বাংলার বিদ্রোহ দমন:

দিল্লি-সুলতানির সূচনাকাল থেকেই বাংলা একপ্রকার স্বাধীন রাজ্যের মর্যাদা ভোগ করে আসছিল। কুতুবউদ্দিন আইবক এবং ইতিয়ারউদ্দিন বখতিয়ার খলজি উভয়েই ছিলেন মহম্মদ ঘুরির ক্রীতদাস এবং সম্ভবত সমমর্যাদাসম্পন্ন। তাই কুতুবউদ্দিন দিল্লির শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেও তিনি বাংলা-বিহারে ইখতিয়ারউদ্দিনের কর্তৃত্বের পরিধি সম্পর্কে না-হস্তক্ষেপ নীতি অনুসরণ করে চলেন। ইতিয়ারউদ্দিনের মতো প্রতিভাবান সৈনিকের আকস্মিক মৃত্যু দুঃখজনক হলেও ; দিল্লিতে কুতুবউদ্দিনের কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানানোর মতো সম্ভাবনাময় একটা শক্তিরও যে অবসান ঘটেছিল, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। পরবর্তী শাসক তুঘ্রিল তুঘান খান একইভাবে বাংলার স্বাধীন অস্তিত্ব কায়েম করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইলতুৎমিসের বিরোধিতার সামনে পূর্ণ সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হন। ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরবর্তী কয়েক বছর দিল্লি-সুলতানির অস্থিরতা ও দুর্বল শাসকদের ক্ষমতালোভের ফলে বাংলাদেশ একপ্রকার স্বাধীনভাবেই শাসিত হতে থাকে। বলবন সিংহাসন দখল করলে লখনৌতির গভর্নর তাতার খাঁ তেষট্টিটি হাতি দিল্লিতে উপঢৌকন হিসেবে প্রেরণ করে সুলতানের প্রতি বাংলার আনুগত্য প্রদর্শন করেন।

অধ্যাপক নিজামী লিখেছেন : “তাতার খাঁ’র পরে বলবনের অন্যতম ক্রীতদাস তুঘ্রিল খাঁ লখনৌতির গভর্নর নিযুক্ত হন। তুঘ্রিল খাঁ বিচক্ষণ, সাহসী এবং উদ্যোগী পুরুষ হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। স্বভাবতই ক্ষমতালাভের অল্পকালের মধ্যে তিনিও স্বাধীন রাজ্যপ্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। সুলতান মুঘিসউদ্দিন উপাধি গ্রহণ করে, নিজনামে মুদ্রা প্রচলন করে ও খুৎবা পাঠ করে দিল্লির অধীনতা অস্বীকার করেন। তুঘ্রিল ঠিক কোন্ বছর বিদ্রোহ ঘোষণা করেন, সে বিষয়ে মতভেদ আছে।” ইসামীর মতে, “তুঘ্রিল বলবনের রাজত্বের অষ্টম বছরে অর্থাৎ ১২৭৫ খ্রিস্টাব্দে বিদ্রোহী হন।” কিন্তু বারাণীর মতে, তুঘ্রিল পঞ্চদশ বা ষোড়শ বছরে বিদ্রোহী হয়েছিলেন। অধ্যাপক নিজামীর মতে, বারাণীর বিবরণ সঠিক নয়। বলবন ১২৮০/৮১ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিদ্রোহ দমন করেছিলেন। তার আগে তিনি আরও দুটি অভিযান বাংলার বিরুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। তাই ধরা যেতে পারে, ১২৭৫ এবং ১২৮০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তীকালে তুঘ্রিলের বিদ্রোহ শুরু হয়ে বিকাশলাভ করেছিল।

তুঘ্রিলের বিদ্রোহপ্রবণতা সম্ভবত দুটি কারণে প্রকট হয়েছিল—(১) ঘরে-বাইরে সুলতান বলবনের ব্যস্ততা এবং (২) বাংলাদেশে নিজের জনপ্রিয়তা ও জাজনগরের (উড়িষ্যা) বিরুদ্ধে সামরিক সাফল্য। তুর্কি-আমিরদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা দমন করেই বলবন মোঙ্গল দস্যুদের আক্রমণ সম্ভাবনা রোধ করার কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। যখন মোঙ্গলদের আক্রমণে দিল্লি বিব্রত, ঠিক সেই মুহূর্তে তুঘ্রিল বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরেন। জাজনগর আক্রমণ করে তিনি বহু অর্থ ও হাতি সংগ্রহ করেছিলেন। নিয়মানুযায়ী এই লুণ্ঠিত অর্থের অংশ তিনি দিল্লিতে পাঠাননি। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মোঙ্গল আক্রমণে বিপর্যস্ত সুলতানের পক্ষে বাংলা নিয়ে মাথাঘামানো সম্ভব হবে না।

তুঘ্রিলের বিদ্রোহ ঘোষণার সংবাদে বলবন প্রথমে হতাশ হন এবং পরে রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। একজন ক্রীতদাসের এই আস্পর্ধা তাঁর কাছে অসহনীয় মনে হয়। বলবন উপলব্ধি করেন যে, তুঘ্রিলের -এই বিদ্রোহ অন্যান্য দাস-কর্মচারীদের কাছে প্রেরণা হিসেবে কাজ করতে পারে। তা ছাড়া, বাংলা স্বাধীন হয়ে গেলে পূর্ব ভারতে সুলতানি সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এবং গাঙ্গেয়ভূমি থেকে অর্থাগমের সম্ভাবনা চিরতরে বিনষ্ট হয়ে যাবে। তাই দ্রুত তিনি বাংলার বিরুদ্ধে অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন।

বলবনের নির্দেশে অযোধ্যার গভর্নর আমিন খাঁ এক বিশাল বাহিনীসহ তুঘ্রিলের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তমর খাঁ, মালিক তাজউদ্দিন প্রমুখ দক্ষ ও অভিজ্ঞ মালিকগণ আমিন খাঁর সহযোগী হিসেবে যান। কিন্তু সরযূ নদীর তীরে তুঘ্রিলের হাতে সুলতানি বাহিনী দারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়। বিধ্বস্ত সুলতানি ফৌজ প্রত্যাবর্তনের কালে হিন্দু উপজাতির আক্রমণে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এই বিপর্যয়ের সংবাদ বলবনের কাছে পৌঁছালে ক্ষিপ্ত সুলতান আমিন খাঁকে প্রকাশ্যে হত্যার নির্দেশ দেন। একজন বিশ্বস্ত সেনাপতির প্রতি সুলতানের এই হীন আচরণ বলবনের প্রতি সাধারণ মানুষ ও তুর্কি মুসলমানদের আস্থাহীন করেছিল বলে বারাণী মতপ্রকাশ করেছেন। অতঃপর বলবন দিল্লির এক দক্ষ যোদ্ধা বাহাদুরের নেতৃত্বে এক নতুন বাহিনী তুঘ্রিলের বিরুদ্ধে পাঠান। কিন্তু অসম সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেও বাহাদুর পিছু হটতে বাধ্য হন। এবারেও বলবন ব্যর্থ বাহাদুরকে হত্যার কথা ভেবেছিলেন। তবে অন্যান্য আমির ও মালিকদের অনুরোধে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন।

পরপর দুটি অভিযানের ব্যর্থতা বলবনকে দারুণ ক্ষিপ্ত করে এবং তিনি স্বয়ং তুঘ্রিলের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার সিদ্ধান্ত নেন (১২৮০-৮১ খ্রিঃ)। বলবন দিল্লির প্রশাসনিক দায়িত্ব মালিক-উল-ফকরুদ্দিন নামক জনৈক আমিরের হাতে ন্যস্ত করে এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সম্পর্কে পুত্র মহম্মদকে বিশেষ নির্দেশ ও পরামর্শ প্রদান করে লখনৌতির উদ্দেশ্যে রওনা হন। অপর পুত্র বুগরা খাঁ সম্রাটের সঙ্গী হন। অযোধ্যায় এসে বলবন আরও দু-লক্ষ নতুন সৈন্য সংগ্রহ করেন। সুলতানের অগ্রগতির সংবাদে ভীত তুঘ্রিল ঢাকার নিকটবর্তী হাজিনগরের জঙ্গলে আত্মগোপন করেন। বলবন লখনৌতি হয়ে সোনারগাঁয়ে উপস্থিত হন। সুলতানি বাহিনী ছোটো ছোটো দলে বিভক্ত হয়ে পূর্ববঙ্গের সমস্ত অঞ্চলে তুঘ্রিলের অনুসন্ধান চালাতে থাকে। শেষ পর্যন্ত মালিক মহম্মদ শেরান্দাজ তুঘ্রিলের গোপন আস্তানার সংবাদ জোগাড় করেন এবং দ্রুত সেই অংশ ঘিরে ফেলেন। সুলতানি বাহিনীর উপস্থিতি বুঝতে পেরে তুঘ্রিল একটি লাগামহীন ঘোড়ায় চড়ে নিকটবর্তী নদী অতিক্রম করে পালানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু আলি নামক জনৈক সুলতানি সৈন্য দ্রুত এগিয়ে গিয়ে তুঘ্রিলকে আঘাত করেন এবং মালিক মুকাদ্দর অস্ত্রাঘাতে তুম্রিলের মুণ্ডচ্ছেদ করেন। বলবন এই সাফল্যের জন্য উভয়কেই পুরস্কৃত করেন। লখনৌতিতে প্রত্যাবর্তন করে বলবন বিদ্রোহী তুঘ্রিলের সমস্ত সমর্থক আত্মীয়পরিজনকে প্রকাশ্য রাস্তায় শূলবিদ্ধ করে হত্যা করেন। এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বারাণী লিখেছেন যে, দিল্লির কোনো সুলতান -এত নৃশংসতার সাথে নরহত্যা সংঘটিত করেননি। অতঃপর নিজপুত্র বুগরা খাঁকে বাংলার শাসকপদে নিযুক্ত করে বলবন স্মরণ করিয়ে দেন—“আমাকে বোঝার চেষ্টা করো। ভুলে যেও না, হিন্দ বা সিন্ধু, মালব, গুজরাট, লখনৌতি কোনো রাজ্য দিল্লির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হলে তুঘ্রিল এবং তার আত্মীয়ের মতোই চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে।” তিনি পরামর্শ দেন ‘দিল্লির প্রতি সদা অনুগত থেকো, এমনকি সেখানে যদি অন্য কোনো বংশ রাজত্ব করে তা হলেও।”