বাংলা উপন্যাস লেখার সূচনা ঘটে উনিশ শতকে। বাংলা সাহিত্যে এ উপন্যাসের ধারা ও ক্রমবিকাশ বড়ো বিচিত্র। নব নব সভ্যতার আলোকে মানুষের চলমান জীবন যেমন গতি পাল্টায়, বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারাও তেমনি তার মত পরিবর্তন করে বিভিন্নমুখী হয়ে প্রবাহিত হয়েছে। বিদেশি, বিভাষী, বিজাতি, বিধর্মী ইংরেজ শাসনামলে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা গদ্যের সূচনালগ্নে বিভিন্ন সাময়িক পত্রপত্রিকায় বাঙালি সমাজের ব্যঙ্গ বিদ্রূপের যে চিত্র প্রতিফলিত হতো তা হতে উপন্যাসের বীজ উপ্ত হয় এবং উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এ বীজ অঙ্কুরিত হয়।

টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত হয় প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল’ নামের কাহিনিগ্রন্থ। আধুনিক উপন্যাসের বেশ কিছু লক্ষণ, যেমন- জীবনযাপনের বাস্তবতা, ব্যক্তিচরিত্রের বিকাশ এবং মানবিক কাহিনি ইত্যাদি এ উপন্যাসে ফুটে উঠেছে এবং একই সঙ্গে কিছু সীমাবদ্ধতাও সুস্পষ্টভাবে দৃষ্টিগোচর হয়। এখানে উল্লেখ্য যে- উনিশ শতকের প্রথম ষাট বছরে এ দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণি তথা উপন্যাসপাঠের উপযোগী জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। এই পরিস্থিতি একজন সার্থক ঔপন্যাসিকের আগমনকে ক্রমশ অনিবার্য করে তোলে। বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক উপন্যাস লেখেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ [১৮৬৫]। কাহিনি-বিন্যাস এবং চরিত্রচিত্রণসহ উপন্যাস রচনার শৈল্পিক কৌশল সম্পর্কে সচেতন হয়ে তিনিই প্রথম জীবনের গভীর দর্শন-পরিশ্রুত ব্যক্তি-মানুষের কাহিনি উপস্থাপন করেন।

বঙ্কিমচন্দ্র বিবিধ বিষয় নিয়ে মোট চৌদ্দখানা উপন্যাস রচনা করেছেন। বাংলা উপন্যাস তাঁর হাতে এসেই বিচিত্র বিষয়, ভাব ও কাঠামো লাভ করলো এবং তাঁর প্রতিভার ঔজ্জ্বল্যে উপন্যাসে সত্যিকারের প্রাণ সঞ্চারিত হলো। বিষয়বস্তুর প্রকৃতি অনুসারে বঙ্কিমের উপন্যাসগুলোকে চার শ্রেণিতে ভাগ করা যায়:

ক. রোমান্স প্রধান ঐতিহাসিক উপন্যাস: ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯), ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ [১৮৭৪] ‘চন্দ্রশেখর’ [১৮৭৫], ‘রাধারানী’ (১৮৭৫];

খ. খাঁটি ঐতিহাসিক উপন্যাস: ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২];

গ. তত্ত্বপ্রধান ও দেশপ্রেমমূলক উপন্যাস: ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২], ‘দেবী চৌধুরানী’ [১৮৮৪], ‘সীতারাম’ (১৮৮৭];

ঘ. সামাজিক ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব সংঘাতমূলক উপন্যাস: ‘ইন্দিরা’ (১৮৭৩), ‘বিষবৃক্ষ’ [১৮৭৩], ‘রজনী’ (১৮৭৭), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ [১৮৭৮।।

দুর্গেশনন্দিনী: ‘দুর্গেশনন্দিনী’ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস, এ উপন্যাসের বিষয়বস্তু ইতিহাসের পটভূমিকায় স্থাপিত।

কপালকুণ্ডলা : কপালকুণ্ডলা বঙ্কিমের একেবারে পরিণত অনবদ্য সৃষ্টি। এ ধরনের ট্র্যাজেডিমূলক ও জীবন সমস্যাসূচক রোমান্স, শুধু বাংলায় কেন, বিশ্ব সাহিত্যেও বিরল। নির্জন সমুদ্রতীর, কাপালিক প্রতিপালিতা চির সন্ন্যাসিনী কপালকুণ্ডলার মূর্তি পরিকল্পনায় বঙ্কিম যে অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন তা একজন বাঙালি ঔপন্যাসিকের পক্ষে সত্যিই বিস্ময়কর।

মৃণালিনী: মৃণালিনীতে বঙ্কিম মুসলমান কর্তৃক বঙ্গ বিজয়ের সুপরিচিত কাহিনিটি বিধৃত করেছেন।

রাজসিংহ: রাজসিংহকে বঙ্কিম তাঁর একমাত্র ঐতিহাসিক উপন্যাস বলে দাবি করেছেন। এ উপন্যাসের কাহিনি ও চরিত্র প্রায় সবই ঐতিহাসিক এবং ইতিহাস এখানে শুধু পটভূমিতে নেই, একেবারে কেন্দ্রস্থ হয়ে আছে। রূপনগরের রাজকন্যা চঞ্চল কুমারীকে কেন্দ্র করে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ও মেবারের রানা রাজসিংহের মধ্যে সংঘাতই এ উপন্যাস কাহিনির ভিত্তি।

‘আনন্দমঠ’, দেবী চৌধুরানী’, ‘সীতারাম’ : বঙ্কিম এ ত্রয়ী উপন্যাসে দেশাত্মবোধ, স্বজাতিবোধ এবং গীতায় উক্ত নিষ্কাম ধর্মমতের প্রচারক।

রজনী: একটি অন্ধ বালিকার অদ্ভুত রূপশক্তি ও মনস্তাত্ত্বিক কৌতূহল উপন্যাসখানির প্রধান বিষয়বস্তু।

ইন্দিরা, রাধারানী ও যুগলাঙ্গুরীয়: এ উপন্যাসগুলো বঙ্কিমের সংক্ষিপ্ত আকারের উপন্যাস।

বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের পর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১] সার্থক শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। আধুনিক চিন্তা-চেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে তিনি সামাজিক, পারিবারিক, মনস্তাত্ত্বিক ও ব্যক্তিজীবনের সংকটমুখ্য কাহিনি রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের রচিত উপন্যাসের সংখ্যা মোট ১২টি। আলোচনার সুবিধার জন্য রবীন্দ্রনাথের সমগ্র উপন্যাসকে
তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা:

ক. ঐতিহাসিক উপন্যাস: ঐতিহাসিক ধারায় রবীন্দ্রনাথের ‘বৌ ঠাকুরানীর হাট’ [১৮৮৩] ও ‘রাজর্ষি’ [১৮৮৭] প্রথম বয়সের রচনা। তাই এ দুটি উপন্যাসেই কেবল কবি তাঁর অপরিণত বয়সজনিত ভাববিহ্বলতার পরিচয় দিয়েছেন।

খ. জীবন সমস্যামূলক সামাজিক উপন্যাস: রবীন্দ্রনাথের জীবন সমস্যাপ্রধান উপন্যাস হিসেবে ‘চোখের বালি’ [১৯০৩] এবং ‘নৌকাডুবি’ [১৯০৬] বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘চোখের বালি’ বাংলা সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস। ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর রোমান্টিক মনোবৃত্তির পরিচয় দিয়েছেন। ‘গোরা’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু মহাকাব্যের আদর্শে পরিকল্পিত। এ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িককালের ভাববিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি লক্ষ করা যায়।

গ. বুদ্ধিবৃত্তি প্রধান বিশ্লেষণধর্মী উপন্যাস: ‘ঘরে বাইরে’ [১৯১৬] এবং ‘চার অধ্যায়’ [১৯৩৪] স্বদেশি আন্দোলনের পটভূমিকায় রচিত বিপ্লবাত্মক উপন্যাস। ‘চতুরঙ্গ’ [১৯১৬] রবীন্দ্রনাথের মতবাদ প্রধান উপন্যাস। ‘যোগাযোগ’ [১৯২৬] দাম্পত্যজীবনের লীলা সংঘর্ষমূখর চরিত্রগুলো বুদ্ধিপ্রধান সংলাপতীক্ষ্ণ। ‘শেষের কবিতা’ [১৯২৯] রবীন্দ্রনাথের ভিন্নস্বাদের উপন্যাস। কাব্যধর্মী ভাষা ও তীক্ষ্ণ যুক্তি তর্কের শাণিত প্রকাশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ‘দুইবোন’ (১৯৩৩) ও ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪] রবীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের ফসল, বিশেষ অনাদর ও অবহেলার সৃষ্টি। দুটি উপন্যাসই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জীবনধর্মের যে একটা স্বভাব নিষ্ঠুর দিক আছে তারই প্রকাশ ঘটেছে ‘দুইবোন’ এবং ‘মালঞ্চে’। রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ প্রতিভার আলোকে উদ্ভাসিত হয়েছে বাংলা উপন্যাসের পরিবেশ।

বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষে বাংলা উপন্যাসে তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮)- যিনি অপরাজেয় কথাশিল্পী নামেও পরিচিত। তিনি সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। শরৎচন্দ্র সামাজিক উপন্যাস রচনায় কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। সমাজ বিহিত প্রেমের কথা অতি দরদের সাথে তিনি অঙ্কন করেছেন। শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয়তার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে মনে হয় বাংলার গার্হস্থ্য এবং সামাজিক জীবনের দিকগুলো তার রচনায় স্পষ্ট ও সমুজ্জ্বল। মানুষের অন্তর্জীবনের দ্বন্দু সংঘাতগুলো তিনি অতি সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। শরৎ উপন্যাসগুলোকে নিম্নলিখিত শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।

ক. পারিবারিক দ্বন্দ্ব সংঘাতমূলক উপন্যাস: ‘বিন্দুর ছেলে’ (১৯১৪), ‘রামের সুমতি’ (১৯১৪), ‘নিষ্কৃতি’ (১৯১৭), ‘বৈকুন্ঠের উইল’ (১৯১৬), ‘পণ্ডিত মশাই’ (১৯১৪), ‘হরিলক্ষ্মী’ (১৯২৬];

খ. সংঘাতমূলক প্রণয় ও দাম্পত্য জীবনের কাহিনি: ‘শুভদা’ [১৮৯৮), ‘দেবদাস’ (১৯১৭), ‘দত্তা’ [১৯১৮), ‘বড় দিদি’ [১৯১৩), ‘চন্দ্রনাথ’ [১৯১৬), ‘দেনা পাওনা’ (১৯২৩), ‘পরিণীতা’ (১৯১৪), ‘কাশীরাম’ (১৯১৭) ও ‘বিরাজ বৌ’ [১৯১৪];

গ. সমাজনীতির সমালোচনা প্রধান উপন্যাস: ‘বামুনের মেয়ে’ (১৯২০) ও ‘পল্লী সমাজ’ (১৯১৬);

ঘ. সমাজবিরোধী অবৈধ প্রেম সম্বন্ধীয় উপন্যাস: ‘চরিত্রহীন’ [১৯১৭), ‘গৃহদাহ’ (১৯২০), ‘শ্রীকান্ত চারপূর্ব’ ১ম পর্ব ১৯১৭, ২য় পর্ব ১৯১৮, ৩য় পর্ব ১৯২৭, ৪র্থ পর্ব ১৯৩৩);

ঙ. মতবাদ প্রধান উপন্যাস: ‘শেষ প্রশ্ন’ (১৯১৩), ‘পথের দাবী’ (১৯২৬), ‘বিপ্রদাস’ [১৯৩৫) ও ‘শেষের পরিচয়’ [১৯৩৯]।

রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের সময়ে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক বাস্তবতা দ্রুত বদলে যায়। মানুষের পারিবারিক জীবনে নতুন মাত্রা যোগ করে শিক্ষার প্রসার ও অর্থনৈতিক সংকট। একদিকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব এবং অন্যদিকে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের প্রেরণা সাধারণ মানুষকে যেমন করে তোলে অস্থির তেমনি তাকে করে তোলে অধিকার- সচেতন। এই নতুন সামাজিক বাস্তবতায় নতুন দিগন্ত সন্ধানের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে যুক্ত হন নতুন ধারার কয়েকজন লেখক। এঁরা মানুষের মনোলোকের জটিল রহস্য সন্ধানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তাঁদের কাছে সাহিত্যের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে সমাজের দরিদ্র এবং অবজ্ঞাত মানুষের জীবন। এঁরা হলেন: বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই তিন লেখক রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্র-পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে প্রধান ঔপন্যাসিক হিসেবে বিবেচিত হন। বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’-‘অপরাজিত’, তারাশঙ্করের ‘গণদেবতা’-‘পঞ্চগ্রাম’, এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

বঙ্কিমচন্দ্রের অনুবর্তী উপন্যাসিকগণের ভিতরে রমেশচন্দ্র ছিলেন অন্যতম। তিনি শিক্ষিত ও রুচিশীল ব্যক্তি ছিলেন।
বঙ্কিমের অনুপ্রেরণায় তিনি সাহিত্যের ক্ষেত্রে প্রবেশ করেন এবং ইতিহাসকে অবলম্বন করে উপন্যাস রচনায় প্রবৃত্ত হন। রমেশচন্দ্র দত্ত চারটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা করেন যথাক্রমে ‘বঙ্গবিজেতা’ (১৮৭৪), ‘মাধবী কঙ্কন’ [১৮৭৭], ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ [১৮৭৮] এবং ‘রাজপুত জীবন সন্ধ্যা’ (১৮৭৯]। রমেশচন্দ্র আরও দু’খানি সামাজিক উপন্যাসও রচনা করেন। যথাক্রমে ‘সংসার’ [১৮৮৬] এবং ‘সমাজ’ [১৮৯৩]। এ উপন্যাস দুটিতে রমেশচন্দ্র রৌদ্র ছায়াখচিত পল্লির সামাজিক সুখ দুঃখ বিরহের চিত্র অঙ্কন করার প্রয়াস পেয়েছেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের বড়ো ভাই সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উপন্যাস রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলো হলো ‘কণ্ঠমালা’ [১৮৭৭), ‘মাধবীলতা’ [১৮৮৪] ও ‘জালপ্রতাপ চন্দ্র’ [১৮৮৩]। ‘কণ্ঠমালা’ সঞ্জীবচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস। মাধবীলতার রোমান্টিক আখ্যানে বস্তুত দেশীয় রূপ কথার কিছু ছাপ আছে। ‘জলপ্রতাপচাঁদ’ ঐতিহাসিক কাহিনি হলেও লেখবার গুণে তা উপন্যাসের মতই চিত্তাকর্ষক। সঞ্জীবের সহানুভূতি উৎপীড়িত ‘জালপ্রতাপচাঁদ ভূমিকাটিকে পাঠকের চক্ষে মহিমামণ্ডিত করেছিল। সঞ্জীব চন্দ্রের রচনারীতির মূলে আছে নির্মল গভীর রসবোধ, ব্যাপক সহানুভূতি ও সূক্ষ্ম কৌতূহল দৃষ্টি।

মীর মোশাররফ হোসেনের প্রথম গ্রন্থ ‘রত্নাবতী’ [১৮৬৯]। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম কর্তৃক রচিত প্রথম উপন্যাস। তাঁর অন্যান্য উপন্যাস হচ্ছে ‘বিষাদ সিন্ধু’, ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’, ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ প্রভৃতি। এর মধ্যে ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ এবং ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’, ব্যঙ্গরসাত্মক রচনা। তবে ‘বিষাদ সিন্ধুই’ তাঁর সর্বাধিক জনপ্রিয় গ্রন্থ। এটা কারবালার বিষাদময় ঘটনা অবলম্বনে রচিত।

মহিলা উপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড়ো বোন স্বর্ণকুমারী দেবী। তাঁর কতকগুলো উপন্যাস ইতিহাসের পটভূমিকায় রচিত, কতকগুলো রচিত সমাজজীবনের পটভূমিকায়। ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে ‘দীপনির্বাণ’, ‘ফুলেরমালা’, ‘মেবাররাজ’ ও ‘বিদ্রোহ’ উল্লেযোগ্য। সামাজিক ও পারিবারিক দ্বণ সংঘাতময় উপন্যাসের মধ্যে ‘ছিন্ন মুকুল’, ‘হুগলীর ইমাম বাড়ী’, ‘হেলতা’ এবং ‘কাহাকে’ উল্লেখযোগ্য।

এক ঐতিহাসিক পটভূমিতেই বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন, মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল হক, নজিবর রহমান প্রমুখ লেখকের আবির্ভাব ঘটে। বিশ শতকের প্রথমার্ধের মধ্যে আবির্ভূত হন কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবীর প্রমুখ। ১৯৪৭ সালে পূর্ববাংলা নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশে পরিণত হয়। নতুন রাজনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এখানে সাহিত্য সাধনা নতুন মাত্রা লাভ করে। সূচনায় বাংলাদেশের উপন্যাস, আধুনিক চিন্তা ও ভাবধারার অনুসারী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, শওকত ওসমান, আবু রুশদ প্রমুখ লেখকের হাত ধরে এগিয়ে চলে। উপন্যাসে উপস্থাপিত হয় ব্যক্তি, সমাজ ও সমগ্র জীবনের বিশ্লেষণমূলক আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পূর্ব পর্যন্ত এ অঞ্চলটি ছিল পাকিস্তানের এক ধরনের উপনিবেশ। ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে নাগরিক জীবন বিকশিত হলেও গ্রামীণ জীবন ছিল পশ্চাৎপদ। অন্ধ কুসংস্কার, ধনী-দরিদ্রের দ্বন্দ্ব, দারিদ্র্যসহ নানা সমস্যায় বিপন্ন ও বিপর্যন্ত ছিল মানুষের জীবন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও বাংলাদেশের উজ্জ্বল অভ্যুদয়ের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয় জীবনে সৃষ্টি হয় নতুন উদ্দীপনা। নাগরিক জীবনে যেমন লাগে আধুনিকতার ছোঁয়া তেমনি শেকড়-সন্ধানী গ্রামীণ জীবনেও সৃষ্টি হয় নবতর উদ্দীপনা। এয়ই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ঔপন্যাসিকগণ রচনা করেন নানা ধরনের উপন্যাস। নিচে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উপন্যাসের নাম দেওয়া হলো:

আবুল ফজলের ‘রাঙা প্রভাত’, সত্যেন সেনের ‘অভিশপ্ত নগরী’, আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, শওকত ওসমানের ‘জননী’ ও ‘ক্রীতদাসের হাসি’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘লালসালু’, ‘চাঁদের অমাবস্যা’ ও ‘কাঁদো নদী কাঁদো’, শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ ও ‘সারেং বউ’, সরদার জয়েনউদ্দীনের ‘অনেক সূর্যের আশা’, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘কাশবনের কন্যা’, রশীদ করিমের ‘উত্তম পুরুষ’, জহির রায়হানের ‘হাজার বছর ধরে’, আনোয়ার পাশার ‘রাইফেল রোটি আওরাত’, আবু ইসহাকের ‘সূর্য-দীঘল বাড়ী’, আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলী’ ও ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘বৃষ্টি ও বিদ্রোহীগণ’, শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’, আহমদ ছফার ‘ওঙ্কার’, হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’, মাহমুদুল হকের ‘জীবন আমার বোন’, রিজিয়া রহমানের ‘বং থেকে বাংলা’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ও ‘খোয়াবনামা’, সেলিনা হোসেনের ‘পোকামাকড়ের ঘরবসতি’ ও ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, হুমায়ুন আহমেদের ‘নন্দিত নরকে’ ও ‘জ্যোৎস্না ও জননীর গল্প’ এবং শহীদুল জহিরের ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ ইত্যাদি।

উপরিউক্ত আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে বিভিন্ন লেখক লেখিকা বা উপন্যাসিক বিভিন্ন উপন্যাস লিখেছেন এবং একেক জন তা দ্বারা সুখ্যাতি লাভ করেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপন্যাস দিন বদলের পালাগানে মুখরিত, সমকালীন জগৎ ও জীবন উপন্যাসের উপজীব্য হয়ে উঠেছে বরাবরই। সে কারণে সাম্প্রতিক উপন্যাসের বিষয় ও বৈশিষ্ট্যের পরিধি নির্ধারণ সম্ভবপর নয়। তাই ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সুবৃহৎ বঙ্গসাহিত্য উপন্যাসের ‘ধারা’ গ্রন্থের এই বলে সমাপ্তি টেনেছেন। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে যে উপন্যাসের সাহিত্য ধারার সূচনা বিংশ শতকের প্রথমার্ধেই তা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে তাদের নিজেদের স্থান করে নিতে সমর্থ হয়। বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস তাই বিশ্বসাহিত্যে বিশেষ মর্যাদার দাবিদার।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।