বাংলা সাহিত্যের সূর্যকরোজ্জ্বল প্রাঙ্গণে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ পরিবেশে এবং নগরজীবনের ক্লান্তি অবক্ষয় বিষণ্ণবেদনার মাঝখানে সহজ ভাবে বিনম্র আন্তরিকতার গ্রামজীবনের কথা বললেন, শোনালেন রাখালিয়া সুর। সাহিত্যগগনে রবীন্দ্রনাথ উজ্জ্বল উদ্ভাসিত, নজরুল রুদ্র মূর্তিতে আবির্ভূত হয়ে ভেঙে ফেলতে চাইলেন ইংরেজসৃষ্ট কারার ঐ লৌহকপাট, প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্য— বুদ্ধদেব শোনাচ্ছেন কল্লোলের গান—তখনই জসীমউদ্দীন বাংলার গ্রামপ্রকৃতির শান্তসুন্দর রূপচ্ছবি অঙ্কন করলেন, বাংলার শ্যামল প্রকৃতির কথা বললেন, শোনালেন ভাটিয়ালী সুরের মেঠো গান।
জসীমউদ্দীন বিভিন্ন ধরনের সাহিত্য রচনা করেছেন যেগুলি তার সৃজনীপ্রতিভার বিস্ময়কর পরিচয় বহন করে। তাঁর বিশিষ্ট কাব্যগ্রন্থ হল—’রাখালী’ (১৯২৭), ‘নকসী কাথার মাঠ’ (১৯২৮), ‘বালুচর’ (১৯৩৪), ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩৪), ‘ধানখেত’, ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’, ‘মা যে জননী কান্দে’, ‘পদ্মাপার’, ‘মাটির কান্না’, ‘হলুদ বরণী’, ‘সাকিনা’, ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ (১৯৭১), ‘মাগো জ্বালিয়ে রাখিস আলো’ (১৯৭৪)। তার ‘নকসী কাথার মাঠ’ ইংরাজীতে অনুবাদ হয় ‘The Field of the Embroydered Quilt’ নামে এবং ‘সোজন বান্দিয়ার ঘাট’ অনুদিত হয় Gipsy Wharf নামে অনুবাদিত যে গ্রন্থ দুটি পাশ্চাত্য দেশের বিপুল সমাদর লাভ করে। এছাড়া জসিমউদ্দীন নাটক (‘বেদের মেয়ে’, ‘ওগো পুষ্পধনু’, ‘পল্লীবধূ’, ‘মধুমালা’) উপন্যাস (‘বোবাকাহিনী’) স্মৃতিকথা (‘ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’, ‘জীবন কথা’, ‘স্মৃতির পট’), ভ্রমণকাহিনী (‘যে দেশে মানুষ বড়’ – রাশিয়া ভ্রমণের কথা, ‘হলদে পরীর দেশে’— যুগোলাভিয়া ভ্রমণের কথা, ‘বলো মুসাফির’– বন্দরে’–জার্মানি ভ্রমণ কথা) ইত্যাদি।
জসীমউদ্দীন গ্রামজীবনের কবি। গ্রামীণ মানুষের সাধারণ জীবনচর্যা—সুখ-দুঃখ আনন্দ বেদনা, গ্রাম বাংলার ভাবনা ঐতিহ্য তাঁর কাব্যে নিবিড় পরিচয় পেয়েছে। তার অধিকাংশ কবিতাই সহজ সরল পল্লীজীবনের শিল্প ভাষ্য। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’র মধ্যেই বেজে উঠেছিল প্রাণের এই গভীর গান সহজ ভাষায় বাঁশীর মেঠো সুরে—
সেই মেয়েটির চলা-পথে সেই মেয়েটির গাঙের ঘাটে
একলা রাখাল বাজায় বাঁশী ব্যথায় ভরা গাঙের ঘাটে।
তার ‘নকশী কাথার মাঠ’ পল্লীজীবনের লৌকিক মহাকাব্য। এর পটভূমি গ্রাম-বাংলার মাঠঘাট প্রান্তর, চরিত্র চাষীর ছেলে মেয়ে, রস করুণ ও বেদনামথিত, বিন্যাস-চৌদ্দ অধ্যায় ভাষা ছন্দ সহজ সরল মনছোঁয়া। প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন— ‘অনুরাগ ও মিলনে নিবিড়প্রেম, প্রতিরোধের দৃপ্ত কোরাস, অবশেষে বেদনাবিধুর সমাপ্তি মিলে এই কাব্য মৈমনসিংহ গীতিকার সার্থক উত্তরাধিকার’। জসীমউদ্দীন দেশের পুরাতন রত্নভাণ্ডারকে নূতনভাবে উজ্জ্বল করেছিলেন, সেকথা উচ্ছ্বসিত ভাবে ব্যক্ত করেছেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন। প্রকৃতির বন্দনা, রোমান্টিক সৌন্দর্য, বাংলা ও বাঙালীর প্রাণচেতনার প্রকাশে জসীমউদ্দীনের কবিতা অপরূপ সুন্দর।
জীবনের জ্বালা যন্ত্রণা দাহ, অর্থনৈতিক সংকট, অন্নের জন্য হাহাকার তাঁর কবিতায় পাওয়া যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় লেখা ‘ধানখেত’ কাব্যগ্রন্থের রাখালের রাজগী’ কবিতাটির মধ্যে এই দুঃসহ জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়—
ক্ষুধিত মানুষ ছুটিতে উধাও, তৃষ্ণা মেটে না কারও।
পেটে ভাত নাই, মুখে নাই হাসি, রোগে হাড়খানা সার,
প্রেত-পুরি যেন নামিয়ে এসেছে বাহিয়া নরক দ্বার।
জসীমউদ্দীন মানুষের কবি জীবনের কবি। তাই বাহান্নর ভাষা আন্দোলন যখন সত্তর একাত্তরের মুক্তি সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়েছিল, পাক সাম্রাজ্যবাদের ভয়াবহ অত্যাচারের বিরুদ্ধে দেশের সব মানুষ মুক্তি সংগ্রামের সামিল হয়েছিল, জসীমউদ্দীনও সেই প্রেরণায় উচ্ছ্বসিত উদ্বেল। বাঙালীদের ওপর পাকিস্তানী সমরনায়কদের অপমান অত্যাচারের রূপ ছিল ভয়াবহ, ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলি’তে সেই বেদনা-বিষণ্ণতা যন্ত্রণা দাহ অপমান-লাঞ্ছনার রক্তাক্ত ছবি আঁকা হয়েছে। নবজাগরণের মহানায়ক শেখ মুজিবরের মহিমা ও মর্যাদার প্রতি কবি শ্রদ্ধা জানিয়ে লিখেছিলেন যে তিনি জাতিভেদ ভুলিয়ে বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করেছেন ধর্মে ধর্মে মিলনের কথা বলেছেন।
এই বাংলায় শুনেছি আমরা সকলি করিয়া ত্যাগ
সন্ন্যাসী বেশে দেশবন্ধুর শাস্ত মধুর ডাক।
শুনেছি আমরা গান্ধীর বাণী-জীবন করিয়া দান
মিলাতে পারেনি প্রেম-বন্ধনে হিন্দু-মুসলমান।
তারা যা পারেনি তুমি তা করেছো ধর্মে ধর্মে তার
জাতিতে জাতিতে ভুলিয়াছে ভেদ সস্তান বাংলার।
এবং ঢাকার কাছে ধামরাইলয়ের ঐতিহাসিক রথ যখন পাকিস্তানীরা ধ্বংস করেছিল কবি তীব্র আর্তনাদ করে লিখেছিলেন—
পাকিস্তানের রক্ষাকারীরা পরিয়া নীতির বেশ
এই রথখানি আগুনে পোড়ায়ে করিল ভস্মবেশে।
কলকাতার সঙ্গে জসীমউদ্দীনের সম্পর্ক ছিল নিকট ও নিবিড়। তিনি কলকাতায় দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্যে এম এ পাশ করেছেন, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বিভাগে কাজ করেছেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভালবাসা পেয়েছেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর কাব্য সম্পর্কে ছিলেন উচ্ছ্বসিত এবং রবীন্দ্রনাথ তার বাংলা কবিতার সংকলন গ্রন্থে জসীমউদ্দীনের ‘উড়ানীর চর’ কবিতাটিকে গ্রহণ করেছেন, ১৯৭২ সালে কবি পশ্চিমবাংলায় এলে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি. লিট উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। মানবতার মহান সাধক রূপে কবি জসিমউদ্দীন চিরদিন উজ্জ্বল হয়ে থাকবেন, চিরকাল।
Leave a comment