ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮) জন্মকালে জোব চার্ণকের শহর কলকাতার বয়স প্রায় শতাব্দীকাল অতিক্রান্ত। বাংলা গদ্য সাহিত্য তখন সবে মিশনারী ও সিবিলিয়ন ছাত্রদের গণ্ডী থেকে মুক্ত হয়ে শিক্ষিত নবজাগ্রত বাঙালীর জ্ঞানচর্চার প্রকাশ হিসাবে কিরণ বিস্তার করতে শুরু করেছে। রামমােহন-বিদ্যাসাগর দেবেন্দ্রনাথ অক্ষয়কুমার প্রমুখের রচনায় বাংলা গদ্যে জ্ঞানমূলক প্রবন্ধের ধারা তখন প্রতিষ্ঠিত। এই পথ ধরেই অদূর-ভবিষ্যতে মধ্যাহ্নদীপ্তি নিয়ে বিকশিত হলেন প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র।

কিন্তু মননশীল গদ্য প্রবন্ধ ছাড়াও বাংলা গদ্যের এই প্রাথমিক পর্বে রসরচনার একটি ধারাও বিকশিত হয়ে উঠেছিল। বাংলা গদ্যের প্রাথমিক পর্ব থেকেই, বিশেষত বিদ্যাসাগরের হাতে রঙ্গব্যঙ্গ-কৌতুকের লঘু-গুরু আঘাত বাংলা গদ্যের একটি বিশেষ ধারা সূচিত করেছিল। সে যুগের সাময়িক পত্রগুলিতেও কিছু কিছু রঙ্গ ব্যঙ্গমূলক গদ্যরচনা প্রকাশিত হতে দেখা গেছে। এই ব্যঙ্গাত্মক রসরচনার যথার্থ প্রথম শিল্পী ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবানীচরণের এই ধারাই উত্তরকালে প্যারীচাদ-কালীপ্রসন্ন সিংহ হয়ে বিপুল নকশা সাহিত্যের এবং বঙ্কিমের ‘রহস্য’-মূলক রচনায় পূর্ণ পরিণত রূপ ধারণ করেছে।

নবজাগরণ যুগের উষালগ্নে রামমােহনের সমসাময়িক ভবানীচরণ শুধু সাহিত্যিক হিসাবে নন, সমাজসংস্কারক হিসাবেও বাংলার ইতিহাসে সুবিদিত। রামমােহনের সঙ্গে একযােগে ১৮২১ খ্রীষ্টাব্দে ভবানীচরণ ‘সংবাদ কৌমুদী’ পত্রিকা প্রকাশ করেন। ইংরাজি শিক্ষিত নব্য বঙ্গসমাজে পত্রিকাটির ব্যাপক ভূমিকা ছিল। কিন্তু সতীদাহ-নিবারণ সম্পর্কিত বিষয়ে রামমােহনের সঙ্গে মতান্তর হওয়ায় মাত্র ১৩টি সংখ্যা প্রকাশের পর ভবানীচরণ ‘সম্বাদ-কৌমুদী’র সংশ্রব ত্যাগ করেন এবং প্রকাশ করেন নিজ সম্পাদিত পত্রিকা সমাচার চন্দ্রিকা। ভবানীচরণ ছিলেন কিছুটা রক্ষণশীল মনােভাবাপন্ন, তাই শেষপর্যন্ত রামমােহনের সতীদাহ নিবারণ বিষয়ক মতামতের বিপক্ষতা করাই ছিল ‘সমাচার চন্দ্রিকা’ নামক সাপ্তাহিক পত্রের প্রধান উদ্দেশ্য। তবে এ ছাড়াও নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রবন্ধাদি সমাচার চন্দ্রিকায় প্রকাশিত হত। উল্লেখ করা যেতে পারে সতীদাহ নিবারণের বিরুদ্ধে ইংলণ্ডে আপীল করার উদ্দেশ্যে যে ‘ধর্মসভা’ গঠিত হয়, ভবানীচরণ ছিলেন তার সম্পাদক। ‘সমাচার চন্দ্রিকা’র পৃষ্ঠায় দক্ষ সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসাবে স্বাক্ষর রাখলেও তাই সে যুগের ইতিহাসে ভবানীচরণ রক্ষণশীল সমাজের প্রতিভূ এবং প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পুরােধা হিসাবেই চিহ্নিত।

নিজস্ব মতাদর্শকে প্রকাশ করতে গিয়ে এবং প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে গিয়ে বিদ্যাসাগরের মতাে ভবানীচরণও ব্যঙ্গাত্মক রচনার আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারই ফলশ্রুতিতে ‘সমাচার চন্দ্রিকায়’ ১৮২১-২২ নাগাদ ‘বাবুর উপাখ্যান’, ‘শৌকীন বাবু’, ‘বৃদ্ধের বিবাহ’, ‘ব্রাহ্মণ পণ্ডিত’, ‘বৈষ্ণব ও বৈদ্য সম্বাদ’ প্রভৃতি যে বিদ্রুপ ও হাস্যরসাত্মক ছদ্মনামা রচনাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল, গবেষকগণ সেগুলিকে ভবানীচরণের রচনা বলে অনুমান করেছে। এই ব্যঙ্গাত্মক রচনাগুলিরই পরিণত রসরুপ ভবানীচরণের ‘কলিকাতা কমলালয়’, ‘নববাবু বিলাস’, ‘নববিবি বিলাস’ প্রভৃতি রচনায় দেখা গেছে। সমাজ সন্দর্শনমূলক এই বসরচনার ধারাই ক্রমপরিণত হয়েছে টেকচঁাদ ও হতােমের প্রতিভায়।

সমকালীন যুগে রামমােহন, বিদ্যাসাগর বা ‘সমাচার চন্দ্রিকা’র প্রমথনাথ শর্মা (ভবানীচরণেরই ছদ্মনাম) যে ব্যঙ্গাত্মক গদ্য লিখেছিলেন, সেখানে রসসৃষ্টি অপেক্ষা আঘাত করার প্রবণতাই ছিল অধিক। কিন্তু ভবানীচরণই প্রথম বাংলা রসসাহিত্যের মাধ্যম হিসাবে ব্যঙ্গাত্মক রচনাকে ব্যবহার করলেন ‘কলিকাতা কমলালয়’ এবং ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাই ভবানীচরণকে বলেছেন বাংলা কথাসাহিত্যের প্রথম প্রবর্তক।

ভবানীচরণের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ১৮২৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘কলিকাতা কমলালয়’। গ্রন্থভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন যে, গ্রাম ও অন্যান্য নগর থেকে কলকাতা নগরীতে এসে সেখানকার আচার-বিচার, রীতি-নীতি সম্পর্কে অনভিজ্ঞতাহেতু যারা অসুবিধার সম্মুখীন হন, তাদের জন্যই ‘কলিকাতা মহানগরের স্থল বৃত্তান্ত বিবরণ করিয়া কলিকাতা কমলালয় গ্রন্থকরণে’ তিনি প্রবৃত্ত হয়েছেন। তার দাবী— ‘এতগ্রন্থ পাঠে বা শ্রবণে অনায়াসে এখানকার ব্যবহার ও রীতি ও বাচাতুরী আশু জ্ঞাত হইতে পারিবেন, অধিকন্তু কলিকাতা কমলালয় হইতে বৃত্তান্তরূপ অনেক রত্নলাভ হইতে পারিবেক।’ এই প্রথম গ্রন্থেই ভবানীচরণের সমাজ জ্ঞান এবং ব্যঙ্গের দীপ্তি সুপরিস্ফুট। কলিকাতার যাবনিক ভাষা, ইংরাজি মিশাল ভাষা ও স্ল্যাঙের দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করার মধ্য দিয়ে এই গ্রন্থে ভবানীচরণ প্রায় নিজেরই অজ্ঞাতে সমাজভাষাবিজ্ঞানেরও এক মহা কার্য সম্পন্ন করেছেন। পরবর্তীকালে এরূপে শব্দ সংগ্রহের কাজে আমরা বিদ্যাসাগরকেও ব্রতী হতে দেখেছি। মােসাহেবী জাতীয় কর্মকে এবং বাবু-সংস্কৃতিকে ভবানীচরণ এই গ্রন্থে ব্যঙ্গের প্রবল আঘাত হানলেন। ‘কলিকাতা কমলালয়’ থেকে তাঁর এ জাতীয় ব্যঙ্গের দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করা যায়— ‘কেহ বাবুর সহিত আলাপ কৌশল করিবার নিমিত্ত নিয়ত যাইতেছে, মনােনীত কথা কহিতে ও কর্ম করিতে তাহারা বিলক্ষণ পারগ। তাহাদিগের সঙ্গে লইয়া বাবু স্থানবিশেষে গমন করেন। লােকে তাহাদিগের কহে ইহারা অমুক বাবুর মােসাহেব, ইহাতে ইহারা মহা আনন্দিত থাকে……।’

‘নববাবুবিলাস’ (১৮২৫) প্রকাশিত হয়েছিল, প্রমথনাথ শৰ্ম্মণ ছদ্মনামে। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে কলকাতার বুকে বাবু সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। ইংরাজের সাহচর্যে ব্যবসায় ও ভূমিব্যবস্থার সূত্রে তখন শিক্ষিত ধনী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। ইংরাজি শিক্ষার সদর্থক দিকগুলি তাদের আয়ত্ত ছিল না, কেবল সামন্তযুগীয় লাম্পট্য ও উচ্ছংখলতাকেই তারা সংস্কারমুক্ত আধুনিকতার নামে পুনর্বার আয়ত্ত করতে চেষ্টা করেছিল। ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থে সেই অর্থে মদমত্ত হঠাৎ নবাবদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের গ্লানি উন্মােচিত হয়েছে। গদ্যে-পদ্যে, তৎসম শব্দসমাবেশে ও চটুল কথ্যরীতিতে বর্ণসংকর ও চমকপ্রদ ভাষাবিন্যাসের মধ্য দিয়ে ভবানীচরণের তির্যক ব্যঙ্গরস পরিবেষিত হয়েছে ‘নববাবুবিলাসে’।

‘নববাবুবিলাসে’ একটি অস্পষ্ট কাহিনীধারা লক্ষ্যগােচর হয়। নববাবুর পূর্বপুরুষের ধনার্জন রহস্য থেকে শুরু করে তার বিদ্যাশিক্ষা, অমাত্য পরিবৃত বিষয়কর্ম, বাবুদর্শনে দীক্ষালাভ ইত্যাদি বিস্তৃতভাবে এখানে বর্ণিত। নিদারুণ জীবন পরিণতির মধ্যে নববাবুর বৃত্তান্ত পরিসমাপ্ত হয়েছে। ফলে প্যারীচাদের আলাল সম্পূর্ণরুপেই ভবানীচরণের ‘নববাবুবিলাসে’র কাছে ঋণী।

‘নববিবিবিলাস’ এবং ‘দূতীবিলাস’ পূর্ববর্তী গ্রন্থেরই পরিপূরক। ‘দূতীবিলাস’ অবশ্য প্রগ্রজ। এটি পদ্যে লিখিত, ‘নববিবিবিলাস’ গদ্যে। ‘নববাবুবিলাস’ গ্রন্থে বাবুদের জীবনবৃত্তান্ত বর্ণিত। এমতাবস্থায় তাদের বিবিদের মধ্যেও লাম্পট্য ও উচ্ছংখলতা প্রকটিত হতে বাধ্য। ‘নববাবুবিলাসে’ সেই সামাজিক ক্লেদ ব্যঙ্গের কাঘাতে উন্মােচিত। এই গ্রন্থটিতে লেখক ভােলানাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ছদ্মনাম গ্রহণ করেছিলেন।

ভবানীচরণের অন্যান্য গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে ‘হিতােপদেশ’, ‘শ্রীশ্ৰীগয়াতীর্থ বিস্তার’, ‘আশ্চর্য উপাখ্যান’ ও ‘পুরুষােত্তম চন্দ্রিকা’। এছাড়া তার কয়েকটি সম্পাদিত গ্রন্থ ‘হাস্যার্ণব’, ‘শ্রীমদ্ভাগবত’, ‘মনুসংহিতা’ ইত্যাদি।

সজনীকান্ত দাস লিখেছিলেন ‘বাংলা গদ্যে সর্বপ্রথম ব্যঙ্গ-রচয়িতা হিসাবে ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম বাংলা সাহিত্যে অক্ষয় হইয়া থাকিবে।’ ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই মত পােষণ করে লিখেছেন— ‘নীরস শাস্ত্রীয় বিচার-বিতর্কের যুগে তিনি বাংলা ভাষায় যে লালিত্য ও রস সঞ্চার করিতে পারিয়াছিলেন; বাংলা ভাষা সাহিত্যের সঠিক ইতিহাস লিখিত হইলে সে সংবাদ বাঙালির অগােচর থাকিত না।’