‘রুদ্র প্রকৃতির নিষ্ঠুরতা আর অস্তগামী আভিজাত্যের নৈরাজ্যে তারাশঙ্করের শিল্পী চেতনা প্রথম পর্যায়ে দ্বিমুখী। বাজে পোড়া তালগাছ কিংবা পত্রহীন কন্টকময় বাবলা গাছের মতো কতকগুলি মানুষ তার সহানুভূতি আকর্ষণ করেছে। আর একদিকে মৃত্যুযাত্রী অতীত তার সমতার অভিসেচন লাভ করেছে। জীবন এবং জগৎ সম্পর্কে তাঁর কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য ফুটে ওঠেনি। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে যে পরিচয় তাঁর ঘটেছিল—তার ফলে তার মনে একটা আদর্শ রূপ নিতে আরম্ভ করেছে।’ তারাশঙ্কর সম্পর্কে এমন মন্তব্য করেছেন—অধ্যাপক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়।

তবে তারাশঙ্করের শিল্পী মানসকে বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথমত, আদিম প্রকৃতিরূপের অন্বেষণ আর বিত্তহীন আভিজাত্যের নৈরাস্যময় ভগ্নচিত্র। দ্বিতীয়ত, রাজনীতির সংস্পর্শে স্বদেশী ভাবনা, ঐতিহ্য ও আদর্শের প্রতি আনুগত্য। তৃতীয়ত, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে মন্বন্তরের অবর্ণনীয় বীভৎসতায় উপন্যাস রচনার প্রেরণা অর্জন। চতুর্থত, রহস্যময় অধ্যাত্ম-চেতনায় উত্তরণ। নবীন ও প্রবীণের দ্বন্দ্ব। রাজনৈতিক সমস্যা আর জাস্তব জীবনের উন্মত্ত প্রবৃত্তির সব কিছু এখানে এক পরম সমাধানের আশ্রয়ে স্থিত ইত্যাদি। তাইতো সমালোচকের উপলব্ধিতে ধরা পড়েছে—হিউম্যানিজমের সঙ্গে আস্তিক্যবুদ্ধির মিশ্রণে তারাশঙ্করের ভাবলোেক সম্পূর্ণতা লাভ করেছে। বলাবাহুল্য এই ভাবলোকের অভিমানের মধ্যে আছে তাঁর মানুষের প্রতি আস্থা তথা আস্তিক্যবুদ্ধির পরিচয়।

তারাশঙ্করের সমগ্র গল্প-উপন্যাসগুলিকে সঠিক বিশ্লেষণে সমর্থ হলে কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। যেগুলির তাঁর মানসজাতি। যেমন—

তারাশঙ্করের সমাজভাবনা :

তারাশঙ্কর সমাজ সচেতন লেখক। রাজনীতি ও দেশসেবার মধ্য দিয়ে পল্লীগঠন ও উন্নয়নের চিন্তা ভাবনা তার অনেক উপন্যাসেই লক্ষিত হয়। তার প্রথম উপন্যাস চৈতালী ঘূর্ণিতে আছে মাটি ও মানুষের প্রতি মমতা এবং জমিদার ও ব্যবসায়ীর মধ্যে সংঘর্ষ চিত্র। এখানে জমিদারের অত্যাচারে কৃষক গ্রাম ত্যাগ করে শহরে এসে এক কারখানার শ্রমিকে রূপান্তরিত হয়। অনেক দুঃখ ভোগের পর সে মৃত্যুবরণ করে। অর্থাৎ “চৈতালীর ক্ষীণ ঘূর্ণি অগ্রদূত কালবৈশাখীর।” তাঁর ধাত্রী দেবতা কালিন্দী ‘গণদেবতা’, ‘পঞ্চগ্রামে’ সমাজ রূপাস্তরের সুস্পষ্ট ভাবনা লক্ষিত হয়। ধাত্রী দেবতায় আছে জমিদাব সস্তান শিবনাথের বিপ্লবীমন্ত্রে দীক্ষিত হওয়া গণদেবতায় ফুটে উঠেছে—সমাজ ভাঙনের চিত্র। পঞ্চগ্রামে অনুরণিত হয়েছে আইন অমান্য আন্দোলন। কালিন্দীতে জমিদার সস্তান অহীন্দ্র মার্কসীয় ভাবধারায় অনুপ্রাণিত। তবে তারা শঙ্কর কখনই মার্কসবাদে আচ্ছন্ন হননি।

তারাশঙ্করের লোকায়ত ভাবনা :

তারাশঙ্করের কতকগুলি উপন্যাসে লোকায়ত ভাবনা সুস্পষ্ট। বলাবাহুল্য, এই উপন্যাসগুলি প্রকৃতিতে আঞ্চলিক। রাঢ় অঞ্চলের বন্য প্রকৃতি আর জীবনোল্লাসের মধ্যে মূর্ত। এই পর্যায়ে আছে—‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’ ও ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী”। প্রথমটি কাহার সমাজের কাহিনী। মাতবুর বনওয়ারীর নেতৃত্বে কালারুদ্র আর বাবা ঠাকুরকে অবলম্বন করে ছিল বাঁশবাদী গ্রামের কাহারদের সংস্কারাচ্ছন্ন জীবনযাপন। চন্দনপুরের রেলশ্রমিক কারালীর প্ররোচনায় আর বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে সেই পুরনো বিশ্বাস ও সংস্কারের প্রাচীর ভেঙে পড়লো। বনডয়ারীর মৃত্যুর পর হাসুলী বাঁকে করালী ফিরেছে। সবল হাতে গাইতি চালাচ্ছে, আর মাটি খুঁড়ছে। উপকথার কোপাইকে ইতিহাসের গঙ্গায় মিশিয়ে দেবার পথ কাটছে জন্মনিল নতুন হাঁসুলী বাঁক। পরবর্তী ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী রাঢ়ের হিজল বিল অঞ্চলের বিষবেদে দলের দুঃখ আনন্দ, দ্বন্দ্ব সংঘাত জনিত উপন্যাস। লেখকের বর্ণনায় উপন্যাসের শেষে আছে লোকায়ত ঢঙে পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণের চেষ্টা : “সাঁওতালীর কথা শেষ, নাগিনী কন্যার কাহিনী শেষ—যে শুনিবা সে যেন দু ফোটা চোখের জল ফেলিও।”

তারাশঙ্করের প্রেম পরিবার ও দার্শনিকতা:

লেখকের বহু উপন্যাসে প্রেম ও পারিবারিক জীবনের সুখ দুঃখের বিচিত্র কাহিনী উপস্থিত। এখানে কোথাও দেখা যায় অন্ত্যজ কবিয়ালের সঙ্গে ঝুমুর গানের নর্তকীর হৃদয় বিনিময়ের কাহিনী। যেমন—’কবি’ উপন্যাসের নিতাই। ‘সপ্তপদীতে’ আছে প্রেম ও সত্য সন্ধানের মধ্যে সমন্বয়। লেখকের মৃত্যু দর্শনের এক আশ্চর্য পরিচয় ‘আরোগ্য নিকেতন’ উপন্যাস। অনেকের মতে এটি তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। উপন্যাসটির কাহিনী কবিরাজ জীবনমশায় বা জীবন দত্তের স্মৃতি চারণা সূত্রে আবর্তিত। সমালোচকের উপলব্ধিতেঃ “সমগ্র উপন্যাসখানি তারাশঙ্করের মৃত্যু দর্শনের এক আশ্চর্য দলিল।” মূলত তারাশঙ্করের অধিকাংশ গল্পের পটভূমি তাঁর সংগ্রাম দক্ষিণ পূর্ব বীরভূম এবং তার চারপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভূমিলগ্ন তাঁর গল্পের কাহিনীপট। চরিত্রদের ভূমিকা এই ভূমিতেই বেহিসেবী বেপরোয়া স্বচ্ছন্দে তাদের চলা। গাঙ্গেয় অববাহিকার নাব্য পলিমাটী নয়, অজয় ও ময়ূরাক্ষীর তীর ঘেঁষা রাঢ়ে রাঙা অথচ কাঁকর জাগা কঠিন মাটি আর সেই সঙ্গে যুগ-যুগান্ত কাল ধরে তন্ত্র সাধনা এবং আশ্চর্য জীবন সংস্কৃতির বহুমিশ্র পঞ্চশস্যে সমৃদ্ধ তার উপন্যাস ও গল্পের আবহ রচিত। আর ‘কল্লোল’ গোষ্ঠীর মতো জীবনদৃষ্টিতে অবিশ্বাস ও দ্বিধা নয়—মানব স্বভাব সম্বন্ধে অচঞ্চল প্রত্যয় অভিজ্ঞতার ছায়া ছায়া কাহিনী নয়। জনমনে বারোয়ারী তলা থেকেই চিন্তার সম্পদ কুড়িয়ে নিয়েছেন তারাশঙ্কর। সেখানে মননে শহুরে আভিজাত্য হয়তো নেই, কিন্তু নেই কল্পদৃষ্টির অভাব। বাস্তব অভিজ্ঞতার পাশাপাশি তার কল্পনা কর্ণের রথের মতোই মাটি হয়ে চলতে শেখেনি। জৈব পশু সত্তার অন্তরালে দুঃখ ত্যাগ ও অশ্রুবেদনায় পরিশুদ্ধ মানবচেতনা তার সেই পথ চলতি দৃষ্টির সম্মুখে স্বাভাবিকভাবেই উদ্ভাসিত হয়েছে।

তারাশঙ্করের বিশালতা :

তারাশঙ্করের উপন্যাসের তুলনায় তার বহুগল্পের চরিত্রের মধ্যে ধরা পড়েছে, এই বিশালতা, তারা দেহে ও মনে বিশাল। যেমন—জলসাগর, তারিণী মাঝি, পৌষ লক্ষ্মী ইত্যাদি। বলাবাহুল্য শরীরের বিশিষ্ট আকৃতির সঙ্গে বাড়তি জীবনশক্তির সংযোগে ভাগ্যের বিরুদ্ধে, শত্রুর বিপক্ষে তাদের সংগ্রাম হয়েছে তীব্রতর। তাই দেখা যায় রায় বংশের জমিদারী ঐশ্বর্য নিঃশ্বেষিত শেষ উত্তর পুরুষ বিশ্বম্ভর রায়ের দীপ্র যৌবন এবং অতীতের স্মৃতি তারকারাজির মতো বুকের আকাশে রায়বংশের মর্যাদার ভাস্কর প্রভায়” তিনি প্রতিবেশী প্রজাদের চোখে এখনও জাজ্জ্বল্যমান। এই যদি হয় বিগত বিত্ত জমিদারের তৈলচিত্র, তবে মনে হয় গল্পকার দেখে শুনে মেপে যেন কুঁদে তৈরী করে তুলেছেন তারিণী মাঝি, চাষী রংলাল, মুকুন্দ পাল, শম্ভু বাজীকর, কেষ্টো বেদের মত মানুষদের পেটানো শরীর এবং প্রবৃত্তি তাড়িত চিত্তকে। এছাড়া চাষী জীবনের একটি অন্তরঙ্গ পরিচয় তারাশঙ্কর তার বিভিন্ন গল্প উপন্যাসের পটভূমি রূপে গ্রহণ করেছেন, মূলত ‘কালাপাহাড়’ পোষ লক্ষ্মী এই অভিধায় বিভূষিত।

তারাশঙ্করের অন্যান্য উপন্যাস:

উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি ছাড়াও যে উপন্যাসগুলি বিভিন্ন ভাবধারায় পরিপুষ্টতা লাভ করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম পাষাণ পুরী, নীলকণ্ঠ, রাইকমল, প্রেম ও প্রয়োজন, আগুন, মন্বন্তর, ঝড় ও ঝরাপাতা, অভিমান, তামস তপস্যা, উত্তরায়ণ, পদচিহ্ন, চাপাগঙ্গার বৌ, স্বর্গমর্ত্য, নবদিগন্ত ইত্যাদি। অর্থাৎ লেখকের চৈতলী ঘূর্ণি (১৯২৮) পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে প্রায় ১৯৭৬ পর্যন্ত তার একটানা লিখে যাওয়ার ইতিহাস। কাজেই তাঁর গল্প উপন্যাসের গ্রন্থ সংখ্যা বিপুলাকারে আত্মপ্রকাশ করে।

সর্বোপরি, বলতে হয় তারাশঙ্করের অধিকাংশ গল্প উপন্যাসের পটভূমি দক্ষিণ-পূর্ব বীরভূমের বিস্তীর্ণ অঞ্চল কাজেই এখানে অভিজাত ক্ষয়িষ্ণু তবু দর্পিত পরিবার আছে, আছে তার পাশে অপজাত জনজীবন—ডোম, বাউরী, বীরবংশী, সাঁওতাল, সাপুড়ে, বেদে শ্রেণীর মানুষ, বর্হিবিশ্বের প্রতিক্রিয়া ও পালাবদলে যাদের জীবন সংগ্রামে, সংস্কারে ও বিশ্বাসের ধারা বদল কিছুই প্রায় হয় না। হাজার হাজার বছর আগেকার সেই আদিম মানুষের উত্তরসূরী রূপে বেঁচে থাকার সহজ আকাঙ্ক্ষার প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে শুরু করে কবির লড়াই দেখা যায় মাঠের সঙ্গে মুঠির, শস্যের সঙ্গে মানব শিশুর সংযোগ। তাই পল্লী জীবনাশ্রয়ী আঞ্চলিক চেতনা পুষ্ট বাস্তব অথচ বিচিত্রাস্বাদী এক রসসাহিত্য নিয়ে বাংলা কথা সাহিত্যের আসরে তাদের আগমন। তারাশঙ্কর তারই শ্রেষ্ঠ রূপকার।