প্রশ্নঃ বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদ আলােচনা কর।

অথবা, সত্তাবিষয়ক মতবাদ হিসেবে বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদ ব্যাখ্যা ও মূল্যায়ন কর।

ভূমিকাঃ জগতের সৃষ্টি সম্পর্কে পরমসত্তার অস্তিত্ব নিয়ে বিভিন্ন দার্শনিক বিভিন্ন তর্কবিতর্ক ও সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছেন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে সত্তাসম্পর্কীয় বিভিন্ন মতবাদ। কারাে কারাে মতে, পরমসত্তা সংখ্যায় এক, এদেরকে বলা হয় একত্ববাদী; কারাে কারাে মতে, পরমসত্তা সংখ্যায় দুই, এদেরকে বলা হয় দ্বৈতবাদী। আর কারাে কারাে মতে, পরমসত্তা সংখ্যায় বহু এদেরকে বলা হয় বহুত্ববাদী। নিম্নে বহুত্ববাদ ও দ্বৈতবাদ আলােচনা করা হলাে-

বহুত্ববাদঃ বহুত্ববাদের মূলকথা হলাে, সত্তা এক নয় দুইও নয়। পরিদৃশ্যমান জগৎ হচ্ছে বৈচিত্র্যপূর্ণ। বিশ্বের এ বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে এর বহু সত্তাকে। কেবল আত্ম বা বস্তু অথবা এরা উভয়ে বিশ্বের বৈচিত্র্যের ব্যাখ্যা করতে পারে। বিশ্বের বৈচিত্র্য, যে মানুষের মনে নানা সত্তার অস্তিত্বের প্রেরণা যােগায়, তা অনস্বীকার্য। নদীর কলতান, সাগরের ভৈরবনাদ, সূর্যের প্রখর কিরণ, চাঁদের রূপালি জ্যোৎস্না, শস্য সবুজ মাঠ, নীল আকাশ ও ধূসর মরুভূমি ইত্যাদি বহু অসম সত্তা ও বৈচিত্র্য মানুষের মনে প্রতীতি জমিয়ে দেয়। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ কল্পনা করে একের পরিবর্তে বহুর। দর্শনের ইতিহাস পর্যালােচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, আধ্যাত্মিক আত্মার প্রভাবের ফলে মানুষ এক চরম সত্তার নাগপাশে আবদ্ধ হয়ে আপন সত্তাকেও হারিয়ে ফেলে। তাই বহুত্ববাদ আধ্যাত্মবাদের বিরুদ্ধে এক কঠোর প্রতিবাদ। বহুত্ববাদের এ দিকটি হল নঞর্থক দিক। এর একটি সদর্থক দিকও অবশ্যই আছে। এর সদর্থক দিক হলাে দৃশ্যমান জগতের আড়ালে। বহু সত্তার অস্তিত্ব প্রমাণ। বহুত্ববাদের চারটি রূপ আছে। যথা- (ক) জড়াত্মক বহুত্ববাদ (খ) আধ্যাত্মিক বহুত্ববাদ (গ) প্রয়ােগবাদী বহুত্ববাদ এবং (ঘ) নব্য বস্তুবাদী বহুত্ববাদ নিম্নে এগুলাে বর্ণনা করা হলাে-

(১) জড়াত্মক বহুত্ববাদ বা পরমাণুঃ পরমাণুবাদ অনুসারে পরিদৃশ্যমান জগতের মূলে রয়েছে অসংখ্য পরমাণু। পরমাণুবাদীদের মতে, জড় ও বস্তুকে যদি ক্রমাগত ভাগ করা যায় তাহলে আমরা ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর, তারপর আরও ক্ষুদ্র কণিকায় এসে উপনীত হয়ে থাকি আর কোনাে ভাগ করা সম্ভব নয়। এ ক্ষুদ্রতম বা অবিভাজ্য কণিকাগুলাে হলাে পরমাণু। পরমাণুর সংমিশ্রণ ও বিমিশ্রণের ফলেই আমাদের অভিজ্ঞতার জগতের সৃষ্টি।

(২) আধ্যাত্মিক বহুত্ববাদ বা মােনাডবাদঃ জার্মান দার্শনিক লাইবনিজ হচ্ছেন এ মতবাদের প্রবর্তক। তার মতে, আমাদের এ পরিদৃশ্যমান জগতের মূলে রয়েছে অসংখ্য চিৎপরমাণু। এ চিৎপরমাণুগুলাে অবিভাজ্য। আধ্যাত্মিক সত্তাসম্পন্ন চেতন ও সক্রিয় পরমাণু হলাে আদর্শ উপাদান। লাইবনিজের মতে, চিৎপরমাণুগুলাে পরীক্ষাবিহীন। কিন্তু তারা স্বনির্ভর, সক্রিয় ও আত্মকেন্দ্রিক। জগতের প্রত্যেকটি বস্তুই একটি গবাক্ষহীন মােনাড। প্রত্যেকটি চিৎপরমানু চেতনধর্মী। লাইবনিজের মতে, ঈশ্বর হলাে সর্বশ্রেষ্ঠ চিৎপরমাণু। সুতরাং জগৎ এক পরম ঐক্য।

(৩) প্রয়ােগবাদী বহুত্ববাদঃ উইলিয়াম জেমস হচ্ছেন এ মতের প্রবর্তক। প্রয়ােগবাদীদের মুখপাত্র জেমসে মতে, হেগেলের একত্ববাদ জগতের বৈচিত্র্য ও অভিনবত্বের কোনাে সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারে না। অর্থাৎ জগৎ হচ্ছে অসংখা স্বনির্ভর বস্তুর সমষ্টি। জগৎ এক নয়, বহু জগতের ঈশ্বরনিরপেক্ষ স্বাধীন অস্তিত্ব আছে। জগৎ কোনাে ব্যক্তিমননিরপেক্ষ। এ জগৎ বুদ্ধ জগৎ নয়। আসল কথা হলাে বহুর ভিতরে একের পরিবর্তে তিনি একের ভিতরে বহুর অস্তিত্বের জয়ধ্বনি করেছেন।

(৪) নব্যবস্তুবাদী বহুত্ববাদঃ নববস্তুবাদীদের মতে, জগতে যেমন বহু বস্তু আছে, তেমনি বহু মনও আছে। এ জগৎ এক আঙ্গিক এক্য নয় বরং বহু বস্তুর সমষ্টি। এদের সম্পর্ক বাহ্যিক, অভ্যন্তরীণ নয়। সত্তার স্তরভেদ আছে জড় নিম্নতম স্তর, প্রাণ উচ্চতর স্তর এবং মন উচ্চতম স্তর। জড় থেকে প্রাণ এবং প্রাণ থেকে মনের উন্মেষ ঘটে। এ জগতের কোনাে আঙ্গিক ঐক্য নেই।

সমালােচনাঃ বহুত্ববাদ নানা দিক থেকে নানাভাবে সমালােচিত হয়েছে।

প্রথমত, পরমাণুবাদ হচ্ছে এক প্রকার জড়বাদ। জড়বাদের সকল দোষ-ত্রুটিই এতে বিদ্যমান। এ মতবাদ স্বভাববাদভিত্তিক। ফলে এ মতবাদ প্রাণ ও মনের যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারে না ।

দ্বিতীয়ত, নব্য বাস্তববাদীদের মতবাদ গ্রহণ করলে জগতের ঐক্য, শৃঙ্খলা ও সামঞ্জস্য ব্যাখ্যা করা যায় না। জগৎ কেবল এলােমেলা নয়, আবার কেবল ঐক্যপূর্ণ নয়। জগতে ঐক্য ও বিশৃঙ্খলা উভয়ই আছে।

তৃতীয়ত, প্রয়ােগবাদী বহুত্ববাদ বহু জগৎকে এলােমেলাে বিশৃঙ্খলার স্কুপমাত্র করে তােলে। আপাতদৃষ্টিতে জগৎ বৈচিত্র্যপূর্ণ হলেও জগতে এক নিয়মের রাজত্ব চলছে। জগৎ এক সুসংহত সুসংবদ্ধ পরম ঐক্য। এখানে বিশৃঙ্খলার ভেতর শৃঙখলা আছে। জগতের সূক্ষ্ম কলাকৌশল, গঠন-নৈপুণ্য জগতের মূলে কোনাে বুদ্ধির অস্তিত্ব স্বীকার করে।

দ্বৈতবাদঃ দ্বৈতবাদ অনুসারে সত্তার সংখ্যা এক নয়, দুই। যে মতবাদ দু’টি স্বতন্ত্র ও পরস্পর নিরপেক্ষ সত্তাকে বিশ্বজগতের আদি বা মূল উপাদান বলে মনে করে তাকে দ্বৈতবাদ বলা হয়। দ্বৈতবাদীদের মতে, জগৎ এক বা বহু সত্তার সমষ্টি নয়, বরং জগৎ হচ্ছে জড় ও মন, দেহ ও চেতনা নামক পরস্পর নিরপেক্ষ দুটি সত্তার সমাহার। এ দুটি সত্তার একটিকে অপরটিতে রূপান্তরিত করা যায় না। কেননা এরা পরস্পর স্বতন্ত্র সত্তা। দ্বৈতবাদের ইতিহাস আলােচনা করলে দেখা যায় যে, প্রধানত দুটি কারণে দ্বৈতবাদ দর্শনের ইতিহাসে একটি সম্মানজনক স্থান অধিকার করে আছে।

প্রথমত, লৌকিক দৃষ্টিতে দ্বৈতবাদ একটি জনপ্রিয় মতবাদ। কেননা দ্বৈতবাদী দার্শনিকদের মতাে সাধারণ মানুষও জড় ও মনের বিপরীতধর্মী অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে অভ্যস্ত।

দ্বিতীয়ত, আধুনিক পাশ্চাত্য দর্শনের জনক ডেকার্টের প্রভাবও দ্বৈতবাদকে একটি পাকাপােক্ত স্থানে অধিষ্ঠিত করতে প্রভূত সহায়তা করেছে। এদিক থেকে ডেকার্টকে দ্বৈতবাদের একজন সফল সাধক বলে অভিহিত করা যায়।

সমালােচনাঃ দ্বৈতবাদীদের মতে, জড় মন দু’টি স্বতন্ত্র ও ভিন্নধর্মী সত্তা। তারা এ দুয়ের মধ্যে সম্পর্কের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেন না। সমজাতীয় বস্তুর মধ্যেই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্ভব। কিন্তু জড় এবং মন দুটি পৃথক ও ভিন্নধর্মী দ্রব্য। অথচ আমরা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতায় দেহের ওপর মনের ক্রিয়া এবং মনের ওপর দেহের ক্রিয়া লক্ষ্য করি। আধুনিক দার্শনিক ডেকার্ট পিনিয়েল গ্রন্থির সাহায্যে দেহ ও মনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু পিনিয়েল গ্রন্থিও একটি জড় পদার্থ।

পরিশেষেঃ পরিশেষে বলা যায় যে, বহুত্ববাদী ও দ্বৈতবাদী কেউই জগতের মৌলিক উপাদান সম্পর্কে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। কাজেই উভয় মতবাদকে চরম মতবাদ বলা যায়। তবে দু’মতবাদই স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তত্ত্ববহুল আলােচনা করেছে। কিন্তু সত্তা সম্পর্কে কোনাে গ্রহণযােগ্য তত্ত্ব উপস্থাপন করতে পারেনি, এটাই উক্ত মতবাদ দুটির প্রধান সমালােচনা।