মৃত্যুর অনিবার্যভাকে স্বীকার করেও আগামী জীবন-পিপাসাই শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’ কবিতার মর্মবস্তু- আলোচনা করো।

আধুনিক বা উত্তর-আধুনিক পর্বের কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। বলা হয় শক্তি চট্টোপাধ্যায় হাংরি জেনারেশনের কবি। উত্তর-আধুনিক কিংবা হাংরি জেনারেশন ইত্যাদি অভিধাগুলির অর্থ তাৎপর্য বা ব্যাখ্যা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক আছে। তবু সাধারণভাবে এবং সংক্ষেপে বলা যেতে পারে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিবেশে বাংলা সমাজ-অর্থনীতি এবং সেইসঙ্গে সাহিত্য-সংস্কৃতি ক্ষেত্রে যে তীব্র হতাশা ও নৈরাশ্যবোধ, মনুষ্যত্বের অপচয় ও ব্যর্থতাবোধ, একাকীত্ব, শূন্যতা, বিচ্ছিন্নতার জন্ম হয়, তা-ই জন্ম দিয়েছে উত্তর-আধুনিক বা হাংরি জেনারেশনকে। এক তীব্র অস্থিরতার যন্ত্রণা, ঐতিহ্য বা দৃঢ় কোনো প্রত্যয়ের শিকড়চ্যুত মানসিকতার উৎকেন্দ্রিকতা, বাহ্য উপকরণ ও স্বেচ্ছাচারের উন্মত্ততায় লক্ষ্যহীনতার যন্ত্রণাকে আড়াল করার চেষ্টা এবং সর্বোপরি শূন্যতাবোধ ও ব্যর্থতাবোধ থেকে জাত মৃত্যু-আকাঙ্ক্ষা এই উত্তর-আধুনিক হাংরি জেনারেশনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

জীবনানন্দের কবিতাতেই আমরা খুব স্পষ্ট ও তীব্রভাবে এই মৃত্যু-অভীপ্সার পরিচয় পেয়ে যাই। রাবীন্দ্রিক মৃত্যু-চেতনা থেকে উত্তর-আধুনিক এই মৃত্যু-চেতনার প্রকৃতিগত পার্থক্য আছে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু-চেতনার সঙ্গে লগ্ন হয়ে আছে রোম্যান্টিক ভাববাদ এবং জীবনের অবিরাম গতিদর্শন। জীবনানন্দের মৃত্যু চেতনা শূন্যগর্ভ যুগচেতনার ও নৈরাশ্যবোধের অনিবার্য পরিণাম। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাতেও মৃত্যু-অভীপ্সার পুনরাবৃত্তি লক্ষ্যহীন শিকড়চ্যুত স্বেচ্ছাচারী মানসিকতারই পরিচয়বাহী।

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সমগ্র কাব্যধারাতেই পুনঃ উচ্চারিত হয়েছে মৃত্যুর কথা, এই জগৎ-সংসার ছেড়ে চলে যাবার এক অমোঘ আকর্ষণ। আত্মরতিবাদ এবং স্বেচ্ছাচারের পথে তিনি উড়িয়ে-ফুরিয়ে দিতে চেয়েছেন জীবনের মোম। ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?’ কবিতাতেও বারবার এসেছে যাবার কথা, মৃত্যুর শীতল হাতছানির প্রসঙ্গ।

জীবনের উপাত্তে দাঁড়িয়ে যেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিমানসে তীব্রতর হয়েছে আসন্ন মৃত্যুর অনুভব। স্বেচ্ছাচারী জীবনের গোধূলিবেলায় কবি যেন স্পষ্ট শুনতে পান মৃত্যুর আহ্বান—

“এখন গঙ্গার তীরে ঘুমন্ত দাঁড়ালে 

চিতাকাঠ ডাকে : আয় আয়।”

যে-কোনো ভাবেই জীবনটাকে বাজি রেখে কবি যেন মৃত্যুর আলিঙ্গনকে অনায়াসে স্বীকার করতে পারেন, তা সে স্বেচ্ছাচারের পথে চাঁদের রোম্যান্টিক আহ্বানে খাদের পতনমুখে নিজেকে নিঃশেষিত করাও তো মৃত্যুকে আলিঙ্গন করারই নামান্তর। আবার স্পষ্টত চিতাকাঠের আমন্ত্রণ তো আছেই।

কিন্তু মৃত্যুর সেই অনিবার্য অমোঘ আহ্বানকে স্বীকার করেও আলোচ্য কবিতায় কবি যেন মৃত্যু পথ থেকে জীবনের দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই চেয়েছেন। শক্তির মোহমুক্ত সন্ন্যাসী মন এখনও হয়তো যে-কোনো দিকেই চলে যেতে পারে অনায়াসে। কিন্তু এ কবিতায় কবির অন্যতর এক জীবনপ্রত্যয় যেন সমস্ত দোলাচলতা ও তীব্র মৃত্যু-অভীপ্সার মধ্য থেকেই ক্রমশ মায়াময় সুখদুঃখজড়িত জীবনের দিকে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। যে-কোনো দিকে চলে যেতে পারার বা মৃত্যুর শীতলতায় সমস্ত অস্থিরতা ও অতৃপ্তিকে শান্তভাবে ঘুম পাড়িয়ে দেবার স্বাধীনতা কবির থাকলেও কবি শক্তি যেন স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেন জীবনের মায়াবন্ধন— 

“সন্তানের মুখ ধরে একটি চুমো খাবো।”

রবীন্দ্রনাথ যেমন মৃত্যুকে ‘শ্যামসমান’ জেনেও বারবার জীবনের সংলগ্ন হতে চান; সুকান্ত যেমন মৃত্যুর অনিবার্যতা স্বীকার করেও পরবর্তী শিশু-প্রজন্মের জন্য এ পৃথিবীকে ‘সুস্থ ও বাসযোগ্য করে তোলার সংকল্প গ্রহণ করেন; কবি শক্তিও তেমনি মৃত্যুকে অনিবার্য বলে স্বীকার করেও সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম বাৎসল্য ও কল্যাণ কামনার মধ্য দিয়েই জীবনতৃষ্ণাকে প্রকাশিত করেন। মৃত্যুর কোলে ঘুমিয়ে পড়ার আগে কবি জীবনের প্রতি সমস্ত দায়িত্ব-কর্তব্য, প্রেম-প্রীতি-মমতার যাবতীয় দায় সুসম্পূর্ণভাবে পালন করে যেতে চান। তাই কবি শঙ্খ ঘোষের বক্তব্য অনুযায়ী “বহিরঙ্গে অবিরাম মৃত্যু আর চলে যাওয়ার কথা থাকলেও তাঁর কবিতায় ভিতরে ভিতরে সর্বদাই লক্ষ করা যায় জীবনের সঙ্গে “লিপ্ত হয়ে থাকবার মরিয়া এক আবেগ।” আলোচ্য কবিতাতেও সেই আকণ্ঠ জীবন-পিপাসাই উচ্চারিত।