প্রকৃতপক্ষে বাংলা সাহিত্যে প্রথম ছোটোগল্পের সৃষ্টি করেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর আগে আমাদের সাহিত্যে ছোটোগল্প বলে কিছু ছিল না, পরেও যে অসংখ্য ছোটোগল্প রচিত হয়েছে। তাদের রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্পগুলির সাথে সমান পর্যায়ে স্থান দেওয়া যেতে পারে, এমন গল্পের সংখ্যা খুব বেশি নয়। রবীন্দ্রনাথের পূর্বে বাংলা সাহিত্যে ছোটোগল্পের সৃষ্টি যে কেন হয়নি, একথা ভাবলে একটু বিস্মিত না হয়ে উপায় নেই। বঙ্কিমচন্দ্রের সর্বতোমুখী প্রতিভা কখনও ছোটোগল্প রচনার দিকে আকৃষ্ট হয়নি বলেই মনে হয়। পরিসরে বা আয়তনে ছোটো এমন দু-একটি গল্প তাঁর আছে। কিন্তু ছোটোগল্প বলতে কথাসাহিত্যের যে প্রকারটিকে বুঝি, বঙ্কিমচন্দ্রের এই গল্পগুলিকে সে পর্যায়ে ফেলতে পারি না। স্বল্প পরিসরের মধ্যে জীবনের একটি ক্ষুদ্র তুচ্ছ খণ্ডাংশকে, কোনও একটি বিশেষ অভিব্যক্তিকে বা বাস্তবানুভূতিকে দু একটি ঘটনার আবর্তে, ভাব ও কল্পনার দ্বন্দ্বে আন্দোলিত করে তাকে স্বাভাবিক পরিণতি দান করা, বস্তুর কোনও একটা বিশেষ পরিচয়কে ভাষারূপে আকৃতি দান করা—ছোটোগল্পের এই সুকঠিন কলাকৃতি রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা সাহিত্যে দেখা দেয়নি। অথচ, ঘটনাবিরল, স্বল্পোত্তেজিত বাঙালির জীবনে উপন্যাসের উপাদান বিশেষ না থাকলেও ছোটোগল্পের উপাদান প্রচুর পরিমাণে ছিল তাতে সন্দেহের কারণ নেই। জীবনের যে বৈচিত্র্য, ঘটনার যে তরঙ্গপর্যায়, যে চঞ্চল রসসমৃদ্ধ জীবনলীলা উপন্যাসের প্রাণ, সমস্যার যে বিচিত্র জটিলতা উপন্যাসের ঘটনাস্রোতকে আবর্তে চঞ্চল ও ঘনীভূত করে তোলে, আমাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে তার প্রসার খুব বেশি ছিল না। যা ছিল, তার দিকেও বঙ্কিমচন্দ্রের দৃষ্টি ও হৃদয় বেশি আকৃষ্ট হয়নি; তাঁর সাহিত্য সৃষ্টিতে সেরূপ পরিচয়ও বড়ো নেই। সেইজন্যই বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসের উপাদান খুঁজেছেন আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের বাইরে। আমাদের জীবনের মন্দগতি ও ধীরপ্রবাহ তাঁর চিত্তে উপন্যাসের রোমান্স সঞ্চার করাতে পারেনি। কী পল্লিতে, কী নগরে আমাদের জীবনযাত্রা ছিল অত্যন্ত সরল ও সহজ। যদিও আজ তা নানা কারণে জটিল হতে জটিলতর হয়েছে। পারিবারিক আক্রোশ, সামাজিক দলাদলি যথেষ্টই ছিল। উইল চুরি নিয়ে, অন্যান্য দুই চারি রকমের জটিলতর সামাজিক অথবা পারিবারিক ব্যাপার নিয়ে, হয়তো দ্বন্দ্ব-আন্দোলন ইত্যাদিও হত। এসব উপাদান নিয়ে রবীন্দ্র-পূর্ব বাংলা সাহিত্যে গল্প উপন্যাস কম রচিত হয়নি। কিন্তু তার রকম ও বৈচিত্র্য খুব বেশি নেই। কিংবা খুব উৎকৃষ্ট সাহিত্যসৃষ্টিও তা নিয়ে হয়নি। দুই চারিটিমাত্র উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত আছে: যেমন, ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘স্বর্ণলতা’ প্রভৃতি। কিন্তু আমাদের জীবনের বাইরের এই সহজ ও সুলভগোচর দিকটি ছাড়া আর একটি গোপন নিভৃত দুর্লভগোচর দিক আছে। একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে, একটু সহানুভূতিপূর্ণ হৃদয় নিয়ে এই নিভৃত দিকটির দিকে তাকালে দেখা যায়, রাষ্ট্রে সমাজে ও পরিবারে আমাদের দৈনন্দিন জীবন অসংখ্য ক্ষুদ্র বিক্ষোভে আন্দোলিত, বিচিত্র দুঃখ-বেদনায় প্রপীড়িত, সুখে ও আনন্দে উদ্বেলিত। প্রতিদিনের কর্ম-কোলাহলে সহজে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় না, বৃহত্তর জগৎ ও জীবনের মুখরতার মধ্যে তার ক্ষীণ আহ্বান সহজেই বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু বৃহত্তর জগৎ বলতে আমাদের কিছু ছিল না, তার মুখরোতাও বাংলাদেশে বহুদিন পর্যন্ত শোনা যায়নি। আমাদের জীবন এক সময় অত্যন্ত সংকীর্ণ ও স্বল্পপরিসর ছিল, এখনও যে তা নয় এমন কথা বলা যায় না। কিন্তু সংকীর্ণ ও স্বল্পপরিসর ছিল বলেই জীবনে আমাদের কোনো আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল না, কোনও দুঃখ-বেদনাবোধ ছিল না এমন নয়। মানুষের মন ও হৃদয়ের যত কিছু বিচিত্র ভাব ও অনুভূতি, তা আমাদের অন্তরের মধ্যে নানা রূপে ও রসে চিত্রিত, বর্ণে ও গন্ধে আকুল হয়ে উঠত, কিন্তু তা প্রকাশের কোনো পথ ছিল না। তাই তার স্বরূপ ছিল অজ্ঞাত। জীবনের এই সব ক্ষুদ্র তুচ্ছ ঘটনা ও খণ্ডাংশ এবং তার তুচ্ছতর সুখদুঃখ নিয়ে সাহিত্যসৃষ্টির প্রয়াস রবীন্দ্রপূর্ব বাংলা সাহিত্যে বড়ো একটা দেখা যায় না। অথচ ক্ষুদ্র এবং তুচ্ছ বলেই, পরিসর এদের কম বলেই, এদের মধ্যে ছোটোগল্পের উপাদানও বেশি করেই ছিল।
রবীন্দ্রনাথই বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম আমাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের সংকীর্ণ ও অকিঞ্চিৎকর বহির্বিকাশের দিক হতে দৃষ্টি ফিরিয়া নিয়ে জীবনের তলদেশে যে নিভৃত ফল্গুধারাটি আছে তা আমাদের দেখিয়ে দিলেন। সেখানে ঘরের কোণে, নদীর ঘাটে, সহস্র তুচ্ছ পরিচিত স্থানে ও আবেষ্টনে কত সহস্র তুচ্ছ ঘটনা, খুঁটিনাটি উপলক্ষ্য করিয়া আমাদের জীবন অবিরত স্পন্দিত হয়েছে। কখনো কখনো তা আবার সুগভীর ভাবরসে বিধৃত হয়ে আছে। আমাদের বৈচিত্র্যবিহীন বাইরের জীবন সেখানে বৈচিত্র্যে ভরপুর, আবেগে চঞ্চল সেখানে তার কোনও দৈন্য নেই, অভাবও নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিচিত্তের অপূর্ব সুগভীর সহানুভূতি ও সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আমাদের জীবনের এই নিভৃত গোপন প্রবাহটি আবিষ্কার করে তাকে আপন ভাবে ও কল্পনায়, রূপে ও রসে আমাদের সম্মুখে ধরে দিলেন। বাংলা সাহিত্যে এক নতুন জগৎ ও জীবনের দ্বার যেন অকস্মাৎ খুলে গেল।
রবীন্দ্রনাথ কবি, তাঁর কবিপ্রতিভা একান্তভাবেই গীতিধর্মী প্রতিভা। সরস সাবলীল গীতিবহুল ছন্দের মধ্যে একটি অপূর্ব সুর ফুটিয়ে তোলা, একটি অনাহত ধ্বনি বাজিয়ে তোলাই গীতিকবিতার ধর্ম। স্বল্পের মধ্যেই তা উচ্ছ্বসিত, যদিও তার অধিকাংশই অব্যক্ত। খণ্ডের মধ্যেই তার পূর্ণতা, যদিও তার রেশটুকু অশেষ। একহিসাবে এটাই রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ ছোটোগল্পেরও ধর্ম। রবীন্দ্রনাথের লিরিক প্রতিভার সমৃদ্ধির তুলনা নেই ; সেই অতুলনীয় সমৃদ্ধি নিয়ে তিনি যখন আমাদের জীবনের দিকে তাকালেন, বাংলাদেশের সহজ অনাড়ম্বর জীবনপ্রবাহ যখন তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল, তখনই তাঁর গীতিপ্রবণ হৃদয় মানবজীবনের ছোটো ছোটো কথা গল্পাকারে বলবার তাগিদ অনুভব করল। রবীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ ছোটোগল্পই একান্তভাবে গীতিকবিতার ধর্ম লাভ করেছে; চিত্তের একটা বিশেষ ‘মুড’ বা ভাব হতেই তাঁর বেশির ভাগ গল্পগুলি অনুপ্রেরণা লাভ করেছে। এক কথায় এটাই বলা যায়, যে-মনোধম মনের যে-বিশেষদৃষ্টি রবীন্দ্রনাথের সৃজনীপ্রতিভাকে গীতিধর্মী করেছে, সেই মনোধর্ম, সেই দৃষ্টিভঙ্গিই তাঁকে গোড়ার দিকে তাঁর ছোটোগল্পের উৎসেরও সন্ধান দিয়েছে।
রবীন্দ্রপরবর্তী বাংলা ছোটোগল্প নানা পথে বিকশিত হয়েছে। কিন্তু অদ্যাবধি রবীন্দ্রনাথই এই ধারার শ্রেষ্ঠ লেখক। রবীন্দ্রনাথ বস্তুধর্মী চরিত্রবিশ্লেষণমূলক উপন্যাসাদি রচনায় ততটা তৃপ্তি পেতেন না, যতটা উৎসাহ বোধ করতেন গীতিরসপুষ্ট ছোটোগল্প রচনায়। এই নবীন সাহিত্যাঙ্গটি তিনি আপনার শিল্পী প্রবণতার বশে আবিষ্কার করেছেন।
Leave a comment