্রথম বাঙলা সাহিত্যের লেখক ও পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছিল।