বাংলা কাব্যে বিষ্ণু দে
“আমাদের বিরাট সময়
বিশ্বগ্রাহী তাই কৌতূহল,
আমাদের উপমেয় নদী,
স্রোতে স্রোতে চলে নিরবধি।
আমাদের স্থান আর কাল
আজ শুধু সন্ধ্যা সকাল
ভবিষ্যৎ নির্মাণের সুরে
দেখ আছি আমরাই দূরে”।
অতীতের আবেশে বা নিরাশার অতলে না হারিয়ে, নিজের সীমা ও অস্মিতা ছেড়ে দেশ-সমাজ ও জীবনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে, ব্যক্তিকে গোষ্ঠীর মধ্যে উপলব্ধির সংকল্প নিয়ে, কাব্যসাধনায় ব্রতী হয়েছিলেন বিষ্ণু দে। বিশ শতকের তিরিশের দশকে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে তিনি সর্ব কনিষ্ঠ। কিন্তু মননজাত আবেগের প্রকাশে হয়ে ওঠেন বিরলতম।
বিষ্ণু দে-র জন্ম ও কর্মজীবন:
কবির পূর্বপুরুষদের আদি নিবাস ছিল হাওড়ায়। বিষ্ণু দে-র জন্ম হয় ১৮ জুলাই ১৯০৯ খ্রীস্টাব্দে কলকাতার পটলডাঙ্গায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে এম. এ. পাশ করেন। এরপরে প্রথমে রিপন কলেজে পরে প্রেসিডেন্সী এবং ইসলামিয়া বা মৌলানা আজাদ কলেজে ইংরেজী সাহিত্যের অধ্যাপনায় তাঁর কর্মজীবনের সূচনা এবং সমাপ্তি ঘটে। বন্ধু সান্নিধ্যেও ছিলেন ভাগ্যবান। সুধীন্দ্রনাথ, বুদ্ধদেব বসু, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র থেকে শুরু করে সত্যেন্দ্রনাথ বসু, শম্ভু মিত্র, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, যামিনী রায়, রথীন মৈত্র, অর্ঘ্য সেন, সুচিত্রা মিত্র, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখ জ্ঞানী ও গুণীজন সান্নিধ্যে হন সমৃদ্ধ। বিদেশ যাবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, কিন্তু টি. এস. এলিয়টের যে প্রিয় জায়গা নিউ হ্যাম্পশায়ার বা রবার্ট ফ্রস্টের যে প্রিয় জায়গা রকপোর্ট ইত্যাদি জ্ঞানে ইংরেজ ও আমেরিকান কবিদের বাসস্থানের ঠিকানা পর্যন্ত তাঁর অজানা ছিল না। বস্তুত, সাহিত্যপাঠ-সঙ্গীত ও চিত্রের মধ্যেই তাঁর চিত্ত ছিল নিমগ্ন। মার্কসবাদ আবার সেই শিল্পিত মনকে জনমুখী শিক্ষায় শাণিত করেছিল। তিনি জানতেন, কবিতা রচনা মনেরই সজ্ঞানতার স্বয়ংনির্দিষ্ট সক্রিয় বিন্যাসধৃত একটি ব্যাপার যা আধুনিকতাবোধেরই সমার্থক। শেষ অবধি যে কবিতা তিনি রচনা করে বসেন তার সে কবিতাই হয়তো প্রকাশ করে সেইসব আশা-আকাঙ্ক্ষা, উদ্বেগ-ভয়, সেইসব সংশয় বা আস্তিক্য অনুভব যাতে তিনি সচেতন-অবচেতনভাবেই অংশীদার বৃহৎ মানব সমাজের সঙ্গে এবং দেশের মানুষের সঙ্গে চৈতন্যে ক্রমান্বয়ে উত্তীর্ণ”
বিষ্ণু দে-র রচনাসমূহ:
আধুনিক কবিদের মধ্যে বিষ্ণু দে-র কাব্যগ্রন্থ ও অন্যান্য রচনাসমূহের সংখ্যা অপর্যাপ্ত। ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দে ‘আকাদেমি পুরস্কার’, ১৯৭৩ খ্রীস্টাব্দের মার্চ মাসে ‘জ্ঞানপীঠ পুরস্কার’ এবং ‘সোভিয়েট ল্যান্ড নেহেরু পুরস্কারে তিনি সম্মানিত হন।
(ক) বিষ্ণু দে-র কাব্যগ্রন্থ : ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’ (১৯৩৩), ‘চোরাবালি’ (১৯৩৭), ‘পূর্বলেখ’ (১৯৪১), ‘সাত ভাই চম্পা’ (১৯৪৫), ‘সন্দ্বীপের চর’ (১৯৪৭) ‘অন্বিষ্ট’ (১৯৫০), ‘নাম রেখেছি কোমল গান্ধার’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬০), ‘আলেখ্য’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬৫), ‘তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ’ (১৯৫৮), ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ (১৯৬৩), ‘সেই অন্ধকার চাই’ (১৯৬৬), ‘সংবাদ মূলত কাব্য’ (১৯৬৯), ‘ইতিহাসে ট্যাজিক উল্লাসে’ (১৯৭০), ‘রবিকরোজ্জ্বল নিজদেশে’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮০), ‘ঈশাবাস্য দিবানিশা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮১), ‘চিত্ররূপ মত্ত পৃথিবীর’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮২), ‘উত্তরে থাকো মৌন’ (১৯৭৭), ‘আমার হৃদয়ে বাঁচো’ (১৯৮১)।
(খ) বিষ্ণু দে-র কবিতা-সঙ্কলন : ‘বিষ্ণু দে-র শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৬২/১৯৫৫ খ্রীঃ), ‘একুশ বাইশ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২), ‘রুশতী পঞ্চশতী’ (১৯৬৭), ‘বছর পঁচিশ’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮০), ‘কবিতা সমগ্র-১’ (১৯৮৯), ‘কবিতা সমগ্র-২’ (বঙ্গাব্দ ১৩৯৭), “বিষ্ণু দে-র প্রেমের কবিতা’ (বঙ্গাব্দ ১৪০১)।
(গ) বিষ্ণু দে-র বাংলা প্রবন্ধ গ্রন্থ : ‘রুচি ও প্রগতি’ (১৯৪৬), ‘সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ (১৯৫২), ‘এলোমেলো জীবন ও শিল্প-সাহিত্য’ (১৯৫৮), “সাহিত্যের দেশ বিদেশ” (১৯৬২), ‘রবীন্দ্রনাথ ও শিল্প সাহিত্যে আধুনিকতার সমস্যা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭২), ‘মাইকেল রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জিজ্ঞাসা’ (বঙ্গাব্দ ১৩৭৪/১৯৬৭ খ্রীঃ), ‘জনসাধারণের রুচি’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮২/১৯৭৫ খ্রীঃ), ‘যামিনী রায়’ (১৯৭৭), ‘সেকাল থেকে একাল’ (বঙ্গাব্দ ১৩৮৭/১৯৮০ খ্রীঃ)।
বিষ্ণু দে-র ইংরেজী প্রবন্ধ গ্রন্থ : ‘The Art of Jamini Roy with John Irwin (1945), ‘Introducing Nirode Majumdar’ (1946), ‘An Introduction to Jamini Roy’ (1953) ‘The Paintings of Rabindranath Tagore’ (1958), ‘India and Modern Art (1959), ‘Prodosh Dasgupta-His Sculpture Lalitkala Akademi’ (1961), ‘The Pioneers of Modern Art in India’ (1961), ‘Satyendranath Bose/A legend in his lifetime’ (1964), ‘In the Sun and the Rain/Essays on Aesthetics (1972). ‘Selected Poems’ (1972), ‘History’s Tragic Exultation/ A few poems in translation’ (1973), ‘Water my roots Essays by and on Bishnu Dey’ (1973), ‘Carmel Doll-Abanindranath’s story (1946), ‘Two Folk tales of Bengal’ (Visva Bharati Quarterly), ‘She waited for him’ Tarashankar Bandyopadhyay’s story entitled ‘Shabari’ (1945), ‘The Music I live by’ (Radio Talk), ‘Swagata-a review’.
(ঘ) বিষ্ণু দে-র অনুবাদ : আঠারোটি ‘সমুদ্রের মৌন’ (১৯৪৬) ফরাসী লেখক ভেরকর-এর Le silence de La Mer-এর অনুবাদ, ‘এলিয়টের কবিতা’ (১৯৫৩), ‘হে বিদেশী ফুল’ (১৯৫৬), ‘মাওৎসে তুং কবিতা’ (১৯৫৮), ‘আফ্রিকায় এশিয়ায় মুরলী মৃদঙ্গে তুর্যে’ (১৯৭০), ‘তুমি রবে কি বিদেশিনী’ (১৯৮৬), ‘সমুদ্রের মৌন’ (১৯৪৬), তথ্য উৎস : “রচনাপঞ্জী”, “বিষ্ণু দে কালে, কালোত্তরে’ (পৃষ্ঠা : ১৬১-১৬৮)।
রবীন্দ্র-স্মরণ ও মুক্তি : অন্যান্য আধুনিক কবিদের মতো বিষ্ণু দে উপলব্ধি করেছিলেন বাংলা কাব্যের মুক্তি রবীন্দ্র অনুসরণে নয়, রবীন্দ্র স্মরণে। ব্যক্তিগত একক সাধনায় নয়, সচেতন সামাজিক সমবেত চেতনার পথে। রবীন্দ্রনাথের সাধনা ছিল একক সাধনা। তাই আধুনিক কবিতার স্বাতন্ত্র্য নির্দেশ করে বলেছিলেন : “হেথা নাই সুশোভন রূপদক্ষ রবীন্দ্র ঠাকুর”। অন্যত্র রবীন্দ্রনাথ ও শিল্প সাহিত্যে আধুনিকতার লক্ষণ বোঝাতে গিয়ে বলেছিলেন“সঙ্কটবোধ যেখানে কেবলমাত্র বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিপ্রধান, সেখানে সঙ্কট নামে ছায়ামূর্তির সঙ্গে, হয়তো বা মধ্যে অবতীর্ণ গণ্ডারের সঙ্গে। অধিকন্তু, ঐ অবাস্তব ভাববাদে, ঐ ধর্মীয়তায় বা ধর্মবিরোধিতায় রাবীন্দ্রিক ভাববাদের বিশ্বজনীনতাও নেই। যে ঐক্যবোধের ধর্মে মানবিকতায় ও সভ্যতায় জীবন সৃষ্টিময় হয়ে ওঠে, সেই পশ্চিমোত্তর সাম্রাজ্যহীন বিশ্বজনীন আশ্বাস তাই এঁদের কাব্যে নাটকে উপন্যাসে চিত্রে ভাস্কর্যে দুর্লভ। অর্থাৎ মানবসভ্যতার আধুনিক বিবর্তনের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি এঁরা হৃদয়ঙ্গম করতে শেষ পর্যন্ত অক্ষম থেকে গেলেন। অর্থাৎ অহম্ সঙ্কট-দীর্ণ মানস উপনীত হল না অবৈকল্যসঙ্কটের পর্যায়ের পরিণতিতে যা হয়েছিল রবীন্দ্রমানস” (উদ্ধৃত, সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় ও পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় : “বিষ্ণু দে-র রবীন্দ্রনাথ”, “বিষ্ণু দে কালে, কালোত্তরে’, ১৯৯৪, পৃষ্ঠা ৯৩)। বিশ্বব্যাপ্তির এই বোধ থেকেই তাঁর নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে রবীন্দ্র-আবিষ্কার।
তাঁর প্রথম পর্বের কবিতায় ছিল রবীন্দ্র-পক্তির ব্যবহারে ব্যঙ্গ-বিচ্ছিন্নতার সুর; যেমন উচ্চবিত্ত সমাজের সান্ধ্য পার্টিতে অলকা-সুরেশ, লিলি ও তার টেনিসের পার্টনার খসরু বেগের নাগরালিকে কটাক্ষ করে কবির মন্তব্য—
“ভস্ম অপমান শয্যা ছাড়ো পুষ্পধনু
পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াও ডন জুয়ানের বেশে
গন্ধমাদন এনে দিলে বৃথায় কে সে হনু?
হে অতনু তনুবিহীন বেড়াও দেশে দেশে।”
অথবা,—
“পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী
বিশ্বময় চলেছে তার ভোজ?
মরমিয়া সুগন্ধ তার বাতাসে ওঠে প্রশ্বাসি
সুরেশ শুধু খায় দেখি গ্লুকোজ।”
দ্বিতীয় পর্বের কবিতায় রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি গভীর এবং ব্যাপক। আন্তর্জাতিক আধুনিকতার সমস্যা সঙ্কটের নিরসনে, সত্তার বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে লড়াইতে তিনি তখন নিত্যপ্রেরণা; সেই প্রেরণা শুরু হয় ২২শে শ্রাবণ থেকে, পৌঁছয় শেষে ২৫শে বৈশাখের স্থায়ী প্রত্যয়ে—
“মৃত্যুকে দূরেই রাখি, জীবনের পঞ্চাগ্নি আলোয়,
চোখে রাখি সর্বদাই পূর্ণতার প্রতীক কবিকে,
অজখ সঙ্গীতে মন সুকুমার, দাঙ্গার কালোয়
হঠাৎ নিভৃত শান্তিনিকেতন আমার চৌদিকে।
রবীন্দ্র ব্যবসা নয়, উত্তরাধিকার ভেঙে ভেঙে চিরস্থায়ী জটাজালে জাহ্নবীকে বাঁধি না, বরং—
আমরা প্রাণের গঙ্গা খোলা রাখি,
গানে গানে নেমে সমুদ্রের দিকে চলি।”
এইভাবে দিনগত পাপক্ষয় থেকে দেশের লজ্জা-দুঃখ-শোক কাটিয়ে বিশ্বের ব্যর্থ কান্না ছিঁড়ে প্রকৃতিস্থ হওয়ার প্রেরণা খুঁজে পান –
“দিনগত পাপ ক্ষয়-পাপ কার? যতই নিষ্ঠুর হোক
প্রাত্যহিক মৃত্যু শতবেশে
যত গ্লানি যত লজ্জা দুঃখশোক
নানা ছলে ছড়াক না আপাতত হতাহত দেশে
তবুও মানব না গ্লানি এই হোক দেশব্যাপী রোখ,
গোটা বিশ্বে প্রকৃতিস্থ হব ব্যর্থ কান্না ছিঁড়ে হেসে।”
আর এই প্রেক্ষিতেই সমালোচকের অভিমতঃ “বলাই বাহুল্য, বিষ্ণু দে-র এই রবীন্দ্র আবিষ্কারে তার কাব্যিক উত্তরণ, নিজ কবি হিসাবে ইগো-ইন্টিগ্রিটির সঙ্গে যুক্ত। রবীন্দ্রনাথের ভারতীয় পরিণতির মহিমা তিনি নিজের তাগিদেই অনুধাবন করেন এ বাস্তবের বিশেষ পটে মানুষের সম্বন্ধ-সমূহ বুঝতে, মানুষের আচার-ব্যবহার চোখ খুলে দেখতে, মানুষের শক্তির নির্দিষ্টতা ও অপরিসীম সম্ভাবনাময়তার স্বরূপ চিনতে জানতে”।
বিষ্ণু দে-র প্রথম কাব্য ‘ঊর্বশী আর্টেমিস’-এ প্রেমচেতনাই প্রধান সুর। ঊর্বশী আর উমাতে দুই বিপরীত ভাবের জীবনচিত্র। তবু,—
“দেখি মুহূর্ত বিম্বে চিরন্তনেরই ছবি।
ঊর্বশী আর উমাকে পেয়েছি এ প্রেমপুটে।”
আবার “সুদীর্ঘ সুঠাম নগ্ন তনুবলীয়ান” সাগরোখিতা আর্টেমিস, না ভিনাস—একজন কৌমার্যরক্ষিণী অন্যজন কৌমার্যহারিণী, এই দুই দেবীর মধ্যে কে বরণীয়া, সেই সংশয়ে কবি স্মরণ নিয়েছেন আর্টেমিসের। কবি জানেন এ যুগে “অর্জুন আসে না আর, চিত্রাঙ্গদা কবে মুছে গেছে”। তাই,—
“আসল কথাটা আমি যা বুঝি
প্রেম ফ্রেম বাজে
আসলে আমরা নতুন খুঁজি
নারীকে পুরুষ পুরুষকে নারী তাই তো খোঁজে-
তার উপর তো জীবনের ধর্ম উপরি আছে
এরি নাম প্রেম।”
এই সংশয় নিয়েই কবি প্রেমের অন্বেষণ করেছেন ‘অভ্যাসবশে’, ‘প্রকৃতির বুদোয়ারে’, পার্টিতে, ড্রয়িংরুমে ‘লিলি-রমা-অলকার’ দলে। কিন্তু এই পান্থপ্রেমের পরিণামে পেয়েছেন কেবল ক্লান্তি আর শ্রান্তি। শেষে বুঝেছেন নারী-পুরুষের সমান অধিকার অর্জনে, আত্মদানে অখণ্ড সত্তায় তবেই এই অন্বেষণের অবসান হতে পারে। তাই ওফেলিয়ার কাছে তাঁর আবেদন—
“শোনো ওফেলিয়া, তোমার আত্মদানে
তোমার শরীরে সারেঙ্গীর গানে গানে
জীবনের মহামৃদঙ্গে নাচে অর্ধনারীশ্বর।
মন দাও প্রাণ দাও সারা দেশে অনাচারে জর্জর।”
সমালোচকের ভাষায়, “প্রেম বিশালতার ঠিকানা এনে দেয় বলেই সে বিস্ময়কর। সে বিস্ময় জীবনের বিস্ময়। বিরাটের সম্বন্ধে যে চেতনা বিষ্ণু দে-র প্রধান নিজস্ব অভিজ্ঞান, তার প্রেমও সেই অভিজ্ঞানেই মুদ্রাঙ্কিত”।
তার ‘চোরাবালি’ কাব্যের ‘ঘোড়সওয়ার’ কবিতা প্রতীকে আবেগস্পন্দে গতির ছন্দে একসময় কবিতাপ্রেমিক বাঙালীর কাছে আত্মমুক্তির আহ্বান নিয়ে এসেছিল—
“জনসমুদ্রে নেমেছে জোয়ার
মেরুচূড়া জনহীন
হালকা হাওয়ায় কেটে গেছে কবে
লোকনিন্দার দিন।
হে প্রিয় আমার প্রিয়তম মোর,
আয়োজন কাপে কামনার ঘোর।
কোথায় পুরুষাকার?
অঙ্গে আমার দেবে না অঙ্গীকার”।
‘পূর্বলেখ’ কাব্যগ্রন্থে এই আত্মজিজ্ঞাসা ও সামাজিক বিশ্লেষণের পাশাপাশি নতুন মূল্যবোধ গড়ে ওঠার গূঢ় ইঙ্গিত আছে। শুধু তাই নয়, বর্তমান সামাজিক অবস্থাকে পৌরাণিক নাম ও ঘটনার পটে উপস্থাপিত করার প্রয়াস দেখা গেছে : “দুর্ভিক্ষ এসেছে রুদ্র মড়কের রাসভ বাহনে। ঠগে ঠগে গাঁ উজাড়, বর্গী এলো শ্রাবণে প্লাবনে/গলিত বল্লভী ঘরে মুক্তদ্বারে যুগান্ত-হ্রেষায়/ নির্বোধ নির্বোধ শিশু হাসে একা আনন্দিত মনে, / বসুন্ধরা দেখে তাই, হয়তো বা বাসুদেব শোনে।” বস্তুত, এইভাবেই একদিন নিজ বাসভূমে পরবাসী মধ্যবিত্ত জীবনের জটিলতর পরিস্থিতিতে সমাজজীবনের পতিত জমিকে কবির মনে হয়েছিল ‘চোরাবালি’র সামিল।
‘সাত ভাই চম্পা’তে দেখা যায় লালকমল, নীলকমল, কঙ্কালী পাহাড় বা কাব্যনামের রূপকল্পে “দেশের জনসমাজের সঙ্গে দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে সেতুবন্ধনের কথা” (বিষ্ণু দে- “সাহিত্যের ভবিষ্যৎ”)। যেমন, ‘মৌভোগ’ কবিতার অংশ বিশেষ স্মরণ করা যায়—
“চোর-ডাকাতে মুখোশ পরে, রাক্ষসেরা ছাড়ে
চোরাই মাল, ঢাকে কালো কানায়
মরীয়া যত রানীর জ্ঞাতি কঙ্কালী পাহাড়ে
মড়ক-পূজা নরবলিতে জানায়।
ওদিকে ওড়ে লালকমলের নীলকমলের হাতে
ভায়ের মিলে প্রাণের লাল নিশান।
তাদের কথা হাওয়ায়, কৃষাণ কাস্তে বানায় ইস্পাতে
কামার শালে মজুর ধরে গান।”
মার্কসবাদী শিক্ষায় এলিয়ট অতিক্রমণ : কবির মার্কসবাদকে আত্মস্থ করে দেশজ জীবনের সঙ্গে কবিতাকে যুক্ত করার প্রয়াস এখানে সুস্পষ্ট। কবি নিজে একসময় তাঁর লিখিত একটি ইংরেজী প্রবন্ধে বলেছিলেন : “a poet’s poet consistently and persistently has to try to be a people’s poets” (‘Mr. Eliot Among the Arjunas, p. 102). কিন্তু তুলনামূলকভাবে দেখা যায়, ‘Waste Land’-এ যে বেদনাবোধ ও হাহাকার ভুলতে এলিয়টকে ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসের দুর্গে আশ্রয় খুঁজতে হয়েছিল, রাজতন্ত্রে আস্থা পেয়ে still centre-এর শাস্তিতে মন সান্ত্বনা পেয়েছিল, সেই স্থিরকেন্দ্রকে ত্যাগ করে বিষ্ণু দে মার্কসবাদের মধ্যে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিলেন। এইখানেই এলিয়টকে তার অতিক্রমণ! তাই দেশজ জীবনের সঙ্গে সেতুবন্ধনের অভিপ্রায়ে রূপকথা উপকথা থেকে শুরু করে সাঁওতাল ওঁরাও লোককথার মধ্যে পর্যন্ত তিনি অন্বেষণ করেছেন সামাজিক পরিবর্তনের জনীত বিপ্লবের কারণগুলি—
“সিদো কেন তুমি রক্তে করেছ চান?
কাহ্নু বলো তো কেন ‘হল্’ গান,
………….
বেনে ডাকাতেরা আমাদের দেশ করে দিল খান্খান।”
পরিবর্তনের আভাস : বিষ্ণু দে-র উত্তর পর্বের কবিতায় এক নতুন পরিবর্তনের আভাস লক্ষ্য করা যায়। সমালোচক পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় এই দিকটি উল্লেখ করে বলেছেনঃ “এক সময় তাঁর কবিতার প্রথম পর্যায়কে; মোটামুটি ১৯২৬ থেকে ৪১-এর পর্বকেই চূড়ান্ত ভাবা হয়েছিল, তার সম্পর্কে মন্তব্য, মূল্যায়ন, তার দুরূহতা— এলিয়টীয় প্রস্থান ইত্যাদি সিদ্ধান্ত পরবর্তী পর্যায়ের কবিতাকে উপেক্ষা করেই করা হয়েছিল। অথচ ১৯৪১-৪৪-এর মধ্যে বিষ্ণু দে-র কবি জীবনে, আলথুসেরীয় অর্থে, একটি স্পষ্ট ব্রেক বা উত্তরণ আসে। ১৯৫৫ পর্যন্ত, তারপরেও এই উত্তরণ অব্যাহত। অনেকে এই পর্বের উপর গুরুত্ব দেন বেশি; বিষ্ণু দে-র মানবিক আস্তিক্য বোধ সঞ্জাত এই পর্যায়ের জীবনের, জগতের, ইতিহাসের গভীর বাঁচার লড়াইয়ের দিকটি বড় হয়ে ওঠে। কারুর কারুর অভিযোগ শোনা যায় কবি “স্টিল সেন্টার”-এ পৌঁছেছেন। ফলে ১৯৫৫ থেকে এর সঙ্গেই, পাশাপাশি আর একটি উপাদানও যে তার কবিতায় আসছে, সেটি চোখ এড়িয়ে যায়। বর্তমান এ সমাজ-দেশ-জীবনের বাস্তব সম্পর্কে তীব্র প্রতিক্রিয়া : বাস্তবের এক তিক্ত বোধ তাঁর কবিতায় আসে, সেটা স্টিল সেন্টারের প্রশান্তি নয়। ঐতিহাসিকবোধেই এই বাস্তবের ছবি তিনি আঁকেন” (“বিষ্ণু দে-র উত্তর পর্ব : একটি দিক’’, ‘এবং এই সময়’, বিষ্ণু দে স্মরণ সংখ্যা, ৬ষ্ঠ বর্ষ, একবিংশ সংখ্যা, ফাল্গুন, ১৩৯৬, পৃষ্ঠা, ১৯৯)। এই ছবি ফুটে উঠেছে তাঁর ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ কাব্যে—
“এ নরকে
মনে হয় আশা নেই জীবনের ভাষা নেই,
যেখানে রয়েছি আজ সে কোনো গ্রামও নয়, শহরও তো নয়
প্রান্তর পাহাড় নয়, নদী নয়, দুঃস্বপ্ন কেবল,
যেখানে মজুর নেই, চাষ নেই,
যেখানে রয়েছি আজ মনে হয়, আশা নেই,
বাঁচবার আশা নেই, বাঁচবার ভাষা নেই,
সেখানে মড়ক অবিরত
সেখানে কান্নার সুর একঘেয়ে নির্জলা আকাশে
মরমে পশে না আর, সেখানে কান্নাই মৃত
কারণ কারোই কোন আশা নেই
অথবা তা এত কম, যে কোনো নিরাশা নেই।
চৈতন্যে মড়ক।”
এই নরকের ভয়াবহ ছবির মধ্যে “চৈতন্যে মড়ক”-এর যে অভূতপূর্ব চিত্রকল্প ধরা পড়েছে উপরোক্ত কবিতায়, বাংলা কাব্যে তা দ্বিতীয়ৱহিত। এই কবিতার ভাষা প্রত্যক্ষ, ক্ষিপ্র প্রতিবাদে স্পষ্টবাক্। বস্তুত, কবি জানতেন দীর্ঘকালীন উপনিবেশ হয়ে থাকার ফলে তার পঙ্গু বিকাশ, আপোষের খণ্ডিত স্বাধীনতা এই দেশের বাস্তব অবস্থাকে চৈতন্যময় শুদ্ধ পথে নিয়ে যেতে দেবে না। তবু তিরিশের দশকে তিনি দেখেছিলেন এর বিরোধী প্রতিবাদী বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, দ্বন্দ্বময় সমাজের প্রকাশ-বিকাশ। তাই তখন আশা ছিল তিনি ধ্যানের বাস্তবকে পাবেন। কিন্তু ক্রমশঃ দেখলেন সন্ত্রাসে সব নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এখন গ্রাম নেই, চাষা নেই, মজুর নেই অর্থাৎ শ্রেণীর যথার্থ অবস্থান নেই যা সংঘটিত করবে বিপ্লব আন্দোলন।
নামকরণের তাৎপর্য নির্ণয়ে দেখা যায়, “এই কাব্যে কবির স্মৃতি অতীতের মত পুরনো নয়, তা বিস্তৃত হয়েছে সমকালীন অস্তিত্ব পর্যস্ত, ভবিষ্যতও এইভাবেই যুক্ত হয়েছে সমকালীন সত্তায়। বলা যেতে পারে, কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক একান্ত ব্যক্তিগত নিরিখে কবি কালকে জরিপ করেন নি। তাই তার ‘স্মৃতি’ শুধু অতীত না হয়ে পরিণত হয়েছে বর্তমান অতীত, বর্তমান-ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান ভবিষ্যৎ থেকে সমকালের সত্তা-অতীত এবং সত্তা-ভবিষ্যৎ হিসেবে” (দ্রষ্টব্য : রামকুমার মুখোপাধ্যায় : ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’, ‘এবং এই সময় পত্রিকা, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ৪৮)।
পুরাণ-মিথের ব্যবহার : কবি সুধীন্দ্রনাথের মতোই বিষ্ণু দে-র কবিতায় ভারতীয় এবং গ্রীক পুরাণের মিথ কাহিনী-চরিত্রের মিলিত ভাবনা দেখা যায়। ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’ কাব্যগ্রন্থে পাওয়া যাবে কখনো ঊর্বশী আর উমাকে একসঙ্গে, কখনো ডায়ানা ঊর্বশীকে পাশাপাশি। অনুরূপভাবে পুরূরবা-ট্রিস্টান ও ইসালেডের পাশে অর্জুন-চিত্রাঙ্গদা, কণ্বমুনি, ক্লিওপেট্রা, ভিনাস, আর্টেমিসের উপস্থাপনা। তাঁর অন্যান্য নানা কবিতায়ও এই মিথ চরিত্রেরা এসেছে; যেমন পুরূরবা-ঊর্বশী, দিতি, ত্রিশঙ্কু ইত্যাদি।
“চোরাবালি’ কাব্যেও দেখা যায় ওফেলিয়া, দেবযানী, প্রসার্পিনা, সাগরসন্তান, উলূপী, পঞ্চমুখ, হৈমবতী, মহাশ্বেতা, ঊর্বশী, যযাতি, বিচিত্রবীর্য, দশরথ, বৃহন্নলা, শিখণ্ডী, হেলেন, গরুড়, মেনকা, ঋষ্যশৃঙ্গ, ক্রেসিডা, কুরুক্ষেত্র, ট্রয়, ইন্দ্রপ্রস্থ প্রভৃতি। উল্লেখযোগ্য কবিতাগুলি হল— ‘ঊর্বশী ও আর্টেমিস’, ‘ঊর্বশী’, ‘সন্ধ্যা’, ‘সোহবিভেক্তমাদেকাকী বিভেতি’, ‘ওফেলিয়া’, ‘পঞ্চমুখ’, ‘খোঁয়ারি’, ‘যযাতি’, ‘অপস্মার’, ‘দ্বিধা দম্পতী’, ‘প্রথম পার্টি’, ‘শিখণ্ডীর গান’, ‘আত্মদান’, ‘ক্রেসিডা’ ইত্যাদি।
তাঁর কবিতায় বর্ণিত মিথ-চরিত্রগুলির অধিকাংশই দেশী-বিদেশী সাহিত্যের নারী মূর্তি। এই মিথ-চরিত্রগুলি তাদের সৌন্দর্যের আদিম আকৃতিকে যেমন প্রকাশ করেছে, তেমনি এক চিরন্তন অনুভূতির জগতে পাঠককে নিয়ে যায়। আবার এরই পাশাপাশি বর্তমান সমাজ সম্পর্কে সচেতন কবির ভাবনাও ফুটে ওঠে কবিতায়, যেমন—
“কবন্ধ দুঃস্বপ্ন ঘেরে
মোক্ষহীন ভিক্ষুকের বিষণ্ণ আবেগ।
হে বন্ধু, এ নচিকেত মেঘ
আসন্ন মুমূর্যাক্ষুব্ধ আমার পাতাল
ধুয়ে দিক, ব্রজযোগে বিদ্যুৎ অঙ্গারে
উড়ায়ে পুড়ায়ে দিক বিষঙ্গের উজ্জীবনে
সঞ্জীবনী প্রতিষেধে, সাবিত্রীর সম্পূরণে
বেঁধে দিক হে সুশ্রুত, উদ্গতির হিরণ্ময় জালে।”
আঙ্গিক এবং দুর্বোধ্যতা : বিষ্ণু দে-র কবিতায় প্রথম পর্যায়ে কাব্য-প্রকরণে এলিয়টের অনুসরণ দেখা যায়। কিন্তু পরবর্তীকালে এই অনুসরণে আর পুনরাবৃত্তি ঘটেনি। অনুরূপভাবে তাঁর প্রথম পর্যায়ের কবিতায় শব্দগত বা পুরাণ-উল্লেখের দুরূহতা পরবর্তী পর্যায়ে কিছুটা সরল হয়ে উঠেছে। তার ‘ক্রতুকৃতম্’, ‘অপাপবিদ্ধমস্নাবির’, ‘সোৎপ্রাসপাশ’ প্রভৃতি শব্দের অর্থ উদ্ধারে পাঠক বিব্রত হয়। সেই কারণে সম্ভবত কবি ও কাব্যবোদ্ধা বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেনঃ “আমি অকপটেই স্বীকার করছি আপনার কোন কোন কবিতা আমি ভালো বুঝতে পারি না। … মাঝে মাঝে চমকপ্রদ চিত্রকল্পের দেখা পাই ; মনের মধ্যে বিচিত্র ছবি ফোটে, আর ছন্দের কৌশল ধ্বনিমর্মরের মোেহ ছড়ায়” (বিষ্ণু দে “চোরাবালি”, ‘কালের পুতুল’)। আবার বিষ্ণু দে-র কবিতার একনিষ্ঠ পাঠক হয়েও সুধীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন— “বিষ্ণু দে-র দায়িত্বপূর্ণ লেখনী আমার আত্মপ্রকাশের গরজে অস্থির নয় বলেই তাঁর লেখা অল্পবিস্তর অসরল”।
উপরোক্ত এইসব অভিযোগ সত্ত্বেও কিন্তু দেখা যায়, বিষ্ণু দে-র কবিতার শিল্পদ্যুতি পাঠককে বিস্মিত করে বারবার; যেমন—
“পাখির আবেগ জাগাবে শরীর মনে?”
………
“গ্রন্থলোকের পরিক্রমা তো শেষ!
শিল্পীজনের মিতালীতে শুধু শ্লেষ।
নিঃসঙ্গতা মুখোমুখি অপলক।
দুপাশে ঘনায় ক্লান্তির মেঘাবেশ।
……….
কাটুক আমার জীবন মরণে সেতুবন্ধনী দিন।”
বিষ্ণু দে-র কাব্যে প্রকরণগত বৈশিষ্ট্য:
প্রকরণগত দিক থেকে তাঁর কাব্যে দেখা গেছে কিছু বৈশিষ্ট্য—
(ক) ভাবনা ও আবেগের সম্বন্ধসূত্র অনুসারে কবিতার স্তবক-রচনা। ফিল্মের ‘কাট’ পদ্ধতি প্রয়োগ করে অনেক সময় দুটি স্তবকের মধ্যে আপাত আবেগের সম্বন্ধ বিলোপ করা হয়েছে ; যেমন ‘ওফেলিয়া’ বা ‘ক্রেসিডা’ কবিতার নামোল্লেখ করা যায়।
(খ) প্রচলিত রীতিতে টেনে টেনে আবেগের তাপ উত্তাপের পরিবর্তে গদ্যের চরণ বিন্যাসের ঋজুতা ও স্পষ্টতা তাঁর কবিতায় আধুনিকতার সূচনা করেছে।
(গ) অনেক সময় “গানে গানে নেমে সমুদ্রের দিকে” চলেছে তার কবিতা—
“অমারজনীর মদিরায় নেই নীড় আকাশ
জেনেছে মন
তোমাতেই পাই প্রাণসত্তার নীলিমাভাস
তাই আপন”। ইত্যাদি
(ঘ) বিষ্ণু দে-র কাব্যে দেখা যায় নদী বা সমুদ্রের মতোই প্রবহমান বৈচিত্র্য, আবার সেইসঙ্গে অবিচ্ছিন্নতা। সমালোচকের ভাষায়, “এক পর্বের প্রকরণ-বৈশিষ্ট্যর সঙ্গে কখনো পরম্পরায় কখনো বৈপরীত্যে তিনি পর্বান্তরে চলেন। ফলে আরো একটা বড় ক্ষতি বিষ্ণু দে-র হঠাৎ-পাঠকের— তাঁদের কাছে স্পষ্ট হয় না কোন্ শব্দ, কোন্ বাক্প্রতিমা, কোন্ উল্লেখ শব্দ-বাক্প্রতিমা উল্লেখের অরণ্য থেকে উঠে এসে কিভাবে তার সামগ্রিক কাব্যে অভিজ্ঞতায় আত্ম-উন্মোচনের কাজ করেছে, তার কবিতার চাবিকাঠির কাজ করেছে”।
(ঙ) ছোট ছোট টুকরো বিচ্ছিন্ন শব্দের বাক্যের সমবায়ে সমকালের শহুরে পরিবেশে ও জনজীবনকে আঁকার চেষ্টা; যেমন, “বড়বাজারের উপল উপকূলে জনগণের প্রবল স্রোত উগারিছে ফেনা” অথবা বিড়ি, সিগ্রেট, উনুন আর মিলের ধোঁয়া; পানের পিক, দীর্ঘশ্বাস; বড়বাবুর গঞ্জনা, বড় সাহেবের কটা চোখের ব্যঞ্জনা; কেরানীর দাম্পত্য মিলনের শ্রস্ত সম্ভাবনা, অপত্যধিক্যের অনুশোচনা, ফেরিওয়ালার জ্যাম ইত্যাদি সব মিলিয়ে জনগণের ‘জনসমুদ্র’ যার বিরাট কোলাহল মনে হয় “একটা লাগডাট আওয়াজ” মাত্র। এই ‘কোলাজ’-ধর্মী চিত্র-প্রকরণও তাঁর কাব্যের অনেক কবিতায় লক্ষ্য করা যায়।
রবীন্দ্রোত্তর যুগের কবিদের মধ্যে সমকালের শ্রেষ্ঠ ভাষ্যকার ও কবিরূপে বিষ্ণু দে-র স্থান কোথায় তা নির্দেশ করে তাঁর সতীর্থ আর এক কবি বুদ্ধদেব বসু যা বলেছেন সে সম্পর্কে কোন দ্বিমত থাকতে পারে না— “Soon transformed himself to an interpreter of contemporary social life and finally came out as a singular, serious and difficult poet. His poetic character is seen in the way he is constantly revising his work, rearranging earlier verses so as to give them an import not intended at the time of composition, joining fragments and occasional pieces in a wider significance” (An Acre of Green Grass’, p. 63).
Leave a comment