বাংলাদেশের প্রকৃতি

ষড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রতি দুমাসে হয় একটি ঋতু। যেমন বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস দুটো হলাে গ্রীষ্মকাল। এরপর আষাঢ়-শ্রাবণ মিলে বর্ষাকাল। এভাবে ভাদ্র-আশ্বিন হচ্ছে শরৎকাল। তার পরে কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস দুটি হেমন্তকালের। পৌষ আর মাঘ মাস হলাে শীতকাল। ফারুন ও চৈত্র এ দু মাস বসন্তকাল।। এরকমভাবে ছয়টি ঋতুই প্রত্যেক বছর আসা-যাওয়া করে। পৃথিবীর সব দেশে কিন্তু দুই মাসে একটি ঋতু হয় না। অনেক দেশে দুটি, কি তিনটি ঋতু দেখা যায়। খুব বেশি হলে চারটি ঋতু। আমাদের প্রতিটি ঋতুতে প্রকৃতির রয়েছে নতুন নতুন সাজ। একেক সাজে তাকে নতুন মনে হয়, তার চেনা চেহারা বদলে যায়।

প্রথমে গ্রীষ্মের কথাই ধরা যাক। গ্রীষ্মে কী প্রচণ্ড গরম! রৌদ্রের অসহ্য তাপ। দুপুরে যদি পথে বের হতেই হয়, তখন মাথার ওপরে ছাতা ধরে লােকে হাঁটে। গরম যতই হােক, গ্রীষ্মকে ন্তুি মধুমাস বলা হয়। এসময় মধুর মতাে মিষ্টি নানা ফল পাওয়া যায়। আম, জাম, কাঁঠাল, আনারস ও লিচু গ্রীষ্মকালের ফল।

গ্রীষ্মের পর আসে বর্ষা। বর্ষায় আবার একেবারে অন্য চেহারা। আকাশ তখন কালাে ঘন মেঘে ছেয়ে যায়। বৃষ্টি পড়ছে তাে পড়ছেই। কখনাে বড় বড় ফোঁটায়, তবে ধীরে ধীরে। কখনাে হুড়মুড় করে। কখনাে পড়ছে ঝিরঝির করে, খুব হালকা। এ ধরনের বৃষ্টির একটা নাম আছে। একে বলা হয় ইলশেগুঁড়ি। আর বড় বড় ফোটায় প্রচুর বৃষ্টির নাম মুষলধারে বৃষ্টি। কখনাে আবার পড়ে ঝমঝম বৃষ্টি। নদীতে তখন ঢল নামে। বর্ষায় ফোটে কদম, কেয়া ও আরাে নানা ফুল। বর্ষার পর আসে শরৎ। শরৎ এলেই আবার সব পাল্টে যায়। শরৎকালে আকাশে সাদা মেঘ পেঁজা তুলাের মতাে ভেসে বেড়ায়। আকাশ হয়ে ওঠে ঘন নীল। এ সময় ফোটে শিউলি ফুল। নদীর পাড় সাদা কাশফুলে ভরে যায়।

শরতের পর পাকা ধানের শীষ নিয়ে আসে হেমন্ত। শুরু হয় ধান কাটা। এ সময় কৃষকের ঘর সােনালি ফসলে ভরে ওঠে। নবান্নের উৎসব ঘরে ঘরে আনন্দ নিয়ে আসে। হেমন্তের শেষ দিকে শীতের আগমন টের পাওয়া যায়। তখন ভােরবেলায় একটু একটু শীত লাগে। এ সময় উত্তুরে হাওয়া বয়। উত্তর দিক থেকে আসা এ হাওয়া খুব ঠাণ্ডা। শীতের রাতে লেপ-কাঁথা গায়ে দিয়ে ঘুমােতে হয়। দিনের বেলায়ও গরম কাপড় পরতে হয়। শীতে খেজুরের রস দিয়ে তৈরি হয় নানা পিঠাপুলি। গ্রামে পিঠা-পায়েস তৈরির ধুম পড়ে যায়।

যেই শেষ হলাে এ ঋতু, অমনি শুরু হয় বসন্তকাল। ফুরফুরে সুন্দর বাতাস বয়। বসন্তের দখিনা হাওয়ায় মন ভরে যায়। বসন্তে কোকিল ডাকে। কোকিলের ডাক বড়ই মিষ্টি। গাছে গাছে জেগে ওঠে নতুন সবুজ পাতা। নানা রঙের ফুলে ভরে যায় গাছ। বাংলাদেশে এই ছয়টি ঋতু এভাবে আসে-যায়। ষড়ঋতুর এত বিচিত্র, সুন্দর রূপ পৃথিবীর আর কোথাও নেই।

 

ভুমিকা:  বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশির বুক চিরে গাঙ্গেয় অববাহিকায় সগর্বে জেগে উঠা পৃথিবীর বৃহত্তম ব দ্বীপ আমাদের এ প্রিয় বাংলাদেশ। এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশত সত্তর বর্গ কিলোমিটারে উর্বর পলল-সমৃদ্ধ ছোট্ট এই দেশটি রূপবৈচিত্র্যের বিচারে পৃথিবীতে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। সাগরের গর্জন, অসংখ্য নদীর বহমানতা স্থলভাগের সবুজ শ্যামলিমা, সংস্কৃতিক স্বাতস্ত্র্য আর অতুলনীয় ঋতুবৈচিত্র্যের পটভুমিতে এদেশে যে অনুপম দৃশ্যের অবতারণা হয় তা মানুষ মাত্রকে মুহুর্তেই ভাবুক করে তোলে । তাই মনের অজান্তেই কবিমন গেয়ে উঠে। –

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।”

সমুদ্র সৈকত: বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। এ ছাড়া কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত বিশ্বের আকর্ষনীয় সমুদ্র সৈকতগুলোর একটি । বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এক অন্যন্য স্বাক্ষর এ দুটি সমুদ্র সৈকত। ফেনিল সাগরের সুনীল বুকে সূর্যোদয় ও সূর্যোস্তের যে মোহনীয় আবেশ এ দুটি সৈকত সৃষ্টি করে তা দেশি -বিদেশি পর্যটকদেরকে দুর্বার বেগে আকর্ষন করে। এ দুটি স্থানের নন্দনিক সৌন্দর্য প্রতিটি মানুষকে আবেশে উন্মনা করে দেয়।

নদ-নদী ও হাওর-বাঁওড়:  বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, মেঘনা, ঘমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদী সারাদেশে জলের মতো ছড়িয়ে থেকে এর রূপবৈচিত্র্যে সৃষ্টি করেছে এক অসাধারণ আমেজ। নদনদীর ভূমিকাতেই শস্য-শ্যামল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। মাঠের সবুজ , ফসলের হাসি, কিংবা বন- বনানীর শ্যামলতা নদনদীর জলধারার গৌরববেই প্রকাশ করে। নদীল বুকে পানকৌড়ি, গাংচিলসহ অসংখ্য পাখির জলকেলি আর সারি বেধে বয়ে চলা রং বেরঙের পালতোলা নৌকার দৃষ্টি নন্দন রূপ হৃদয় মনে এক অনির্বচনীয় আনন্দের সৃষ্টি করে। তদুপরি পালতোলা নৌকার উদাস মাঝি আনমনে যখন গেয়ে উঠে-

“মন মাঝি তোর বৈঠা নে-রে আমি আর বাইতে পারলাম না।”

তখন আমাদের হৃদয়ও যেন হারিয়ে যেতে চায় দূর অজানায় । অপরদিকে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জজুড়ে অবস্থিত চলনবিল এবং সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওরসহ অসংখ্য হাওর -বাওড় এদেশের পরিবেশ ওজীববৈচিত্র্যে বিশিষ্টতা দান করেছে। তাই আজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে সংরক্ষণে এ গুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল:  বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্থান পলিগঠিত বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল। উর্বর এ সমভূমি অঞ্চলে দৃষ্টিগোচর হয় সবুজের সমারোহ। সমুখের বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় এ যেন সবুজের বিশাল সমুদ্র। শস্যসম্ভবা তৃণরাশি যখন মৃদুমন্দ বাতাসে আলোড়িত হয় তখন মনে হয় সবুজ ঊর্মিমালা ধেয়ে যাচ্ছে দিগন্তের পানে। আর এমনই কোনো অপরূপ মুহুর্তে কবিমন অকস্মাৎ গেয়ে উঠে-

“ধানের ক্ষেতে বাতাস নেচে যায় দামাল ছেলের মতো ডাক দে বলে আয়রে তোরা আয় ডাকব তোদের কত।”

পাহাড়িয়া অঞ্চল: পাহাড়িয়া অঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধতর করেছে। এ অঞ্চলটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ , সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে বিস্তৃত।ময়মংসিংহের মধুপুরের গড়, গাজীপুরের ভাওয়ালের গড় ও কুমিল্লা লালমাই পাহাড় যেন অপার সৌন্দর্যের আধার। এ  ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া অঞ্চল, গারো পাহাড়ের পাদদেশ ও সিলেটের সবুজে ছাওয়া বিস্তীর্ণ চা বাগানসহ সমগ্র পাহাড়িয়া অঞ্চল জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ।

পল্লি প্রকৃতি: বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ। এখানে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। প্রকৃতির অপরূপ রূপবৈচিত্র্য গ্রামবাংলাকে ঋদ্ধ করেছে। গ্রামের সৌন্দর্য অকৃত্রিম। যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজ মাঠ আর সোনালি শস্যের কাকচক্ষু জলে ফুটে থাকা শাপল কিংবা পদ্মের সৌন্দর্য মানুষকে মুদ্ধ করে। ক্লান্ত রাখালের অপূর্ব বাশিঁর সুর দশদিক আলোড়িত করে। চিরন্তর গ্রামবাংলার এই নয়নাভিরাম স্যেন্দর্য মুগ্ধ কবি গেয়ে উঠেছেন-

“অবিরিত মাঠ, গগন ললাট্, চুমে তব পদধুলি ছায়া সুনিবিড় .শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলি পল্লব ঘন আম্র কানন রাখালের খেলাগেহ স্তব্ধ অতল দীঘি কালো জল নিশীখ শীতল স্নেহ।”

ঋতুবৈচিত্র্য:  পৃথিবীর অধিকাংশ দেমের চারটি ঋতু পরিলক্ষিত হয়। এগুলো গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। কিন্তু বাংলাদেশে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঋতু হিসেবে বর্ষা ও শরৎসহ মোট ছয়টি ঋতুর আবির্ভাব ঘটে। আর প্রটিটি ঋতু প্রকৃতিতে বিচিত্র রূপমাধুর্যের সৃষ্টি করে। বছরের শুরুতে নতুনের বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে গ্রীষ্মের। এর আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ, বিবর্ণ ও বিশুষ্ক হয়ে উঠে। হারিয়ে যায় সবুজ প্রকৃতির শ্যামর শোভা । ভয়াল রুদ্র রূপ নিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে আসে কালবৈশাখী। প্রকৃতিকে নবরূপে সজ্জিত করার জন্যই বুঝি গ্রীষ্মের এই দুর্দান্ত আগমন। অতঃপর বজ্রের কাড়া-নাকাড়া বাড়িয়ে, বিদ্যুতের পতাকা উড়িয়ে বর্ষা আসে দিগি¦জয়ী যোদ্ধার মতো। প্রকৃতির সমগ্র অবয়বে বর্ষা আনে এক সতেজ কোমলতা। বৃষ্টির অঝোর ধারায় গাছে গাছে, পাতায় পাতায় লাগে শিহরণ, জাগে সজীবতা,। আর এই সজীবতা দোলা দেয় মানব মনকেও। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

“এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।”

বর্ষা যখন অলস মন্থর, একঘেয়েমি আর বিষন্ন বিধুর নিঃসঙ্গতায় রূপন্তরিত হয় ঠিক সেই মুহুর্তে মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলতে হালকা চপল ছন্দে শরৎ আসে। এ যেন একটু মেঘ, এক পশলা বৃষ্টি , এক ঝলক হাওয়া আর পারক্ষনেই সোনালি রোদ্দুর । এ সময় বাতাসে এক খুশির সুর বেজে উঠে। এরপর আসে হেমন্ত । সাঁঝের পর হালকা কুয়াশায় জোনাকির মিটিমিটি জ্বলার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায় এ ঋতুতেই। এই আলো -আঁধারি কুয়াশা গায়ে মেখেই বড় কুন্ঠিত পদক্ষেপে সমৃদ্ধি নিয়ে কৃষকের দুয়ারে আবির্ভূত হয় হেমন্ত। হেমন্তের উৎসবমুখর গ্রমাবাংলার হিমেল পরশ বুলিয়ে একদিন শীত আসে। প্রকৃতি এ সময় যেন সমস্ত সাজ সজ্জা ফেলে দিয়ে রিক্ত রৈাগীল রূপ পরিগ্রহ করে। অপরদিকে বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের ফুলে ফুলে প্রকৃতির আচঁল ভরে উঠে। অবশেষে মাঘের তুহিন শীতল বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে সুসজ্জিতা ফাগুন , আসে বসন্ত তার রাজসিক রুপমাধুর্য নিয়ে । সবুজ কিশলায় বিকশিত হয় পত্রহীন শূণ্য বৃক্ষশালা। অশোক পলাশ কৃষ্ণচুড়া আর শিমুলের বনে যেন আগুন লাগে রক্তরঙিন ফুলের । এভাবে ছয়টি ঋতুর পালাবদলে বাংলার প্রকৃতি হয়ে উঠেছে রুপমাধুর্যের এক অপরুপ লীলাকেন্দ্র।

উপসংহার: সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশের অপরুপ সৌন্দর্য পৃথিবীখ্যাতে। এদেশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সৌন্দর্যপ্রেমীরা যেমন ঘর ছেড়েছে, তেমনি বিদেশি পর্যটকেরাও ছুটে এসেছে। প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্য মানুষের মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে, যা যুগে যুগে বাংলায় কালজয়ী গীতি-কাব্য সাহিত্য সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে। বাংলার তুলেছে। আর এজন্যই বাংলাদেশে পৃথিবীর অন্যতম সুরম্য লীলা নিকেতন।

 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

ভূমিকা

বাংলাদেশকে প্রকৃতির লীলানিকেতন বলা হয়। লীলাময়ী প্রকৃতি মুক্তহস্তে আপন সৌন্দর্য দান করে এ দেশকে অপরূপ সাজে সজ্জিত করেছে। নদী নালায় শস্যসম্পদে ঋতু বৈচিত্র্যে সবুজের সমারোহে পরিপূর্ণ এমন সুন্দর দেশ পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি না সন্দেহ।

 

গ্রামবাংলার দৃশ্য

বাংলাদেশ মূলত গ্রামবহুল দেশ। আটষট্টি হাজার গ্রাম নিয়ে এ দেশ গঠিত। গ্রামের শস্যশ্যামল ক্ষেত তৃণাচ্ছাদিত উন্মুক্ত প্রান্তর পুষ্পপল্লবে ঘেরা ঝোপঝাড় বৃক্ষরাজির সুনিবিড় ছায়া নানা প্রকার পাখীর কলতান আম জাম কাঁঠালের কুঞ্জবন প্রভাতের স্নিগ্ধ সূর্যকিরণ গোধূলির স্তব্ধ গাম্ভীর্য সত্যই আমাদেরকে মুগ্ধ না করে পারে না। মোটকথা গ্রামবাংলার এমন শান্ত স্নিগ্ধকমনীয় রূপ পুষ্পমঞ্জরীতে পরিপূর্ণ এমন মানুষমণ্ডিত সুন্দর পরিবেশ সত্যই দুর্লভ।

 

পল্লির প্রাকৃতিক দৃশ্য

হাজারো গ্রামের সমন্বয়ে গড়ে উঠা বাংলার পল্লি প্রকৃতি রাণীর বাসর ঘর সদৃশ। জ্যোৎস্না গ্লাবিত রাতে প্রকৃতি যেন সবুজ পাড় সম্বলিত তারকার বুটি দেওয়া নীলাম্বরী শাড়ি পরে এবং পুষ্পমাল্য শোভিত কণ্ঠে মনোলোভা রূপ সমেত পল্লির বাসর ঘরে প্রিয়জনের আগমন প্রতীক্ষায় চাঁদের প্রদীপ হাতে পথপানে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। পল্লির অগণিত মাঠ ঘাট ত্রিকালের সাক্ষী বটবৃক্ষের ছায়া তৃণগুলা শোভিত অরণ্যানীর মাধুরী শস্যক্ষেতের শ্যামলিমা ইত্যাদির অনির্বচনীয় সৌন্দর্য এবং সুদূর হতে ভেসে আসা রাখালের বাঁশির সুর দেশি বিদেশি সবারই হৃদয় মন হরণ করে।

 

নদ নদীর দৃশ্য

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদ নদী খাল বিল এখানে জালের মত ছড়িয়ে আছে। পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্রহ্মপুত্র ইত্যাদি স্রোতস্বিনী এর বুকে সদা চঞ্চলা বালিকার মত লীলায়িত ভঙ্গিতে ছুটে চলেছে। এসব নদীতীরের দৃশ্য অতীব মনোরম। এদের বুকে অসংখ্য নৌকা পাল তুলে লঞ্চ ষ্টীমার ইত্যাদি বাষ্পীয় যান ধূম উদ্‌গীরণ করে যখন দ্রুতগতিতে ধাবিত হয় তখন নদীর জলধারা তরঙ্গায়িত হয়ে এক অপরূপ শোভার সৃষ্টি করে। নদীবক্ষে পতিত জ্যোৎস্নার রূপালী আলোর মেলা আমাদের চোখ জুড়িয়ে দেয়।

 

ঋতু বৈচিত্র্য

বাংলার ষড়ঋতু লক্ষ্য করার মত। গ্রীষ্মের খররৌদ্রে এর শান্ত ও সৌম্য রূপ দুর্দান্ত আবেগে ফেটে পড়ে। কাল বৈশাখীর প্রচণ্ড তান্ডবে আমাদের সবকিছু তছনছ হয়ে যায় । আঁধারের যেমন একটি রূপ আছে এ রুদ্র প্রকৃতিরও তেমনি একটি বিশেষ রূপ আছে। প্রকৃতির শক্তির কাছে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ে। বর্ষার বারিধারার সাথে সাথে প্রকৃতির এ অশান্ত রূপ পরিবর্তিত হয়ে সৌম্য ও শান্ত রূপ ধারণ করে। আকাশ তখন ঘন মেঘে ঢেকে যায়, গুরুগম্ভীর মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের চোখঝলসানো আলোর মাঝে নেমে আসে বর্ষার অবিরল ধারা, নদনদী কানায় কানায় পূর্ব হয়। মাঠঘাট প্লাবিত হয়। বনলতা, বৃক্ষরাজি আবার নতুন পত্রপল্লবে সুশোভিত হয়। আসে শরৎ তার শিশির ও শেফালি ফুলের ডালি নিয়ে। শুভ্র হাল্কা মেঘ তখন আকাশে ইতস্ততঃ ভেসে বেড়ায়। জলে কুমুদদল মনের আনন্দে খেলা করতে থাকে। আসে হেমন্ত । তখন আকাশ বাতাস শুভ্র রূপ ধারণ করে। কৃষকের ক্ষেত থামার শস্যে পরিপূর্ণ হয়। হেমন্তের পরে আসে শীত। শীতে প্রকৃতি মলিন ও আড়ষ্ট ভাব ধারণ করে। সর্বশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। ফুলের মনমাতানো সৌরভে চারদিক মোহিত হয়। কোকিলের কুহু রবে কুঞ্জবন মুখরিত হয়। মৃদু মন্দ সমীরণ আমাদের হৃদয় মনকে সাব ও সতেজ করে তোলে। এভাবে বার মাস ধরে এদেশে ষড়ঋতুর বিচিত্র লীলা চলতে থাকে।

 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অবস্থান

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। বাংলাদেশের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। এজন্য বাংলাদেশের জলবায়ু মােটামুটি সমভাবাপন্ন। মৌসুমি বায়ুর প্রভাব দেশের জলবায়ুর ওপর এত বেশি যে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঋতুতে জলবায়ুর কিছুটা তারতম্য লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪° সেলসিয়াস এবং শীতকালীন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ০৭° সেলসিয়াস। এ দেশের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় ২০৩ সেন্টিমিটার। পশ্চিমাংশ অপেক্ষা পূর্বাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশের মােট বৃষ্টিপাতের পাঁচ ভাগের চার ভাগই বর্ষাকালে হয়ে থাকে। শীতকালে উত্তর-পূর্ব শুষ্ক মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশের উত্তরে ভাওয়াল ও মধুপুর গড়। গেরুয়া রঙের মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গজারি গাছ। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর সুন্দরবন। পূর্বে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সাজানাে চা বাগান। এরই মাঝে বিশাল সব ছায়াবৃক্ষ। পশ্চিমে ধু ধু প্রান্তর। প্রকৃতির রুক্ষতার মাঝেও এখানে দেখা যায় সারি সারি আম্রকানন আখের খেত কিংবা পানের বরজ। বাংলাদেশের সুন্দরবন সুন্দরী গাছের জন্য বিখ্যাত। কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৈকত। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকাজুড়ে সীমাহীন সৌন্দর্যের সমাবেশ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আদিবাসীদের বসবাস। হাতে গােনা শহরগুলাে বাদ দিলে বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। গ্রামের সৌন্দর্যে কোনাে কৃত্রিমতা নেই। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। প্রকৃতিগত অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশকে সমৃদ্ধিশালী দেশ বলা যায়।

 

বাংলাদেশের মাটি

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছােট বড় অসংখ্য নদী এদেশে জালের মতাে ছড়িয়ে আছে। প্রতিবছর বন্যায় এ নদীগুলাে পলিমাটি বহন করে। আর এ কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল পলিমাটি দিয়ে গঠিত। পলি মাটির উর্বরতার কারণে এদেশে ভালাে ফসল জন্মায়। এদেশের প্রায় অধিকাংশ অঞ্চলে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন করা হয়।

 

বাংলাদেশের তাপমাত্রা

বাংলাদেশ নাতিশীতােষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত। এদেশের ওপর দিয়ে ক্রান্তীয় মৌসুমি বায়ু বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় প্রবাহিত হয়। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪৫° সেলসিয়াস এবং শীতকালে ১৫ থেকে ২৫° সেলসিয়াস থাকে। এদেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বেশি শীত ও এপ্রিল মে মাসে গরম বেশি থাকে। তবে প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের কারণে যেভাবে সমস্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আমাদের দেশেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

 

জলবায়ু

মৌসুমি বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে বছরের অধিকাংশ সময়ই প্রবাহিত হয়। ফলে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তিত হয়। গ্রীষ্মকালে এদেশে দক্ষিণ পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। এ বায়ু প্রচুর জলীয় বাষ্প বহন করে। ফলে গ্রীষ্মের শেষে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।

 

ঋতুভেদে প্রাকৃতিক দৃশ্যের ভিন্নতা

আবির্ভূত হয়। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদে খাল বিল শুকিয়ে যায়। এ সময় প্রকৃতি বুদ্ৰ বুক্ষ ভয়াল মূর্তি ধারণ করে কালবৈশাখীর ভাঙলীগায় বছরের সঞ্চিত ক্লেদ গ্লানি ও জঞ্জালকে সুদূরে উড়িয়ে নিয়ে যায়। গ্রীষ্মের অবসানে মেঘের পাহাড় নিয়ে ও ঢাক ঢোল কলিয়ে মহাসমারোহে নেমে আসে বর্ষা। আকাশে চলে বজ্র বিদ্যুতের তাণ্ডব নৃত্য। শুরু হয় অবিরাম বারিবর্ষণ। মাঠ ঘাট নদী নালা তলিয়ে যায় অথৈ পানির নিচে। দিকে দিকে নানাবিধ ফুল প্রস্ফুটিত হয়ে প্রকৃতিকে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলে।বর্ষার অবসানে কাঁচা সোনা রঙ গায়ে মেখে আবির্ভূত হয় সোনালি শরৎ ছড়িয়ে পড়ে রকমারি ফুলের মন মাতানো সৌরভ। শারদ প্রকৃতির নয়নাভিরাম দৃশ্য বাঙালির হৃদয়ে বুলিয়ে দেয় প্রশান্তির মৃদু মলয়। হেমন্তের আগমন ঘটে হৈমন্তির ধানের হেমহাসি নিয়ে। প্রকৃতির অঙ্গে অঙ্গে দেখা দেয় যৌবনের পূর্ণ দীপ্তি। শীতকালে প্রকৃতি শুষ্ক শীর্ণ ও বিবর্ণ হয়ে যায়। তরুলতা ও গুল্বরাজি সবুজ পোশাক পরিত্যাগ করে বিধবার সাজ পরে।শীতের অবসানে রূপ বৈচিত্র্যের ডালি হাতে আবির্ভূত হয় ঋতুরাজ বসন্ত। বসন্তের আগমনে প্রকৃতিতে রূপ লাবণ্যের জোয়ার বয়ে হয়। প্রকৃতি নবযৌবন লাভ করে। পত্র পুষ্পে নববধূর সাজে সজ্জিত হয় গোটা বিশ্ব প্রকৃতি। ভ্রমরের গুঞ্জনে কোকিলের কুণ্ডতানে নদীর কূল কূল ধ্বনিতে বসন্তের স্তুতিবাদ ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়ে গোটা বিশ্বকে মুখরিত করে তোলে!

 

বাংলাদেশের প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যতা

প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্যের রূপ ছড়িয়ে আছে গােটা দেশ জুড়ে। তবে অঞ্চলভেদে বৈচিত্র্যও আছে। শাল মহুয়ার ঘন বীথি ঝিলিমিলি ঝিল আর বিশাল বিল প্রকৃতিকে করেছে ঐশ্বর্যশালী ও লাবণ্যময়। পশ্চিম অঞ্চলের অবারিত প্রান্তর, বালুময় পথঘাটে আছে ধূলিধূসর রুক্ষতা। তবে মাঠের পর মাঠ আখের ক্ষেত আম বাগান ও পানের বরজ আছে। সেখানেও দিগন্ত জুড়ে সবুজ শ্যামলিমা। পূর্বাঞ্চলে নীলাভ পাহাড়ের ঢালে বিছানাে চায়ের বাগানগুলাে যেন সবুজ সিঁড়ির ধাপ দিয়ে সাজানাে। তারই ফাঁকে ফাঁকে ছায়াবীথির বিস্তার। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পাহাড়ি নদীর বুকে ঢলে পড়া সূর্যের আভা রঙের কারুকাজ ফুটিয়ে তােলে। মধুপুর ও ভাওয়াল অঞ্চলের প্রকৃতিতে রয়েছে ভিন্নতর দৃশ্যপট। সেখানে গেরুয়া মাটিতে সারি সারি গজারি গাছের বিস্তার। আর দক্ষিণের উপকূল জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। সেখানে রয়েছে চির সবুজ পাতার টোপর পরা পল্লবঘন তরুবীথি। আর সেখানেই বসতি পেতেছে ডােরাকাটা বাঘ আর চিত্রল হরিণেরা। দক্ষিণের সুনীল সাগরের বুকে ভেসে থাকা দ্বীপাঞ্চলে রয়েছে আর এক ধরনের চিত্র।সেখানে প্রকৃতির দৃশ্যপট তৈরি করেছে তাল নারকেল সুপুরির বাগান। বেত শােলা কেওড়ার বন আর প্রান্তর জোড়া ধানক্ষেত। সেখানে ঘর বেঁধেছে। সংগ্রামে দুর্জয় মানুষেরা। জলােচ্ছ্বাসের মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে তারা বাঁচে আর সমুদ্র শান্ত থাকলে তারা বাঁচে সাগরের সঙ্গে মিতালি করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উপমহাদেশের এ দেশটি তাই মন মাতানাে দৃষ্টিনন্দন এবং কবি লেখক তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। এর সৌন্দর্যে বিভাের হয়ে কবি পেয়েছে ভাষা মানুষ পেয়েছে আশা। পর্যটক চোখ খুলে মন ভরে উপভােগ করে এর সৌন্দর্য মেটায় অন্তরের তৃষ্ণা। এর অনুপম নৈসর্গিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উপভােগের জন্য বাংলাদেশ যুগে যুগে হাতছানি দিয়েছে কাছের ও দূরের ভ্রমণপিপাসুদের। অনেকেই তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় প্রশক্তি গেয়েছেন বাংলাদেশের মনলােভা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের।

 

বনভূমি ও পাহাড়

পৃথিবীর সবচেয়ে বড়াে ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া এ বন নানা জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে নানা বৃক্ষরাজিতে শােভিত গভীর রহস্যে ভরা। পাহাড়িয়া অঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধতর করেছে। এ অঞ্চলটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ সিলেট চট্টগ্রাম পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বান্দরবান অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। ময়মনসিংহের মধুপুর ও গাজীপুরের ভাওয়ালের গড় কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের বনাঞ্চল যেন অপার সৌন্দর্যের আধার। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া অঞ্চল গারাে পাহাড়ের পাদদেশ ও সিলেটের সবুজে সবুজে ছাওয়া বিস্তীর্ণ চা বাগানসহ সমগ্র পাহাড়িয়া অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ।

 

নদ নদী ও হাওর বাঁওড়

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর নদী নালা হাওড় বাওড় খাল বিল সব মিলে৷ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এক বিচিত্র রূপের অপূর্ব সমারােহ। পদ্মা মেঘনা যমুনা ব্রহ্মপুত্র তিস্তা আড়িয়াল খাঁ কর্নফুলী আর বুড়িগঙ্গা যার বুকে ভেসে থাকা রংবেরঙের পাল তােলা সারিসারি নৌকার অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন রূপ বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও মােহনীয় ও আকর্ষণীয় করে তােলেছে। অপরদিকে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জুড়ে অবস্থিত চলনবিল এবং সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওড়সহ অসংখ্য হাওড় বাওড় এদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বিশিষ্টতা দান করেছে। তাই আজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগুলাে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

 

বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল

বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চল পলিগঠিত বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল। উর্বর এ সমভূমি অঞ্চলে দৃষ্টিগােচর হয় সবুজের সমারােহ। সবুজ মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় এ যেন সবুজের বিশাল সমুদ্র। শস্যসম্ভবা সবুজ শ্যমলিমা যখন মৃদুমন্দ বাতাসে আলােড়িত হয় তখন মনে হয় সবুজ উর্মিমালা বুঝিব ধেয়ে যাচ্ছে দিগন্তের পানে।

 

সংস্কৃতি

হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গড়া এ দেশ। এ দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এর রূপমাধুর্যে যেন একটি স্বতন্ত্র মাত্রা যােগ করেছে। বাংলা বর্ষবরণ ও বসন্তবরণের মতাে অনুষ্ঠানগুলাে আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এগুলাে রঙ রূপ ও বৈচিত্রে সমকালীন প্রকৃতির অনুরূপ। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশে এগুলাে ভিন্ন ও রােমাঞ্চকর আমেজ সৃষ্টি করে। ফলে সুপ্ত মনের পাতায় পাতায় মনের অজান্তেই আমরা এঁকে যাই প্রকৃতির ছবি লিখি কবিতা গেয়ে উঠি গান। মন হারিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়।

 

প্রাকৃতিক বিপর্যয়

বাংলাদেশের প্রকৃতি কখনাে কখনাে ধ্বংসাত্মকরূপে আবির্ভূত হয়। গ্রীষ্মের আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ ও বিবর্ণ হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড তাপে হারিয়ে যায়, সবুজ প্রকৃতির অপরূপ শ্যামল শােভা। ফেটে চৌচির হয়ে যায় ফসলের মাঠ শুকিয়ে যায় নদী চারিদিকে কেবল ধু ধু হাহাকার। ভয়াল রুদ্র রূপ নিয়ে হাজির হয় কালবৈশাখি। এটি উড়িয়ে নিয়ে যায় আমাদের বাড়িঘর ভেঙে ফেলে গাছপালা। প্রচণ্ড গরমে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে। মানুষ তখন চাতক পাখির ন্যায় আকাশ পানে চেয়ে থাকে। বর্ষাকালেও প্রকৃতি মাঝে মাঝে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। বন্যা জলােচ্ছাসের ফলে মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ভােগ করতে হয়। উপকূলবর্তী মানুষের সাথে প্রকৃতি সবসময় বৈরী আচরণ করে। জলােচ্ছাসের সাথে তাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। অতিরিক্ত বন্যায় গবাদি পশুর অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। শীতকালে আমাদের দেশের গরিব মানুষদের দুঃখের সীমা থাকে না। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষদের বেশি শীতের কষ্ট সহ্য করতে হয়। শীতে বৃদ্ধ ও শিশুদের বেশি কষ্ট হয়ে থাকে। নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সময় কাটাতে হয়।

 

উপসংহার

বাংলার ছায়াঘেরা পল্লী তৃণাচ্ছাদিত মাঠঘাট আম জাম কাঁঠালের কুঞ্জবন তাল নারকেল সুপারি বৃক্ষের সারি পুকুর দীঘি জলাশয় ইত্যাদি এক মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি করে। কবির ভাষায়

অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে পদধূলি ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি
পল্লবঘন আম্র কানন রাখালের খেলাগেহ স্তব্ধ অতল দীঘি কালোজল নিশীথশীতল স্নেহ।
তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় বাংলার প্রাকৃতিক দৃশ্য অপূর্ব। পৃথিবীর কোন দেশের সাথে এর সৌন্দর্যের তুলনা হয় না।

 

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য (১৬ পয়েন্ট)

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অপরুপা। যেন দু’চোখ ঝুড়িয়ে যায়। ছয় ঋতুর দেশ এই রুপসি বাংলাদেশ। প্রিয় ৬ ৭ ৮ ৯ ১০ ১১ ১২ শ্রেণির বন্ধুরা আজকের রচনাটি খুবই সহজ ও সাবলিল ভাষায় প্রায় ১৬ টি পয়েন্ট দিয়ে সাজিয়েছি। আশা করি তোমাদের ভালো লাগবে। 

ভূমিকা

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরুপ লীলাভূমি এই বাংলাদেশ। অপরুপা এ দেশের সবুজ বন বনানী, সুবিশাল ম্যানগ্রোভ বনরাজি, নদনদী, শ্যামল পাহাড়, বিস্তীর্ণ সমুদ্র সৈকত, প্রাচীন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভ্রমণ পিপাসু উৎসাহী মানুষকে আকৃষ্ট করে আসছে। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে দু’চোখ ঝুড়িয়ে যায়। তাই রূপমুগ্ধ, বিষয়-পুলকিত কবি তার আবেগ-স্নিগ্ধ উচ্চারণে বাংলাকে বলেছেন-‘রূপসি বাংলা’। ছয় ঋতুর দেশ এই রুপসি বাংলাদেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইল দেশটি যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মিউজিয়াম। সবুজ শ্যামল প্রকৃতির জন্যে এর প্রশংসা যুগ যুগ ধরে কবিদের বাণীতে উচ্চারিত হয়েছে। তাইতাে কবি বলেন-

এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক অবস্থান

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ। বাংলাদেশের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে কর্কটক্রান্তি রেখা চলে গেছে। এজন্য বাংলাদেশের জলবায়ু মােটামুটি সমভাবাপন্ন। মৌসুমি বায়ুর প্রভাব দেশের জলবায়ুর ওপর এত বেশি যে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের জলবায়ু ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ু নামে পরিচিত। বিভিন্ন ঋতুতে জলবায়ুর কিছুটা তারতম্য লক্ষ করা যায়। বাংলাদেশের গ্রীষ্মকালীন সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৪° সেলসিয়াস এবং শীতকালীন সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ০৭° সেলসিয়াস। এ দেশের বার্ষিক বৃষ্টিপাতের গড় ২০৩ সেন্টিমিটার। পশ্চিমাংশ অপেক্ষা পূর্বাংশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বর্ষাকালে আমাদের দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বাংলাদেশের মােট বৃষ্টিপাতের পাঁচ ভাগের চার ভাগই বর্ষাকালে হয়ে থাকে। শীতকালে উত্তর-পূর্ব শুষ্ক মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয় বলে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। বাংলাদেশের উত্তরে ভাওয়াল ও মধুপুর গড়। গেরুয়া রঙের মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি গজারি গাছ। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর আর সুন্দরবন। পূর্বে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সাজানাে চা-বাগান। এরই মাঝে বিশাল সব ছায়াবৃক্ষ। পশ্চিমে ধু-ধু প্রান্তর। প্রকৃতির রুক্ষতার মাঝেও এখানে দেখা যায় সারি সারি আম্রকানন, আখের খেত কিংবা পানের বরজ। বাংলাদেশের সুন্দরবন সুন্দরী গাছের জন্য বিখ্যাত। কক্সবাজারের সমুদ্র উপকূল বিশ্বের সর্ববৃহৎ সৈকত। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল এলাকাজুড়ে সীমাহীন সৌন্দর্যের সমাবেশ। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ আর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আদিবাসীদের বসবাস। হাতে গােনা শহরগুলাে বাদ দিলে বাংলাদেশ গ্রামপ্রধান দেশ। গ্রামের সৌন্দর্যে কোনাে কৃত্রিমতা নেই। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু মাঠ আর মাঠ। প্রকৃতিগত অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশকে সমৃদ্ধিশালী দেশ বলা যায়।

বাংলাদেশের মাটি

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। ছােট-বড় অসংখ্য নদী এদেশে জালের মতাে ছড়িয়ে আছে। প্রতিবছর বন্যায় এ নদীগুলাে পলিমাটি বহন করে। আর এ কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ অঞ্চল পলিমাটি দিয়ে গঠিত। পলি মাটির উর্বরতার কারণে এদেশে ভালাে ফসল জন্মায়। এদেশের প্রায় অধিকাংশ অঞ্চলে বছরে তিনবার ফসল উৎপাদন করা হয়।

বাংলাদেশের তাপমাত্রা

বাংলাদেশ নাতিশীতােষ্ণ মণ্ডলে অবস্থিত। এদেশের ওপর দিয়ে ক্রান্তীয় মৌসুমি বায়ু বছরের প্রায় অধিকাংশ সময় প্রবাহিত হয়। ফলে বর্ষাকালে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা ৩৫ থেকে ৪৫° সেলসিয়াস এবং শীতকালে ১৫ থেকে ২৫° সেলসিয়াস থাকে। এদেশে ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে বেশি শীত ও এপ্রিল-মে মাসে গরম বেশি থাকে। তবে প্রাকৃতিক নানা বিপর্যয়ের কারণে যেভাবে সমস্ত পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে আমাদের দেশেও তার প্রভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে।

জলবায়ু

মৌসুমি বায়ু এ দেশের ওপর দিয়ে বছরের অধিকাংশ সময়ই প্রবাহিত হয়। ফলে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তিত হয়। গ্রীষ্মকালে এদেশে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয়। এ বায়ু প্রচুর জলীয় বাষ্প বহন করে। ফলে গ্রীষ্মের শেষে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ঋতুবৈচিত্র্য

উত্তরে হিমালয়, দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। পৃথিবীর মানচিত্রে এশিয়ার ছােট্ট, সবুজ ভূমি বাংলাদেশ। এর নদী-নালা, খাল-বিল, এর পাহাড়-টিলা, বন-বনানী, এর সমতল ভূমি মিলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া এক বিচিত্র রূপের অপূর্ব সমারোহ। প্রকৃতির রূপসী কন্যা আমাদের এই বাংলাদেশ। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তার ঋতুবৈচিত্র্যের মধ্যে চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। বার মাসে ছয় ঋতুর এদেশে প্রতিটি ঋতু তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে আগমন করে এবং নিজের অনাবিল সৌন্দর্য উপহার দিয়ে বিদায় নেয়। সারাটি বছর নব নব রূপের মধ্যে আমাদের বসবাস। প্রকৃতি পাল্টায়। আকাশ রং বদলায়। আমাদের মনের আকাশেও লাগে তার ছোঁয়া। বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ, অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ।

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্তের নিয়ত লীলা এর নিসর্গকে দিয়েছে বিচিত্র বিভূতি। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রােদ, ছাতিমের স্নিগ্ধ ছায়া, নদীর নীলাভ গহ্বর থেকে জেগে ওঠা বালুচরে খেয়ালি দুপুরে হঠাৎ হাওয়ার মাতম গ্রীষ্মের এই বাংলাদেশ বর্ষায় একেবারে ভিন্ন রকম। শুধু কুলছাপানাে কালাে জল, শুধু সারাদিন সারারাত গলে পড়ে আকাশ। গ্রীষ্মের বুকফাটা বাংলাদেশ বর্ষায় ফিরে পায় অকূল যৌবন। আসে শরৎ, ধীর, সজল, লাবণ্যময়। তার সাদা কাশফুল, স্বচ্ছ নীল আকাশে উড়ে যাওয়া বলাকার সারি আর রাত্রিভর অবিরাম, অকৃপণ নীলিমা তার পেয়ালা থেকে ঢেলে দেয় জোছনার সফেদ স্নিগ্ধতা। হেমন্তে পাকে ধান। বাংলাদেশের মুখে তখন মাতৃত্বের মহিমা। এর মধ্যে ঘাসের বুকে জমে ওঠে শিশির। শীত আসে। পাতা ঝরে। ভােরের বাঁকা রােদে ঘাসের ডগায় লেগে থাকা অসংখ্য শিশিরকণায় ঝলমল করে লক্ষ কোটি বাংলাদেশ।

তারপর বসন্ত। হাওয়া বয় দক্ষিণে। ফুলে ওঠে নৌকার পাল। বৃক্ষের বাকল চিরে বেরিয়ে আসে পাতা। রােদে তা পান্নার মতােই ঝলমল করে। রিপ ভ্যান উইঙ্কল -এর মতাে ‘এ দেশ যেন গাঢ় শীতার্ত রাত্রির দীর্ঘ সুপ্তি থেকে জেগে ওঠে।’ কড়ি ও কোমলে বাঁধা এর জলবায়ু, এর প্রকৃতি। যেমন প্রকৃতি, তেমনি সাহিত্য আর সংস্কৃতি। হেমন্তের ধানী রং উদাস অন্তরাগে যে মাঝি নদীজলে ভাসায় ডিঙি, দূর অচেনা গায়ে কোনােদিন না পাওয়া কলসি কাঁখের বধূটির জন্যে, গলায় তােলে সুর— বর্ষায় খরস্রোতা নদীতে দক্ষ হাতে সেই ধরে হাল।

বলিষ্ঠ মুঠিতে ধরে রাখে লাঙলের বাঁট — জেগে ওঠা চরে নিশীথে প্রতিধ্বনিত হয় তারই হুংকার। এদেশে যেমনি রয়েছে লালন-রবীন্দ্রনাথ, তেমনি নজরুল-মাইকেল। যেমনি নন্দলাল, তেমনি জয়নুল। যেমন আব্বাসউদ্দিন, তেমনি রমেশ শীল কিংবা অমর নট বুলবুল চৌধুরী। খােল-করতালের আদিবাসী উৎসবের পাশে এখানে সকাল-সন্ধ্যায় উচ্চারিত হয় শান্ত, আজান ধ্বনি, বাজে মন্দিরের কাঁসার ঘণ্টা। সুন্দরবনের ডােরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার আর গােখরার বিশাল ফণার নিচেই তাে এখানে বাস করে আয়তচোখ অসংখ্য হরিণ শিশু। তাই বলতে হয় –

রুপসি বাংলার বাংলাদেশ, রূপের যে তার নেইকো শেষ।

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

বাংলাদেশ প্রকৃতির নন্দনকাননের সৌন্দর্যমণ্ডিত কোনাে সার্থক চিত্রশিল্পীর নিখুঁত চিত্রকর্মের সঙ্গে তুলনীয়। ব-দ্বীপ সদৃশ এ বঙ্গভূমির রয়েছে বিচিত্র ভূভাগ এবং সমুদ্র শুনিত বিস্তীর্ণ উপকূল। সমুদ্র তটরেখা ও ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন যা অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার। এখানে আছে সমান্তরাল ভূমি, পাহাড়-পর্বত, জলপ্রপাত, চা-বাগানের আহামরি দৃশ্য, সবুজ গালিচার মতাে শস্য ক্ষেত, মাঠ-প্রান্তর। আর বিশেষ করে মাকড়সার জালের মতাে ছড়িয়ে আছে রূপালি সব ছােট বড় নদনদী। এছাড়া আমাদের এই সবুজ শ্যামল বাংলার প্রকৃতি জুড়ে ছয় ঋতুর অপরূপ খেলা চলে বছর জুড়ে। বাংলাদেশের প্রকৃতি যেন বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের খনি। এর রৌদ্রময় উজ্জ্বল দিন, স্নিগ্ধ জোৎস্নাময় রাত, দিগন্ত জোড়া ছায়াঘন বন-বনানী, কত না নদীর রুপালি ঢেউয়ের হাসি ইত্যাদির তুলনা নেই। এ দেশের কাজলকালাে দিঘির জলে ফুটে থাকা অযুত শাপলার শােভা, মাঠে মাঠে হাওয়ার দোলা, সরষে ফুলের অফুরন্ত সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে। এমনই বিচিত্র ও অপরূপ সৌন্দর্যের আধার আমাদের এই বাংলাদেশ। আর এ জন্যই এ দেশে এত সাধক, কবি, শিল্পী ও কর্মীর এমন অপূর্ব সমাবেশ। এত রূপ আর এত মহিমার প্রকৃতিঘেরা দেশ আর কি কোথাও আছে?

বাংলাদেশের প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বৈচিত্র্যতা

প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্যের রূপ ছড়িয়ে আছে গােটা দেশ জুড়ে। তবে অঞ্চলভেদে বৈচিত্র্যও আছে। শাল মহুয়ার ঘন বীথি, ঝিলিমিলি ঝিল আর বিশাল বিল প্রকৃতিকে করেছে ঐশ্বর্যশালী ও লাবণ্যময়। পশ্চিম অঞ্চলের অবারিত প্রান্তর, বালুময় পথঘাটে আছে ধূলিধূসর রুক্ষতা। তবে মাঠের পর মাঠ আখের ক্ষেত, আম বাগান ও পানের বরজ আছে। সেখানেও দিগন্ত জুড়ে সবুজ শ্যামলিমা। পূর্বাঞ্চলে নীলাভ পাহাড়ের ঢালে বিছানাে চায়ের বাগানগুলাে যেন সবুজ সিঁড়ির ধাপ দিয়ে সাজানাে। তারই ফাঁকে ফাঁকে ছায়াবীথির বিস্তার। পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া – পাহাড়ি নদীর বুকে ঢলে পড়া সূর্যের আভা রঙের কারুকাজ ফুটিয়ে তােলে। মধুপুর ও ভাওয়াল অঞ্চলের প্রকৃতিতে রয়েছে ভিন্নতর দৃশ্যপট। সেখানে গেরুয়া মাটিতে সারি সারি গজারি গাছের বিস্তার। আর দক্ষিণের উপকূল জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন।

সেখানে রয়েছে চির সবুজ পাতার টোপর পরা পল্লবঘন তরুবীথি। আর সেখানেই বসতি পেতেছে ডােরাকাটা বাঘ আর চিত্রল হরিণেরা। দক্ষিণের সুনীল সাগরের বুকে ভেসে থাকা দ্বীপাঞ্চলে রয়েছে আর এক ধরনের চিত্র। সেখানে প্রকৃতির দৃশ্যপট তৈরি করেছে তাল-নারকেল-সুপুরির বাগান। বেত-শােলা-কেওড়ার বন আর প্রান্তর জোড়া ধানক্ষেত। সেখানে ঘর বেঁধেছে। সংগ্রামে দুর্জয় মানুষেরা। জলােচ্ছ্বাসের মতাে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে তারা বাঁচে আর সমুদ্র শান্ত থাকলে তারা বাঁচে সাগরের সঙ্গে মিতালি করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর উপমহাদেশের এ দেশটি তাই মন-মাতানাে, দৃষ্টিনন্দন এবং কবি লেখক তৈরিতে সহায়ক হয়েছে। এর সৌন্দর্যে বিভাের হয়ে কবি পেয়েছে ভাষা, মানুষ পেয়েছে আশা। পর্যটক চোখ খুলে মন ভরে উপভােগ করে এর সৌন্দর্য, মেটায় অন্তরের তৃষ্ণা। এর অনুপম নৈসর্গিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উপভােগের জন্য বাংলাদেশ যুগে যুগে হাতছানি দিয়েছে কাছের ও দূরের ভ্রমণপিপাসুদের। অনেকেই তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় প্রশক্তি গেয়েছেন বাংলাদেশের মনলােভা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের। এমনই একজন পর্যটকের উক্তিঃ

বাংলাদেশে প্রবেশের হাজার দুয়ার খােলা রয়েছে কিন্তু বেরুবার একটিও নেই।

সমুদ্র সৈকত, লেক ও দ্বীপাঞ্চল

পৃথিবীর দীর্ঘতম বেলাভূমি কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। আর এ কক্সবাজারের কথা বললেই চোখে ভাসে মুক্ত আকাশ। সামনে অবারিত জলরাশি।

শুভ্র ফেনিল ঢেউ যে কাউকে মুহূর্তে তন্দ্রাচ্ছন্ন করে ফেলে। রয়েছে সাগর মােহনায় নৈসর্গিক শােভামণ্ডিত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ। এছাড়াও রয়েছে সােনাদিয়া দ্বীপ, সাগর কন্যা নিঝুম দ্বীপসহ আরও অনেক দ্বীপের মনলােভা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দৃশ্যপট। ফয়েস লেকের নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেমন অপরূপ তেমনি মােহনীয়। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি কুয়াকাটা। প্রকৃতির কোলে অথই জলরাশি শুধু কৌতূহল জাগায়। এর সমুদ্রতট থেকে দেখা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য। সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে মিতালী করে বেঁচে থাকে এখানকার মানুষ।

বনভূমি ও পাহাড়

পৃথিবীর সবচেয়ে বড়াে ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। প্রকৃতির নিজের হাতে গড়া এ বন নানা জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, নানা বৃক্ষরাজিতে শােভিত গভীর রহস্যে ভরা। পাহাড়িয়া অঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধতর করেছে। এ অঞ্চলটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ, সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও বান্দরবান অঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত। ময়মনসিংহের মধুপুর ও গাজীপুরের ভাওয়ালের গড়, কুমিল্লার লালমাই পাহাড়ের বনাঞ্চল যেন অপার সৌন্দর্যের আধার। এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া অঞ্চল, গারাে পাহাড়ের পাদদেশ ও সিলেটের সবুজে সবুজে ছাওয়া বিস্তীর্ণ চা বাগানসহ সমগ্র পাহাড়িয়া অঞ্চল জীববৈচিত্র্যে ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ।

পল্লি-প্রকৃতি

তুমি যাবে ভাই, যাবে মাের সাথে। আমাদের ছােট গাঁয়?

হরিতে-হিরণে, সবুজে-শ্যামলে, সুজল-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই দেশ বাংলাদেশ।যার মূলভিত্তি ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় ছােট ছােট গ্রামগুলাে। প্রায় বিরানব্বই হাজার গ্রাম নিয়ে গঠিত এই দেশের শতকরা ৮৫ জন লােক পল্লিগ্রামে বাস করে। পল্লির সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা রূপ নিয়ে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল-

আমাদের গ্রামখানি ছবির মতন, মাটির তলায় এর ছড়ানাে রতন

নদ-নদী ও হাওর-বাঁওড়

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এর নদী-নালা, হাওড়-বাওড়, খাল-বিল সব মিলে৷ টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া- এক বিচিত্র রূপের অপূর্ব সমারােহ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, আড়িয়াল খাঁ, কর্নফুলী আর বুড়িগঙ্গা যার বুকে ভেসে থাকা রংবেরঙের পাল তােলা সারিসারি নৌকার অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন রূপ বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও মােহনীয় ও আকর্ষণীয় করে তােলেছে। অপরদিকে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জুড়ে অবস্থিত চলনবিল এবং সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওড়সহ অসংখ্য হাওড়-বাওড় এদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে বিশিষ্টতা দান করেছে। তাই আজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এগুলাে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল

বাংলাদেশের বেশির ভাগ অঞ্চল পলিগঠিত বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল। উর্বর এ সমভূমি অঞ্চলে দৃষ্টিগােচর হয় সবুজের সমারােহ। সবুজ মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় এ যেন সবুজের বিশাল সমুদ্র। শস্যসম্ভবা সবুজ শ্যমলিমা যখন মৃদুমন্দ বাতাসে আলােড়িত হয় তখন মনে হয় সবুজ উর্মিমালা বুঝিব ধেয়ে যাচ্ছে দিগন্তের পানে।

সংস্কৃতি

হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে গড়া এ দেশ। এ দেশের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এর রূপমাধুর্যে যেন একটি স্বতন্ত্র মাত্রা যােগ করেছে। বাংলা বর্ষবরণ ও বসন্তবরণের মতাে অনুষ্ঠানগুলাে আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হয়েছে। এগুলাে রঙ, রূপ ও বৈচিত্রে সমকালীন প্রকৃতির অনুরূপ। ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশে এগুলাে ভিন্ন ও রােমাঞ্চকর আমেজ সৃষ্টি করে। ফলে সুপ্ত মনের পাতায় পাতায়, মনের অজান্তেই আমরা এঁকে যাই প্রকৃতির ছবি, লিখি কবিতা, গেয়ে উঠি গান। মন হারিয়ে যায় অজানা ঠিকানায়।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়

বাংলাদেশের প্রকৃতি কখনাে কখনাে ধ্বংসাত্মকরূপে আবির্ভূত হয়। গ্রীষ্মের আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ ও বিবর্ণ হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড তাপে হারিয়ে যায়, সবুজ প্রকৃতির অপরূপ শ্যামল শােভা। ফেটে চৌচির হয়ে যায় ফসলের মাঠ, শুকিয়ে যায় নদী, চারিদিকে কেবল ধু-ধু হাহাকার। ভয়াল রুদ্র রূপ নিয়ে হাজির হয় কালবৈশাখি। এটি উড়িয়ে নিয়ে যায় আমাদের বাড়িঘর, ভেঙে ফেলে গাছপালা। প্রচণ্ড গরমে মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে। মানুষ তখন চাতক পাখির ন্যায় আকাশ পানে চেয়ে থাকে। বর্ষাকালেও প্রকৃতি মাঝে মাঝে ধ্বংসাত্মক হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত বন্যায় সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এ সময় মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। বন্যা, জলােচ্ছাসের ফলে মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট ভােগ করতে হয়। উপকূলবর্তী মানুষের সাথে প্রকৃতি সবসময় বৈরী আচরণ করে। জলােচ্ছাসের সাথে তাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। অতিরিক্ত বন্যায় গবাদি পশুর অনেক ক্ষতি সাধিত হয়। শীতকালে আমাদের দেশের গরিব মানুষদের দুঃখের সীমা থাকে না। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষদের বেশি শীতের কষ্ট সহ্য করতে হয়। শীতে বৃদ্ধ ও শিশুদের বেশি কষ্ট হয়ে থাকে। নানান প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সময় কাটাতে হয়।

উপসংহার

বাংলাদেশের প্রকৃতির ন্যায় এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পৃথিবীর আর কোথাও পরিলক্ষিত হয় না। প্রকৃতিই বাংলাদেশকে আলাদা বৈশিষ্ট্য দান করেছে। বাংলাদেশের ছয়টি ঋতু তাদের সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলেছে বাংলার প্রকৃতিকে। এর প্রভাব বাঙালির হৃদয়েও পরিলক্ষিত হয়। প্রকৃতি এ দেশের মানুষের মনকে নানা রঙের আলপনায় বিচিত্র অনুভবে রঙিন করে  তােলে। প্রকৃতির কল্যাণেই আমরা বাংলাদেশে চিরকাল সুখ, সৌন্দর্য ও শান্তি অনুভব করি।