ভূমিকা: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৩৮-১৮৯৪] বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক শিল্পী। বাংলা উপন্যাসের শিল্পীত রূপায়ণ প্রথম সংঘটিত হয় সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমের মননশীল লেখনীর মাধ্যমে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের যুগে বাংলা সাহিত্যে প্রবেশ করেন স্বশিক্ষিত বঙ্কিমচন্দ্র। এর ফলে তাঁর শিল্প চৈতন্য এবং ব্যক্তি চৈতন্যের মধ্যে কাজ করেছে দুটি বিপরীতমুখী দ্বন্দ্ব। প্রথমত, প্রগতিশীল সত্তা অর্জিত হয়েছে পাশ্চাত্য শিক্ষা এবং সভ্যতা থেকে। দ্বিতীয়ত, রক্ষণশীল সত্তা বহন করেছেন পারিবারিক ও সনাতন ঐতিহ্য প্রীতির কারণে। উপন্যাসের প্রাথমিক প্রচেষ্টায় বিচিত্র পরীক্ষা- নিরীক্ষা কালাতিক্রমের পর বাংলা সাহিত্যে প্রথম সার্থক উপন্যাস রচনায় কৃতিত্ব বঙ্কিমচন্দ্রের। তাঁর রচিত উপন্যাসের বিষয় বিন্যাস, যুক্তি প্রয়োগ, রসসৃষ্টি, ভাষা ও সংলাপ ব্যবহার, প্রকৃতি চেতনা, মানবচরিত্র বিশ্লেষণ ইত্যাদি দিক থেকে বাংলা উপন্যাসের ধারায় নব প্রেরণা সৃষ্টি করেছে। তাঁর উপন্যাসে প্রাধান্য পেয়েছে, সমকালীন মধ্যবিত্ত হিন্দুসমাজের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, জীবনাচরণ, ধর্ম ও নৈতিকতাবোধ।
বঙ্কিমচন্দ্র-বাংলাভাষার প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিক: বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল তাঁর ছাত্রজীবনেই ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকরে’ কলেজীয় কবিতাযুদ্ধে কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি ইংরেজি ভাষায় লিখলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস Rajmohan’s Wife [১৮৩৫] এবং তারপরই ফিরে এলেন স্বধারায় বাংলা উপন্যাস রচনায়। বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলাভাষার প্রথম যথার্থ উপন্যাসক এবং বলা চলে, এখনো পর্যন্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক। তিনি শুধু উপন্যাসের আদি স্রষ্টাই নন, বাংলাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমালোচক অধ্যাপক ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায়,
“বঙ্কিমের হাতে বাংলা উপন্যাস পূর্ণ যৌবনের শক্তি ও সৌন্দর্য লাভ করিয়াছে।… তাঁহার সবকয়টি উপন্যাসের মধ্যেই একটা সতেজ ও সমৃদ্ধভাব খেলিয়া যাইতেছে, জীবনের গভীর রহস্য ও বিকাশগুলো ফুটিয়া উঠিয়াছে এবং জীবনের মর্মস্থলে যে বিমূঢ় রহস্য আছে, তাহার উপর আলোকপাত করা হইয়াছে। তিনি জীবনকে বিচিত্র রসে পূর্ণ ও কল্পনার ইন্দ্রজালে বেষ্টন করিয়াছেন বটে কিন্তু সত্যের সূর্যালোকের পথ অবরুদ্ধ করেন নাই ইহাই তাঁহার চরম কৃতিত্ব।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত মোট উপন্যাসের সংখ্যা ১৪। বিষয় অনুযায়ী উপন্যাসগুলোকে নানাজনে নানাভাবে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত করে থাকেন। সর্বাধিক যুক্তিসম্মত শ্রেণিবিভাগ নিম্নোক্ত রূপ হতে পারে: ক. ঐতিহাসিক ও রোমান্সধর্মী উপন্যাস: ১. দুর্গেশনন্দিনী [১৮৬৫), ২. কপালকুণ্ডলা [১৮৬৬], ৩. মৃণালিনী [১৮৬৯), যুগলাঙ্গুরীয় [১৮৭৪), ৫. চন্দ্রশেখর [১৮৭৫), ৬. রাজসিংহ (১৮৮৪), ৭. সীতারাম [১৮৭৭]; খ. সামাজিক ও গার্হস্থ্যধর্মী উপন্যাস: ৮. বিষবৃক্ষ (১৮৭৩), ৯. রজনী [১৮৭৭), ১০. কৃষ্ণকান্তের উইল (১৮৭৮]; গ. দেশাত্মবোধক উপন্যাস: ১১. আনন্দমঠ [১৮৮২), ১২. দেবী চৌধুরাণী [১৮৮৪]; ঘ. উপন্যাসিকা:-১৩. ইন্দিরা [১৮৭৩] এবং ১৪, রাধারাণী [১৮৭০]।
‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫): ইতিহাস রোম্যান্সের মৌলিক উপাদান। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসের কাহিনি লোকমুখে প্রচলিত গল্প থেকে গ্রহণ করেছেন। আবার বিভিন্ন ইতিহাসবিদের কাছ থেকেও তথ্য গ্রহণ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রথম উপন্যাসে অপরিণতির চিহ্ন রাখলেও ইতিহাস ও কল্পনার আনুপাতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য এই নয় যে, ইতিহাস বর্ণনা করবেন। তিনি শিল্প প্রতিভা নিয়ে সাহিত্য রচনা করার উপাদান হিসেবে ইতিহাস গ্রহণ করেছেন। উপন্যাসে দুর্গস্বামীর আকস্মিক পরিণতি দেখালেও আদর্শ পর্যবসিত হতে দেননি। চরিত্রগুলো দুই-একটি রেখার দ্বারা জীবন্ত হয়ে উঠেছে। জগৎসিংহ, তিলোত্তমা ও আয়েষা প্রভৃতি চরিত্র এমনভাবে তৈরি করেছেন যেন ইতিহাসও আছে, বাস্তবতার সীমাও লঙ্ঘন করেনি।
‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬): বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর রোমান্সধর্মী উপন্যাসের অন্যতম উৎস দৈবশক্তির লীলা। এর প্রথম সার্থক অভিব্যক্তি পাওয়া যায় ‘কপালকুণ্ডলায়’। কপালকুণ্ডলা প্রকৃতি পালিতা। কাপালিক কালিকা ভক্তি তার চরিত্রে গভীর ছাপ আছে। তান্ত্রিক ধর্ম সাধনা, কালিকানুরাগ ও আরণ্যভাগ কপালকুণ্ডলা চরিত্রে যে রহস্যময়তা জটিল অসাধারণ মানসিকতার জন্ম দিয়েছে তার মধ্যেই রয়েছে রোমান্সের প্রকৃত রস। তাই নবকুমারের সীমাহীন প্রণয়ে বিতৃষ্ণা, ব্যবহারিক জীবনে লোভহীনতা, সন্ন্যাসিনী মনোভাব সর্বোপরি ক্যালকার নির্দেশে আত্মবির্সজন।
সাগরতীরবাসিনী, কাপালিকা-প্রতিপালিতা, চিরসন্ন্যাসিনী কপালকুণ্ডলার মূর্তি কল্পনায় বঙ্কিম যে অসামান্য প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন, তা একজন বাঙালি ঔপন্যাসিকের পক্ষে বাস্তবিকই বিস্ময়কর। আর এই বিস্ময়কর কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন বঙ্কিম। ইতিহাস আছে, আছে ইতিহাসের চরিত্র। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাস্তব জীবনের ঘটনা ও রহস্যময় বনের নানা দৃশ্য। গ্রিক ট্র্যাজেডির মতো সামান্য বর্ণনায় পরিণতি বলে দিলেন। কল্পনা শক্তি ছিল বলেই বাস্তব ইতিহাস রহস্যময় পরিবেশ শিল্পমান লাভ করেছে। যার পরিণতি রোমান্সের সার্থক উদাহরণ।
‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯): এ উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মুসলমান সতেরো জন অশ্বারোহী দ্বারা যে রাজত্বের অবসান হয় তাকে ইতিহাসের কলংকজনক অধ্যায় বলে মনে করেছেন এবং তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য ‘মৃণালিনী’ উপন্যাস রচনা করেছেন। জগৎসিংহ-তিলোত্তমার প্রেম অপেক্ষা হেমচন্দ্র মৃণালিনীর প্রেম আরো একটি জটিলতর বাস্তবতার আরো একটু গভীরতর তল স্পর্শ করেছে। তিলোত্তমা অপেক্ষা মৃণালিনী অনেক বেশি উজ্জ্বল। শান্ত ক্ষমাশীল আদর্শে অধিকতর বাস্তব।
‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৯৭৪): উপন্যাসটি আধুনিক ছোটোগল্পের আদলে রচিত উপন্যাস। এতে ঘটনা বিন্যাসে বিস্ততি নেই, আবার চরিত্র চিত্রনও আকর্ষণীয় নয়। ঐতিহাসিক উপন্যাস মনে করারও কোনো কারণ নেই। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক সময় অপ্রত্যাশিত অনেক ঘটনার আবির্ভাব হয়, আর সেই অপ্রত্যাশিত ঘটনা নিয়ে রচিত ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ উপন্যাস। শিল্প প্রতিভা ছিল বলেই সুদূর অতীতের কাহিনি বর্তমানে জীবন্ত করে তুলতে পেরেছেন। অসাধারণত্ব আছে কিন্তু তা পাত্র-পাত্রীর স্বাভাবিক ও আধুনিক মনোভাব সব অসামাজিক ও অসাধারণত্বকে দূর করে দিয়েছে।
‘রাধারাণী’ (১৯৭৫): ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ উপন্যাসের মতো আধুনিক ছোটো গল্পের আদলে রচিত ‘রাধারাণী’ উপন্যাস। এ উপন্যাসের ঘটনাকাল আধুনিক হলেও সন্দেহ ও অবিশ্বাসের মাত্রা অনেক বেশি। রাধারাণীর প্রেম আধুনিক। তাছাড়া ছেলেমানুষী ঘটনার মধ্য দিয়েও মধুর ও গভীর রস সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছে।
‘চন্দ্রশেখর’ (১৮৭৫): বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর শ্রেষ্ঠ উপন্যাসসমূহের মধ্যে অন্যতম ‘চন্দ্রশেখর’। এ উপন্যাসে ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের পারিবারিক জীবনের রাজনৈতিক জগতের সম্মিলন হয়েছে। ইংরেজদের সাথে মীর কাসিমের বিরোধ এ উপন্যাসের ঐতিহাসিক পটভূমি। তাছাড়া ইংরেজ বণিকগণ অর্থ উপার্জনের মোহে মুগ্ধ হয়ে সাম্রাজ্য স্থাপন অপেক্ষা প্রজা শোষণের দিকে বেশি মনোযোগী ছিল।
‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের রোমান্স মূলত অরাজক পরিবেশের প্রভাব আমাদের পারিবারিক জীবনে কতটা পঙ্কিল করে তার উদাহরণ শৈবালিনী। মনস্তত্ত্বমূলক রোমান্সও এ উপন্যাসে উপস্থিত। গার্হস্থ্য জীবনের উপর রাজনীতির প্রভাব সুন্দরভাবে দেখানো হয়েছে। শৈবালিনী একেবারে আমাদের বাস্তব জীবনের পরিচিত দৃশ্য। অবশেষে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রোমান্সের বর্ণোচ্ছ্বাস গাঢ়তর করে অপরিচিত পরিবেশকে রপ্ত করে দিয়েছেন এবং কবিত্বময় উপস্থাপন আমাদের মুগ্ধ করেছে।
‘রাজসিংহ’ (১৮৮২): রাজসিংহ উপন্যাসে ইতিহাস আছে কিন্তু কল্পনার সংমিশ্রণ হয়ে কাল্পনিকের সংমিশ্রণ হয়েছে। আর এমতামত আমাদের দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। এ উপন্যাসের রোম্যান্স অপেক্ষা ঐতিহাসিকতা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২): ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে কল্পনা বিন্যাস বাস্তবতাকে একেবারে মুছে ফেলেছে। রাজনৈতিক বিশৃংখলা ও অরাজকতার পথ ধরে আমাদের সাধারণ জীবনের উপর রোমান্সের অলৌকিকত্ব এসে পড়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে দুটি ঐতিহাসিক আন্দোলনের সৃষ্টি করেছে তা পাঠকের পক্ষে অভাবনীয় ছিল। আনন্দমঠের সত্যানন্দ এমন এক বিরাট আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে। সত্যানন্দের যে দেশশক্তি ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি তা সে যুগে কোনো বাঙালির পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফলে বাস্তবতার অনুপস্থিত সহজেই লক্ষযোগ্য।
আমাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে আনন্দমঠের আখ্যান-বস্তুর কোনো বাস্তব যোগ নেই। চরিত্র অঙ্কনেও বঙ্কিম সম্পূর্ণ বাস্তববাদী হতে পারেননি। ‘আনন্দমঠে’র এক পদ বাস্তব পদে ও অপর পদ আদর্শলোকে স্থাপিত হয়েছে। বাস্তব ও রোমান্স এই উভয়রূপ উপাদানের সংমিশ্রণে তা গঠিত। অবাস্তবতার পাশাপাশি বাস্তব স্তরও এ উপন্যাসে আছে।
‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৪): আনন্দমঠ উপন্যাসের দুই বছর পর প্রকাশিত হয়েছে দেবী চৌধুরানী উপন্যাস। এ উপন্যাসেও রাজনৈতিক বিশৃংখলা আছে, আছে অরাজকতা। আমাদের সাধারণ জীবনকে রোমান্সের অলৌকিকত্ব দ্বারা ঢেকে রেখেছে। ভবানীর দুরদৃষ্টি বাঙালির পক্ষে ভাবা কঠিন। দেবী চৌধুরানী উপন্যাসে অসাধারণত্ব আছে কিন্তু বাস্তবতার প্রাধান্যই বেশি। এতে অলৌকিক উপাদান যাও আছে, তা আমাদের বাস্তব জীবনের সঙ্গে সহজের মিলোনো যায়। ভবানী পাঠক, সত্যানন্দের মতো অতিমানব মহাপুরুষের স্তরে উন্নীত হয়নি।
‘সীতারাম’ (১৮৮৭): বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর শিল্প প্রতিভার উজ্জ্বল নিদর্শন ‘সীতারাম’ উপন্যাস। এ উপন্যাসে রোমান্স, বাস্তবতা, ধর্মতত্ত্ব সবমিলে এক বৃহৎ পরিধি নিয়ে আলোচনা করেছেন। রোমান্স আছে তবে তা অত্যন্ত সূক্ষ্ম রূপে। বাস্তবতার পরিচয় আমরা পাই কিন্তু মাঝে মাঝে এমন কিছু দৃশ্য তৈরি করেছেন যা পাঠ করে অভিভূত হই।
কারণ আমাদের কল্পনাকে বিস্মিত করে।
বঙ্কিমের উপন্যাসের আর একটা বড়ো দিক হলো উপকাহিনি। তার অধিকাংশ রচনায় লক্ষ করা যায় মূল কাহিনির পাশে শক্তিশালী উপকাহিনি। উপন্যাসের প্লট তৈরির ব্যাপারে তিনি প্রায়ই পিরামিডের মতো আকৃতি গড়ে তুলেছেন। তার গল্পের জীবন সমস্যা ঘটনা চরিত্রের দুই পায়ে সমান তাল রেখে চলতে চায় অর্থাৎ ভিতরের মন আর বাইরের ঘটনা ঘনিষ্ঠ ও সাপেক্ষা হয়ে উঠে। লেখকের একটি সুনির্দিষ্ট কেন্দ্রীয় অভিপ্রায় থাকে এবং প্রায়ই তা দ্বন্দ্বমূল। সংঘাত ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, ব্যক্তি চিত্তের ভিতরে নিজের সাথে মানুষে ও ভাগ্যে এবং সংঘাত ঘটনায় ঘটনা চরিত্রে অচ্ছেদ্য ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, চরিত্রকে সর্বদাই নিয়ন্ত্রণ করে বা করতে চায়।
বঙ্কিমের উপন্যাসের ভাষার কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় উপন্যাসে ভাষার আবশ্যকীয়তা। জনৈক সমালোচক বলেন, “No doubt each great man creates his own form but no novelist has yet creates one.” একথা স্বীকার করতেই হবে যে, উপন্যাসের আকার, গঠন নৈপুণ্য চরিত্র এ কয়টি ছেড়ে দিলেও উপন্যাসের শ্রেষ্ঠত্ব বিচারে এর ভাষাই সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাসে ভাষাকে চিৎশক্তি বলে গ্রহণ করেছিলেন। কারণ একমাত্র সহজ ও সাবলীল ভাষার গুণেই গ্রন্থকার পাঠকের কল্পনা শক্তিকে উদ্বুদ্ধ করতে পারতেন।
আলঙ্কারিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বঙ্কিমের ভাষা প্রাঞ্জল। যেমন- “যাহাকে ভালোবাস তাহাকে নয়নের আড় করিও না। যদি প্রেমবন্ধন দৃঢ় রাখিবে। তবে সূতো ছোট করিও। বঞ্চিতকে চোখে চোখে রাখিও, অদর্শনে কত বিষময় ফল ফলে।” এছাড়া সংস্কৃতানুগ অর্থাৎ তৎসম শব্দবহুল দীর্ঘ ক্রিয়া ও সর্বনাম পদ আধিক্যতাও বঙ্কিমের ভাষার বৈশিষ্ট্য। কোথাও তিনি কৌতুক রসাত্মক (কমলাকান্তের দপ্তর) আবার কোথাও চিত্রাত্মক। যেমন- “সেই গম্ভীরনাদি বারিধিতীরে, সৈকতভূমে অস্পষ্ট সন্ধ্যালোকে দাঁড়াইয়া অপূর্ব নারী মূর্তি।” কপালকুণ্ডলার রূপ বর্ণনার এ অংশে বঙ্কিমচন্দ্র চিত্রের পর চিত্র সাজিয়ে দেন।
সাধুরীতির বর্ণনাত্মক ভাষা বৈশিষ্ট্যও বঙ্কিমের ছিল। তিনি তাঁর সব উপন্যাস সাধুভাষার রচনা করেছেন। যেমন- “বর্ষাকাল। রাত্রি জ্যোৎস্না। জ্যোৎস্না এখন বড় উজ্জ্বল নয়, বড় মধুর একটু অন্ধকার মাখা পৃথিবীর স্বপ্নময় আবরণের মতো।”
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে বাংলা উপন্যাস পূর্ণ যৌবনের শক্তি ও সৌন্দর্য লাভ করেছে। তাঁর সকল উপন্যাসেই জীবনের গভীর রস ও বিকাশগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন এবং জীবনের মর্মস্থলে যে নিগূঢ় রহস্য আছে, তা উদঘাটন করেছেন। আধুনিক উপন্যাসে যে বাস্তবতার কথা আমরা পাই তা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর উপন্যাসে নেই কিন্তু তথ্যের ফাঁকগুলো তিনি কল্পনা দিয়ে পূরণ করেছেন। তিনি জীবনকে বিভিন্ন রূপ ও রস দিয়ে বেষ্টন না করে সত্যকে প্রকাশ করেছেন। রোমান্স উপন্যাসের সকল গুণ অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তাঁর উপন্যাসে সন্নিবেশিত হয়েছে বলেই কালোত্তীর্ণ হয়েছে। পাশ্চাত্য উপন্যাস ও রোমান্সের প্রভাবে সর্বপ্রথম নানা ধরনের বাংলা উপন্যাসের সার্থক নির্মাণ বঙ্কিমচন্দ্রের অপরিসীম কৃতিত্বের পরিচায়ক। তিনি শুধু বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ঔপন্যাসিকই নন, সর্বশ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিকও বটে। তার উপন্যাসে পূর্ণ কাহিনি আছে, আছে ঘটনার সংঘাত, চরিত্র সৃষ্টির অপরূপ মাধুর্য, ইতিহাসের সাথে কল্পনার সুসংগত সংমিশ্রণ, সর্বোপরি আছে মানব মনের গোপন রহস্যের সন্ধান।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।
Leave a comment