বাংলা কাব্যে মাইকেল মধুসূদন দত্ত

“Will not this make me immortal”— মেঘনাদকাব্যের প্রুফ সংশোধনের সময় রাজনারায়ণ বসুকে এই প্রশ্নটি করেছিলেন যিনি তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর ঐতিহ্যপুষ্ট, বিবর্তনশীল যুগমানসের উজ্জ্বল প্রতিভু—মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

ভারতচন্দ্রের সম্ভোগময় কেলিবিলাস, কবিয়ালদের যাযাবরী উদ্দামতাই ছিল ঈশ্বর গুপ্তের কাব্যের পরিবেশ-শাসিত রুচি-নিষ্ঠার ফসল। শিক্ষিত বাঙালীর মন যদিও উচ্চতর সাহিত্যাদর্শের জন্য ছিল পিপাসার্ত, কিন্তু তবু উপযুক্ত প্রতিভার অভাবে কাব্যের নির্ঝরিণী ধারা ছিল অবরুদ্ধ। প্রতিভার ঐশ্বর্য নিয়ে বিপ্লবী মধুসূদনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে কাব্যের ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ” হলো শতধারায় উচ্ছ্বসিত। জ্ঞানতরুণ পাশ্চাত্যের সঙ্গে প্রাচ্যের ঘটল মিলন। আর বাংলা সাহিত্যও কৌমার্যের বন্ধন ঘুচিয়ে যৌবনকে জানাল সাদর আমন্ত্রণ।

মাইকেল মধুসূদন দত্তের রচনাসমূহ:

(ক) বাংলা কাব্য : ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ (১৮৬০), ‘মেঘনাদবধকাব্য’ (১৮৬১), ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬১), ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২), চতুর্দশপদী কবিতাবলী’ (১৮৬৬)।

(খ) ইংরাজি কাব্য: ‘Captive Ladies (1849), ‘Visions of the Past’ (1849), ‘Tilottama’ (Incomplete) ‘Queen Seeta’ (Incomplete), Upsori (Inc.), Miscellaneous poems.

“বিকশিত বিশ্ব-বাসনার অরবিন্দে” তিলোত্তমার “অতি লঘুভার পাদপদ্ম” বন্দনা করে কবির সারস্বত সাধনার হল প্রথম উদ্বোধন। উদাত্ত অমিত্র-ছন্দে ও পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে সে বাঙালী পাঠকের মনোলোকে পেল প্রবেশের ছাড়পত্র। কীটস্-এর ‘Hyperion’ কাব্যের রূপায়ণে পরাজিত দেবতাদের চিত্র ও সুন্দ-উপসুন্দের দৃপ্ত পৌরুষ, এবং তিলোত্তমাকে কেন্দ্র করে দুজনের জীবন-সমাধি সংক্ষেপে এই হল কাব্যটির কথা ও কাহিনী। ব্যভিচার-মত্ত জীবন চিত্রায়নই সুন্দ-উপসুন্দর মধ্য দিয়ে সঙ্কেতিত। পৌরুষ, দার্ট ও বীর্যবত্তা থাকা সত্ত্বেও সম্ভোগের ইন্ধনে দিতে হয়েছে জীবনাহুতি। এ কাব্যের মধ্যে কতকগুলি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়—

  • (১) এই কাব্যটির মধ্য দিয়ে প্রথম আখ্যান কাব্যের সূচনা হয়।
  • (২) সুন্দ-উপসুন্দের চরিত্র সৃষ্টিতে কবির সৃষ্টি ক্ষমতার অভিনবত্ব অনায়াসলক্ষ্য। দেবমহিমায় মুখরিত দেশে প্রথম মানব-মহিমার জয়গান করে কবি গতানুগতিকতা ভাঙতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
  • (৩) বাংলা কাব্য জগতে লিরিকের দীপ জ্বালিয়ে কবি নারীর মোহিনীশক্তির পুরাকাহিনী শুনিয়েছেন। তিলোত্তমা এখানে শুধু মাত্র রূপোত্তমা নয়, তা কবির বিশুদ্ধ সৌন্দর্য-স্বপ্নের মানস-মূর্তি। কবি সেই সৌন্দর্যের রূপাঙ্কনেই মুগ্ধবিবশ। নারীর এই বিশ্ববিজয়িনী মূর্তির কল্পনা পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথের ‘উর্বশীর’ মধ্যে দেখা গেছে।
  • (৪) অমিত্রাক্ষর ছন্দ-স্রোতের উল্লোল গর্জন এ কাব্যের মধ্যে দিয়ে প্রথম ধ্বনিত হয়। তবে কাব্যটিতে কবির শিক্ষানবিশীর চিহ্ন সর্বত্র বিদ্যমান তাই এ কাব্য ত্রুটিমুক্ত নয়।

সূর্যোদয়ের আগে অরুণরশ্মির পাবকস্পর্শে সুপ্ত চৈতন্য যেমন জাগ্রত হয়, তেমনি ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের আগে ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্যে’ সেই রকম সম্ভাবনার আভাস ছিল। বিশ্বন্ধর প্রতিভার বিস্ময়কর প্রকাশে যা ছিল অস্পষ্ট “মেঘনাদবধ কাব্যে’ তাই হল মূর্ত। এরপর থেকেই কবির মৌলিকতা স্বকীয় ধারায় অভিব্যক্ত। দেব-প্রধান দেশে মানব মহিমার বিজয় ঘোষণা, সঙ্গীত-মুখর গীতিকাব্য রচনা, অভিনব পত্রকাব্য সৃষ্টি, ইতালীয় মিত্রছন্দের আশ্চর্যপ্রয়োগ ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের পরিপূর্ণ বিকাশ ইত্যাদি। ‘Captive Ladie’-র ছদ্মনামের কবি ‘Timothy Pen Poem Esq’ চিরতরে হল নির্বাসিত।

যাবতীয় ক্লাসিক সাহিত্য আরব্য রূপকথার ফিনিক্স পাখির মতো যুগে যুগে আপন দেহ হতে নবতর সৃষ্টির উপাদান যোগায়। সেই সাহিত্য মানবমনকে আনন্দদান করে। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলো না। কিন্তু রামায়ণের কাহিনী থেকে মেঘনাদের আখ্যায়িকা নির্বাচিত হল কিন্তু মধুসূদন তাকে এমনভাবে রূপ দিলেন যা “মহাকবির কল্পনাতে ছিল না তার ছবি।” আবার শুধু পথ চাওয়া আর পথ চলাই শিল্পীর ধ্রুব-কামনা নয়, তার লক্ষ্য নতুনভাবে সৃষ্টি। হোমারের ‘ওডিসি’ কাব্য টেনিসনের ইউলিসিসে নতুনভাবে সঞ্জীবিত। এখানেও পাই তার পরিচয়। কাব্যটির কায়ানির্মাণে মধুকবি মাধুকরীবৃত্তির আশ্রয়ী—হোমার, ভার্জিল, দাত্তে, ট্যাশো, মিলটন প্রমুখ পাশ্চাত্ত্য কবি এবং বাল্মীকি, কালিদাস, কৃত্তিবাস, কাশীরাম দাস ইত্যাদি প্রাচ্য কবির “চিত্তফুলবন মধু” আহরণ করেই এই অনন্যসুন্দর কাব্যটি সৃষ্টি করেছেন। তবু কাব্য মধ্যে কবি কল্পনার মৌলিকতা লক্ষ্য করা যায়।

মধূসূদনের মেঘনাদবধ মহাকাব্যের শিরোপায় ভূষিত এটি কাব্য। যেমন Authentic Epic নয়, তেমনি আবার Literary Epic-এর পরিপূর্ণ বৈশিষ্ট্য থেকেও এর মধ্যে আরও কিছু উপাদান বিদ্যমান। আলঙ্করিক বিশ্বনাথ কবিরাজের ‘সাহিত্যদর্পণ’ গ্রন্থানুসারে মহাকাব্যের মধ্যে (১) ত্রিলোকব্যাপী বিস্তার, (২) অষ্টাধিক সর্গ, (৩) রাজর্ষি ধীররত্ন গুণান্বিত নায়ক, (৪) শৃঙ্গার, বীর অথবা শাস্তের মধ্যে যে কোন একটি অঙ্গীরস, (৫) কাব্যের পরিণামে মহাশান্তির ললিত বাণী শোনাতে হবে।

মহাকাব্যের নায়ক কল্পনাতেও মধুসূদন উত্তমর্ণের মহিমা-স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। কাব্যের নায়ক–বিচারে মতদ্বৈধ থাকলেও রাবণ-চরিত্রের ভাবমূৰ্চ্ছনায় যে প্রধান রাগটি সঙ্গীতায়িত হয়েছে, তা হল ‘দেশানুরাগ’ বা জাতীয়তাবাদ। বিশ্বনাথের ‘সাহিত্যদর্পণ’ যেখানে নীরব, মধুসূদন সেখানে এক নতুন ভাবনার প্রবর্তক : “কি সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে প্রচেতঃ / হা ধিক্ ওহে জলদলপতি! / এই কি সাজে তোমারে অলঙ্ঘ্য অজেয় তুমি?” সমুদ্রকে লক্ষ্য করে এখানে তার জাতিগত প্রতিনিধিত্ব উদ্‌ঘাটিত। আবার “হৃদয়বৃত্তে ফুটে যে কুসুম, / তাহারে ছিড়িলে কাল বিকল হৃদয় ডোবে শোকসাগরে, মৃণাল যথা জ্বলে যাবে কুবলয়ধন লয় কেহ হরি” আক্ষেপে বীরবাহুর মৃত্যুতে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন বেদনার কথা শোনা যায়। তার সাজানো বাগান ধীরে ধীরে শুকিয়ে গিয়ে বীরশূন্য লঙ্কা বিষাদপুরীতে পরিণত হয়েছে। কাব্যের শেষ সর্গে চারিদিকের মহাশূন্যতার মাঝে একটি বৃহৎ বনস্পতি পত্রহীন শাখা-প্রশাখাগুলি রৌদ্র জ্বালাময় আকাশের দিকে প্রসারিত করে ভগ্ন হৃদয়ের যে নীরব আর্তি জানিয়ে যাচ্ছে তা অনন্তকালের মধ্যে যেন পরিব্যাপ্ত হয়েছে : “ছিল আশা, মেঘনাদ, মুদিব অস্তিমে / এ নয়নদ্বয় আমি তোমার সম্মুখে / সঁপি রাজ্যভার, পুত্র তোমায় করিব মহাযাত্রা! /… কোথা পুত্র পুত্রবধূ আমার? শুধিবে / যবে রাণী মন্দোদরী—কি সুখে আইলে / রাখি দোঁহে সিন্ধুতীরে, রক্ষোকুলপতি? / কি কয়ে বুঝাব তারে? হায় রে কি কয়ে?” অনেকের মতে, রাক্ষসের মধ্যে দিয়ে উনিশ শতকের নিয়তি-লাঞ্ছিত বাঙালীর পরিচয় আভাসিত।

নারী চরিত্র নির্মাণে মধুসুদনের কবি-মানস বাঙালী সংসারের প্রতি আবদ্ধ। শুধু সীতা সরমাই নয়, প্রমীলার চরিত্রনির্মাণেও কবি বাঙালীর সর্বজনপরিচিত সংস্কারের প্রতি যেন মুগ্ধবিবশ। সপ্তম সর্গে সুশোভনা প্রমীলার সঙ্গে সখী বাসন্তীর সংলাপের মধ্য দিয়ে আসন্ন বিলাপমুখর লগ্নের আভাস যেন “মুহূর্তের দীপের শাশ্বত শিখায়” আভাসিত হয় “বামেতর আঁখি মোহ নাচিছে সতত; / কাদিয়া উঠিছে প্রাণ। না জানি সজনি! / হায় লো, না জানি, আজি পড়ি কি বিপদে?”

আবার তৃতীয় সর্গে তার দৃপ্ত মূর্তি দাহিকায় দীপ্তশিখায় উদ্ভাসিত : “পর্বতগৃহ ছাড়ি | বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে / কার হেন সাধ্য সে যে রোধে তার গতি?” ট্যাসোর ক্লরিণ্ডা, ভার্জিলের ক্যামিলা, হোমারের এথেনী চরিত্রের সঙ্গে কাশীরাম দাসের ‘অশ্বমেধ পর্বের’ ‘প্রমীলা’ ও মার্কণ্ডেয় চণ্ডীর সুষম সাজুয্যে এবং বাঙালী নারীর পতিপ্রাণতা, কুসংস্কার প্রবণতা, ইত্যাদি সুকুমার মনোবৃত্তির শাশ্বত চিত্রণে এ চরিত্র পাঠকচিত্তে আজও অনশ্বর হয়ে আছে।

“I come out like a tremendous commet”—কবির এই সত্যোচ্চারণ অমিত্রাক্ষর ছন্দের মধ্যেই ধ্বনিত হয়। মিলটনের ‘Blank Verse’-এর উৎস-মুখ হলেও এখানে তার মৌলিকতা সর্বজনস্বীকৃত। এ ছন্দ কবি কল্পনায় সঞ্চারিত যেন এক সংস্কার। “যাদঃপতি রোধঃ যথা চলোমি আঘাতে” প্রবহমানতার ছন্দে বাঙালীর অন্তলোক হল স্পন্দিত। শুধু ছন্দ নয় চিন্তার কৌলীন্য ও ভাষার ঈশিত্ব তাঁর কাব্যের এক মূল্যবান অভিজ্ঞান। অলঙ্কৃত বাণীমঞ্জরী মধুসূদন কাব্যমালঞ্চের দৃশ্যরূপ। তিনি ইংরেজি alexan drine-এর মতো, ইতালীয় Ottava Rima-র মতো স্তবক বিন্যাস করেছিলেন বাংলা কবিতায়। ওড, এপিসল, সনেট, লা ফঁতেজের আদর্শে নীতিকবিতা লিখেছিলেন।

ইতালীয় ‘Ottava Rima’ নামক ছন্দের অনুকরণের Lyrical Ode বা ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্যের’ সৃষ্টি হয়। কবির বৈষ্ণব পদাবলী সম্পর্কে মনোভাব ছিল এইরকম”I hate gwalla Krishna but I have a poor sympathy for Miss Radha”. তাই মানবদুর্লভ আধ্যাত্মিক ব্যঞ্জনা নয়, যুগযুগান্তকারী মানব-মানবীর জীবনলীলা ও নিখিল নিসর্গের অকথিত বাণীই একাব্যের ধ্রুবপদ

“সাগর উদ্দেশে নদী   ভ্রমে দেশে দেশেরে

অধিবাস গতি,

আমার প্রেম-নাগর    দুয়ারে মোর সাগর

তারে ছেড়ে রব আমি? ধিক্ এ কুমতি!”

সহজ মানবিক লিরিকের ভাবধারায় কাব্যটি অভিষিক্ত।

ইতালীয় কবি ওভিডের Heroides কিংবা ‘Epistles of Heroines’ পত্রকাব্যের অনুসরণে লেখা হয় “বীরাঙ্গনা কাব্য”। ওভিড়ের মত কবিও কাহিনীর নায়িকা নির্বাচনে ক্লাসিক সাহিত্যের কাছে ঋণী। পুরাণের কৈকেয়ী, শকুন্তলা, জনা প্রমুখ চরিত্রেরা ঊনবিংশ শতাব্দীর বজ্রস্তনিত আকাশতলে দাঁড়িয়ে তাদের নির্বাসিত কামনার বেদনাগুলির কারণ বিশ্লেষণে তৎপর হয়েছে। স্পর্ধিত স্বরে ও সুগর্বিত বিশ্বাসে জীর্ণ সমাজকে উপেক্ষা করে আপন অস্তরের প্রেমকে লালন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞা দেখিয়েছে। নারীর এই দৃপ্ত মূর্তি থেকেই হয়ত পরবর্তীকালে কথাসাহিত্যে মৃণাল, কিরণময়ী, কমলের উদ্ভব হয়েছে। Heroides‌কাব্যের সঙ্গে এর সাদৃশ্য দেখা যায়— ‘দুষ্ম্যক্তের প্রতি শকুন্তলা’র সঙ্গে ‘ইউলিসিসের প্রতি পেনিলোপ’র ‘সোমের প্রতি তারা’র সঙ্গে ‘হিপোলিটাসের প্রতি ফেইড্রা’র, দশরথের প্রতি কৈকেয়ীর’ সঙ্গে ‘দেমোফেনের প্রতি ফিনিস পত্রের। তবু ভাষার গাম্ভীর্যে যতি ও ছন্দের বৈচিত্র্যে, পরিপূর্ণ হৃদয় সংযোগে এ কাব্য এক অনন্য সৃষ্টি হয়ে উঠেছে : “যেদিন কুদিন তারা বলিবে কেমনে / সেদিনে, হে গুণমণি, যেদিন হেরিলে / আঁখি তার চন্দ্রমুখ—অতুল জগতে!” অমিত্রাক্ষর ছন্দের পরিপূর্ণ রূপ এই কাব্যে প্রতিফলিত।

ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসে কবি বন্ধুকে লেখেন “I want to introduce Sonnet into our language.” তাই পেত্রার্কীয় ভাবনায় কবি রচনা করেন “চতুর্দশপদী কবিতাবলী।” ‘sonet’ কথাটির উৎপত্তি ইতালীয় ‘sonetto’ থেকে, যার অর্থ ‘short song, বাংলায় বিন্দুতে সিন্ধুদর্শন। চৌদ্দটি অক্ষর নিয়ে ‘sonet’ নির্মিত। তা আবার ‘অষ্টক’ ও ‘ষষ্টক’ দুটি উপস্তরে বিভক্ত। এক্ষেত্রে মধু-কবি শুধু ‘পথিকৃৎ ই ছিলেন না, ছিলেন অন্যতম নিপুণ শিল্পী। নির্বান্ধব ফ্রান্সে দেশের বটবৃক্ষ, শ্যামাপক্ষী, শিবমন্দির ইত্যাদি ছিল কবির নিত্য সহচর। তাঁর ‘বিজয়াদশমী’ কিংবা ‘আত্মবিলাপে’র সেই শাশ্বত আর্তনাদঃ “আশার ছলনে ভুলি কি ফল লভিনু হায়, তাই ভাবি মনে / জীবনপ্রবাহ বহি কালসিন্ধু পানে ধায় ফিরাব কেমনে” পক্তি যথার্থই “a moment’s monument”। এই অগ্নিবিহঙ্গটি দেশে থাকতে পশ্চিম আকাশ পথে উড়ে চলছিল। কিন্তু বিদেশে আসার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রূপান্তরিত হলেন ‘শ্রীমধুসূদনে’—অগ্নিবিহঙ্গটি শাস্ত, ক্লান্ত-চিত্তে যেন পূর্বপ্রাত্তে প্রত্যাগমন করল। Wordsworth শেক্সপিয়রের সনেট সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন(সনেটের) এই চাবির সাহায্যে হৃদয়ের দরজা তাঁর কাছে উন্মুক্ত হয়েছিল। মধুসূদন সম্পর্কেও এই উক্তি স্মর্তব্য। তিনি সনেটের মধ্যে তাঁর হৃদয়-দুয়ার উন্মুক্ত করে অবরুদ্ধ ভাবরাশিকে অনাবৃত আলোকের মধ্যে মুক্তি দিয়েছিলেন।

মননের দীপ্ত বিলাসে, বিশ্বকেন্দ্রিক আভিজাত্যে এবং ব্যক্তি-চেতনার অতি সজাগ অভিমানে জাতপ্রাজ্ঞ মধুসূদন “ক্ষণিকের অতিথি” হয়েও বাংলা কাব্যে মৃত্যুহীন কৃতিত্ব। বন্ধুর কাছে দুঃখ করে তিনি লিখেছিলেন: “These men (Pundits), my dear Raj, little understand the heart of a proud, silent, lonely man of song”। সহস্ৰ আলোচনায় যা অজ্ঞাত থেকে যায় এখানে তা অভিব্যক্ত। এই নিঃসঙ্গ কবি হৃদয় থেকেই আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার উদ্ভব হয়েছে। তার সামনে যে কাব্যভাষা ছিল তাকে তিনি “found it brick and left it marble”. একদিকে সংস্কৃত ভাষার ‘phrasual music’ অন্যদিকে পাশ্চাত্ত্য মহাকাব্যের ধ্বনিসম্পদ ও ব্যঞ্জনা—এই উভয়ের সমন্বয়েই তাঁর কাব্য রূপায়িত হয়েছে। তাই কবিবন্ধু রাজনারায়ণ কবিকে পরিয়েছিলেন অমরতার স্বর্ণ মুকুট : ‘Your reward is very great indeed immortality.’