উনিশ শতকের শেষার্ধে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গের মহিলা কবিদের মধ্যে কবি কামিনী রায়ের নামটি সর্বজন পরিচিত। তার কারণ কবিরূপে এবং ছাত্রী-জীবনেই বেথুন স্কুলে জাতীয়তাবোধের নেতৃত্বদানে তিনি হয়েছিলেন সুপরিচিতা। সরলা দেবী চৌধুরাণী তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন : “…এদিকে স্কুলে উপর ক্লাসের কতকগুলি মেয়েদের নেতৃত্ব প্রভাবে আমার জাতীয়তার ভাব উত্তরোত্তর বর্ধিত হতে লাগল। তাদের মধ্যে অন্যতম নেত্রী ছিলেন— কামিনী দিদি ও অবলা দিদি—কবি কামিনী রায় ও লেডি অবলা বসু”।

কামিনী রায়ের জন্ম ও কর্মজীবন:

কবি কামিনী রায় ১৮৬৪ খ্রীস্টাব্দের ১২ অক্টোবর বাখরগঞ্জ জেলার অন্তর্গত বাসন্ডা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সে যুগের খ্যাতিমান সাহিত্যিক ও ম্যাজিস্ট্রেট চণ্ডীচরণ সেনের কন্যা এবং স্ট্যাটুটারি সিভিলিয়ান কেদারনাথ রায়ের পত্নী। ১৮৮০ খ্রীস্টাব্দে তিনি বেথুন কলেজ থেকে এনট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৬ খ্রীস্টাব্দে এই স্কুলের কলেজ বিভাগ থেকে ভারতে প্রথম মহিলা যিনি সংস্কৃতে অনার্সসহ বি. এ. পাশ করেন। তারপর ‘ইলবার্ট বিল’ আন্দোলন তথা সুরেন্দ্রনাথের কারাবরণের সময় কামিনী সেন বেথুন স্কুলে ছাত্রীদের নেত্রীস্থানীয়া হয়ে ওঠেন। কলেজী শিক্ষার পর তিনি প্রথমে বেথুন স্কুলে, পরে কলেজ-বিভাগে অধ্যাপনার কাজে বিবাহের (১৮৯৪ খ্রীঃ) পূর্ব পর্যন্ত যুক্ত ছিলেন।

কবি হেমচন্দ্রের গুণমুগ্ধ পাঠিকা রূপেই কামিনী রায়ের কাব্যপাঠে অভিনিবেশ হয়। একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন : “রবীন্দ্রের অভ্যুদয়ের পূর্বে হেমচন্দ্র বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তাঁহার জ্বলন্ত স্বদেশ প্রীতি, নারীজাতির প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধাপূর্ণ অকপট সহানুভূতি, দেশাচারের প্রতি ঘৃণা ও ধিক্কার, জাতীয় পরাধীনতায় ক্লেশ ও লজ্জাবোধ— এ সকল তাঁর মত তেজস্বিতা ও সহৃদয়তার সহিত তাঁহার পূর্বে কেহ প্রকাশ করিতে পারেন নাই। এখানকার বিচারে তাঁহার রচনার মধ্যে অনেক ত্রুটি পাওয়া যাইতে পারে, কিন্তু আমরা সেকালে কলাকুশলতা (art) হইতে কবির উচ্ছ্বসিত হৃদয় (heart) দেখিয়া মুগ্ধ হইতাম”

রবীন্দ্র-কাব্যের রোমান্টিক রহস্যময়তায় তিনি ছিলেন নিঃস্পৃহ। রবীন্দ্র-কাব্যের সূক্ষ্মতা বা রোমান্টিক কবিদের কল্পনাভিসারেও ছিলেন অমুগ্ধ। বরং তার পরিবর্তে তিনি চেয়েছিলেন“সুখ, দুঃখ, ক্ষুধা, তৃষ্ণা, আশা, আকাঙ্ক্ষা, গভীর আনন্দ ও তীব্র বেদনা এই সকল দিয়া যে মানব জীবন তাহার একটা জাগ্রত অস্তিত্বও আছে এবং তাহার একটা সবল প্রকাশের উপযোগী কবিতাও আছে ও থাকিবে” (পূর্বোক্ত, চিঠি) তাকে প্রকাশ করতে। এই প্রকাশে বিদ্রোহের দীপ্তি নেই, সহজ সরল অনুরাগী মাধুর্য আছে।

কামিনী রায়ের কাব্যগ্রন্থসমূহ:

(১) কাব্য-কবিতা : ‘আলো ও ছায়া’ (১৮৮৯, মতান্তরে ১৮৯৯), ‘নির্মাল্য’ (১৮৯০), ‘মাল্য ও নির্মাল্য’ (১৯১৩), ‘সাদ্ধিকী’ (১৯১৩)।

(২) নাট্যকাব্য : শোকগাথা‘পৌরাণিকী’ (১৮৯৭), ‘অম্বা’ (১৯১৫), ‘অশোকসঙ্গীত’ (১৯১৪), ‘সিতিমা’ (১৯১৬), ‘দীপ ও ধূপ’ (১৯২৯) এবং জীবন পথে’ (১৯৩০)।

(৩) শিশুসাহিত্য : ‘গুঞ্জন’ (১৯০৫), টলস্টয়ের গল্পের অনুবাদ ‘ধর্মপুত্র’ (১৯০৭), ঠাকুরমার চিঠি’ (১৯২৩)।

কামিনী রায়ের প্রথম কাব্য ‘আলো ও ছায়া’ হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকাসহ প্রকাশিত হয়। হেমচন্দ্র গুরুত্ব দিয়েছিলেন নারীত্বের উপর, কিন্তু কামিনী রায়ের তা মনোমত হয় নি। তবে “কবিতাগুলি আজকালের ছাঁচে ঢালা”—মহাকবির এই মন্তব্যকে মান্য করেছিলেন। সমকালের ‘ভারতী’ পত্রিকায়ও একটি প্রবন্ধে লেখা হয়েছিল “কোন সমাজের কোন দিকই কামিনীর ভাল করিয়া দেখিবার অবসর বা সুবিধা ঘটে নাই। সামাজিক জীবনের অভিজ্ঞতা তাহার বড়ই কম। তাহার আদর্শ বেশির ভাগ ইংরেজী ও সংস্কৃত সাহিত্য-জগৎ হইতে লব্ধ ও কল্পনা প্রসূত। কাজেই তাঁহার কবিতাগুলি পুরাতন ছাঁচে ঢালা হইতে পারে নাই”

বিষাদময়তা : এই কাব্যের মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয় বিষাদময়তা, যা একান্তভাবেই সহজ সরল রমণী-মনের বেদনা-দীপিত; যেমন

“গিয়াছে ভাঙ্গিয়া সাধের বীণাটি,

ছিঁড়িয়া গিয়াছে মধুর তার,

গিয়াছে শুকায়ে সকল মুকুল; 

সকলি গিয়াছে কি আছে আর। 

নিবিল আকাশে আশার প্রদীপ

ভেঙে চুরে গেল বাসনা যত 

ছুটিল অকালে সুখের স্বপন

জীবন মরণ একই মত!” (‘সুখ’)

এই কাব্যের শেষাংশে সংস্কৃত সাহিত্যের আদর্শে রচিত ‘মহাশ্বেতা’ এবং ‘পুণ্ডরীক’ নামে দুটি দীর্ঘ কবিতা স্থান পেয়েছে। বাংলা কাব্যে সংস্কৃত সাহিত্যের চরিত্র-নির্ভর এরকম রচনা প্রথম দৃষ্টান্ত বলা চলে।

নাট্যকাব্য/শোকগাথা/সনেট : ‘পৌরাণিকী’ এবং ‘অম্বা’ নাট্যকাব্য। এর আদর্শ রবীন্দ্রকাব্য থেকে সংগৃহীত। ‘গুঞ্জন’ নামে শিশুপাঠ্য কাব্যটিও রবীন্দ্রনাথের ‘শিশু’ কাব্যের অনুসরণ। হতাশা ও অভিমানে বিক্ষুব্ধ নারী-হৃদয়ের আত্মবিলাপ শোনা যায় ‘মাল্য-নির্মাল্য’ কাব্যে; এখানেও রবীন্দ্রপ্রভাব অনুভব করা যাবে। তার পুত্র-শোকাতুর হৃদয়ের শোকগাথা ‘অশোকসঙ্গীত’ কাব্যটি; এখানে বিদেশী শোক-কাব্যের আদর্শ যেমন দেখা গেছে, তেমনি আছে রবীন্দ্রকাব্য ‘স্মরণ’-এর অনুসরণ। অনুরূপভাবে ‘দীপ ও ধূপ’ এবং ‘জীবনপথে’র সনেটগুলি ভাবে ও ভাষায় রবীন্দ্রানুসারী।

কাব্যরীতি : ভাব ও ভাষা রীতির দিক থেকে কামিনী রায়ের কবিতা একান্তভাবেই নারী-চিত্তের বৈশিষ্ট্যে অনুরাগ-রঞ্জিত। তাঁর “তোরা শুনে যা আমার মধুর স্বপন, শুনে যা আমার আশার কথা” অথবা “অনল শুষিতে চাহি আপনার হিয়া মাঝে” ইত্যাদি বাচনভঙ্গীর মধ্যে সেই সৌকুমার্যের পরিচয় আছে। কাব্যছন্দের দিক থেকেও তিনি হেমচন্দ্রের অনুসরণে প্রবহমান, যতিপ্রান্তিক পয়ার, ত্রিপদী, চৌপদী, বিশিষ্ট কলামাত্রিক ছন্দে লিখেছেন। রবীন্দ্রনাথের অনুসরণে সমিল প্রবহমান পয়ারে লিখেছেন, পেত্রার্কের অনুভাবনায় সনেট লিখেছেন শতাধিক। অবশ্য ভাবগত অষ্টক-ষষ্টক বিন্যাস সর্বত্র স্পষ্ট হয় নি। কিন্তু কল্পনার ঐশ্বর্যে সনেটগুলি অনেক সময় সার্থক হয়েছে।

সমকালীন মহিলা কবিদের মধ্যে কামিনী রায়ের কৃতিত্ব সর্বাধিক, এ কথা সত্য। প্রেম-প্রকৃতি-স্বদেশপ্রেম ইত্যাদি বিষয়গত বৈচিত্র্যও ছিল বেশি। কিন্তু তবু বিষয়বস্তুর চমক, বাক্-রীতির কৃতিত্ব, ছন্দ নির্মাণে অভিনবত্ব দেখিয়ে কোন পুরোবর্তিতা তিনি উত্তরসূরী কবিদের জন্য রেখে যেতে পারেন নি।