‘চলিত চিত্রকলা’ বলতে লেখক বুঝিয়েছেন দুধরনের শিল্প–আটপৌরে শিল্প ও পোশাকি শিল্প। বাংলাদেশের আটপৌরে ছবি তার পটের ছবি, আর পালপার্বণের শিল্প বলতে বোঝায় দেবমূর্তি, প্রতিমা ইত্যাদি। এই দুই শিল্পধারা স্বতন্ত্র ও বিশিষ্ট। প্রথমটি সহজ, সরল, প্রসাধনের চেষ্টা নেই, সংস্কারের প্রয়োজন বা প্রেরণা নেই। দ্বিতীয় শ্রেণির ছবি আভিজাতিক, গঠনের দিক থেকেও এই দুই জাতের ছবির মধ্যে পার্থক্য যথেষ্ট।
পটুয়া শিল্পকে ঘিরে দেশে কয়েকটা কুসংস্কার আছে। অনেকের ধারণা পটুয়া ছবি আর কালীঘাটের ছবি শব্দ দুটি একার্থক। আসলে কালীঘাটের পটুয়ারা পটে যে শিল্প অঙ্কিত করেন, সেই শিল্পকে অনেকে পটুয়া শিল্প ভাবেন। এই কথার মধ্যে সত্য নেই এমন বলা চলে না। যদিও সত্যের অংশ অল্প, তবুও ইতিহাসের গতিধারা বিচার করলে এর যথার্থ তাৎপর্য বোঝা যায়। ‘কলকাতা যখন সবে গড়ে উঠেছে, তখন গ্রাম থেকে একদল লোক নতুন শহর কলকাতায় চলে আসে, বাসা বাঁধে এবং ছবি এঁকে চলে। এদের বলা হত গ্রামের শিল্পী। সেখানে তারা প্রতিমা গড়ত। কিন্তু শহরে এসে শহরসভ্যতার সংস্পর্শে এসে তাদের মধ্যে পরিবর্তন অনিবার্যভাবে এল। শহরের একটা দাবি আছে, শহরের বাজারে চাহিদা আছে। শহর বা শহরতলির চারপাশে যে মেলা বসত, সেখানেই ছিল ছবির বাজার। এই শহরের বাজারে তারা ছবি বিক্রি করত। এইভাবে নগরজীবনের সান্নিধ্যে এসে এরা নগরজীবনকে অবলম্বন করে ছবি আঁকত। নগরজীবনের ছাপ এই সব ছবিতেও এসে পড়ত। এর ফলে চিত্রশুদ্ধি বিনষ্ট হত। এ-ছবি আসলে পটুয়া ছবি নয়। কারণ এর ভাষায় গ্রাম্যতা রইল, বক্তব্যে শহরবৃত্তি এল। এই ধরনের শিল্পে একটা দ্বিধা আছে, একটা দ্বন্দ্ব আছে। বিষয়বস্তু আর আঙ্গিকের মিলন এখানে পূর্ণ নয়। এর ফলে ছবি হয়ে গেল আদর্শচ্যুত। পটুয়া শিল্পের আদর্শ থেকে এরা বঞ্চিত হল। এদের মধ্যে দেশজ ভাবনা অনেকটা ক্ষুণ্ন হল। বিদেশের সমালোচকরা কালীঘাট থেকে ছবিগুলো সংগ্রহ করেছেন। তাঁরা তাই এই সব ছবিকে মৌলিক পটের ছবি বলে মনে করতেন। এইভাবে পটুয়া শিল্প যেভাবে প্রচলিত হয়ে গেল, সে সম্পর্কে লেখক এই সাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন।
পটুয়া ছবি সম্পর্কে বিভ্রান্তি যথেষ্ট। এই ভ্রান্তি বিদেশি সমালোচকদের ভ্রান্তির প্রতিধ্বনি। পটুয়া ছবি কলকাতা শহর গড়ে ওঠার পূর্বে প্রাক-ব্রিটিশ যুগে প্রচলিত ছিল। প্রাক-ব্রিটিশ যুগে এরা ছিল খাঁটি দেশজ শিল্প। সেই সময় এই শিল্পের দেহে প্রাণ ছিল। আদিম শিল্পীরা বহুদিনের সাধনায় ছবির মূল গড়ন ও বক্তব্য যেভাবে খুঁজে পেয়েছিল তা একালের শিল্পীশ্রেষ্ঠ যামিনী রায়ের কাছেও শ্রদ্ধার বস্তু। পটের ছবি পরবর্তীকালে আর বেশিদিন চলিত থাকেনি। পটুয়ামহলের নিছক অভ্যাস হিসেবে এদের প্রচলন ছিল। পটুয়াশিল্পে লোকশিল্পের বোধ জেগেছিল। লোকায়ত মানসের ছবি বলে চিহ্নিত করা হয়। এই দিক থেকে বিচার করলে দেখা যায় লোকশিল্পের প্রথম বোধ এখন পটুয়াশিল্পীরা ভুলে গেছে। এইজন্য বলা যায়, “পটুয়া শিল্পের মূল তথ্যকে তাই শুধু বাংলাদেশের ছবির ইতিহাসে একটি বিশেষ অধ্যায় বললে কমিয়ে বলা হবে।” একে শিল্প-ইতিহাসের মূল কথা বলা যায়। সমস্ত দেশের প্রাগৈতিহাসিক ছবির মধ্যে এই ধরনের তথ্য বা বক্তব্য বিকশিত হয়েছে। শিল্পের মূল রহস্য কী তা জানার জন্য কেউ যদি প্রয়াসী হন, তাহলে বাংলাদেশের প্রাকৃতে পটুয়া ছবিকে বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কারণ এদের মধ্যে দিয়ে ছবির মূল সত্যের সন্ধান এখানে এসেছিল।
পটুয়া শিল্পের ভিত্তি ছিল পুরাণ। এই পুরাণকে বলা হত myth। পটুয়া ছবির আবেগ পুরাণের ওপর দানা বেঁধেছিল। পটুয়া ছবি আঙ্গিকের দিক থেকে অ-সংস্কৃত, অ-প্রসাধিত অর্থাৎ সহজ, স্বাভাবিক ও সুন্দর। পাশাপাশি সংস্কৃত শিল্প প্রচলিত। ওই সংস্কৃত শিল্প পটুয়া শিল্প থেকে স্বতন্ত্র।
পটুয়া শিল্পের মূল কথা বিশ্বপ্রকৃতির নিখুঁত প্রতিলিপি নয়, প্রকৃতির অনুকৃতি নয়। কিন্তু প্রকৃতির মূল কথাকে পৌঁছে দেওয়া পটুয়া শিল্পের দায়িত্ব।
এইভাবে লেখক চলিত চিত্রকলার ‘সাধারণ বর্ণনা দিয়েছেন। এখানে ‘সাধারণ বর্ণনা’ বলতে লেখক পটুয়া শিল্পের রূপরেখা এঁকেছেন। এই রূপরেখার মধ্যে শিল্পের বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব ধরা পড়েছে। লেখক সাধারণভাবেই বর্ণনা করেছেন এই শিল্পের। এইজন্য লেখক এই ব্যাখ্যাকে ‘সাধারণ বর্ণনা’ বলেছেন।
Leave a comment