ভূমিকা: সাহিত্য সমাজ দেশ কাল ও তার ইতিহাস ঐতিহ্যের সামগ্রিক রূপে শিল্পিত রূপায়ণ যেখানে সাহিত্যিক তার নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে অবলোকন করেন। এ কারণে যেকোনো কালের সাহিত্য ধারণ করে সে কালের আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার স্বরূপ। সংগ্রাম বিপ্লব যেমন সমাজের স্বাভাবিক ধারাকে ব্যাহত করে পরবর্তীকালের স্পর্শ দেয় তেমনি সাহিত্যেও তার প্রভাব অনিবার্য। বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন পরবর্তীকালে পরিবর্তিত শিল্পায়নে রূপ নিয়েছে বিভিন্ন প্রণয়োপাখ্যান ও দেবদেবী সংলগ্ন মঙ্গলকাব্যে। মধ্যযুগে বাংলা সহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বিভিন্ন মুসলমান নৃপতি ও সামন্ত রাজা। পরবর্তীতে ইংরেজ শাসনামলে তাদের পতন ঘটলে সাহিত্যের রূপেও আসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।

আঠারো শতকে নবাবের পরাজয়ের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে বাংলায় যে আর্থসামাজিক পরিবর্তন সূচিত হয় তার অনিবার্য পরিণতিতে রাজধানী কলকাতাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে এক শ্রেণির নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও লাখেরাজ সম্পত্তির বাজেয়াপ্তের ফলে মুসলমান সমাজ তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি হারিয়ে হয়ে পড়ে হৃতসর্বস্ব। আর ইংরেজ শাসনের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় একদল হিন্দু রাতারাতি হয়ে উঠে প্রভাবশালী, বস্তুত এরাই নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি, বাংলা সাহিত্যের আধুনিক বাংলা সাহিত্য এ শ্রেণিরই পরবর্তী প্রজন্মের অবদান।

এ সময়ে পুরনো শাসনের অবসানের লক্ষ্যে মঙ্গলকাব্য, পাঁচালি গান ও বৈষ্ণব কবিতার গান কিছুকালের জন্য কবিয়ালদের উপর বর্তেছিল বটে তবে কলকাতার বাংলা গদ্য, সংবাদপত্রে ইউরোপীয় শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার ফলে স্বভাবতই রুচি ও পিপাসা প্রবলতর হয়ে উঠে।

উনিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগেই বাংলা সাহিত্যের মহাকাব্য, গীতিকাব্য, উপন্যাস, ছোটোগল্প ও নাটকের ক্ষেত্রে জন্মান্ত র ঘটে যায়। ঈশ্বরচন্দ্র, মধুসূদন, প্যারীচাঁদ প্রমুখ যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে তা পূর্ণতা পায়।

গোটা উনিশ শতকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরাজয়ের অপরিসীম বেদনায় মুসলমানরা অধিকাংশই ছিল স্বেচ্ছানির্বাসিত। ইংরেজ প্রশাসন ও ইংরেজ সাহিত্য বিমুখ এ মুসলমান শ্রেণি। হিন্দু মধ্যবিত্তের অগ্রসরমান জীবনধারণে ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের যুক্ত করেননি এবং পরিণামে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ও সমৃদ্ধির পর্বে তাদের কোনো ভূমিকার পরিচয় মেলেনি। তবে এক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হচ্ছে কায়কোবাদ ও মীর মশাররফ হোসেনের আবির্ভাব।

এছাড়া পূর্ববাংলার অধিকাংশ বাঙালি কৃষিজীবী হওয়ায় কলকাতার সাথে এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর কোনো যোগাযোগ ছিল না। তাই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে কিছু শিক্ষিত মধ্যবিত্তের দেখা মেলে বটে কিন্তু একটি সংগঠিত মুসলমান সমাজ তখনো উপেক্ষিত থেকে যায়। ১৮৬৬ সালে মোহামেডান লিটারারি সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পর বাঙালি মুসলমান ইংরেজি সাহিত্য ও সংস্কৃতির স্পর্শে আসে। তাই উনিশ শতকের শেষ দিকে বাঙালি শিক্ষিত মুসলমানদের সংযোগ স্বভাবতই বেড়ে যায় এবং এরা পরবর্তীতে সচেতন হয়ে উঠে। চাকরিক্ষেত্রে তারা নিজেদের জন্য বিশেষ সুবিধা দাবি করেন। বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ সুসংগঠিত এবং ১৯১২ সাল থেকেই এ সমাজের রাজনৈতিক চেতনাও বৃদ্ধি পায়।

মধুসূদনের কাব্যে হিন্দু মধ্যবিত্তের যে ঐশ্বর্যের দ্যুতি বিচ্ছুরিত হতে দেখি বরীন্দ্রনাথের সাধনায় তার পূর্ণতা পায়। রবীন্দ্রনাথ তুলনারহিত সংবেদনশীলতায় একটি সর্বভারতীয় জাতিসত্তা কল্পনা করেছিলেন। মধ্যবিত্তের মানসিকতাকে কাটিয়ে উঠে তিনি স্পষ্ট করেছিলেন গ্রামবাংলার মানুষের জীবনকে।

বাংলা সাহিত্যে অসহযোগ আন্দোলনের শক্তিশালী রূপকার কাজী নজরুল, হিন্দু পুরাণ ও মুসলিম ঐহিত্যের সমন্বয়ে এক সার্থক রূপায়ণ ঘটান তিনি। তাঁর সাহিত্যে তৎকালীন আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিলক্ষিত হয়।

বিশ শতকের তৃতীয় দশক থেকেই নজরুলের প্রতিভার মধ্য দিয়ে মুসলিম মধ্যবিত্তের সাহিত্য সাধনার উন্মেষ ঘটে তা মূলত কাব্যনির্ভর। সৃজন অথবা গল্পনির্ভর সাহিত্যে এ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ মেলেনি। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কাজী আব্দুল ওদুদ, হুমায়ুন কবির, কাজী ইমাদুল হক প্রমুখ।

দীর্ঘকাল একই দেশে বসবাস করলেও বাঙালি হিন্দু ও মুসলমানের জীবনাচরণ ছিল ভিন্ন ভিন্ন। ইংরেজ আমলে এ ব্যবধান আরো বেড়ে যায়। অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০) উভয় সম্প্রদায়ের সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল হলেও তা ছিল সাময়িক। নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতা ও গল্পে মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজকে একটি সম্ভ্রান্ত আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের পুনঃবিকশিত ধারার সাথে নজরুল ইসলামের মধ্যস্থতায় বাঙালি মুসলিম মধ্যবিত্তের যোগ ঘটেছিল।

তিরিশের দশক থেকেই কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ রাজনীতিতে পরস্পরের তীব্র প্রতিবাদী হয়ে উঠে। ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ যখন স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রয়োজনে লাহোর প্রস্তাব পেশ করেন তখন স্বসমাজের সর্বাঙ্গীণ যুক্তির কামনায় নতুন কদরের অভিযাত্রী হন ফররুখ আহমদ। আরবি ফারসি শব্দের ব্যবহার ইসলামি ঐহিত্যের সম্ভার ও মুসলিম মধ্যবিত্তের পৃথক আবাসভূমির প্রয়োজনীতার কথা তিনি তাঁর রচনায় তুলে ধরেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের মূল্যবোধের বিনষ্টি অথবা শূন্যতার প্রভাবে তিরিশের দশকের বাংলাদেশে ক্ষয়িষ্ণু হিন্দু মধ্যবিত্তের চৈতন্যে যে নৈরাশ্যের সূচনা কল্লোল যুগের কাব্য ও কথাশিল্পে তারই প্রতিচ্ছায়া। এ ভাব পরিমণ্ডল থেকে পৃথক ছিলেন ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ।

পৃথক ছিলেন ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ। ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কম্যুনিস্ট পার্টি। নজরুল ইসলামই প্রথম মার্কসবাদে দীক্ষিত কবি। তবে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে সমরসেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প, উপন্যাস মার্কসীয় তত্ত্ব আরো গভীরভাবে উন্নীত হয়। ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে ১৯৪৭ সালের পরবর্তী পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে যে মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ গড়ে উঠেছিল বস্তুত তারাই বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্রমবিকাশের ইতিহাস। নতুন রাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাহিত্য, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির পরিচয় কী হবে তা নিয়ে দেখা দেয় নানা মতান্তর। কবি গোলাম মোস্তফা এ সময় মতামত দেন যে যেহেতু নজরুলের কাব্যাদর্শের সাথে পাকিস্তানি আদর্শের সম্পৃক্ততা নেই, তাই নজরুল ইসলামের কবিতাবলির সংশোধনী পাকিস্তানি সংস্করণ প্রকাশিত হওয়া জরুরি।

সৈয়দ আলী আহসান বলেছিলেন যে, প্রয়োজন হলে রবীন্দ্র সাহিত্য বর্জন করেই রাষ্ট্রের সংস্কৃতি পরিকল্পিত হবে। কেননা সাহিত্যের চেয়ে রাষ্ট্রীয় সংহতি বড়ো।

কিন্তু এ দুটি অভিমতের মধ্যে ইংরেজ স্বাতন্ত্র্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। পক্ষান্তরে ইংরেজ বিদায়ের পর বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত মুসলিম সম্প্রদায় অতীত সামন্তবাদী চেতনা ও তিক্ততার স্মৃতি থেকে মুক্ত হয়ে উঠে। সামান্ততন্ত্রের অবসান এবং ইউরোপীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির অভিঘাতে উনবিংশ শতাব্দীর বাঙালি যেমন উদার মানবতাবাদে অভিষিক্ত হয়েছিল স্বাধীনতার উপলব্ধিতে এবং দেশীয় পুঁজির নিরঙ্কুশ বিকাশের সম্ভাবনায় পূর্ববাংলার নবীন মধ্যবিত্ত হয়ে উঠে উচ্ছ্বসিত।

উপসংহার: পরিশেষে বলা যায় যে, উনিশ শতকের শেষ পাদ থেকে যে সমাজ সংগঠনের সূত্রপাত প্রায় একশ বছরের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলেছিল তা এখন একটি সুস্পষ্ট পরিচয়ে চিহ্নিত। বাংলাদেশের সাহিত্য মূলত এ সমাজ সত্তারই অভিব্যক্তি। তাই গত ৩৫ বছর ধরে এদেশের বস্তুগত জীবনের যে বিবর্তন তাকে কেন্দ্র করেই বিকশিত হয়েছে আমাদের শৈল্পিক সাধনা।

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ উপরের লেখায় কোন ভুল থাকে তাহলে দয়া করে আমাদেরকে কমেন্ট করে জানাবেন আমরা সেটা ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করবো, ধন্যবাদ।