প্রশ্নঃ সামাজিক জরিপের ধাপগুলাে আলােচনা কর। বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় সামাজিক জরিপ পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা আলােচনা কর।

অথবা, বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় সামাজিক জরিপ পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধর।

ভূমিকাঃ সামাজিক ঘটনাবলি বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার জন্য গবেষকরা এই পদ্ধতিটি বেশ গুরুত্বের সাথে ব্যবহার করে থাকেন। বৃহত্তর গবেষণার ক্ষেত্রে জরিপ পদ্ধতির কোনাে বিকল্প নেই। এই পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহের জন্য প্রশ্নপত্র কৌশল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। উন্নয়নশীল দেশগুলােতে জরিপ পদ্ধতির প্রয়ােগের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায়। জাতীয় পর্যায়ের সমস্যা নির্ণয় ও সমাধানের জন্য জরিপ প্রত্যেক দেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শুধুমাত্র উন্নয়নশীল দেশেই নয়, উন্নত বিশ্বেও সামাজিক সমস্যা জানার জন্য জরিপ প্রক্রিয়া চালু রয়েছে।

সামাজিক জরিপের ধাপসমূহঃ নিম্নে এগুলাে সংক্ষিপ্ত আকারে আলােচনা করা হলাে-

(১) বিষয়বস্তু মনােনয়নঃ গবেষণা অনুসন্ধানের বিষয় সাধারণত বিষয়বস্তুকে বিস্তারিতভাবে নির্দিষ্ট করে। যা পেশাদার পরামর্শদাতার গবেষণা কার্যের জন্য বাস্তব উদ্দেশ্যাবলির পরিপ্রেক্ষিতে একটি আলােচনার বিষয়।

(২) সমস্যার বিস্তারিত ব্যাখ্যাঃ এই পর্যায়ে আলােচনার বিষয়বস্তু অনুসন্ধানের বিষয় আলােচনা, দলিল দস্তাবেজ, বিশ্লেষণ, স্থান পরিদর্শন বা অনুরূপ গবেষণায় কর্মরত ব্যক্তির সাথে আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা নির্দেশ করা যেতে পারে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে উত্তম নিরীক্ষণের জন্য গবেষণা এলাকায় একটি অগ্রবর্তী জরিপ চালানাের প্রয়ােজন হতে পারে।

(৩) জরিপ প্রশ্নাবলি প্রণয়নঃ এই পর্যায়ে একটি সাধারণ প্রশ্নাবলি প্রণয়ন করা হয় যার উত্তর জরিপ চলাকালীন সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। যেমন “সমগ্রকে আর্থ-সামাজিক বৈশিষ্ট্যসমূহ কী?” অথবা আরাে বেশি নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে” “সমগ্রকের আয়ের সহিত বসবাসের অবস্থার কী সম্পর্ক?”

(৪) জরিপ প্রশ্নাবলির ক্রিয়াপ্রণালীঃ তৃতীয় পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত জরিপ প্রশ্নাবলি সরাসরিভাবে জরিপে ব্যবহার করা যায় না। কৌশলে ব্যবহার এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায় এরূপ ধারায় এগুলােকে রূপান্তর করা উচিত। বিষয়বস্তুকে অবশ্য চিহ্নিত করতে হবে এবং তথ্যের উৎসসমূহের নির্দেশনা দিতে হবে। যদি উত্তরদাতা থেকে সরাসরি তথ্য সংগ্রহ করতে হয় তাহলে ভৌগােলিক এলাকা এবং জরিপ সমগ্রকের সংজ্ঞা প্রদান করা প্রয়ােজন। প্রকৃত তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি মনােনয়নে সক্ষম হবার জন্য তথ্যের যথার্থতা এবং নির্ভরশীলতা নির্দিষ্ট করা উচিত।

(৫) প্রাপ্তিসাধ্য সঙ্গতি লাভঃ তাত্ত্বিক পরিপ্রেক্ষিতে জরিপের নকশা, সময়, জনশক্তি এবং প্রয়ােজনীয় অর্থ ইত্যাদি দ্বারা এর উদ্দেশ্যাবলি, যথার্থতা এবং নির্ভরযােগ্যতা প্রভাবিত হয়। জরিপের জন্য সময়, অর্থ ও সহকর্মীবৃন্দ সচরাচর বাস্তব বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জরিপের নকশা ও বিশেষ তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি প্রয়ােজনীয় যথাযথ নির্ভরযােগ্যতা এবং প্রাপ্তিসাধ্য সঙ্গতির মধ্যে আপােষ করার ফলস্বরূপ।

(৬) তথ্য সংগ্রহের পদ্ধতি মনােনয়নঃ উপযােগী জরিপ পদ্ধতি মনােনয়ন দীর্ঘ নীতিমালার ওপর নির্ভর করে এই নীতিমালা উপস্থাপন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেননা নীতিমালার ওপর ভিত্তি করে গবেষণা কার্যটি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে।

(৭) তথ্য সংগ্রহ পদ্ধতি পরিকল্পনাঃ নকশা ও যতদূর সম্ভব পক্ষপাত-ত্রুটি এড়ানাের জন্য অত্যন্ত সাবধানের সাথে প্রত্যেক পদ্ধতির নকশা প্রণয়ন ও পরিকল্পনা করতে হবে। প্রশ্নমালা, জরিপের নীতিমালা পরিকল্পনা এবং নকশা প্রণয়ন পদ্ধতি তাই জরিপ পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

(৮) তথ্য সংগ্রহঃ তথ্য সংগ্রহ একটি সময়সাপেক্ষ ব্যাপার যা উত্তমরূপে তদারক করা প্রয়ােজন। তথ্য সংগ্রহ করার পর সেই তথ্যকে বিশ্লেষণ করে গবেষক প্রয়ােজনীয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয় এবং দিক নির্দেশনা প্রদান করে থাকে।

(৯) তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণঃ শুধু তথ্য সংগ্রহ করলেই হয় না, সেই তথ্যগুলােকে বিশ্লেষণ করার জন্য প্রক্রিয়াজাত করনের প্রয়ােজন পড়ে। এই পর্যায়ে কায়িক পরিশ্রমে এবং কম্পিউটারের সাহায্যে তথ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের মধ্যে যেকোনাে একটি বেছে নিতে হবে।

(১০) তথ্যের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যাঃ এই পর্যায়ে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করবার উদ্দেশ্যে তথ্যসমূহকে মূল মানে রূপান্তর করা হয়। মুলমানে রূপান্তর করার পড়ে, তার একটি ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়ে থাকে। সে ব্যাখ্যার ওপরই সামগ্রিক গবেষণার প্রতিফলন দেখা যায়।

(১১) ফলাফল উপস্থাপনঃ প্রত্যেক জরিপ পর্যায়ের ফলাফল চূড়ান্ত মানের ওপর বিস্তার করে। অনেক সময় প্রথম পর্যায় ডিঙ্গিয়ে যাওয়া হয়। ফলে মাঠকর্ম তাড়াতাড়ি শুরু হয়। এহেন অবস্থায় জরিপ প্রশ্নমালা সঠিকভাবে প্রয়ােগ করা যায় না। এবং খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। প্রারম্ভিক অবস্থায় তাড়াহুড়া করলে তথ্য সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণ উভয়ই সমস্যাভারে বিলম্বিত হয় এবং তা ঘােলাটে আকার ধারণ করে।

বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় সামাজিক জরিপ পদ্ধতির গুরুত্বঃ সামাজিক উন্নয়ন ও প্রগতির ক্ষেত্রে সামাজিক জরিপ এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। সামাজিক পরিকল্পনার জন্য বাস্তব অবস্থার জরিপ অপরিহার্য। অন্যথায় এই পরিকল্পনা কখনই বাস্তবমুখী হবে না এবং এর দ্বারা সামাজিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভবপর হবে না। জরিপভিত্তিহীন সামাজিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সামাজিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা অনেকটা অন্ধকারে হাতড়িয়ে বেড়ানাের সামিল। আমাদের মতাে উন্নয়নগামী দেশে সামাজিক জরিপের গুরুত্ব অপরিসীম।

বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় সামাজিক জরিপ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতাঃ সংগৃহীত তথ্যের সঠিকতা ও নিভরযােগ্যতার মধ্যেই সামাজিক জরিপের কার্যকারিতা নিহিত। যে বিষয়ে অনুসন্ধান করা হবে সে বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা না থাকলে সঠিক ও নির্ভরযােগ্য তথ্য লাভের সম্ভাবনা কমে যায়। ফলে জরিপের কার্যকারিতাও নষ্ট হয়ে যায়। জরিপ সময়ােপযােগী হওয়া বাঞ্ছনীয়। অর্থাৎ যখন তথ্যের প্রয়ােজন তখনই তথ্য সংগ্রহ করা আবশ্যক।

পরিশেষঃ পরিশেষ বলা যায় যে, বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় সামাজিক জরিপের ব্যবহার প্রায় সর্বত্রই লক্ষ্য করা যায়। দেশটি আকারে ছােট হলেও জনসংখ্যা কম নয়। এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে কম অর্থ ব্যয়ে, অল্পসময়ে এবং অল্প শ্রমে অনেক সময়ই বিভিন্ন ধরনের অ্যাকশন গবেষণা করতে হয়। তাই সামাজিক জরিপের সীমাবদ্ধতা যদি সতর্কতার সাথে মােকাবিলা করা যায় তাহলে এই পদ্ধতি বাংলাদেশের সমাজ গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে তাতে কোনাে সন্দেহ নেই।