প্রথম জীবনে ছিলেন সমাজবন্ধহীন-কিশোর। যৌবনে হন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক। তারপরে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার কর্ণধার রূপে রাজদণ্ডিত বন্দী চিহ্নিত হন। এইরূপ বিবিধ পরিচয়ে জনপ্রীতিধন্য বিদ্রোহী-সাম্য-সর্বহারা-অগ্নিবীণার কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালীর জীবনে ও সাহিত্যে হয়ে উঠেছেন এক প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব। নজরুলের ব্যক্তিগত এবং সাহিত্যজীবন দুই-ই অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময়।
নজরুল ইসলামের জন্ম ও কর্মজীবন:
বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে কবির জন্ম। ডাক নাম ছিল, দুখু মিঞা। পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ। মা জাহেদা খাতুন। বাল্যেই পিতৃবিয়োগ হয়। দারিদ্র্যের মধ্য দিয়েই জীবনের সূচনা। ভৃত্যের কাজ থেকে শুরু করে ৪৯ নম্বর বাঙালী পল্টনে যোগদান পর্যন্ত বিভিন্ন পেশার মধ্য দিয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। তারপরে পরাধীন ভারতে ইংরেজ শাসন ও শোষণ, সামন্ততন্ত্র ও জমিদারদের অত্যাচারে প্রজা সাধারণের দুর্দশা, ধর্মীয় বিদ্বেষ-জাতিভেদ ও সাম্প্রদায়িকতা-রাজনৈতিক উৎপীড়ন দেখে অগ্নিক্ষরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে প্রেম-প্রণয়ভঙ্গ, বিবাহ-বিচ্ছেদ ইত্যাদি ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় প্রেমের আবেগে একের পর এক কবিতা লিখে চলেন। নানা ঘটনায় ভরে ওঠে কবির জীবনপাত্র; যেমন– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ফজিলতুন্নেসার কাছে প্রেম নিবেদন ও প্রত্যাখ্যান, রাণু সোমকে গান শেখাতে গিয়ে অপ্রিয় ঘটনা, দৌলতপুরে সৈয়দা খাতুন ওরফে নার্গিসের সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদ, কুমিল্লায় ধীরেন্দ্র সেনগুপ্ত ও গিরিবালার কন্যা দোলনচাপা আশালতা ওরফে প্রমীলার সঙ্গে প্রণয় ও বিবাহ, শনিবারের চিঠিতে সেই নিয়ে সমালোচনা প্যারডি রচনা ইত্যাদি। এসব কিছুই আজ “অতীত দিনের স্মৃতি” যার কথা “কেউ ভোলে না কেউ ভোলে।”
নজরুল ইসলামের রচনাসমূহ:
নজরুলের সাহিত্যজীবন শুরু হয় পালাগান রচনায়। ‘শকুনি বধ’, ‘মেঘনাদ বধ’, ‘চাষার সং’, ‘রাজদূত’, ‘আকবর বাদশা’, ‘দাতাকর্ণ’ ইত্যাদি। তারপর সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন ‘হাবিলদার কবি’ করাচীতে থাকার সময় লেখেন ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’, ‘রিক্তের বেদনা’, ‘বাঁধনহারা’ ইত্যাদি রচনা।
নজরুল ইসলামের কাব্য, অনুবাদ ও সঙ্গীত গ্রন্থ:
‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), ‘দোলন-চাপা’ (১৯২৩), ‘বিষের বাঁশী’ (১৯২৪), ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), ‘চিত্তনামা’ (১৯২৫), ‘ছায়ানট’ (১৯২৫), ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫), ‘পূবের হাওয়া’ (১৯২৬), ‘ঝিঙে ফুল’ (১৯২৬), ‘সর্বহারা’ (১৯২৬), ‘ফণিমনসা’ (১৯২৭), ‘সিন্ধুহিল্লোল’ (১৯২৮), ‘সঞ্চিতা’ (১৯২৮), ‘বুলবুল’ (১৯২৮), ‘চক্রবাক’ (১৯২৯), ‘সন্ধ্যা’ (১৯২৯), ‘চোখের চাতক’ (১৯২৯), ‘রুবাইয়াৎ-ই হাফিজ’ (১৯৩০), ‘নজরুল-গীতিকা’ (১৯৩০), ‘প্রলয়শিখা’ (১৯৩০), ‘নজরুল স্বরলিপি’ (১৯৩১), ‘চন্দ্রবিন্দু’ (১৯৩১), ‘সুরসাকী’ (১৯৩২), ‘বনগীতি’ (১৯৩২), ‘জুলফিকার’ (১৯৩২), ‘সাতভাই চম্পা’, ‘গুল-বাগিচা’ (১৯৩৩), ‘কাব্য আমপারা’ (১৯৩৩), ‘গীতি-শতদল’ (১৯৩৪), ‘সুরলিপি’ (১৯৩৪), ‘সুরমুকুর’ (১৯৩৪), ‘গানের মালা’ (১৯৩৪), ‘মক্তব সাহিত্য’ (১৯৩৫), ‘নির্ঝর’ (১৯৩৯), ‘নতুন চঁাদ’ (১৯৪৫), ‘মরু-ভাস্কর’ (১৯৫১), ‘শেষ সওগত’ (১৯৫৮) ‘বুল্বুল্-২য়’ (১৯৫৯), ‘সঞ্চয়ন’ (১৯৫৫), ‘রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম’ (১৯৫৯), ‘মধুবালা’ (১৯৬০), ‘ঝড়’ (১৯৬১), ‘ধূমকেতু’ (১৯৬২), ‘রাঙাজবা’ (১৯৬৬)।
নজরুল ইসলামের উপন্যাস ও ছোটগল্প:
‘বাঁধনহারা’ (১৯২৭), ‘কুহেলিকা’ (১৯৩১), ‘মৃত্যুক্ষুধা’ (১৯৩০), এবং ছোটগল্প—‘ব্যথার দান’ (১৯২২), ‘রিক্তের বেদন’ (১৯২৫), ‘শিউলি মালা’ (১৯৩১)।
নজরুল ইসলামের নাটক:
‘ঝিলিমিলি’ (১৯৩০), ‘আলেয়া’ (১৯৩৮), ‘পুতুলের বিয়ে’ (১৯৬৪) এছাড়া ‘বিদ্যাপতি’, ‘শ্রীমন্ত’, ‘ইদলফেতর’, ‘প্রীতি উপহার’, ‘বনের বেদে’, ‘মধুমালা’ প্রভৃতি নাটকগুলি রেকর্ড কোম্পানীর জন্য রচিত হয়।
নজরুল ইসলামের প্রবন্ধ:
‘যুগবাণী’ (১৯২২), ‘দুর্দিনের যাত্রী’ (১৯২৬), ‘রুদ্রমঙ্গল’ (১৯২৭)।
নজরুল ইসলামের পত্রিকা প্রকাশ:
‘ধূমকেতু’ নামে পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ (১৯২২)।
নজরুলের জীবন ও কাব্যের পটভূমি:
ঘটনাবহুল নজরুলের জীবনের মতই তাঁর কাব্যের পটভূমিও বৈচিত্র্যময়। কবি জীবনের প্রথম পর্ব কাটে চুরুলিয়া গ্রাম, আসানসোল শহর, ময়মনসিংহের সিমলা গ্রাম রানীগঞ্জের সিয়ারসোল অঞ্চলে। সিয়ারসোলে রাজ হাইস্কুলে ছাত্রাবস্থায় রচিত হয় ‘মুক্তি’, (রানীগঞ্জের পটভূমিকায় প্রথম মুদ্রিত কবিতা ১৯১৬ খ্রীস্টাব্দে), ‘চড়ুই পাখীর ছানা’, ‘করুণ গাথা’, ‘করুণ বেহাগ’ ইত্যাদি কবিতা। তার সৈনিক জীবন ঘিরে শুরু হয় দ্বিতীয় পর্ব; প্রধানত নৌশহরা ও করাচীতে। করাচীতে থাকাকালীন, সেখানকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘বাউণ্ডুলের আত্মকাহিনী’ গল্প ‘সওগাত’ পত্রিকায়। এছাড়া বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘হেনা’ ও ‘ব্যথার দান’ গল্প এবং হাফিজের লেখা একটি রুবাইয়াতের অনুবাদ ‘আশা’ কবিতা। ‘সবুজপত্রে’ কবিতাটি প্রকাশের আশায় পাঠানো হয়। কিন্তু রবীন্দ্র-প্রভাব অনুভব করে সম্পাদক প্রমথ চৌধুরী তা প্রত্যাখ্যান করেন। তারপর পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের উদ্যোগে তা ‘প্রবাসী তে প্রকাশিত হয়। তাঁর পত্রোপন্যাস ‘বাঁধন হারা’, ‘মোসলেম ভারত’ নামে একটি মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘শাত-ইল্-আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবাণী’ ও ‘মোহরম’, ‘বিদ্রোহী’, ‘কামালপাশা’ ইত্যাদি কবিতা। তবে ‘মোসলেম ভারতে’র পূর্বে সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় প্রথম ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি মুদ্রিত হয়। ‘বিদ্রোহী’ কবিতার খ্যাতি ও জনপ্রিয়তা কাজী নজরুলকে বাংলা সাহিত্যে অমরত্ব দান করে।
হুগলী জেলে দিন যাপনের সময় তিনি লেখেন ‘আজি সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে’ কবিতা, যা পরে ‘কল্লোল’ পত্রিকা প্রকাশ করে। দারিদ্র্য’ কবিতাও এখানে প্রকাশিত হয়। রচিত হয় ‘শিকল ভাঙার গান’ (‘বিষের বাঁশী’), ‘ভাঙার গান’, (জেল) ‘সুপার বন্দনা’ ইত্যাদি বেশ কিছু গান।
হুগলীর পর কবি কৃষ্ণনগরে আসেন। সেখানে লেখেন দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ (কান্ডারী হুঁশিয়ার) নামে কবিতাটি। এখানে ‘কুহেলিকা’ ও ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস দুটিও রচিত হয়। ইন্টারন্যাশানাল’ গীত ‘গণবাণীতে প্রকাশিত হয়।
কৃষ্ণনগর থেকে কলকাতায় আসার পর রচিত হয় ‘সর্বহারা’, ‘ফণিমনসা’ প্রভৃতি কাব্য। বিভিন্ন গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানী ও কলকাতার বেতার কেন্দ্রের জন্য তিনি অজস্র গান রচনা করেন। এই কলকাতায় ৭নং প্রতাপ চ্যাটার্জী লেন থেকে প্রকাশিত হয়। কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় ‘ধূমকেতু’ পত্রিকা (১৯২২ খ্রীঃ ১২ই আগস্ট)। সপ্তাহে দুবার এই পত্রিকা প্রকাশিত হয়, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ সমকালের বহু স্বনামধন্য ব্যক্তি এই পত্রিকার প্রকাশকে স্বাগত জানিয়ে আশীর্বাদ করেন। কবিকে ঘিরে বসে মজলিস—আব্দুল হালিম, যতীন্দ্রমোহন বাগচী, মুজফ্ফ্ফর আহমেদ, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত সরকার, শরৎ পণ্ডিত প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ সেখানে উপস্থিত হতেন।
১৯২৬ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৯২৯ খ্রীস্টাব্দের মধ্যে নজরুল দু’বার চট্টগ্রামে যান। সেখানে ‘সিন্ধু হিল্লোল’, ‘চক্রবাক’, ‘ঝিঙে ফুল’, ‘জিঞ্জির’, ‘নতুন চঁাদ’, ‘মরু-ভাস্কর’, ‘সঞ্চয়ন’ প্রভৃতি কাব্যগুলি রচিত হয়। চট্টগ্রামের প্রকৃতি তার ‘কর্ণফুলী’, ‘গীতের সিন্ধু’, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, ‘সিন্ধু হিল্লোল’ প্রভৃতি কবিতায় আত্মপ্রকাশ করে।
১৯৫৮ খ্রীস্টাব্দে ‘শেষ সওগত’ নামে কাব্যটি নজরুলের অপ্রকাশিত কবিতাসহ প্রকাশিত হয়। ১৯৬১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘ঝড়’ নামক কাব্য। মহম্মদের (প্রথম ২৫ বৎসর) জীবনী অবলম্বনে লেখা হয় ‘মরু-ভাস্কর’ কাব্য। খান মঈমুদ্দীন সাহেব বলেন— “হজরত মহম্মদের জীবনী নিয়ে লেখা একটি কাব্য। এই বই নজরুল ইসলাম প্রথম লেখা আরম্ভ করেন সওগাতে (বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৭)। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও এটা তিনি শেষ করতে পারেন নি” (‘যুগস্রষ্টা নজরুল’, পৃষ্ঠা ২৬৮)। নজরুলের ‘কাব্যে আমপারা’ কোরান শরীফের কিছু অংশের কাব্যানুবাদ।
গীতিকার ও সুরকার : ভারতবর্ষের এক অদ্বিতীয় গীতিকার ও সুরকার রূপেও নজরুল চিরস্মরণীয়। গজল গান, ইসলামী গান, শ্যামা সঙ্গীত, ভাটিয়ালী গান ইত্যাদি বহুবিধ গানের তিনি অসামান্য স্রষ্টা। তাঁর সমগ্র গানের সংখ্যা কারো মতে, (যেমন নারায়ণ চৌধুরী) তিন হাজার, কারো মতে (আবদুল আজীজ আল্ আমান হরফ প্রকাশনীর স্বত্ত্বধিকারী) একুশশো-র কিছু বেশি। এর মধ্যে বহু গান লুপ্ত এবং হয়ত কয়েক শত গান কারোর ব্যক্তিগত সংগ্রহের খাতায় সংরক্ষিত। অনেকের খাতায় কবি যে গান লিখেছিলেন তা সম্পূর্ণ তালিকা এখন পাওয়া দুষ্কর। বেশ কিছু গান পুরনো গ্রামোফোন রেকর্ডের মধ্যে আবদ্ধ হয়ে আছে। বিভিন্ন গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানী তাঁকে দিয়ে অনেক গান লিখিয়ে নেয়। কবি নিজেও কলকাতা বেতার কেন্দ্রে গান রচনায় যোগ দিয়েছিলেন।
কবির শেষ জীবন অত্যন্ত দুঃখময়। ১৩৩৫-এ প্রথমে মা, তারপরে ১৩৩৭-এ শিশুপুত্র বুলবুলের মৃত্যুশোক তাঁকে আহত করে। পুত্রশোকে স্তব্ধ কবি “শূন্য’ এ বুকে পাখী মোর ফিরে আয়, ফিরে আয়” শীর্ষক গানটি রচনা করেন। এই বছরে পত্নী প্রমীলার পক্ষাঘাত দেখা দেয়। দুঃখে-দারিদ্র্যে-শোকে-অসুখে-অশাস্তিতে বিহুল কবি ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৯৭৬ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৩৪ বৎসর সৃষ্টিশীলতা হারিয়ে বাক্শক্তিহীন হয়ে পড়েন। ২৯শে আগস্ট ১৯৭৬-এ বাংলাদেশে তাঁর জীবনাবসান হয়।
নজরুল ইসলামের কাব্য পরিচয়:
বিষয়-বৈচিত্র্যে ও কল্পনায় নজরুলের কবিতা সমৃদ্ধ। তার কবিতাসমূহকে সাধারণভাবে দুটি ভাগে বিন্যস্ত করা যায়(ক) বিষয়নিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান, (খ) ব্যক্তিনিষ্ঠ ও কল্পনাপ্রধান। প্রথম পর্যায়ের কাব্য-কবিতার মধ্যে সমাজ, সমাজের আর্থ-রাজনৈতিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয়ে নানা সমস্যা, বিদ্রোহ, বিক্ষোভ, অভিযোগ, স্বদেশ, যুদ্ধ ঘোষণা প্রভৃতি দেখা যায়। দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশুদ্ধ Lyric বা কবি মনের ভাবোচ্ছ্বাস, ব্যক্তিময়তা বা মন্ময় ভাব প্রাধান্য পায়।
নজরুল ইসলামের কাব্যে বিদ্রোহ ও সমাজভাবনা:
নজরুলের বস্তুনিষ্ঠ ও বক্তব্যপ্রধান কবিতাগুলির মধ্যে ‘বিদ্রোহী’, ‘ফরিয়াদ’, ‘সাম্যবাদী’, ‘অন্ধ স্বদেশ’, ‘দেবতা’, ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এইসব কবিতার মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও বিদ্রোহের দীপ্তি ও দাহ যুগমানসের বৈশিষ্ট্যরূপে প্রকাশিত সমালোচক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নজরুল কবিতার আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেনঃ “মনে রাখতে হবে সেই যুগ যখন বাংলার যুবশক্তির আবেগোম্বেল প্রাণ দক্ষিণপন্থী, কংগ্রেস-নীতির নরম ও মোলায়েম প্রায় নিয়মতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ আক্রোশে গর্জন করে উঠেছে। বাংলার অগ্নিপুরুষ দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন গড়ে তুলেছেন তাঁর গরমপন্থী ‘স্বরাজ্যদল’, আর দেশবন্ধুর পরম অনুগত পার্শ্বচর, যুদ্ধ-ফেরৎ নজরুল তাঁর সঙ্গে সঙ্গে সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। সে যুগে হিসাব ছিল না, বিচারও ছিল না। অসন্তোষ আর বিক্ষোভের ধারা-প্রতিধারা চার দিক থেকে এসে আছড়ে পড়ছিল”
এই বিক্ষোভ উত্তাল হয়ে উঠেছে। ‘আমার কৈফিয়ৎ’ কবিতায়—
“পরোয়া করি না, বাঁচি বা না বাঁচি যুগের হুজুগ কেটে গেলে,
মাথার ওপরে জুলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে!
প্রার্থনা ক’রো-যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস,
যেন লেখা হয় আমার রক্ত-লেখায় তাদের সর্বনাশ।”
কখনো বা ‘বিদ্রোহী’র ভূমিকায়—
“মহা-বিদ্রোহী রণক্লাস্ত
আমি সেইদিন হবো শাস্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না-”
আবার কখনো বা বিপ্লবের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার প্রেরণায়—
“নবীন মন্ত্রে দানিতে দীক্ষা আসিতেছে ফাল্গুনী,
জাগো রে জোয়ান! ঘুমায়ো না ভুয়ো শান্তির বাণী শুনি।”
কবি ধ্বংসের জয়গান গেয়েছেন। কারণ তার মধ্যে আছে নতুন দিনের ইঙ্গিত—
“ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর? প্রলয় নূতন সৃজন বেদন
আছে নবীন-জীবন হারা অসুন্দরে করতে ছেদন।”
তাই “ওই নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়” দেখে তিনি আনন্দিত, শুনতে পান—
“ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয়গান
আসি অলক্ষ্যে দাঁড়ায়েছে তারা দিবে কোন্ বলিদান?
আজি পরীক্ষা, জাতির অথবা জাতের করিবে ত্রাণ?”
সাম্প্রদায়িক ভেদনীতির বিরুদ্ধে ‘কাণ্ডারী’ তথা দেশনেতাকে ‘হুঁশিয়ার’ করে দেওয়ার সচেতনতাই এই কবিতার মর্মসত্য। কলকাতায় অনুষ্ঠিত ১৯৪২ খ্রীস্টাব্দের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর এই কবিতাটি লেখা হয়।
বিপ্লববাদের মতই নজরুলের ‘সাম্যবাদী’, ‘ইন্টারন্যাশনাল গীত’, অস্তর-ন্যাশনাল সঙ্গীত নামে রচিত ‘কৃষাণের গান’, ‘শ্রমিকের গান’, ‘ধীবরের গান’ প্রভৃতি কবিতায় জাতিভেদহীন সাম্প্রদায়িকতামুক্ত এক উদার সাম্যবাদী ভাবনা প্রতিফলিত। তবে “বিশুদ্ধ আবেগজীবী নজরুল অত্যাচারিতের প্রতি সমর্থনে, শোষক সম্প্রদায়ের প্রতি মহৎ ঘৃণায় এবং সর্বমানবিক কল্যাণ বোধের আমন্ত্রণে সাম্যবাদের কাছে এসেছেন, কিন্তু তার ধীর স্থির অনুশীলনে, প্রাচীন বিশ্বাস ও সংস্কারের ক্রমাপসরণে, ‘সিজনড্ টিম্বারে’র সহিষ্ণুতার দিনে দিনে প্রস্তুত হয়ে ওঠা—এই সম্পূর্ণতা অর্জন তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি”।
প্রেম ও প্রকৃতি-বিষয়ক বিদ্রোহ-বিপ্লবের কবিতার মধ্যেই নজরুলের কবি প্রতিভা আবর্তিত হয়নি, ‘বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি’, ‘গানের আড়াল’, ‘আমি গাই তার গান’ প্রভৃতি কবিতায় প্রেম ও প্রকৃতির অপূর্ব সমাহার অনুভব করা যায়; যেমন—“বাতায়ন পাশে গুবাক তরুর সারি”—
“অস্ত-আকাশ-অলিন্দে তার শীর্ণ-কপোল রাখি,
কাঁদিতেছে চঁাদ, ‘মুসাফির জাগো, নিশি আর নাহি বাকী’।
নিশীথিনী যায় দূর বন-ছায় তন্দ্রায় ঢুলুঢুলু
ফিরে ফিরে চায়, দুহাত জড়ায় আঁধারের এলোচুল!”
কবি মুসাফির নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালীন তার ঘরের জানালার পাশে গুবাক তরুর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। কোন এক অনামিকা প্রেমিকার কাছে হৃদয়-নিবেদনের মুহূর্তে তার স্মৃতিচিত্র কবিকে আলোড়িত করেছে। আবার সমাসোক্তি অলঙ্কারে সুসজ্জিত ‘গানের আড়াল’-এর এই অংশও রোমান্টিকতার বিরহ-মাধুর্যে মনোহর—
“যে-চাদ জাগালো সাগরে জোয়ার, সেই চাদই শোনে নাই!
সাগরের সেই ফুলে ফুলে, কাদা, কূলে কূলে নিশিদিন?
সুরের আড়ালে মূৰ্চ্ছনা কাঁদে, শোনে নাই তার বীণ?
জানায়ো আমারে, যদি আসে দিন, এইটুকু শুধু যাচি
কণ্ঠ পারায়ে হয়েছি তোমার হৃদয়ের কাছাকাছি।”
নজরুল ইসলামের শিশু বিষয়ক কাব্য:
কাজী নজরুল বেশ কিছু শিশু বিষয়ক কাব্য-কবিতা-নাটক রচনা করেছেন। তাঁর ‘খুকী ও কাঠুবেরালী’, ‘প্রভাতী’, ‘লিচু-চোর’, ‘ঝুমকো লতায় জোনাকী’, ‘মট্কু মাইতি বাঁটকুল রায়’, ‘ঘুমপাড়ানি গান’, ‘আমি যদি বাবা হতাম বাবা হত খোকা’, ‘সাতভাই চম্পা’, ‘শিশুর জাদুকর’ ইত্যাদি কবিতাগুলি এই পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য। শিশুর সরল কৌতূহল ও উল্লাস এইসব কবিতায় লক্ষণীয়। যেমন কাঠবেরালীকে দেখে খুকীর প্রশ্ন—
“এ রাম! তুমি ন্যাংটা পুঁটো?
ফ্রকটা নেবে? জামা দুটো?
আর খেয়ো না পেয়ারা তবে,
বাতাবি নেবুও ছাড়তে হবে!
দাঁত দেখিয়ে দিচ্ছে ছুট? অ’মা দেখে যাও।’
কাঠুবেরালী! তুমি মর! তুমি কচু খাও।”
সমগ্র দৃশ্যটি যেন শিশুর কণ্ঠস্বর সহ একটি শ্রুতিময় চিত্র হয়ে ওঠে। তার ‘পুতুলের বিয়ে’ নাটকে শিশুমনের উপযোগী নাটক ও কবিতার সমাবেশ দেখা যায়।
নজরুল ইসলামের সাঙ্গীতিক প্রতিভা:
গান রচনায় নজরুল ‘স্বরাজ্যে স্বরাট্’। তিনি আগমনী বিজয়া গান (যেমন ‘আমার উমা কই গিরিরাজ, কোথায় আমার নন্দিনী’, ‘বর্ষা গেল, আশ্বিন এল, উমা এল কই’ ইত্যাদি), রাম-শ্যাম বা কৃষ্ণ চৈতন্য-শঙ্কর-দুর্গা-সরস্বতী-বন্দনা, মহাপুরুষ-বন্দনা, বৈষ্ণব ভাবমূলক পদ (যেমন—’ও তুই যানে রাই কিশোরী কদম তলাতে’, ‘চির-কিশোর মুরলীধর কুঞ্জবনচারী’), হাস্যরসাত্মক কবিতা (যেমন ‘আমি তুরগ ভাবিয়া মোরগে চড়ি’, ‘বদনা গাড়ুতে গলাগলি করে’, ইত্যাদি) গজল-মারফতী মুর্শিদ, জারি, সারি, ঝুমুর, খেয়াল, ঠুংরী, বাউল, কাজরী, ভাটিয়ালী, শ্যামাসঙ্গীত ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের গান রচনা করে সাঙ্গীতিক প্রতিভার বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। কাব্য ও কবিতা রচনায় নজরুলের যে অসংযম ও বাণীশৈথিল্য দেখা যায় গানে তার পরিচয় অবিরল নয়। নজরুলের উপর কোন বাংলা কবি-সাহিত্যিকের প্রভাব পড়েনি। এখানে তিনি স্বাতন্ত্র্যে উজ্জ্বল। বাংলা সাহিত্যের সুরসিক ও ভাবুকের কাছে নজরুল আজও নিত্য প্রেরণা।
Leave a comment