কবিত্ব শক্তির আপেক্ষিক স্বল্পতা সত্ত্বেও কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন হিন্দু সংস্কৃতির ভাব প্রতিনিধিত্বের প্রতীক। তিনি বাংলা কাব্যে মধুসূদনের পরেই এক মর্যাদাপূর্ণ আসনের অধিকারী। মধুসূদনের অপেক্ষা তিনি বয়ঃকনিষ্ঠ, কিন্তু জনপ্রিয়তায় মধুসূদনের যুগে তাঁর সমকক্ষ কবি বিশেষ দেখা যায় না।
হেমচন্দ্রের জন্ম ও কর্মজীবন:
হুগলী জেলার গুলিটা গ্রামে কবি হেমচন্দ্রের জন্ম। তবে বাল্যকাল কাটে কলকাতার খিদিরপুর অঞ্চলে। হিন্দু স্কুলে বিদ্যাশিক্ষা শুরু হয়। বঙ্কিমচন্দ্র বি. এ. পাশ করার পরের বৎসরে হেমচন্দ্র পাশ করেন। তারপরে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কিছুকাল সরকারী চাকরী করেন, পরে কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি করেন। শেষ জীবনে অন্ধ হয়ে যান এবং অন্ধ-দশা সত্ত্বেও বেশ কিছু কবিতা রচনা করেন। নানা রকম কাব্য, গীতিকবিতা, ব্যঙ্গাত্মক কবিতা, দেশপ্রেমমূলক কবিতা, নাটকানুবাদ এবং মহাকাব্য বা আখ্যানকাব্য রচনা করে হেমচন্দ্র স্মরণীয় হয়ে ওঠেন।
মধুসূদন ও হেমচন্দ্রের মধ্যে তুলনা:
মধুসূদনের মৃত্যুর পর বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন— “বঙ্গ কবির সিংহাসনে যিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন, তিনি অনন্তধামে যাত্রা করিয়াছেন, কিন্তু হেমচন্দ্র, থাকিতে বঙ্গমাতার ক্রোড় সুকবিশূন্য, বলিয়া আমরা কখন রোদন করিব না” (উদ্ধৃত, “কবি হেমচন্দ্র”,—“বাঙলা সাহিত্যে নবযুগ’, ‘শশিভূষণ দাশগুপ্ত’ ১৩৫৯, পৃষ্ঠা ১৪২)।
কেবলমাত্র বঙ্কিমচন্দ্র নন, রবীন্দ্রনাথও সমকালের শিক্ষিত বাঙালী পাঠকের মনোভাব অনুভব করে দেখেছিলেন— “স্বর্গোদ্ধারের জন্য নিজের অস্থিদান এবং অধর্মের জন্য বৃত্তের সর্বনাশ যথার্থ মহাকাব্যের বিষয়” (দ্রষ্টব্য : সমালোচনা, রবীন্দ্ররচনাবলী: অচলিত ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ৭৯)।
আবার একালেও কোন কোন সমালোচক (শশিভূষণ দাশগুপ্ত) মনে করেছেনঃ “দুইটি বিষয়ে শিষ্য হেমচন্দ্র গুরু মধুসূদনকেও ছাড়াইয়া গিয়াছিলেন—ইহা প্রথমত তঁাহার কাব্যের বিষয় নির্বাচনে, দ্বিতীয়ত তাঁহার মহাকাব্যের সুদৃঢ় সংযত বলিষ্ঠ কঠোর বাঁধুনিতে” (‘বাঙলা সাহিত্যের নবযুগ’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৫৭)।
হেমচন্দ্র নিজেও ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকা লিখে মহাকাব্য রচনায় উৎসাহিত হয়েছিলেন, এ তথ্য সর্বজনস্বীকৃত। স্বয়ং মধুসূদন রাজনারায়ণ বসুকে এই সংবাদ দিয়ে লিখেছিলেন : “Meghnad is going through a second edition with notes, and a real B. A. has written a long critical preface” (4th June, 1862).
মেঘনাদবধ এবং বৃত্তসংহার কাব্যের মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্য:
‘মেঘনাদ বধে’র সঙ্গে ‘বৃত্রসংহারে’র ভাবগত সাম্য লক্ষ্য করা যায় – (১) মেঘনাদ স্রষ্টা মধুসূদনের রাক্ষসদের প্রতি সহানুভূতি ও পক্ষপাত হেমচন্দ্রের ‘বৃত্রসংহারে’ও বৃত্রাসুরের বীরত্ব বর্ণনায় প্রথমাংশে দেখা যায়। (২) মধুসূদনের উপমালঙ্কার রীতি, সর্গে সর্গে কাব্য বিন্যাসকল্পনার অনুসরণ দেখা যায়। (৩) চরিত্র-পরিকল্পনায়ও রাবণের সঙ্গে বৃত্রের, ইন্দ্রের সঙ্গে রামচন্দ্রের, লক্ষ্মণের সঙ্গে জয়ত্তের, মেঘনাদের সঙ্গে রুদ্রপীড়ের, সীতার সঙ্গে শচীর ঘনিষ্ঠ মিল দেখা যায়।
এই মিল বা সাদৃশ্য সত্ত্বেও দুই কাব্যের মধ্যে পার্থক্যই বেশি; যেমন—
প্রথমেই বলা যায়, মধুসূদনের কবি-স্বভাবের বৈপ্লবিকতা হেমচন্দ্রে ছিল না, তিনি ছিলেন কাব্যানুরাগী সামাজিক ব্যক্তি, কবিত্বশক্তিতে নিতান্ত মাঝারি মাপের মানুষ। মধুসূদনের বিশ্বন্ধর প্রতিভার অনুসরণ ছিল তার সাধ্যাতীত। পাশ্চাত্য রীতিতে মহাকাব্য লিখতে গিয়ে তিনি ভাব-ভাষা-ছন্দের অর্গল মুক্ত করে মহাকাব্যের সিংহদুয়ার উন্মোচন করতে পারেন নি। অমিত্রাক্ষর ছন্দের ওজোগুণ এবং আবেগমুক্তির গুরুত্ব না বুঝে তিনি মিলহীন পয়ার রচনা করেই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন।
দ্বিতীয়ত, ধ্রুপদী গ্রীক মানসিকতা এবং নব্য রোমান্টিক চেতনাকে মধুসূদন বাংলা কাব্যের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চেয়েছিলেন। জনৈক গ্রীকের মত করে তাঁর ‘মেঘনাদ বধ’ লেখার আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সুপ্ত ছিল গ্রীক ethos, গ্রীক আইনের বিবেকবান উদারতা, অপরাধীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগদান প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন। বলা বাহুল্য, হেমচন্দ্রের সাধারণ কবি-প্রতিভায় তা অকল্পনীয় ছিল।
তৃতীয়ত, ‘বৃত্রসংহার’ মহাকাব্যের কায়িক বিশালতা লাভ করলেও তাঁর মধ্যে ‘মেঘনাদবধে’র দ্যুলোক ভূলোকসঞ্চারী অপার বিস্ময় নেই, চরিত্রের জীবন পরিণতির মধ্যে মানবভাগ্যের নিদারুণ ট্র্যাজেডি নেই, নেই মহাকাব্যোচিত গাম্ভীর্য, বাক্বৈভব বা আলঙ্কারিক নিপুণতা।
চতুর্থত, মধুসূদনের মহাকাব্যে পিতৃলোক বর্ণনা ও নরক দর্শন মানবিক রসাপ্লুত। মহাকবি-সুলভ অনুভূতিতে তার পাপীদের যন্ত্রণা রূপাঙ্কিত। তত্ত্বের দূরূহতা সেখানে অনুপস্থিত। অন্যদিকে হেমচন্দ্রের নরকবর্ণনা দার্শনিক তত্ত্ব সমাকীর্ণ। মাইকেল পৌরাণিক চিত্রকল্পনার অনুগামী। হেমচন্দ্র উপনিষদের তত্ত্বগ্রহণে রূপ-রিক্ত পথের পথিক।
পঞ্চমত, মধু কবির ‘নিয়তিবাদ’ আধুনিক মনের জীবনার্তির প্রকাশ এক দৈব প্রতিরূপ। হেমচন্দ্রের ‘নিয়তিবাদ’ কর্মফলের উপর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিধানের অমোঘ ন্যায়বিচার। প্রথমটিতে আছে প্রশ্নময় বিদ্রোহী মানসিকতা, দ্বিতীয়টিতে আছে আত্মসমর্পণ। ‘মেঘনাদবধে রাবণ চরিত্রের সঙ্গে কবি-আত্মা যেমন একাত্ম হয়ে মহাকাব্যের কল্লোলধ্বনির মধ্যে লিরিকের নুপূর ধ্বনি শুনিয়েছে, হেমচন্দ্রের কাব্যে তার কোন চিহ্নমাত্র দেখা যায় না।
বস্তুত, ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র অপূর্ব রসবিন্যাস, সমুন্নত ভাবকল্পনা, তীক্ষ্ণ জীবনদর্শন-ব্যঞ্জনা ছিল হেমচন্দ্রের অনায়ত্ত— মহাকাব্যের হরধনুতে জ্যা রোপণ ছিল শক্তির অতীত। তাই মহাকাব্যের গাঢ়বদ্ধতার বদলে একটা শিথিল আখ্যানসূত্রের বন্ধনে ‘বৃত্রসংহার’ কাব্যের কাহিনী রূপায়িত।
হেমচন্দ্রের কাব্যসমূহ:
হেমচন্দ্র ছাত্রাবস্থা থেকেই কবিতা লিখতে শুরু করেন। সেইগুলি বাদে তার প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল – ‘চিন্তাতরঙ্গিণী’ (১৮৬১), ‘বীরবাহু কাব্য’ (১৮৬৪), খণ্ড কবিতাবলীর সংকলন ‘কবিতাবলী’ (প্রথম ১৮৭০, দ্বিতীয় ১৮৮০), ‘বৃত্রসংহার’ (১ম ভাগ ১৮৭৫, ২য় ভাগ ১৮৭৭), ‘আশাকানন’ (১৮৭৬), ‘ছায়াময়ী’ (১৮৮০), ‘দশমহাবিদ্যা’ (১৮৮২), চিত্তবিকাশ’ (১৮৯৮), ‘নাকে খৎ’ নামে কাব্য (১৮৮৫)।
ইংরেজী রচনা: ‘The Life of Shrikrishna’ (1857), ‘Brahmo Theism in India’ ( 1869).
নাটকের অনুবাদ: টেম্পেস্টের অনুবাদ ‘নলিনীবসন্ত’ (১৮৬৮), ‘রোমিও জুলিয়েটের অনুবাদ’ (১৮৮৫)।
হেমচন্দ্রের ‘চিন্তাতরঙ্গিণী’ কাব্যটি শোককাব্য, বিষয়—কবির বাল্যসুহৃদের (শ্রীচন্দ্র ঘোষ) আত্মহত্যা উপলক্ষে জীবনের গভীর অস্তিত্ব রহস্যের অনুসন্ধান এই কাব্যের রচনারীতিতে ভারতচন্দ্র এবং ঈশ্বর গুপ্তের প্রতি আনুগত্য দেখা যায়। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে কাব্যটি রচিত হয়। কাব্যটি এক সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যতালিকাভুক্ত হয়। কিছু কিছু পক্তির মধ্যে আন্তরিকতা থাকলেও এর কাব্যমূল্য যৎসামান্য। এছাড়া Shelley-র ‘To a Skylark’ কবিতার তিনি যথার্থ ও সাবলীল অনুবাদ করেন। ‘চাতকের প্রতি’ অনুবাদ কবিতাটি শেলীর কবিতাটিকে সহজে বুঝতে সাহায্য করে।
পরবর্তী ‘বীরবাহু কাব্য’ আখ্যান কাব্যধর্মী রচনা। কবি ভূমিকায় লিখেছেনঃ “উপাখ্যানটি আদ্যোপান্ত কাল্পনিক, কোন ইতিহাসমূলক নহে”। কনৌজের যুবরাজ বীরবার পাঠান কর্তৃক অপহৃতা পত্নী হেমলতা উদ্ধারের কাহিনী এর বর্ণনীয় বিষয়। কবি স্বাজাত্যবোধের প্রেরণায় উদ্দীপিত হয়ে প্রাচীন ভারতের গৌরব স্মরণে বলেছেন—
“আর কি সেদিন হবে জগৎ জুড়িয়া যবে
ভারতের জয়কেতু মহাতেজে উড়িত।
যবে কালিদাস শুনায়ে মধুর ভাষা
ভারতবাসীর মন সদা তুষিত।”
তবে এখানেও কাব্যকলার আশানুরূপ অভিব্যক্তি ঘটেনি।
তৃতীয় কাব্য ‘আশাকানন’ একটি রূপক কাব্য। কবির ভাষায় “আশাকানন একখানি সাঙ্গ রূপক কাব্য। মানবজাতির প্রকৃতিগত প্রবৃত্তি সকলকে প্রত্যক্ষীভূত করাই এই কাব্যের উদ্দেশ্য।” সমগ্র কাব্যটি দশটি কল্পনায় বিভক্তঃ মানবমনের শক্তি, অধ্যবসায়, সাহস, ধৈর্য, শ্রম, উৎসাহ প্রভৃতি বিষয়গুলি রূপকের আকারে বিবৃত। আশা দেবীর সঙ্গে কবির আশাকাননে প্রবেশ, যেখানে বিভিন্ন দ্বারে বিভিন্ন প্রবৃত্তির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে কাব্য সমাপ্ত হয়েছে। কাব্যের ভঙ্গী নতুন, কিন্তু বর্ণনা গতানুগতিক, শিল্পগুণ বিলুপ্ত।
‘ছায়াময়ী’ কাব্যটির ভূমিকা পড়ে জানা যায়, “প্রসিদ্ধ ইউরোপীয় দাস্তের লিখিত ডিভাইনা কমেডিয়া কিঞ্চিত্মাত্র আভাস” দেবার জন্যই কবি হেমচন্দ্রের এই কাব্যরচনা। এখানে দাস্তের খ্রীস্টানী আদর্শে পাপ-পুণ্য, নরক-প্রায়শ্চিত্ত-স্বর্গ চিত্রণের আদর্শে হিন্দুর স্বর্গ-নরক-পরলোক প্রভৃতি বর্ণিত। এই কাব্যেরও শিল্পমূল্য তেমন উচ্চাঙ্গের নয়।
হিন্দু পুরাণ ও তন্ত্রের দেবী মাহাত্ম্য নিয়ে লেখা হয় ‘দশমহাবিদ্যা’ কাব্য। দেবীর দশ রূপের কল্পনা ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে বর্ণিত বিষয় উপকরণ রূপে সংগৃহীত, যদিও এর উপস্থাপনার কল্পনা কবির মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচায়ক। দেবীর দশটি রূপের মধ্যে মানব সভ্যতার দশটি বিভিন্ন স্তরের কল্পনা আছে ; যেমন সভ্যতার আদিরূপ কালীতে জীবধর্মের আদি সত্য হিংসা প্রকাশিত, তারপর স্তর পরম্পরায় দশম রূপ মহালক্ষ্মীতে দেখা গেছে সভ্যতার কল্যাণময় বিকাশ। এই কাব্যটির মধ্যে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখা যায়— (ক) প্রাচীন পুরাণ ও তন্ত্রশাস্ত্রকে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের রূপকের দ্বারা বিশ্লেষণ। (খ) আধুনিক যুগ সুলভ যুক্তিবোধের পরিচয়। (গ) সতীহারা মহাদেবের শোকার্ত পরিচয় প্রকাশ—“রে সতী, রে সতী, কাদিল পশুপতি, পাগল শিব প্রমথেশ”। (ঘ) প্রচলিত ছন্দের পরিবর্তে হ্রস্ব-দীর্ঘ মাত্রার ছন্দ সৃষ্টির অভিনবত্ব—
“কৈলাস অম্বরময় তারাসূর্য্য অনুদয় ক্ষণকালে নিবিল সকল।
তমসন্ন দিগাকাশ কেবলি করে উল্লাস নীলকণ্ঠ কণ্ঠের গরল ॥”
তবে এই কাব্যের মধ্যেও হিন্দু জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রীতির পরিচয় অবিলুপ্ত নয়।
হেমচন্দ্র গীতিকবিতা বা লিরিক রচনায় সফল হয়েছিলেন। এর একটি কারণ সম্ভবত শিবনাথ শাস্ত্রীর সেই বিখ্যাত উক্তি : “বাঙালী যাহা চায়, হেমচন্দ্রের প্রতিভা তাহাই দিয়াছে” (উদ্ধৃত, মন্মথনাথ ঘোষ, ‘হেমচন্দ্র’, পৃষ্ঠা ৩৫)। দ্বিতীয় কারণ, তার রোমান্টিক মানসিকতা, যা অনেক সময় হয়ত ভাবালুতায় আচ্ছন্ন—নিজের হৃদয় আর বাইরের নিসর্গ অনেক সময় এক যোগে যুক্ত হয়ে “কবি হৃদয়ের প্রকৃত ইতিহাস” (শশাঙ্কমোহন সেন) হয়ে উঠেছে ; যেমন—
“হায়রে প্রকৃতি সনে মানবের মন
বাঁধা আছে কি বন্ধনে বুঝতে না পারি,
নতুবা যামিনী দিবা প্রভেদে এমন,
কেন হেন উঠে মনে চিন্তার লহরী?”
এই কাব্যের কিছু কবিতায় রাজনৈতিক বা সমকালের সামাজিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যঙ্গরস উপভোগ্য হয়ে উঠেছে; যেমন—মুখে ইংরেজ বিদ্রোহ অথচ ভেতরে ইংরেজ তোষণের ধ্বজাধারীদের প্রতি ব্যঙ্গ—
“পরের অধীন দাসের জাতি ‘নেশন’ আবার তারা।
তাদের আবার ‘এজিটেশন’ নরুণ উঁচু করা ।”
বলা বাহুল্য, এই ব্যঙ্গের অন্তরালে কবি হেমের স্বদেশপ্রীতির ভাবটি কোথাও আচ্ছন্ন থাকে নি। তাঁর এই স্বদেশমূলক কবিতাগুলি হিন্দুমেলার উদ্যোগীদেরও উদ্বুদ্ধ করেছিল—
“বাজারে শিঙ্গা, বাজ্ এই রবে,
সবাই স্বাধীন, এ বিপুল ভবে,
সবাই জাগ্রত মানের গৌরবে
ভারত শুধুই ঘুমায়ে রয়।”
তাঁর ‘জীবনসঙ্গীত’ কবিতাটিতেও উৎকৃষ্ট কবিত্ব শক্তির পরিচয় আছে। আবার কাব্য-বিষয়ের সঙ্গে লিরিক-প্রকরণ সম্পর্কেও তিনি যে সচেতন ছিলেন তা বোঝা যায়, লিরিক ওডের স্ট্রোফি অ্যান্টি-স্ট্রোফি ইপোড ইত্যাদি কায়াক্রম যথাযথ অনুসরণের প্রয়াসে এবং ছন্দে বৈচিত্র্য সৃষ্টির মনোসংযোগে।
মহাকাব্যরূপে আলোচিত হেমচন্দ্রের ‘বৃত্রসংহার’ কাব্যটি তার প্রতিভার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন।
কবি হেমচন্দ্রের শেষ জীবন অত্যন্ত দুঃখজনক। অন্ধকবি অন্ধকারের মধ্যে যেভাবে জীবনযাপন করেছেন তা স্মরণ করে সমালোচক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মস্তব্য করেছেনঃ- “তাঁর জীবনের শেষ কটা দিন মনে হলে তাঁর কাব্যকবিতার বিচার বিশ্লেষণ ম্লান হয়ে যায়, তার প্রতি মমতায় পাঠকের মন সজল হয়ে ওঠে।……অন্ধ হেমচন্দ্র দূর প্রবাসে কাশীধামে প্রায় নিঃসঙ্গ, নির্বান্ধব অবস্থায় জীবনের শেষ কটা দিন কাটিয়ে গেছেন সেকথা মনে হলেই তার প্রতি আমাদের মন সহানুভূতিতে ভরে যায়’’
বাস্তবিক, কবি তার জীবনেশ্বরের কাছে যে প্রশ্ন করেছেন, তা পাঠককে আজও বেদনায় আচ্ছন্ন করে—
“বিভু কি দশা হবে আমার।
প্রতিদিন অংশুমালী সহস্র কিরণ ঢালি
পুলকিত করিবে সকলে।
আমারি রজনী শেষ হবে নাকি হে ভবেশ
জানিব না দিবা কারে বলে?”
Leave a comment