পল্লীপ্রকৃতিকে লোকজীবনের সঙ্গে যুক্ত করে তার সহজ রূপটির উন্মোচনের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে এসেছিলেন কবি জসীমউদ্দিন। কলকাতায় কর্মের অন্বেষণে এসে শহরের জীবনযাত্রা এবং ঘটনাসূত্রে রবীন্দ্রনাথ-অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখ স্বনামধন্য ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটে। রবীন্দ্র স্নেহধন্য এই তরুণ কবি তাঁর চোখে দেখা পুরাতন সরলতা-ভরা গ্রাম আর স্বভাবের সদ্যোজাত গ্রামীণতাকেই তার একটিমাত্র কাব্যে জীবন্ত করে তোলেন। সেই কাব্যটির নাম ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ (১৯২৯)।

জসীমউদ্দিনের কবিতা বর্ণনাময় এবং ব্যঙ্গ-বর্জিত। দার্শনিকতা নয় চিত্রময়তা, ভাব গভীরতার পরিবর্তে ভাবালুতায় তাঁর কবিতা পাঠককে আকর্ষণ করে, এক নস্ট্যালজিক আবেগে মুগ্ধ করে! কখনো-বা কল্পনার নায়ে পাঠককে রূপকথার জগতে ভাসিয়ে নিয়ে যায়; যেমন

“কে যাওরে পাল ভরে’ কোন্ দেশে ঘর 

পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর? 

কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে। 

কোন্ দেশে হিরামন্ পাখী বাস করে! 

কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়, 

ঘুম যায় আর হাসে হিম-সিম্ বায়। 

সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই, 

ছোট মোর বোন্‌টিরে যদি সাথে পাই!”

কোন কবিতায় রাতের নিসর্গচিত্র বর্ণনার ইঙ্গিতে মূর্ত হয়েছে; যেমন—

“উড়ানির চরে’ তৃণের অধরে

রাতের বাণী

আঁধারের ঢেউছোঁয়াইয়া যায় 

কী মায়া টানি।”

জসীমউদ্দিনের রচনাসমূহ:

(ক) কাব্যগ্রন্থ : ‘রাখালী’ (১৯২৭), ‘নক্সী কাথার মাঠ’ (১৯২৯), ‘বালুচর’ (১৯৩০), ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ (১৯৩০), ‘হাসু’ (১৯৩০), ‘ধানখেত’ (১৯৩২), ‘রূপবতী’ (১৯৪৬), ‘এক পয়সার বাঁশী’ (১৯৪৮), ‘মাটির কান্না’ (১৯৫১), ‘সকিনা’ (১৯৫৯), ‘সুচয়নী’ (১৯৬১), ‘মা যে জননী কান্দে’ (১৯৬৩), ‘হলুদ বরণী’ (১৯৬৬), ‘জলের লেখন’ (১৯৬৯), ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ (১৯৭১), ‘মাগো জ্বালায়ে রাখিস আলো’ (১৯৭৬)।

(খ) গীতিগ্রন্থ : ‘রঙিলা নায়ের মাঝি’ (১৯৩৩)।

(গ) নাট্যগ্রন্থ : ‘পদ্মাপার’ / ‘গাঙের পার’ (১৯৫০), ‘পল্লীবধূ’ (১৯৫০), ‘মধুমালা’ (১৯৫১), ‘বেদের মেয়ে’ (১৯৫১), ‘গ্রামের মায়া’ (১৯৫৩), ‘ওগো পুষ্পধনু’ (১৯৬৮)।

(ঘ) স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনী : ‘যাদের দেখেছি’ (১৯৫২), ‘‘চলে মুসাফির’ (১৯৫২), ঠাকুর বাড়ির আঙিনায়’ (১৯৬১), ‘জীবনকথা’ (১৯৬৪), ‘হলদে পরীর দেশে’ (১৯৬৫), ‘যে দেশে মানুষ বড়’ (১৯৬৮), ‘স্মৃতির পট’ (১৯৬৮), “জার্মানীর শহরে-বন্দরে’ (১৯৭৬)।

(ঙ) গল্প ও উপন্যাস গ্রন্থ : ‘বোবা কাহিনী’ (১৯৬৪), ‘ডালিম কুমার’ (১৯৬৩), ‘বাঙালীর হাসির গল্প’ (১ম খণ্ড ১৯৬০, ২য় খণ্ড বঙ্গাব্দ ১৩৭১)।

(চ) প্রবন্ধ এবং সম্পাদিত গ্রন্থ : ‘জারীগান’ (১৯৬৮), ‘মুর্শিদী গান’ (প্রকাশিতব্য)।

জসীমউদ্দিনের জন্ম-শিক্ষা ও পুরস্কার লাভ:

রবীন্দ্রনাথ-নজরুল প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের স্নেহধন্য জসীমউদ্দিন বাংলা কাব্যের জগতে প্রধানতঃ ‘পল্লীকবি’ হিসাবেই সুপরিচিত। ১৯০৪ খ্রীস্টাব্দের (মতান্তরে ১৯০২ অথবা ১৯০৩ খ্রীস্টাব্দে) ১লা জানুয়ারী ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত তাম্বুলখানা গ্রামে মাতুলালয়ে জসীমউদ্দিনের জন্ম। তার পৈত্রিক গ্রাম গোবিন্দপুর। তাম্বুলখানা গ্রাম থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১২ কিলোমিটার। জসীমউদ্দিনের পিতা মৌলবী আনসারউদ্দীন আহমদ মোল্লা, মা আমেনা খাতুন, ডাকনাম রাঙাছুট। আনসারউদ্দিন স্কুল শিক্ষক এবং এক সময় ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট রূপেও সম্মানিত। জসীমউদ্দিনের বংশগত উপাধি ‘মোল্লা’। কিন্তু কবির স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, কিশোর বয়সে কাগজে প্রকাশের জন্য নজরুল ইসলামের কাছে একটি কবিতা পাঠানো হলে নজরুল স্বয়ং জসীমউদ্দিনের নামের পর ‘মোল্লা’ শব্দটি কেটে দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে জসীমউদ্দিন আর দ্বিতীয়বার সেই ‘মোল্লা’ উপাধি ব্যবহার করেন নি। পারিবারিক পরিচয়ে কবিরা চার ভাই, কবি মধ্যম পুত্র। কবির জীবদ্দশায় তাঁর তিন ভাই কয়েক বছরের ব্যবধানে অকালে মারা যান। দুঃখময় অভিজ্ঞতায় স্পর্শকাতর কবিচিত্ত হয় বিচলিত। তাঁর কবিত্বের উত্তরাধিকার ছিল পারিবারিক সূত্রে লব্ধ। পিতা আনসারউদ্দিনের সাহিত্যানুরাগ এবং অন্ধ দাদা দানু মোল্লার লোকগানের প্রতি অনুরাগ কবিমনে শৈশবেই সঞ্চারিত হয়।

জসীমউদ্দিনের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায় “আমার কবি-জীবনের প্রথম উন্মেষ হইয়াছিল এই দাদার গল্প, গান ও কাহিনীর ভিতর দিয়া। সেই ছোটবেলায় মাঝে মাঝে আমাকে গানে পাইত। নিজে মনোক্তি করিয়া ইনাইয়া বিনাইয়া গান গাহিয়া যাইতাম। দাদা একদিন একজনকে বলিতেছিলেন, “পাগলা গানের মধ্যে কি যে বলে কেউ শুনে না, আমি কিন্তু মনোযোগ দিয়া শুনি, ওর গান” (দ্রষ্টব্যঃ ‘জসীমউদ্দিন কবিতা, গদ্য ও স্মৃতি’, তিতাস চৌধুরী, প্রথম প্রকাশ আষাঢ় ১৪০০, পরিশিষ্টক, পৃষ্ঠা ১৭৫)। অন্যদিকে কবিগানের আসর ঘুরে হয় “নানা ছন্দে ছড়া তৈরী” (দ্রষ্টব্য : ‘জীবন কথা’ : জসীমউদ্দিন, পৃষ্ঠা ১২৬) বাবার শিক্ষা “নানা সুরের ধুয়ার সঙ্গে পদ যোজনা” (পূর্বোক্ত) করার অভ্যাস।

জসীমউদ্দিনের শৈশব শিক্ষার সূত্রপাত ফরিদপুরের হিতৈষী এম. ই. স্কুল। তারপরে ঈশান স্কুল, জেলা স্কুল প্রভৃতি একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ঈশান স্কুলের পণ্ডিতমশায় ক্ষীরোদবাবু ছিলেন জসীমউদ্দিনের কবি-জীবনের একজন প্রেরণাদাতা। কবির নিজের ভাষায় : “…কবিতা রচনা বিষয়ে তিনি আমাকে নানা উপদেশ দিতেন” (‘জীবন কথা’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৩০)।

১৯২১ খ্রীস্টাব্দে জসীমউদ্দিন ফরিদপুর জেলা স্কুল থেকে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা, ১৯২৪ খ্রীস্টাব্দে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে তৃতীয় বিভাগে আই. এ. পরীক্ষা এবং ১৯২৯ খ্রীস্টাব্দে এই কলেজ থেকেই স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। আই. এ. পাশ করার পাঁচ বছর পরে বি. এ. পাশ করেন। কারণ তিনি এই সময় কাব্য-চৰ্চা, গ্রাম্যগীতি সংগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছিলেন। ১৯৩১ খ্রীস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইণ্ডিয়ান ভার্নাকুলার বিভাগ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অষ্টম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি দীনেশচন্দ্রের স্নেহধন্য। প্রধানত, দীনেশচন্দ্রের উদ্যোগেই জসীমউদ্দিনের ক্লাস টেনে লেখা ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য তালিকাভুক্ত হয়। স্বভাবতই লোকসাহিত্যের সংগ্রাহকরূপে প্রথমে সত্তর টাকা বৃত্তি নিয়ে জসীমউদ্দিন গবেষকের কাজ করেন। পরে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেনের সহায়তায় ও সহানুভূতির ছায়ায় ১৯৩৩ খ্রীস্টাব্দে ‘রামতনু লাহিড়ী’ সহকারী গবেষক পদে নিযুক্ত হন। এই পদে তিনি ১৯৩৭ খ্রীস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন। এর পরে ১৯৩৮ খ্রীস্টাব্দে কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে লেকচারার পদে যোগ দেন। ১৯৪৪ খ্রীস্টাব্দে সরকারের প্রচার বিভাগে যোগ দিয়ে কর্মজীবনের আর এক দিকের সূচনা করেন। এই পদে সুদীর্ঘ চৌদ্দ বছর চাকরি করে কবি জসীমউদ্দিন ১৯৬১ খ্রীস্টাব্দে সরকারী চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

কবি-জীবনের আর একটি মনোরম আশ্রয় ছিল সাধু সন্ন্যাসীর আখড়া ও আড্ডা : “আমাদের ঘরে নানা অভাব, সেই অভাব অবলম্বন করিয়া নানা কলহ। সেখান হইতে কে যেন আমাকে বংশীধ্বনির আকর্ষণ করিয়া এই সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে টানিয়া আনিত। এখানে আসিলে ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা, শাস্তি। সুযোগ পাইলেই আমি সন্ন্যাসী ঠাকুরের কাছে আসিয়া বসিয়া থাকিতাম।… আমার প্রাণের মানুষ – আমার মনের মানুষ” (‘জীবন কথা’, পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৭)। আর এইভাবেই “জসীমউদ্দিনের শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের উন্মেষকাল কেটেছে লোকজ ও গ্রামজ পরিবেশে, বনে-বাদাড়ে, মাঠে ময়দানে, খাল-বিল, নদীতীরে, নাম না জানা ফলমূল আর পাখ-পাখালির সন্ধানে, সাধু সন্ন্যাসীর আখড়ায় ও আড্ডায় এবং কখনো জনসেবায়, কখনো নিরুদ্দেশ থেকে” (দ্রষ্টব্যঃ “জসীমউদ্দিন গদ্য, কবিতা ও স্মৃতি’, তিতাস চৌধুরী পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা ১৭৬)।

স্কুলজীবনে শিক্ষাপর্বেই তিনি ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে আসেন এবং তার ফলে হিন্দুধর্মের পৌত্তলিক উপাসনা পদ্ধতি ও নানা অন্ধ সংস্কার ও প্রথার প্রতি তাঁর পূর্বের আসক্তি থেকে মুক্ত হন। পরে একজন সুস্থ ও উদারচিত্ত অসাম্প্রদায়িক মানুষ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তার মধ্যে দেখা দেয়। পরবর্তীকালে দীনেশচন্দ্র সেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ গুণীজন সান্নিধ্যে জসীমউদ্দিন ‘সহজ মানুষ’ হয়ে ওঠেন।

জসীমউদ্দিনের বিদেশ ভ্রমণ ও পুরস্কার লাভ:

সরকারী প্রচার দপ্তরের কর্মকর্তা রূপে জসীমউদ্দিন, দেশে ও বিদেশের নানা অঞ্চলে ভ্রমণ করেন। যুক্তরাষ্ট্র, স্কটল্যান্ড, যুগোশ্লাভিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, তুরস্ক, বার্মা, চীন, পশ্চিম জার্মানী, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উপলক্ষ্যে লেখেন নানাবিধ রচনা যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে পর্যটনের অভিজ্ঞতায় লেখা হয় ‘চলে মুসাফির’, যুগোশ্লাভিয়ার ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় রূপায়িত হয় ‘হলদে পরীর দেশে’, রাশিয়া দর্শনের পটভূমিতে দেখা দেয় ‘যে দেশে মানুষ বড়’, জার্মানীতে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে গড়ে ওঠে ‘জার্মানীর শহরে বন্দরে’ প্রভৃতি গ্রন্থ। জীবিতকালেই কবি দেশে ও বিদেশে সর্বোচ্চ স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভে সমর্থ হন; যেমন ১৯৫৮ খ্রীস্টাব্দে প্রেসিডেন্ট পুরস্কার ‘Pride of Performance’, ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে D. Lit. উপাধি, ১৯৭৪ খ্রীস্টাব্দে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার (অবশ্য পরে কবি তা প্রত্যাখ্যান করেন)। ১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দে ‘একুশে পদক’, ‘হলদে পরীর দেশে’ গ্রন্থের জন্য UNESCO পুরস্কার, ১৯৭৮ খ্রীস্টাব্দে ‘স্বাধীনতা দিবস’ পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ প্রভৃতি। ১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দের ১৪ই মার্চ রবিবার কবি জসীমউদ্দিন লোকান্তরিত হন। তাঁর শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার নিজ গ্রাম গোবিন্দপুরে ডালিম গাছের তলায় তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।

কবি জসীমউদ্দিনের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাখালী’। এখানে আছে ‘কবর’, ‘পল্লীজননী’, ‘মাও পাহাড়িয়া’ প্রভৃতি কবিতা। খণ্ড কবিতাবলীর দিক থেকে এটি শ্রেষ্ঠ সংকলন। এই কাব্যরচনার পূর্বে কিছু কিছু খণ্ড কবিতা লেখার জন্য তাঁর সুখ্যাতি হয়েছিল। তবে কল্লোল পত্রিকায় প্রকাশিত ‘কবর’ কবিতাটি জসীমউদ্দিনকে খ্যাতিমান করে তোলে

এইখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে,

তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

………..

গাছের পাতারা সেই বেদনায় বুনোপথে যেত ঝরে,

ফাল্গুনী হাওয়া কাঁদিয়া উঠিত শূন্য মাঠখানি ভরে।

পথ দিয়ে যেতে গেঁয়ো পথিকেরা মুছিয়া যাইত চোখ 

চরণে তাদের কাঁদিয়া উঠিত গাছের পাতার শোক।”

জসীমউদ্দিনের কাব্যটির গুরুত্ব:

এই কবিতা পড়ে দীনেশচন্দ্র লিখেছিলেন: “দূরাগত রাখালের বংশীধ্বনির মতো তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি” (উদ্ধৃত, ‘জসীমউদ্দিনকবিতা, গদ্য ও স্মৃতি’, পৃষ্ঠা ১৭৯)। এই এলিজি ধরনের লোকগাথামূলক কবিতাটি Dramatic Monologue-এর আদলে রচিত। ক্রিশ্চিনা রসেটির “They grew in Beauty side by side”, জন মিলটনের ‘Lycidas’, শেলির ‘Adonois’, টেনিসনের ‘In Memorium’ প্রভৃতি কবিতার ভাবগত মর্মবাণী ‘কবর’ কবিতাটিকে যেন স্পর্শ করেছে বলে মনে হয়। জসীমউদ্দিনের পরবর্তী কাব্য ‘নক্সী কাথার মাঠ’-এ বিষয়বস্তু অতি সাধারণ। কিন্তু পল্লীপ্রকৃতি ও পরিবেশ ভাষার সহজাত লাবণ্যে ও মুগ্ধ দৃষ্টিপাতে অপরূপ হয়ে উঠেছে

“মাঠের মাঝে জলীর বিলে জলো রঙের টিপ,

জ্বলছে যেন এ-গাঁর ও-গাঁর বিরহেরি দীপ।”

অথবা 

“জনম কালো মরণ কালো, কালো ভূবনময়,

চাষীদের ওই কালো ছেলে সব করেছে জয়।”

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপদেশমত এই কাব্যের চিত্রিত মলাট এবং তার প্রতি অধ্যায়ের পূর্বে নানা ধরনের গ্রাম্য গান, ছড়া, প্রবাদ জুড়ে দেওয়া হয়। ইংরেজিতে ই. এম. মিলফোর্ড ‘The field of the Embroidered Quilt’ নামে এই কাব্যটির অনুবাদ করেন। ইতালীতে কবি ফাদার মেরিনো রিগ্যান এর অনুবাদ প্রকাশ করেন। জি. এ. মান্নান এই কাব্যটিকে নৃত্যনাট্যে রূপদান করেন। দেশে-বিদেশে এর একশ আশিটিরও বেশি নাট্য প্রদর্শনী হয়।

জসীমউদ্দিনের তৃতীয় কাব্য ‘বালুচর’ রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতিলাভের সৌভাগ্য অর্জন করে। এই কাব্যের আকর্ষণ এই কারণে যে

“কাল সে আসিবে, মুখখানি তার নতুন চরের মত

চখা আর চখি নরম ডানায় মুছায়ে দিয়েছে কত।”

এই চিত্রকল্প বাংলা কাব্যে খুব সুলভ নয়। ‘ধানক্ষেত’ কাব্যে আছে ছাব্বিশটি কবিতা। গ্রামজীবনের সুখ-দুঃখের ভাবচিত্র এবং পল্লীবাংলার রূপচিত্র এই কবিতাগুলির মধ্যে লক্ষিত হয়

“সবুজে হলুদে সোহাগ ঢুলায়ে আমার ধানের ক্ষেত,

পথের কেনারে পাতা দোলাইয়া করে সদা সঙ্কেত।

……..

 এইখানে এসে দুঃখের কথা কহি তাহাদের সনে,

চৈত্রদিনের ভীষণ খরায় আষাঢ়ের বরিষণে।

……….

শিশির তাহারে মতির মালায় সাজায় সারাটি রাতি,

জোনাকীরা তার পাতায় পাতায় দোলায় তারার বাতি।”

জসীমউদ্দিনের কবিত্বশক্তির মহত্তম প্রকাশ ‘সোজান বাদিয়ার ঘাট’। কবির নিজের ভাষায়“…দু’টো নর-নারীর দাগহীন প্রেম ভালবাসা কিভাবে দু’টো ভিন্ন সমাজের নানা প্রতিকূল অবস্থায় বিষের পাহাড় গড়ে তুলতে পারে—এরই বেদনাবিধুর চিত্র এঁকেছি ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ কাব্যে।” সোজন ও দুলীর অপূর্ব প্রেমকাহিনী এর বিষয়বস্তু। দুলীর দেহের রূপ বর্ণনা প্রকৃতির রঙে এবং সংরক্ত আবেগে চিত্রিত

“দূর্বাবনে রাখলে তারে দূর্বাতে যায় মিশে

মেঘের খাটে শুইয়ে দিলে খুঁজে না পাই দিশে।

………..

সোজনের সাথে তার ভারি ভাব, দুলীর ইচ্ছে করে, 

সোজনেরে সে যে লুকাইয়া রাখে সিঁদুর কৌটা ভরে।

আঁচল খানিরে টানিয়া টানিয়া বড় যদি করা যেত,

সোজনেরে সে যে লুকায়ে রাখিত কেহ নাহি খুঁজে পেত।”

প্রেমের চিত্রগুলি এখানে বাস্তব ঘটনা, পারিপার্শ্বিকতা এবং নৈসর্গিক পরিবেশের সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে এইগুলি দেহ-নির্ভর হয়েও সহজ আবেগে অশালীন আচরণ মুক্ত। পরবর্তী ‘হাসু’ কাব্যটি প্রধানতঃ শিশুতোষ গ্রন্থ। শান্তিনিকেতনের আশ্রমকন্যা হাসুকে উপলক্ষ করে কাব্যটি রচিত। এখানে শিশুমনের গভীরে ডুব দিয়ে তার স্বভাব-চরিত্র, একাকীত্ব, নিঃসঙ্গতা, আনন্দ-উল্লাস, চিত্ত চাঞ্চল্য, বায়না, আবদার ও কৌতুকময়তা দেখানো হয়েছে। ‘হাসুর দুঃখ’, ‘খুকীর সম্পত্তি’, ‘ঠিকানা’ প্রভৃতি কবিতা এই কাব্যের অন্যতম সম্পদ; যেমন

“তাহলে কি লক্ষ্মীরা সব, মাঝে মাঝে খবর নিও

কেমন থাকে বিড়াল ছানা লিখে আমায় পত্র দিও।

কুকুর ছানা ঘুমায় রাতে? দুষ্টু ইঁদুর পালায় কোথা,

ক’বার কাদেন ব্যাঙের পিসী? লিখো আমায় সকল কথা।”

‘রূপবতী’ কাব্যের মুখ্য অবলম্বন, সৌন্দর্য ও প্রেম। কবির উদ্ধৃত এক অজ্ঞাতনামা পল্লীকবির মাধ্যমে ব্যক্ত এর ভাবরূপ

“মালির বাগিচায় ফুলের গাছটি ভোমর উড়িয়া পড়ে

তুমি সোজন দেখিয়া করিও পিরীতি, মরিলে বাঁচাইতে পারে।”

‘এক পয়সার বাঁশী’ কাব্যটি শিশু চিত্ত বিনোদনের জন্য লেখা। এখানে কবি শিশুমনের সুখ-দুঃখের, হাসি-কান্নার কৌতূহলের সীমানা পেরিয়ে অন্য এক জগতে ঢুকেছেন। সমাজের অত্যাচার-অনাচার-শোষণের বিরুদ্ধে কবি এখানে সোচ্চার। সর্বমোট সতেরটি কবিতার সমন্বয়ে সংগঠিত এর কাব্যশরীর। বিদ্রোহের দহনদীপ্তি লক্ষ্য করা যায়

“তোমার মুখে বাজবে বাঁশী

অন্ধকারের ধুম্ররাশি, 

ফুঁয়ে ফুঁয়ে উঠবে জ্বালায় জ্বলে।

………..

লক্ষ যুগের অত্যাচারের

শোধ লইতে সকল মারের

তোমার মুখে বাজবে বাঁশী 

অগ্নি শিখায় জ্বলে।”

এই কাব্য সার্থক হলেও পরবর্তী ‘মাটির কান্না’ কাব্যটি ব্যর্থ সৃষ্টি। একজন সমালোচকের মতে, “নিজস্ব কাব্য চরিত্র বর্জন করলে একজন অসামান্য কবিরও যে কি পরিমাণ স্খলন হতে পারে— তার দলিল ‘মাটির কান্না’।

নরনারীর প্রেমভাবনার জটিলতা ও আস্তিক্যবোধের প্রকাশিত রূপ ‘সকিনা’ কাব্য

“খোদার নিকট পঞ্চ রাকাত নামাজ আদায় করি

সাতবার সে যে মনে মন নিল দরুদ সালাম পড়ি।”

জসীমউদ্দিনের শ্রেষ্ঠ কবিতা সঙ্কলন ‘সুচয়নী’। এই কাব্য ইতালীতে অনুবাদ করেছেন ফাদার মারিনো রিগ্যান। ‘মা যে জননী কান্দে’ কাব্যে কবির প্রেম-ভালোবাসার নমভূমি ছেড়ে রুক্ষ বাস্তবভূমিতে উত্তরণ ঘটেছে। ‘হলুদ বরণী’তে রোমান্টিক সৌন্দর্য, কবিমনের আবেগ-আর্তি ও প্রেমভাবনার পরিচিত রূপের প্রকাশে কোন নতুন চমক নেই।

‘জলের লেখন’ কাব্যেও প্রেম ও সৌন্দর্যই মূল বিষয়। শহীদ সামাদকে উৎসর্গ করা কাব্য ‘ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে’ কাব্যকল্পনার রঙীন রূপ ত্যাগ করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সমাজসচেতন কবিমনের প্রকাশ ঘটেছে। এই কাব্যে ‘বঙ্গবন্ধু’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কবিতা। তার শেষ পর্যায়ের কাব্য ‘মাগো জ্বালায়ে রাখিস আলো’তে লোকজ-সংস্কৃতির প্রতি তার তীব্র অনুরাগ প্রকাশ পেয়েছে

“মা গো তুই হেথা

জ্বালায়ে রাখিস আলো

যদিও সামনে ঘনঘটা রাত আঁধার নিকষ কালো,

সবাই ভুলেছে, সব চলে গেছে

বিগত কালের কলা-কৌশল আনি

এ-যুগে সে-যুগে সেতুবন্ধন দিস মা যতনে টানি।

এই আশাবাদের উজ্জ্বল প্রকাশেই কাব্যটি আকর্ষণীয়।

জসীমউদ্দিনের গদ্যরচনা:

কাব্যরচনা বাদে জসীমউদ্দিন গদ্যরচনায়ও পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। তার ভ্রমণকথা ও স্মৃতিচারণামূলক গ্রন্থগুলি এ ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন। বস্তুতঃ জসীমউদ্দিনের কৃতিত্ব এইখানেই যে– (১) ‘কল্লোল’ পত্রিকার লেখক হয়েও কল্লোলীয় আধুনিকতা এবং রবীন্দ্র-বিরোধিতা থেকে দূরত্ব রক্ষা। (২) বস্তুস্বাতন্ত্র্য এবং সহজ ভাবনায় মনকে স্পর্শ করার দক্ষতা। (৩) পল্লীপ্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ কখনো বা একাত্ম হয়ে মানবপ্রেম ও দুঃখকে বোঝার প্রচেষ্টা। (৪) প্রবাদ-প্রবচন, লোকগীতি, লোকনাট্যের অনুষঙ্গকে কবিতায় প্রকাশ করা। আঞ্চলিক বাগ্‌ভঙ্গির নিখুঁত ব্যবহার। (৫) উদার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবে সর্বশ্রেণীর পাঠকের আত্মীয় হয়ে ওঠা। (৬) তত্ত্ব বিনির্ভর সহজ সরল ভাবনায় জীবনসত্যকে প্রকাশ করা।

খুব স্বাভাবিক ভাবে তাই তাঁর কাব্যের অনুবাদ করতে গিয়ে E. M. Milford-এর মনে হয়েছিল : “Jasimuddin Villager’s rejoice and suffer, desire, and undesired, hate and despair from the very depth of the soul; there is nothing trival about them, nothing superficial, they are real.” (The field of the Embroidered Quilt’/ Jasimuddin’)।

সীমাবদ্ধতা : বিপরীত দৃষ্টিতে জসীমউদ্দিনের কাব্যে কিছু সীমাবদ্ধতাও দেখা যায়। তার সুদীর্ঘ একান্ন বছরের কবিতাচর্চার (১৯২৫-১৯৭৬ খ্রীঃ) মধ্যে প্রথম দিকের কাব্যগুলি (যেমন—’রাখালী’, ‘নকসী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’ প্রভৃতি) | যতটা ভাবনা ও কল্পনায় উজ্জ্বল, পরবর্তী কাব্যগুলির মধ্যে উপাদান স্বল্পতা, ক্লান্তিকর অতীত রোমন্থন অনুভব করা যায়। তবু আধুনিক বাংলা কাব্যের সূচীপত্রে জসীমউদ্দিনের নামটি স্বতন্ত্র মর্যাদায় স্থান পাবার যোগ্য।