পার্টি-কর্মী ও কবির মধ্যে দূরত্ব রেখে নয়, ভাবের ধোঁয়াশায় ‘সিল্যুয়েট’-মূর্তি হয়ে নয়, সহজ সত্য স্পষ্টভাষণে এবং অকপট আত্মপ্রকাশেই কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষত্ব। অনেক স্থলে তাঁর কবিতা চড়া সুরে বাঁধা, কিন্তু সহজবোধ্য। অনেক স্থলে ব্যঙ্গময় কিন্তু ব্যঞ্জনায়, আবেগের সংহত প্রকাশে আশ্চর্য রূপময়। কথা বলার রীতিতে কবিতা লেখার এমন সুনিপুণ সার্থক কারুকলা আর দ্বিতীয় জনের মধ্যে দেখা যাবে না। বস্তুতঃ তাঁর কবিতা পাঠককে পড়তে বাধ্য করে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম:

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম ১২ই ফেব্রুয়ারী, ১৯১৯, নদীয়ার কৃষ্ণনগরে, মাতুলালয়ে। পিতা ক্ষিতিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মা যামিনী দেবী। পিতার আবগারী বিভাগে বদলীর চাকরী হওয়ায় কবির ছেলেবেলা কাটে বিভিন্ন স্থানে। পড়াশুনো যথাক্রমে, প্রথমে নওগাঁর (উত্তর বাংলার মহকুমা শহর) স্কুলে, পরে কলকাতার মেট্রোপলিটান, সত্যভামা ইনস্টিটিউশন এবং ভবানীপুর মিত্র স্কুলে। তারপরে আশুতোষ কলেজ, স্কটিশচার্চ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বিভিন্ন স্থানে অধ্যয়ন-প্রয়াস। অবশ্য রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হওয়ার ফলে সে প্রয়াস সম্পূর্ণতা পায় নি। সাহিত্যরসিক শিক্ষকরূপে পান কবি কালিদাস রায়, ‘কালি ও কলম’ পত্রিকার সম্পাদক মুরলীধর বসুকে এবং বন্ধুরূপে গায়ক হেমস্ত মুখোপাধ্যায়, রমানাথ রায়, পরিমল সেনগুপ্ত, রমাকৃষ্ণ মৈত্র প্রমুখ ব্যক্তিবর্গকে। আরো পরে কর্মসূত্রে পান কবি বিষ্ণু দে, সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু থেকে শুরু করে তাঁর কারাজীবনের সঙ্গী আব্দুর রজ্জাক খান, সতীশ পাকড়াশী, পরভেজ শহীদী (উর্দু সাহিত্যিক), চারু মজুমদার, গিরিজা মুখার্জী, চিন্মোহন সেহানবীশ প্রমুখ স্বনামধন্য মানুষদের।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনীতি ও কর্মজীবন:

কবি ছাত্রজীবন থেকেই ছিলেন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ১৯৩২-৩৩ খ্রীস্টাব্দে ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কিশোর ছাত্রদল’-এর সক্রিয় সদস্য রূপে যোগ দেন। সমর সেনের দেওয়া ‘হ্যান্ডবুক অফ মার্কসিজম্’ পড়ে মার্কসীয় রাজনীতিতে অনুপ্রবেশ। শুরু হয় মার্কসীয় ক্লাসে পাঠগ্রহণ। ১৯৩৯-এ লেবার পার্টির সঙ্গে হয় সংযোগ। তারপর ছাত্রনেতা বিশ্বনাথ মুখার্জির প্ররোচনায় লেবার পার্টি ছেড়ে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি তার আকর্ষণ অনুভব, পার্টির কাজে অংশগ্রহণ, ১৯৪২-এ পার্টির সদস্যপদ লাভ। এইসময় ‘ফ্যাসিস্ট বিরোধী লেখক শিল্পী সংঘের সংগঠন কমিটিতে বিষ্ণু দে-র সঙ্গে যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তারপরে মাসিক পনেরো টাকা ভাতায় সর্বক্ষণের কর্মীরূপে পার্টির ‘জনযুদ্ধ’ পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯৪৬-এ দৈনিক স্বাধীনতা পত্রিকায় সাংবাদিক হয়ে আসেন। ১৯৪৮ খ্রীঃ মার্চে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ঘোষিত হলে বহু কমিউনিস্ট বন্দীর সঙ্গে কবিও কারাবরণ করেন। দমদম জেলে হাঙ্গার স্ট্রাইকে সামিল হন। ১৯৫০ খ্রীঃ নভেম্বরে তার কারামুক্তি ঘটে।

জেল-ফেরৎ জীবনে দেখা দেয় প্রচণ্ড আর্থিক দুরবস্থা। মাত্র পঁচাত্তর টাকা বেতনে একটি নতুন প্রকাশনা সংস্থায় সাব এডিটর হন। তারপর সেই কাজ ছেড়ে ১৯৫১-তে ‘পরিচয়’-এর সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। ঐ বছরেই গীতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহ হয়। বিবাহের পর সস্ত্রীক ১৯৫২ খ্রীস্টাব্দে বজবজে গিয়ে ব্যঞ্জনবেড়িয়া গ্রামের মজদুর বস্তিতে মাটির ঘরে থেকে ঐ অঞ্চলের চটকল মজুর সংগঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। বজবজের পর কলকাতায় পোর্ট অঞ্চলে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ করেন। ১৯৬৪-তে পার্টি ভাগ হলেও তিনি পুরনো পার্টিতেই থেকে যান। ১৯৬৭-তে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে দেওয়ার কারণে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে দ্বিতীয়বার কারাবরণ করেন এবং তেরো দিন কারারুদ্ধ থাকেন। সত্তরের দশকে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটে। নকশাল আন্দোলন সমর্থন করেন না ব’লে ‘কে কোথায় যায়’ উপন্যাস লিখে বিরূপতা ব্যক্ত করেন। ১৯৭৭-এর জরুরী অবস্থাকে সমর্থন করেন। অন্যদিকে এ্যাফ্রো-এশিয়ান লেখক সমিতির কাজে দায়িত্ব বেড়ে যাওয়ায় ট্রেড ইউনিয়নের কাজ থেকে সরে আসতে হয়। অতঃপর পার্টির রণনীতি ও রণকৌশলের বিপক্ষে মত প্রকাশে ও কিছু কিছু রাজনীতিগত প্রশ্ন উত্থাপনে ১৯৮১ খ্রীস্টাব্দে পার্টির সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি নেন। তারপর বামপন্থী রাজনীতি পরিত্যাগ করে দক্ষিণপন্থী পার্টি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করায় তিনি হয়ে উঠেন একালের সব চাইতে বিতর্কিত (হয়ত-বা বামপন্থীদের দ্বারা অনেকাংশে ঘৃণিত) রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তার মৃত্যু পর্যন্ত এই বিতর্ক অব্যাহত ছিল।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রচনাসমূহ:

সুভাষ মুখোপাধ্যায় সৃষ্টিশীল লেখক। কবিতা-অনুবাদ কাব্য-ছড়া-রিপোর্টাজ ভ্রমণকাহিনী-উপন্যাস ইত্যাদি সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা। তবে কবিতার ভূমিতে তাঁর পদপাতই সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ ও সুন্দর। তার সেই সৃষ্টিশীল সাহিত্যের পরিচয়টি নিম্নরূপ

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য : ‘পদাতিক’ (১৯৪০), ‘অগ্নিকোণ’ (১৯৪৮), ‘চিরকূট’ (১৯৫০), ‘ফুল ফুটুক’ (১৯৫৭), ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৪), ‘যত দূরেই যাই’ (১৯৬২), ‘কাল মধুমাস’ (১৯৬৬), ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৭০), ‘এই ভাই’ (১৯৭১), ‘ছেলে গেছে বনে’ (১৯৭২), ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য সংগ্রহ – ১ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৯), ‘কাব্যসংগ্রহ—২’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮১), ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’ (১৯৭৯), ‘জল সইতে’ (১৯৮১), ‘চইচই চইচই’ (১৯৮৩), ‘বাঘ ডেকেছিল’ (১৯৮৫), ‘যা রে কাগজের নৌকা’ (১৯৮৯), ‘ধর্মের কল’ (১৯৯১)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদ কাব্য : ‘নাজিম হিকমতের কবিতা’ (১৯৫২), ‘দিন আসবে’ (‘নিকোলো ভাপৎসারভ’ বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), ‘পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮০), ‘ওলঝাস সুলেমেনভ-এর রোগা ঈগল’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮১), ‘নাজিম হিকমতের আরো কবিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮৬), ‘পাবলো নেরুদার আরো কবিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮৭), ‘হাফিজের কবিতা’ (১৯৮৪), ‘চর্যাপদ (১৯৮৬), ‘অমরুশতক’ (১৯৮৮)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ছড়া : ‘মিউ-এর জন্যে ছড়ানো ছিটানো’ (১৯৮০)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রিপোর্টাজ ও ভ্রমণকাহিনী : ‘আমার বাংলা’ (১৯৫১), ‘যখন যেখানে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৭), ‘ডাকবাংলার ডায়েরী’ (১৯৬৫), ‘নারদের ডায়েরী’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), ‘যেতে যেতে দেখা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৬), ‘ক্ষমা নেই’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৮), ভিয়েতনামে কিছুদিন’ (১৯৭৪), ‘আবার ডাকবাংলার ডাকে’ (১৯৮৪), ‘টো টো কোম্পানী’ (১৯৮৪), ‘এখন এখানে’ (১৯৮৬), ‘খোলা হাতে খোলা মনে’ (১৯৮৭)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অর্থনীতিমূলক রচনা : মার্কসের ‘ওয়েজ লেবার এ্যান্ড ক্যাপিটাল’ অবলম্বনে ‘ভূতের বেগার’ (১৯৫৪)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনুবাদমূলক রচনা : ‘মত ক্ষুধা’ ভবানী ভট্টাচার্যের ‘So many Hungers’ উপন্যাসের অনুবাদ (১৯৫৩), ‘রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ’ (১৯৫৪), ‘ব্যাঘ্ৰকেতন’ (১৩৬৭) —সুভাষচন্দ্র বসুর কর্ম ও জীবনের অনুবাদ ‘রুশ গল্প সঞ্চয়ন’ (১৯৬৮), ‘ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একদিন’ (১৯৬৮), ‘চে গেভারার ডায়েরী’ (১৯৭৭), শের জঙ্গের ‘Tryst with Tigers’ অবলম্বনে ‘ডোরাকাটার অভিসারে’ (১৯৬৯), ‘আনাফ্রাঙ্কের ডায়েরী’ (১৯৮২), ভীষ্ম সাহানীর রচনা ‘তমস’-এর অনুবাদ (বঙ্গাব্দ ১৩৯৫)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা-সম্পর্কিত গদ্য রচনা : ‘কবিতার বোঝাপড়া’, ‘টানাপোড়েনের মাঝখানে’।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস : ‘হাংরাস’ (১৯৭৩), ‘কে কোথায় যায়’ (১৯৭৬)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জীবনী : ‘জগদীশচন্দ্র’ (১৯৭৮), ‘আমাদের সবার আপন ঢোল-গোবিন্দের আত্মদর্শন’ (১৯৮৭), ‘ঢোল-গোবিন্দের মনে ছিল এই’।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শিশু ও কিশোরদের জন্য রচনা : ড. নীহাররঞ্জন রায়ের ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস’ (আদি পর্ব)-এর সংক্ষিপ্ত কিশোর সংস্করণ (১৯৫২), অক্ষরে অক্ষরে’ আদি পর্ব (১৯৫৪), ‘কথার কথা’ (১৯৫৫), ‘দেশবিদেশের রূপকথা’ (১৯৫৫), ‘বাংলা সাহিত্যের ‘সেকাল ও একাল’ (১৯৬৭), ইয়াসিনের কলকাতা’ (১৯৭৮)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদিত গ্রন্থ : হিরণকুমার সান্যালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশের বিশিষ্ট কথাশিল্পীদের জবানবন্দী ‘কেন লিখি’ (১৯৪৫), গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় ফ্যাসিস্টবিরোধী কবিতা সংকলন ‘একসূত্র’ (১৯৫৫), ছোটদের পুজো সংকলন— ‘পাতাবাহার’, ‘বার্ষিক আগামী’ প্রভৃতি।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সংকলন : ‘কবিতাসংগ্রহ’–১ম (১৯৯২), ২য় (১৯৯৩), ৩য় (১৯৯৪), ৪র্থ (১৯৯৪), ‘গদ্য সংগ্রহ’ (১৯৯৪)।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতা সূচনা থেকেই শ্রমিক-কৃষকের মিলিত শক্তির জয় ঘোষণা। তার কারণ, এই দুই মিলিত শক্তির বৈপ্লবিক প্রকাশে ধনতান্ত্রিক কাঠামো এবং ধনতন্ত্রের চূড়ান্ত রূপ যে উপনিবেশবাদ, তার উচ্ছেদ-সাধন সম্ভব ব’লে কবির ধারণা হয়। এই ধারণাই হয়ে ওঠে কবি ব্যক্তিত্বের মেরুদণ্ডস্বরূপ। ‘পদাতিক’ কাব্যের ‘মে দিনের কবিতা’য় এই ঋজু প্রত্যয় প্রথম ফুটে ওঠে

“শতাব্দী-লাঞ্ছিত আর্তের কান্না

প্রতি নিঃশ্বাসে আনে লজ্জা;

মৃত্যুর ভয়ে ভীরু বসে থাকা, আর না-

পরো পরো যুদ্ধের সজ্জা। 

প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য 

এসে গেছে ধ্বংসের বার্তা,

দুর্যোগে পথ হয়, হোক দুর্বোধ্য

চিনে নেবে যৌবন আত্মা।”

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য বৈশিষ্ট্য:

এই কাব্যের দুটি বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার– (ক) জনগণের সমস্যাকে তুলে ধরা এবং অনেক সময় তার সমাধানের সুস্পষ্ট নির্দেশ, যা অনেক সময় কবিতার নান্দনিক আবেদন নষ্ট করেছে। (খ) ব্যঙ্গ বিদ্রূপের মধ্য দিয়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক সমস্যা ও মধ্যবিত্তের দোলাচলবৃত্তি তির্যক-শাণিত ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে; যেমন

“একদা ছিলাম উচ্চ আশার কৈলাসে 

ধূলিসাৎ বটে সে বাল্যখিল্য স্বপ্নরা; 

আজো হাসি, তাও মুখভঙ্গির অভ্যাসে 

দগ্ধ হৃদয় হাওয়ায় মেলতে পথে ঘোরা।

এর সমাধান হল

কৃষক, মজুর। আজকে তোমার পাশাপাশি 

অভিন্ন দল আমরা। বন্ধু, আগে চলো-

সবাই আমরা নিজ বাসভূমে পরবাসী; 

এই দোলাচল দলকে কেবল পথ বলো।।”

বলা বাহুল্য, দ্বিতীয় উদ্ধৃতির মধ্যে রাজনৈতিক বক্তব্য যতটা প্রধান, কবিতার প্রকাশ ততটাই সঙ্কুচিত। অবশ্য শুধু বিদ্রোহ-বিপ্লবের বাণীতে ‘পদাতিক’ উত্তপ্ত নয়, রবীন্দ্রনাথের গাঁয়ের বধূর শহরে এসে একা হয়ে যাওয়ার বেদনাও গুমরে মরেছে

“ইহার মাঝে কখন প্রিয়তম

উধাও; লোক লোচন উঁকি মারে

সবার মাঝে একলা ফিরি আমি

লেকের জলে মরণ যেন ভালো”।

আবেগের সঙ্গে বহির্বিশ্বের অপরূপ সমন্বয়ে সুভাষের ‘চিরকুট’ কাব্যটি উজ্জ্বল। এখানে কবি অভিজ্ঞতায় অনেক সুস্থির, বিশ্বাসের দীপ্তিতে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর কখনও বিদ্রুপে ব্যঙ্গে তীক্ষ্ণ, কখনও বা আবেগে ব্যথায় বিধুর। তাই এগিয়ে চলার গান বিপ্লবের সম্ভাবনায় সংহত হয়

“গঙ্গার জোয়ারে এসে লাগে

ভল্লার তীরের স্পর্শ

চোখে নব সূর্যোদয় জাগে;

মুক্তি আজ বীরবাহ

শৃঙ্খল নেমেছে পরাভব ;

দিগন্তে দিগন্তে দেখি

বিস্ফরিত আসন্ন বিপ্লব।”

এখানে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ, ভারতবর্ষে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, ৪২-এ দুর্ভিক্ষের দুঃস্বপ্ন ইত্যাদি বহুবিধ প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে ‘স্ফুলিঙ্গ’, ‘জবাব চাই’, ‘প্রতিরোধ প্রতিজ্ঞা আমার’, ‘ফের আসবো’, ‘এই আশ্বিনে’, ‘চিরকুট’ প্রভৃতি কবিতায় ; যেমন দুর্ভিক্ষের সহানুভূতি-সিক্ত ছবি

“হাত পাতবো কার কাছে

গাঁয়ে সবার দশা এক

তিন সন্ধ্যে উপোস দিলাম

আজ খাচ্ছি বুনো শাক”-

পরবর্তী ‘অগ্নিকোণ’ মাত্র পাঁচটি কবিতার সমষ্টি। এখানে কবি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সংবাদে উদ্বেলিত। “অনামী পাহাড়ে মেকং নদীর বানডাকা জলে” ঘুম ভেঙে জেগে ওঠা ‘অগ্নিকোণের মানুষ কিভাবে সংগ্রামের বীরত্বের সৃষ্টির সূচনা করেছে তার পরিচয় আছে এই অংশে

লক্ষ লক্ষ হাতে

অন্ধকারকে দু’টুকরো ক’রে

অগ্নিকোণের মানুষ 

সূর্যকে ছিঁড়ে আনে।”

বলা বাহুল্য, এই সূর্য গ্রহমাত্র নয়, তা ফ্যাসিস্ট শক্তি জাপানের প্রতিবিম্ব স্বরূপ। আর অগ্নিকোণের মানুষ চীনের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী মানুষ যাদের প্রয়াসে “পোড়া মাঠে মাঠে বসন্ত ওঠে জেগে”।

এই কাব্য রচনার উদ্দেশ্য ব্যাখ্যায় কবি স্বয়ং সুবীর রায়চৌধুরীকে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন : “৪৮-এর পার্টি দৈনিকে টাকা তোলার জন্য লিখি ‘অগ্নিকোণ’ অর্থাৎ In and For—উভয়তই অগ্নিকোণ। রাজনীতিকে সঙ্গে নিয়েই রাজনীতির জন্যেই অগ্নিকোণের প্রকাশ।

রাজনৈতিক দিক থেকেও এই সময়টি গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৮ খ্রীস্টাব্দে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে গৃহীত হয়েছে উগ্র বাম এক ঝানোভীয় নীতি। ডাক দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্র দখলের জন্য সশস্ত্র গণ-অভ্যুত্থানের। ফলস্বরূপ পশ্চিমবঙ্গে পার্টি হয়েছে নিষিদ্ধ, কর্মীরা হয়েছেন কারারুদ্ধ। কবি নিজেও হয়েছেন বন্দী। একবার নয়, পর পর দু’বার—১৯৪৮-এর জুন এবং ১৯৫০-এর নভেম্বরে। প্রথমবার জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দ্বিতীয়বার জেলে যাওয়ার মধ্য পর্বে লেখেন ‘মিছিলের মুখ’ নামে একটি অনবদ্য কবিতা।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মিছিলের চিত্রকল্প:

কবিতাটির পটভূমি সম্ভবত মিছিল নগরী কলকাতা। আন্দোলনে বিক্ষোভে তাপিত মিছিলের পূর্ব এবং পরের অবস্থা এই কবিতায় বর্ণিত। অবশ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় ‘মিছিলে’র ব্যবহার এই প্রথম নয়, তা এক বহু পরিচিত চিত্র। তার ‘লাল টুকটুকে দিন’ বা ‘জয়মণি স্থির হও’ ইত্যাদি কবিতায় বা অন্যত্র ‘মিছিল’ শব্দের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটে বারবার। বস্তুতঃ ‘মিলিত অগ্রগতি’র (পদাতিক) গান দিয়েই তো শুরু হয় তার চলা, উচ্চকিত কণ্ঠস্বরে শুরু হয় কথা বলা। তিনি নিজেই কত মিছিলের পদযাত্রায় অংশী ও সঙ্গী। কিন্তু লক্ষ্য করা যায়, বর্তমান কবিতায় কবির ভূমিকা অন্যরকম। এখানে কবি স্বয়ং মিছিলের উত্তাল স্রোতে ভাসমান না হয়ে মিছিলের স্মৃতিচারণায় (মিছিল দেখেছিলাম’) যেন একটু সরে গিয়ে মিছিলের অগ্রগতি লক্ষ্য করেছেন। বলা বাহুল্য, এই দূরত্ব রক্ষার মধ্যে নান্দনিক অভিপ্রায় নিহিত। সমকালীন বা বর্তমান ঘটনাকে সুষ্ঠু ও সম্পূর্ণভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার প্রয়োজনে শিল্পীকে অনেক সময় নির্লিপ্ত দর্শকের ভূমিকা নিতে হয়। এখানেও দেখা যায় কবিতায় প্রথমাংশে অতীত ক্রিয়াপদের ব্যবহারে মিছিলের একটি পূর্ণ চিত্র : “মিছিলে দেখেছিলাম একটি মুখ, / মুষ্টিবদ্ধ একটি শাণিত হাত / আকাশের দিকে নিক্ষিপ্ত; বিস্রস্ত কয়েকটি কেশাগ্র/আগুনের শিখার মত কম্পমান।” মিছিল কোন একটি মুখের বা হাতের চিত্র নয়, এ কথা সত্য। কিন্তু দূর থেকে আসা সারিবদ্ধ এক শব্দ এক সুরে, এক তানে এক তালে উত্তোলিত হাত জনসমষ্টিকে একটি নিরেট প্রতিজ্ঞায় স্থিত এক পূর্ণমানুষের ভাবমূর্তিতে দেখাতে পারে (অথবা প্রথম মুখটিই সমবেত আবেগের রূপমূর্তি হয়ে উঠতে পারে)। সেদিক থেকে মিছিলের সামগ্রিক ছবি সমবায়িক আবেগে উদ্ভাসিত একটি মুখের রূপ নেয়; “ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের ফেনিল চূড়ায়” যা ফসফরাসের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠে কবি-দর্শকের কাছে।

২৬শে মার্চ ১৯৪৮-এ অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ঘোষিত হলে মার্কসবাদী বা সাম্যবাদী চিন্তাধারার বাহক গ্রন্থ ও পত্রিকা প্রভৃতি নিষিদ্ধ হয়। সেক্ষেত্রে সাম্যবাদী ভাবধারার প্রচার অব্যাহত রাখার প্রয়োজনে পার্টির ‘আন্ডারগ্রাউণ্ড সেলটার’ থেকে বিলি করা হত গোপনে রাজদ্রোহমূলক ইস্তাহার। সেই বাস্তবসত্য কাব্যসত্য হয়ে দেখা দিয়েছে এই কবিতায় কবির স্বীকারোক্তিতে : “অন্ধকারে হাতে হাতে তাই গুঁজে দিই আমি / নিষিদ্ধ এক ইস্তাহার”। এখানে ‘অন্ধকার’ শব্দের মধ্যে সেই ভয়ার্ত সময়ের সংবাদ আছে, আছে “হাতে হাতে” এই দ্বিত্ববোধক শব্দপ্রয়োগে পরিবর্তনে প্রতীক্ষায় আকুল লক্ষ লক্ষ মানুষের নীরব উল্লেখের নাটকীয় ব্যবহার। আবার “উদ্বেলিত মিছিলে একটি মুখ দেহ পায়”—এই আকাঙক্ষায় কবির ডাক দেওয়ার মধ্যে বিপ্লবের ভাবরূপ বাস্তবায়িত হওয়া কিংবা নেতৃত্বের আবির্ভাব ঘটছে—এই দুই কামনা পরিপূর্ণ হওয়ার ইঙ্গিত হতে পারে।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যে চিত্র প্রকরণ:

১৯৫১ থেকে ১৯৫৭-র বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও পূর্ণতায় পরিস্ফুট ‘ফুল ফুটুক’ কাব্যগ্রন্থ। এখানে কবির দৃঢ় প্রত্যয়ে ঘোষণা—

“ফুল ফুটুক না ফুটুক

আজ বসন্ত”।

এই কাব্যের কবিতাগুলির রচনাভঙ্গী ও বক্তব্যের মধ্যে পরিবর্তন ও পরিণতির সুর স্পষ্ট। আবেগের উঁচু পর্দায় কবিতার সুরে পাঠক ডাকার রীতি এখানে পরিত্যক্ত। ব্যাপকতর জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে খুঁটিনাটি ঘটনা ও বহির্বিশ্বের প্রতি কবির দৃষ্টি নিবদ্ধ। তাই এখানে কবিতা যেমন ছবির দৃশ্যে আবদ্ধ, তেমনি সহজ সরল দৈনন্দিন ভাষায় সমৃদ্ধ। বস্তুত, এর মূলে ছিল কবির কবিতার ভাষা ও শিল্প সম্পর্কে নব নব অভিজ্ঞতা সঞ্চয়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘অগ্নিকোণ’ এবং ‘ফুল ফুটুক’ কাব্যের কবিতা রচনার মধ্যবর্তী কালে নাজিম হিকমতের কবিতা অনুবাদ করতে গিয়ে উপলব্ধি করেন : “সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে জীবন প্রতিফলিত। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে যা কিছু সংঘাত সংগ্রাম আর প্রেরণা, জয় পরাজয় আর জীবনের ভালোবাসা, খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব কটি দিক। সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যা ধারণা দেয় না। কবিতার গদ্যের আর কথা বলবার ভাষার বিভিন্নতা নতুন কবি স্বীকার করেন না। এমন এক ভাষায় তিনি লেখেন—যা বানানো নয়, কৃত্রিম নয় সহজ, প্রাণবন্ত, বিচিত্র, গভীর, একান্ত জটিল—অর্থাৎ অনাড়ম্বর সেই ভাষা” (‘নাজিম হিকমতের কবিতা’, মুখবন্ধ)।

প্রকৃতপক্ষে ‘ফুল ফুটুক’, ‘যত দূরেই যাই’, ‘কাল মধুমাস’ তিনটি কাব্যেই কবিতা যেমন জীবন ও জগতের প্রাত্যহিক উপাদানের ছবিতে ভরা এ্যালবাম। সাম্যবাদের গৎ-বাঁধা বিশেষণ বাদ দিয়ে চিত্রকল্পের অভিনব নিরীক্ষায় কবিতা একেবারে কথ্য গদ্যের চালে উপস্থিত

“জলায় এবার ভাল ধান হবে-

বলতে বলতে পুকুরে গা ধুয়ে

এ বাড়ির বউ এল আলো হাতে 

সারাটা উঠোন জুড়ে

অন্ধকার নাচাতে নাচাতে।”

অন্ধকারের এই কম্পিত চিত্র বাংলা কাব্যের জগতে প্রায় দুর্লভ।

অথবা

“আজও দেখতে পাচ্ছি-

হিরণ্যগর্ভ দিন

হাতে লক্ষ্মীর ঝাপি নিয়ে আসছে।

গান গেয়ে

আমাকে বলছে দাঁড়াতে। 

গুচ্ছ গুচ্ছ ধানের মধ্যে দাঁড়িয়ে

তার বলিষ্ঠ হাত দুটো আমি দেখতে পাচ্ছি”

(“এখন ভাবনা” (১) ‘ফুল ফুটুক’)

এই কাব্যেরই অন্তর্ভুক্ত একটি বিশিষ্ট কবিতা ‘সালেমনের মা’। কবিতাটি কাহিনী নির্ভর। কাহিনীটি এইরকম পঞ্চাশের দশকে এক জোলা পরিবারের মানুষ দিন-মজুর বাবরালির আকালের উৎকণ্ঠায় মাথা খারাপ হয়ে যায়। তার মেয়ে সালেমন তখন ছোট। মেয়ে কোলে সালেমনের মা ফিরে আসে বাপের বাড়ি। কিন্তু সেখানেও বাপ-ভাইয়ের জীবন রুজি-রোজগারের জন্য হয় প্রাণান্ত। অগত্যা সালেমনকে রেখে তার মা কলকাতা যাবার নাম করে হারিয়ে যায়। সালেমন তাকে খুঁজতে বেরোয়। পথে চটকল মজুরদের বোনাসের দাবির মিছিলে সে সামিল হয়। আর সেইসুত্রে সালেমনকে নিয়ে গড়ে ওঠে এই অসাধারণ চিত্রময় কবিতা

“বারবার পিছিয়ে পড়ে 

বাবরালির মেয়ে সালেমন 

খুঁজছে তার মাকে

……….

বাবরালির চোখের মত এলোমেলো

এ আকাশের নিচে কোথায় 

বেঁধেছ ঘর তুমি, কোথায়

সালেমনের মা?

…………

এক আকালের মেয়ে তোমার 

আরেক আকালের মুখে দাঁড়িয়ে 

তোমাকেই সে খুঁজছে।”

আমাদের চারপাশে ছড়ানো এ ধরনের অবহেলিত ভাঙা-চোরা জীবন নিয়ে কবিতা রচনার প্রয়াস এর পরেও দেখা গেছে ‘মা তুমি কাঁদো’, ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক’, ‘অগ্নিগর্ভ’, ‘বাসীমুখ’, ‘একটি লড়াকু সংসার’ ইত্যাদি কবিতায়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যে আঙ্গিক প্রকরণ:

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার আঙ্গিক নির্মাণরীতির বিশেষত্ব ও বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতো। পুরাণ-প্রতিমা, চিত্রকল্প, ভাষা, ছন্দ, স্তবক-বিন্যাসে শিল্প নিষ্ঠা বিস্ময়কর। এই নিষ্ঠার বশেই তিনি কবিতার মধ্যে রাজনৈতিক ভাব প্রকাশে সক্রিয়। সহজ সর্বজনবোধ্য আটপৌরে ভাষা উপস্থাপনায় উৎসাহী।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যে পুরাণ প্রসঙ্গ:

এই উপস্থাপনায় পুরাণ-প্রসঙ্গ এসেছে সহজ সর্বজনপরিচিত ভাবনায়। শকুনি-রণচণ্ডী, কুম্ভকর্ণ-দধীচির হাড় প্রভৃতি বিভিন্ন পুরাণ প্রতিমায় তাঁর কাব্য সুসজ্জিত। ‘চিরকুট’ কাব্যের ‘প্রতিরোধ প্রতিমা আমার’ কবিতায় দেখা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সঙ্কট, মিউনিখ চুক্তির ব্যর্থতায় সর্বনাশা যুদ্ধ শুরু হওয়ায় সংবাদে কবি বলেছেনঃ শকুনির নখে, চোখে “উন্মত্ত হিংসায় লুব্ধ লালা ঝরে”। যারা ছিল মিত্র, তারা আজ ভিন্ন : “এদিকে বেড়েছে বৈরী কলির গোকুলে”। আজকের সভ্যতাকে অলক্ষ্যচারী শত্রু ধ্বংস করবে। চণ্ডী ও দৈত্যের লড়াই তুল্য এই যুদ্ধঃ “অরণ্য পর্বত শোনে রণচণ্ডী সাঁজোয়ার নহবতে আজ / আনি গুহার সুর” চতুর্দিকে ভাঙন / ও ধ্বংসের মধ্যেই পাওয়া যাবে বাঞ্ছিত মুক্তি : “তবু এই দধীচির হাড় / ধ্বংসের বন্যাকে বাঁধবে, খুলে দেবে মুক্তির দুয়ার”। কবি নিজেই যেন এই দধীচির বেনামদার।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অনেক কবিতায় রামায়ণ-মহাভারতের অনুষঙ্গ দেখা যায়। অস্থির, বিপন্ন দেশ তাঁর চোখে ‘কুরুক্ষেত্র’; অত্যাচারীরা ‘দুঃশাসন’ বা ‘শকুনি’, যেমন ‘অগ্নিকোণ” কবিতা : “অন্ধকারের বুকে হাঁটু দিয়ে দুহাতে উপরে আনে দুঃশাসনের ভিৎ”। আবার রামায়ণে ভস্মলোচনের উপাখ্যানে দেখা যায়, রাবণ রামকে মারবার জন্য শিবের বরে বলীয়ান ভস্মলোচনকে পাঠান এই আশায় যে, তার দৃষ্টিমাত্রে সব ভস্ম হয়ে যাবে। কিন্তু দর্পণ বাণ মেরে রাম তার চারদিকে এক প্রতিবিম্বের বেড়াজাল তৈরি করেন। যে দর্পণে নিজেকে দেখে সে ছাই হয়ে যায়। অনুরূপভাবে শোষক ও অত্যাচারীর দল যে কৃতকর্মের ভোগ করে ধ্বংস হচ্ছে, তার কারণ “রক্তের লাল দর্পণে মুখ দেখে / ভস্মলোচন”। এইরকমভাবে ‘ছেলে গেছে বনে’ কবিতায় অন্ধ মুনির প্রসঙ্গ ইক্ষ্বাকু বংশের রাজার কথা, ‘ধর্মের কল’ কবিতায় তৃতীয় পাণ্ডবের উল্লেখ দেখা যায়।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যে রূপকথা-লোককথা প্রসঙ্গ:

‘সাত ভাই চম্পা’র প্রসঙ্গ নিয়ে রূপকথার আর্কিটাইপে লেখা হয় ‘পারুল বোন’ কবিতা। রাজনৈতিক অত্যাচারে বন্দিনী কারাগারে দিন গুনছে মুক্তির“শুয়ে শুয়ে দিন গুনছে / পারুল বোন আমার” আবার ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র প্রসঙ্গ অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদহীনতার প্রসঙ্গে এসেছে : “কাড়ে না কেউ রা / ভালোমানুষের ছাঁ”। ‘যেতে যেতে’ কবিতায় আছে দুমুখো নদীর গল্প বলতে বলতে রাজকন্যার কথা। কবির কাছে যা একদিন হয়েছিল জীবন-সর্বস্ব, আজ “সেই রাক্ষুসীই আমাকে খেলো”। আবার লোকটা জানল-ই না’ কবিতায় বুক পকেটের নিচে হৃদয়ের খোঁজ পাওয়ার আনন্দ হয়ে উঠে “আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ”।

“দিয়েন বিয়েন ফুঃ’ কবিতায় লৌকিক আচার বিশ্বাস কবিকে সাপে কাটা বর্তমান জগতকে বাঁচাবার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছে : “যা রে / সাপের বিষ / দিয়েন বিয়েন ফুঃ”। “গাজনের গান’ কবিতার মধ্যেও আছে লৌকিক বিশ্বাসের প্রতিফলন। কখনও বা গার্হস্থ্য জীবনের সুখ-শান্তির প্রতীকরূপে দেখতে পান “সারি সারি লক্ষ্মীর পা”।

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের নাটকীয়তা ও গল্পময়তা:

চরিত্র ও ঘটনার নাটকীয়তা এবং ছোটগল্পের কথন রীতি তাঁর কবিতার আঙ্গিককে ব্যাপ্তি ও গভীরতা দিয়েছে। লিরিক কবিতায় গদ্যধর্মিতার এমন অপরূপ সংযোগ তার পূর্বেকার কবিতায় বিরলদৃষ্ট; যেমন—

“আরে! মুখুজ্যে মশাই যে! নমস্কার, কী খবর?

আর এই লেখা-টেখা সংসার-টংসার নিয়েই ব্যস্ত

(“মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ”, “যত দূরেই যাই’)

এই কবিতার প্রেরণায় একজন উদীয়মান গল্পকার লিখেছেন ‘জুতোর পেরেক’ গল্প। তার ‘সালেমনের মা’ কবিতা থেকে কিভাবে গল্প লেখার প্রেরণা পেয়েছেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় ‘ছোটগল্পের সীমারেখা’তেও তা সবিস্তারে জানিয়েছেন। আবার যেতে যেতে’ কবিতা শুরু হয়েছে রূপকথার ঢঙে

“তারপর যে-তে যে-তে যে-তে

এক নদীর সঙ্গে দেখা”

‘ঘোড়ার চাল’ কবিতায় আছে সংলাপের ঢঙ—

“তোমাদের রাজ্যগুলোকে সামলাও হে, নইলে

এক কিস্তিতেই মাত যে।”

সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্যে ছন্দরীতি:

অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্ত ছন্দের সূক্ষ্ম পরীক্ষায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা সমৃদ্ধ। স্তবক-বিন্যাসের নতুনত্ব দেখা গেছে একাধিক কবিতায়; যেমন—

“আমি তারস্বরে চেঁচিয়ে বললাম :

জয়মণি, স্থির হও

হে কালবৈশাখী, শান্ত হও-

এই নতুনত্ব আর বাগ্‌ভঙ্গীর বলিষ্ঠতা নিয়ে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আজও বাংলা কবিতার জগতে দীপ্তিমান।