রবীন্দ্রনাথের প্রতিভার দীপ্তিতে বাংলার কবিসমাজ যখন আচ্ছন্ন, তখন যে-কয়েকজন কবি নিজস্বতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন, মােহিতলাল মজুমদার (১৮৮৮-১৯৫২ খ্রি.) তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

মােহিতলাল মােট ছয়খানি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন : ‘দেবেন্দ্রমঙ্গল’ (১৯২২ খ্রি.), ‘স্বপনপসারী’ (১৯২২ খ্রি.), ‘বিস্মরণী’ (১৯২৭ খ্রি.), ‘স্মরগরল’ (১৯৩৬ খ্রি.), ‘হেমন্ত গােধূলি’ (১৯৪১ খ্রি.) এবং ‘ছন্দ চতুর্দশী’ (১৯৪১ খ্রি.)।

কবি হিসেবে মােহিতলালের কৃতিত্ব বা খ্যাতির কারণগুলি নীচে সংক্ষেপে সূত্রাকারে আলােচনা করা হল-

  • আঙ্গিক-সচেতন শিল্পীমন: ভাবের বিন্যাস, শব্দ নির্বাচনে এবং ছন্দের প্রয়ােগে মােহিতলালের সচেতন শিল্পীমনের পরিচয় পাওয়া যায়। কোনাে কোনাে সমালোচক তাঁর কবিতাকে ‘ভাস্কর্যধর্মী’ বলেও চিহ্নিত করে থাকেন।

  • ইন্দ্রয়পরায়ণ রােমান্টিকতা: মােহিতলালের কাব্যদর্শনের মূলে আছে দেহবাদ এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণতা—“আমি মদনের রচিনু দেউল—দেহের দেউল পরে/পঞ্চশরের প্রিয় পাঁচ ফুল সাজাইনু থরে থরে।”

  • যুক্তিবিন্যাস: মােহিতলালের কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল ভাবালুতা বর্জন ও যুক্তিপারম্পর্যের শৃঙ্খলে কবিতাকে কাঠিন্য দান।

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন—“মােহিতলালকে আমরা আধুনিকতার পুরােধা মনে করতাম …”—এই স্বীকৃতির মধ্যে রয়েছে কবি হিসেবে মােহিতলালের একটি বড়াে সার্থকতা।

বাংলা কবিতার জগতে দুরন্ত ঝড়ের মতাে আবির্ভূত হয়েছিলেন কাজি নজরুল ইসলাম (১৮৯৮-১৯৭৬ খ্রি.)। তাঁর লেখা উল্লেখযােগ্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ হল- ‘অগ্নিবীণা’, ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’, ‘সাম্যবাদী’, ‘সর্বহারা’, ‘ফণিমনসা’, ‘সিন্ধুহিন্দোল’, ‘জিঞ্জির’ প্রভৃতি। কবিতার সঙ্গে সঙ্গে নজরুল ইসলাম গানও লিখেছেন প্রচুর। বিষয়বস্তু অনুসারে নজরুলের কবিতাগুলিকে নীচের কয়েকটি শ্রেণিতে ভাগ করা যেতে পারে :

  • প্রতিবাদী কবিতা: পরাধীনতার যন্ত্রণা থেকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাে বটেই, যে-কোনাে অন্যায় বা অত্যাচারের বিরুদ্ধেই সরব ছিলেন নজরুল। তাঁর এরকম একটি কবিতা হল ‘বিদ্রোহী’।

  • প্রেম ও সৌন্দর্য-বিষয়ক কবিতা: নজরুলের অনেক কবিতারই বিষয় হয়েছেপ্রেম, সৌন্দর্যপিপাসা কিংবা ভক্তির আবেগ। দোলনচাঁপা এই শ্রেণির প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা।

  • শিশুদের উপযােগী কবিতা: কাজী নজরুল ইসলাম শিশুমনের উপযােগী বেশ কয়েকটি কল্পনানির্ভর কবিতা লিখেছিলেন, যেগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল- ‘লিচু-চোর’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘খুকী ও কাঠবেড়ালী’, ‘প্রভাতী’ ইত্যাদি।

  • যৌবন বন্দনা: বিদ্রোহের কবি হওয়ায় যৌবন বন্দনা প্রত্যাশিতভাবেই নজরুলের কবিতার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দেশের যুবক সম্প্রদায়কে স্বাধীনতা ও বিপ্লবের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলতে তিনি অনেক উদ্দীপনামূলক কবিতা লিখেছিলেন।

তাঁর কবিতার অন্যতম বিশেষত্ব হল তৎসম ও তদ্ভব শব্দের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়ােগ। শব্দ ব্যবহারের এই রীতি তাঁর কবিতায় নিয়ে এসেছে এক অভিনব গতিময় ঝংকার।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ: জীবনানন্দ দাশের দুটি উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ হল ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২ খ্রি.) এবং ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭ খ্রি.)। এ ছাড়াও কবি ‘ঝরা পালক’ (১৯২৭ খ্রি.), ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬ খ্রি.), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৬ খ্রি.), ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮ খ্রি.), ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ (১৯৬১ খ্রি.) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রণেতা।

জীবনানন্দ দাশের কাব্যচর্চা: রবীন্দ্রোত্তর পর্বের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ খ্রি.-১৯৫৪ খ্রি.)। একদিকে বাংলার প্রকৃতি অন্যদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমকালের অবক্ষয়, যন্ত্রণা, মানুষের বিচ্ছিন্নতা অনবদ্য ভঙ্গিতে মূর্ত হয়ে উঠেছে তাঁর কবিতায়। কবিতার মধ্যে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য চিত্র ফুটিয়ে তােলার ক্ষেত্রে জীবনানন্দের তুলনা মেলা ভার। এই কারণে রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের কবিতাকে ‘চিত্ররূপময়’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তবে জীবনানন্দের কবিতার মূল বিষয় আধুনিক ব্যক্তিমানুষের বিচ্ছিন্নতা ও নিঃসঙ্গতার যন্ত্রণা।

তাঁর কবিতা প্রাণের স্পর্শে যেমন বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে, ঠিক তেমনি কবির বিশেষ মৃত্যুচেতনা, স্বদেশচেতনা, সমাজচেতনা এবং ইতিহাসচেতনাও তাতে প্রকাশিত হয়েছে।

জীবনানন্দের কবিতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বিভিন্ন ‘ইতর’ শব্দকেও অনায়াসে তিনি কাব্যকৌলীন্য দান করেছিলেন। তৎসম শব্দের সঙ্গে তিনি অনায়াসে ব্যবহার করতে পারেন ‘ঠ্যাং’, ‘গাড়ল’, ‘খিচড়ে’, ‘থুতথুড়ে’ প্রভৃতি দেশজ শব্দকে জীবনানন্দের কাব্যভাষা এবং উপমা ও চিত্রকল্প বাংলা কবিতায় দোসরহীন।

সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কবি। সুধীন্দ্রনাথের প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ‘তন্বী’ (১৯৩০ খ্রি.)। তাঁর উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল— ‘অর্কেষ্ট্রা’ (১৯৩৫ খ্রি.), ‘ক্রন্দসী’ (১৯৩৭ খ্রি.), ‘উত্তরফাল্গুনী’ (১৯৪০ খ্রি.), ‘সংবর্ত’ (১৯৫৩ খ্রি.), ‘প্রতিধ্বনি’ (১৯৫৪ খ্রি.) এবং ‘দশমী’ (১৯৫৬ খ্রি.)। তাঁর কাব্যের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

  • ভাস্কর্যধর্মী: কবিতার গঠনের ক্ষেত্রে সুধীন্দ্রনাথ এতখানিই সতর্ক ছিলেন যে, তাঁর কবিতাকে বলা যায় ভাস্কর্যধর্মী। ‘অর্কেষ্ট্রা’র প্রেমিক কবিমন ‘ক্রন্দসী’-তে এসে প্রতীকাশ্রয়ী মননশীলতার দিকে ঝুঁকেছে।

  • নৈরাশ্যচেতনা: ‘উত্তরফাল্গুনী’তে কবির নৈরাশ্যচেতনা বেশ প্রকটরূপে প্রকাশ পেয়েছে। সুধীন্দ্রনাথের ‘সংবর্ত-এর কবিতায় শােনা যায় যুগন্ত্রণায় রক্তাক্ত কবির আর্তকণ্ঠ- “আর্তনাদ ছাড়া আজ নৈবেদ্যের যােগ্য কিছু নেই।”

  • নাগরিক জীবনযন্ত্রণার রূপায়ণ: পৌরাণিক কাহিনির নবরূপায়ণে এবং আধুনিক নাগরিক জীবনের যন্ত্রণার চিত্র অঙ্কনে পারদর্শী কবি সুধীন্দ্রনাথ শূন্যতা ও নিরাশার অমােঘ আকর্ষণ থেকে কখনােই নিজেকে মুক্ত করতে পারেননি।

  • নিঃসঙ্গতা, হতাশা, দুঃখ: তাঁর কবিতায় নিঃসঙ্গতা, হতাশা, দুঃখ তীব্রভাবে প্রকাশিত।

  • শিল্পনৈপুণ্য: তাঁর বাক্যবিন্যাস, শব্দপ্রয়ােগ, ছন্দের ব্যবহার সবকিছুর মধ্যেই আছে সচেতন শিল্পপ্রয়াস এবং নৈপুণ্য। সুধীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় অনেক অপ্রচলিত শব্দ ব্যবহার করলেও তাঁর কবিতা কিন্তু দুর্বোধ্য নয়।