“তুমি শাল গ্রাম শিলা
শোয়া বসা যার সকলি সমান,
তারে নিয়ে রাসলীলা!”
এই ধরনের আবেগমুক্ত মনোভাব নিয়ে কৃত্রিম সংস্কার ও বিলাস ঘুচিয়ে যিনি ঘোষণা করেছিলেন—“প্রেম ও ধর্ম জাগিতে পারে না বারোটার পরে রাতি।” সেই ইঞ্জিনিয়ার কবি যতীন্দ্রনাথ ‘দুঃখবাদী’ রূপেই সুপরিচিত। বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গী। বাস্তবে অনুরাগ আর ব্যঙ্গপ্রবণ অভিলাষ নিয়ে যতীন্দ্রনাথের আবির্ভাব। প্রেম-প্রকৃতি-ভগবান-রোমান্টিকতার নামে যাবতীয় ভোগবিলাস ও সংস্কার ছিল তার আক্রমণের লক্ষ্য বিষয়। ভারতী গোষ্ঠীর লেখকেরা যখন রবির ভাবে ও তাপে উত্তপ্ত, তখন ভাষায় ও বক্তব্যে, উপমায় অলঙ্কারে চিত্রকল্পে নিজস্ব দার্শনিকতায় রবীন্দ্র যুগের প্রথম বিদ্রোহী কবি রূপে যতীন্দ্রনাথের আত্মপ্রকাশ। বস্তুত আধুনিক কবিদের মধ্যে তাঁর কবিতায় প্রথম দেখা গেল মুগ্ধ আত্মতৃপ্তির বিরুদ্ধে স্পষ্ট প্রতিবাদ, নির্মীলিত নেত্রে সৌন্দর্যে দর্শনের বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ-তীক্ষ্ম আঘাত এবং গণ সংযোগ প্রচেষ্টা। সেই দিকে থেকে আধুনিক বাংলা কাব্যে তাঁরই মাধ্যমে গণকাব্যের সূচনা বলা চলে।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কাব্যসমূহ
মরীচিকা (১৯২৩), মরুশিখা (১৯২৭), মরুমায়া (১৯৩০), ত্রিযামা (১৯২৮), সায়ম (১৯৪০), অনুপূর্বা (১৯৪৬), নিশান্তিকা (১৯৫৭ মৃত্যুর পরে প্রকাশিত)।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের কবি বৈশিষ্ট্য:
ক) দুঃখবাদী দার্শনিকতা : কবি তার কাব্য মানসকে এক বিশিষ্ট অভিধায় চিহ্নিত করতে আগ্রহী, তাই নিজেকে বলেছেন—’দুঃখবাদী বৈরাগী’। তাঁর দৃষ্টিতে দুঃখ, লাঞ্ছনা, নৈরাশ্য ও মৃত্যু মানভাগ্যের নিদারুণ এক অনিবার্য পরিণাম। তাই তাঁর কাছে প্রেম প্রকৃতি নারী মানে বিশুদ্ধ ফাকি, সুখ-আনন্দ-স্বপ্ন-প্রেম শুধু মরুমায়া, মরীচিকা, আলেয়ার আলো মাত্র—
প্রভাত হৃদয়-বনে ছুটে মায়ামৃগ,
দুপুরে বুকের মরুমায়া মরীচিকা,
আঁখির জলায় সাঁঝে আলেয়ার খেলা
নিশীথে হারায় পথ প্রাণ খাদ্যোতিকা। (জীবন)
কঠোর বাস্তববাদী কবি জানেন ‘বনের আঁধার মুখ’ জোনাকীর আলোয় যেটুকু দেখায় মৃগ তৃষ্ণার ছবিতে মরুর তৃষ্ণা যতটা বোঝায়, আলেয়ার আলো পথিককে যে বারে বারে ভোলায় তা কাব্যের উপমামাত্র : কারণ—
বন্ধু, বন্ধু হে কবি বন্ধু, উপমার ফাঁসগুনি।
আসল কথাটা চাপা দিতে ভাই কাব্যের জাল বুনি।’ (কবির কাব্য) আবার, স্বকীয় স্বাতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন—
প্রেম বলে কিছু নাই,
চেতনা আমার জড়ে মিশাইলে
সব সমাধান পাই। (ঘুমের ঘোরে)
তবে মনে রাখা দরকার, কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত কোন দুঃখবাদ বা নৈরাশ্যের অতল অন্ধকারে নিজেকে এ সম্পর্কে স্পষ্ট জানিয়েছেন— “যতীন্দ্রনাথের দুঃখবাদ শেষ পর্যন্ত নৈরাশ্যের অন্ধকারে-পরিণামহীন শূন্যতার পথে আকাঙ্ক্ষায় অতৃপ্ত জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে কোন বিবর্ণ মরুভূমির মধ্যে হারিয়ে যায়নি। তাঁর শ্লেষের আঘাত আত্মধ্বংসমূলক হয়- তা আত্মসমীক্ষামূলক ভন্ডামি, মূঢ়তা, বঞ্চনা আর বাষ্পাবিলতার বিরুদ্ধে তার খুরধার আক্রমণ।”
এ বক্তব্যের প্রমাণ মেলে তাঁর ‘ঘুমের ঘোরে’র শেষ পর্যায়ের কবিতায় দুঃখের দেবতাকে অশ্রুধারায় অভিষিক্ত করে কবি মানব প্রেমের জয়গান করেছেন—
শুনহ মানুষ ভাই!
সবার উপরে মানুষ শ্রেষ্ঠ,
স্রষ্টা আছে বা নাই।
যদিও তোমাদের ঘেরিয়া রয়েছে মৃত্যুর মহারাত্রি,
সৃষ্টির মাঝে তুমিই সৃষ্টি ছাড়া দুখ পথযাত্রী।
খ) মানবপ্রেম : যতীন্দ্রনাথের কবিতায় আরও এক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান তা হল মানবপ্রেম বা মানুষের জয়গান। প্রকৃতপক্ষে মানুষের দুঃখ-অপমান-লাঞ্ছনার জন্যই তাঁর ভাব বিলাসের বিপক্ষে আক্রমণ। ভণ্ড দেশ প্রেমিকদের প্রতি তার মর্মভেদী আঘাত—
খাঁটি চাষা ছাড়া কে মাখিবে কাদা?
মনো করো ভাই মোরা চাষী নই
চাষার ব্যারিষ্টার। (পিছু হঠার গান)
বলাবাহুল্য চাষার সমর্থনে তার এই রোধ শিক্ষিত বিত্তবান দেশনেতার উদ্দেশে এই আত্মশ্লাঘাত আত্মধ্বংসে নয় পাঠককে আত্মসমীক্ষায় প্ররোচিত করে। তার ‘কৃষ্ণা’ কবিতায় আছে অবমানিত নারীত্বের প্রতি বজ্রমস্থ আহ্বান। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত মানুষজনের প্রতি তার অপরিসীম মমতা মানুষ চাষার বেগার, বার নারী, প্রভৃতি কবিতায় সোচ্চার ‘পাঁচীর ছেলে’ কবিতায় মৃত্যুকাহিনী যেভাবে বর্ণিত হয়েছে আজও তা বেদনায়, যন্ত্রণায় পাঠক মনকে বিদ্ধ করে—
ছাই কুড়ে, মান খুঁড়ে যেমনি তোলে মাগো!
বলে ছুটে এসে পড়িল টলে।
অপরূপ, নিপীড়িত, লাঞ্ছিত মানুষের প্রতি সুগভীর বেদনাবোধে দুঃখময় জীবনের প্রতি আত্মীয়তার অনুভবে ‘কচিভাব’ নামক কবিতাখানি বাংলা কাব্যের অবিনশ্বর সম্পদ—
দারুণ শীতের সাজ হে আমার নটরাজ
কোন রূপে এসেছিল দ্বারে?
বস্তুত সমালোচকের ভাষায় বলতে হয়—“মোহাচ্ছন্ন জীবনের আত্মারতির বিরুদ্ধে তার শিবরাত্রির যাপন। যতীন্দ্রনাথের শিবপূজা ব্যর্থ হয়নি। শীতে প্রান্তে তুষার বর্ষণের মধ্যে যেমন করে দরিদ্ররূপী ভগবান এসেছিলেন তলস্তয়ের কাছে – তাঁর কবিতাতেও তেমনি কচি ডাবের’ পসরাবাহী বৃদ্ধ এক হিমের রাত্রিতে নীলকণ্ঠরূপে দেখা দিয়েছেন।” এক কথায় –‘ঘুমের ঘোরে’র অবিশ্বাসী অজ্ঞেয়বাদী কবি এই ভাবেই সর্বহারা দীন দরিদ্র মানুষের প্রতি মমতায় ভালোবাসায় রূপান্তরিত হয়েছেন মানবপ্রেমিক।
যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের অবদান :
ক) নিছক ভাব বিলাস ও আত্মপ্রেমের কৃত্রিমতা থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্তিদান। কবিতায় সযত্ন লালিত আস্তিক্য দর্শনকে সমকালের ঐতিহাসিক পটভূমিতে ও দুঃখবাদের আয়ে অভিজ্ঞতায় যাচাই করার প্রচেষ্টা—
চেরাপুঞ্জির থেকে
একখানি মেঘ ধার দিতে পার
গোবি সাহারার বুকে?
খ) দারিদ্র লাঞ্ছিত মানুষের জীবনের দুঃখময় অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করে কবিতাকে গণমুখী করে তোলার প্রচেষ্টা। ভাষা ও ভাবের এই অভিনবত্ব স্মরণ করে অশতি পরবর্তী কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছেনঃ “যতীন্দ্রনাথের কাছে জেনেছিলাম, পরিশীলিত ভাষা ও সুবিন্যস্ত ছন্দের বাইরে চলে এলেও কবিতার জাত হয় না।”
গ) ‘শুরু’ প্রান্তর ও রাত্রিভাবনার রূপকায়িত কাব্য-নামে আংশিক জীবনের হতাশা ও নৈরাশ্যকে প্রকাশ করা। পরবর্তী কবি প্রজন্মের কাছে রবীন্দ্রনাথ থেকে ভিন্নতর ভাবের উপকরণ ও দৃষ্টিকোণ অনুসন্ধানের প্রেরণাদান।
ঘ) রবিদ্রোহিতার বশে রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্যধ্যানকে প্রথমে আঘাত করলেও পরে দ্বিপ্রহরের মরু উত্তাপ কিভাবে সন্ধ্যার শরতন স্নিগ্ধ বাতাসকে আপোষ করে নেয়—পরবর্তী অনুজ কবিদের কাছে তা শিক্ষণীয় আদর্শ হয়ে উঠেছিল।
তাই বলতে হয়, ছন্দে, শব্দচয়নে— লোকায়ত জীবধর্মে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত তাই একালের সাহিত্য রসিক বাঙালী পাঠকের একান্ত আত্মজন হয়ে উঠেছিলেন।
Leave a comment