সুলতানি রাজত্বকালে কৃষির বিকাশ ও প্রযুক্তিগত রূপান্তরের ফলে অ-কৃষিজ উৎপাদন বা কারিগরি শিল্পের বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ভারতে সুলতানি শাসন শুরুর আগেও গ্রামীণ শিল্প উৎপাদনের ঐতিহ্য ছিল। তবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে না ওঠার কারণে প্রাচীন কারিগরি শিল্প তার গ্রামীণ চরিত্র নিয়ে টিকেছিল। তুর্কি-আফগান সুলতানদের আমলে শহরের বিকাশ এবং নতুন নতুন প্রযুক্তির আবির্ভাব কারিগরি শিল্প-উৎপাদনের গুণগত পরিবর্তন সম্ভব করে। অধ্যাপক ইরফান হাবিব অ-কৃষিজ উৎপাদনের এই রূপান্তরের তিনটি উপাদানকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এগুলি হল- (১) মুসলমানদের সাথে সাথে একদল দক্ষ কারিগর তাদের উন্নত প্রযুক্তিজ্ঞান-সহ ভারতে প্রবেশ করেছিল। (২) দাসব্যবস্থার প্রচলন থাকায় এদেশে অদক্ষ শ্রমিকের সুলভ যোগান ছিল। এবং (৩) নগরায়নের ফলে উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদন ভোগ করার ক্ষমতাসম্পন্ন অভিজাত ও বুর্জোয়া শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এই পরিবর্তন আকস্মিক হয়নি। চিরাচরিত শিল্প পদ্ধতির পরিবর্তে এদেশে ধীরে ধীরে নতুন প্রযুক্তি ও শৈলীর সাথে শিল্পী-কারিগরদের পরিচয় ঘটেছিল।
গ্রামীণ বা কুটিরশিল্প গড়ে উঠেছিল স্থানীয় প্রয়োজনবোধ থেকে। সাধারণত কৃষিকার্যের পাশাপাশি গ্রামীণ কারিগররা শিল্পকর্মে নিয়োজিত থাকত। প্রতিটি গ্রামের শিল্পী-কারিগররা তাঁতে কাপড় বোনা, গোরুর গাড়ির চাকা তৈরি, হাল, লাঙল, জোয়াল তৈরি, ছুরি, কাঁচি, ছোরা, তলোয়ার, ঘোড়ার নাল, বাসনপত্র, দড়ি ইত্যাদি তৈরির কাজ করত। নির্মাণ-পদ্ধতি ছিল পুরোনো, তবে স্থানীয় প্রয়োজন মেটাবার পক্ষে ছিল যথেষ্ট। ড. রোমিলা থাপার লিখেছেনঃ “তখন করিগররা পেশা অনুসারে নানা বর্ণে বিভক্ত ছিল। ইসলামে ধর্মান্তরিত হিন্দুদের মধ্যেও বর্ণপ্রথা ছিল। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কারিগররা বংশানুক্রমে একই কারিগরিবিদ্যার চর্চা করত।” কৃষিপণ্য থেকে উৎপাদিত কুটির শিল্পজাত দ্রব্যের অন্যতম ছিল সুগন্ধী তেল। পরিশুদ্ধ তেল চোলাই করে সুগন্ধী গোলাপ জল তৈরি করার প্রযুক্তি মুসলমানরাই প্রথমে আবিষ্কার করে। পি. কে. গোডে (P. K. Gode) তাঁর ‘Studies in Indian Cultural History’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, ষোড়শ শতকের আগে ভারতীয় সাহিত্যে সুগন্ধী জলের উল্লেখ পাওয়া যায় না। আমির খসরুর রচনায় গোলাপ জলের উল্লেখ আছে। পরবর্তীকালে ভারতে তেল ও চন্দনকাঠ থেকে সুগন্ধী তৈরি করা হতে থাকে। মালিক মহম্মদ জায়সী ‘মৈদু’ ও ‘চুবাই’ নামক দুটি উগ্রগন্ধি আতর উৎপাদনের কথা লিখেছেন। ভেষজ নির্যাস থেকে এগুলি তৈরি হত। তবে নির্দিষ্ট ভেষজটি সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। বাংলদেশে গন্ধদ্রব্য ব্যবসায়ীরা ‘গন্ধ-বণিক’ নামে একটি পৃথক শ্রেণি হিসেবে চিহ্নিত হতেন। একাদশ শতক নাগাদ ইসলামিক জগতে মদ চোলাই শিল্প করায়ত্ত হয়েছিল। সম্ভবত ইতালিতে আনুমানিক দ্বাদশ শতকে এই প্রযুক্তির উদ্ভব হয়। একাদশ শতকে ইসলামিক জগৎ হয়ে তা ভারতে প্রবেশ করে। বারাণী ও আবুল ফজলের বর্ণনা থেকে অনুমিত হয় যে, আখের রস বা গুড় থেকে ভারতে মদ চোলাই শুরু হয়েছিল। অবশ্য পারস্যে এই কাজে আঙুরের রস ব্যবহৃত হত। সুলতানি আমলে অভিজাতদের মধ্যে মদ পানের ব্যাপকতা বন্ধ করার জন্য আলাউদ্দিন খলজি প্রকাশ্যে মদ বিক্রি ও প্রস্তুত নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য গৃহের অভ্যন্তরে নিজ নিজ প্রয়োজনে মদ তৈরির কাজ চালানো যেত। আমির খসরু, মা-হুয়ান প্রমুখের রচনা থেকে জানা যায় যে, সুলতানি আমলে আখের রস, খেজুরের রস ও নারকেলের রস থেকে উগ্র পানীয় তৈরি করা হত। এ ছাড়া ভাত ও মহুয়া থেকে সুরা তৈরির রেওয়াজ আগের মতোই চালু ছিল। বাংলাদেশের বাজারে প্রকাশ্যে মদ বিক্রি হত।
গ্রামীণ শিল্প ছাড়াও মধ্যযুগে এমন কিছু শিল্প গড়ে উঠেছিল যা নিছক স্থানীয় চাহিদার কারণে সৃষ্টি হয়নি। এই ধরনের দুটি প্রধান শিল্প হল সরাসরি সুলতানদের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা সরকারি কারখানা এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে স্থাপিত বস্তুবয়ন-শিল্প। সরকারি কারখানাগুলিতে শাসক পরিবার ও উচ্চ অভিজাতদের চাহিদা অনুযায়ী নানা ধরনের দ্রব্য তৈরি হত। যেমন—টুপি, ওড়না, জুতো, ঘোড়ার রেকাবি, চাদর ইত্যাদি। বিদেশি শাসকদের কাছে প্রেরণের জন্য নানা ধরনের উপহারসামগ্রীও এখানে তৈরি করা হত। মহম্মদ তুঘলক প্রতি বছর শরৎ ও বসন্তকালে প্রায় দু-লক্ষ মহার্ঘ পরিচ্ছদ ‘সম্মানী’ হিসেবে বিতরণ করতেন। শরৎকালে পোশাকের কিছু উপকরণ সরকারি কারখানায় প্রস্তুত হত। অভিজাত মহিলাদের পোশাকে সোনার সুতো ব্যবহার করা হত। কয়েক হাজার মহিলা কারিগর এই স্বর্ণতত্ত্ব নির্মাণের কাজে নিয়োজিত থাকতেন।
সুলতানি আমলে বস্ত্রশিল্প :
সুলতানি আমলে ভারতের বস্ত্রশিল্প ছিল বেশ উন্নত এবং উৎপাদিত বস্ত্রের পরিমাণও ছিল যথেষ্ট। বস্ত্রশিল্পের জন্য আবশ্যিক প্রাথমিক উপাদানগুলির, যেমন—তুলো, রেশম, বুনন যন্ত্র ইত্যাদির সহজলভ্যতা ভারতীয় বয়ন শিল্পের দ্রুত অগ্রগতির সহায়ক হয়েছিল। সারা দেশেই তুলোর চাষ জনপ্রিয় ছিল। পার্বত্য এলাকায় ব্যাপক মেষ পালনের রেওয়াজ ছিল। ফলে পশমের জোগানে টান পড়ত না। আর ভারতে, বিশেষত বাংলাদেশে রেশমকীটের (গুটি পোকা) চাষের জন্য বিখ্যাত ছিল বলে মা হুয়ানের বিবরণী থেকে জানা যায়। অবশ্য ইম্পিরিয়াল গেজেটিয়ার’ (১৯০৮) এর সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, তখন বিদেশ থেকে বিপুল পরিমাণ রেশমি সুতো আমদানি করে তাঁতিদের চাহিদা মেটানো হত।
অভিজাত ও ধনী ব্যক্তিদের পশমি বস্তু সাধারণভাবে বিদেশ থেকে আমদানি করা হত। তবে স্বদেশে তৈরি সুক্ষ্ম সুতিবস্ত্র, ক্ষৌমবস্ত্র, পশুর লোমে প্রস্তুত শীতবস্ত্র ইত্যাদিও ধনীদের অঙ্গে শোভা পেত। সূক্ষ্ম সুতিবস্ত্র তৈরির কাজে হিন্দুস্তানের তাঁতিরা খুবই দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। বিদেশি পর্যটকদের প্রায় সবাই একবাক্যে ভারতীয় সুতিবস্ত্রের উন্নতমানের প্রশংসা করেছেন। অধ্যাপক ইরফান হাবিবের মতে, ত্রয়োদশ শতকে তকলির পরিবর্তে চরকার ব্যবহার এবং তুলো পেঁজার জন্য ‘ধুনুরির’ প্রয়োগ হিন্দুস্তানের উন্নত বস্ত্রবয়ন শিল্পের উপযুক্ত প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। এই দুটি বয়ন যন্ত্রের ব্যবহার কোন্ সময় শুরু হয়েছিল, তা সঠিক বলা যায় না; তবে ত্রয়োদশ শতকে এগুলির দক্ষ প্রয়োগ জানা ছিল বলে অধ্যাপক হাবিব দাবি করেছেন।
উন্নতমানের বস্ত্র উৎপাদন ও রপ্তানির দুটি অগ্রণী অঞ্চল ছিল গুজরাট এবং বাংলাদেশ। গুজরাটের ক্যাম্বে অঞ্চল উচ্চমান অথচ স্বল্পমূল্যের বস্ত্র উৎপাদনের জন্য পর্যটক বারবোসার ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। তাঁর মতে, ইউরোপের ফ্ল্যান্ডার্সের মতোই দক্ষ শিল্পীদের সমাবেশ ঘটেছিল ক্যাম্বেতে। শুভ্র সুতিবস্ত্র, রেশম, মখমল, সাটিন এবং কার্পেট ইত্যাদির বুনলে এখানকার শিল্পীরা যথেষ্ট দক্ষতা দেখান। উচ্চমান ও নিম্নমূল্যের কারণে ক্যাম্বের বস্ত্রসম্ভার পশ্চিম ইউরোপ ও দক্ষিণ আফ্রিকায় যথেষ্ট সমাদৃত ছিল। ইবন বতুতার আগমনকালে মালাবার অঞ্চল ও সুতিবস্ত্র উৎপাদনে খ্যাতি অর্জন করেছিল। চিনা পর্যটক মা হুয়ানের বিবরণী থেকে জানা যায় যে, কোয়েম্বাটুর অঞ্চলেও উন্নতমানের সুতিবস্ত্র তৈরি হত। একইভাবে এখানকার ছাপা সিল্ক বস্ত্রও বিদেশে রপ্তানি হত বলে মা-হুয়ান লিখেছেন। ত্রয়োদশ-পঞ্চদশ শতকে সুখ্যাত ও জনপ্রিয় সুক্ষ্ম কাপড়ের মধ্যে সলাহিয়, বৈরামিয়, শিরিন, কাতান-এ -রানী প্রভৃতি নাম পাওয়া যায়। পূর্ব ভারতে বয়ন-শিল্পের প্রাণকেন্দ্র ছিল বাংলাদেশ। চতুর্দশ শতকে বাংলাদেশ পর্যটনের সময় (১৩৪৬ খ্রিঃ) ইবন বতুতা সেখানে অতি অল্পমূল্যে অতি সুক্ষ্ম বস্ত্র বিক্রয়ের ঘটনা লক্ষ্য করেছেন। চতুর্দশ শতকে আগত চিনা পর্যটক মা হুয়ান প্রায় ছয় ধরনের সূক্ষ্ম বস্ত্র উৎপাদনে বাংলার খ্যাতি ছিল বলে উল্লেখ করেছেন। চিনা লেখক ওয়ান-তা-ইউয়ান ও ফেই সিন্ এবং পোর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা বাংলাদেশের উন্নতমানের তুলাজাত বস্তুসম্ভারের প্রশংসা করেছেন। বাংলার সূক্ষ্ম ‘মসলিন’ বস্ত্রের খ্যাতি ও চাহিদা ছিল জগৎজোড়া। বাংলার শাসনকর্তা বুগরা খাঁ তাঁর পুত্র সুলতান কাইকোবাদকে বাংলায় প্রস্তুত যে সূক্ষ্ম কাপড় উপহার দিয়েছিলেন, আমির খসরু তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তাঁর ভাষায় এই কাপড়ের মান এতই সূক্ষ্ম যে, তার ভিতর দিয়ে শরীরের প্রতিটি রেখা স্পষ্ট দেখা যেত। পর্যটক বার্থেমা বাংলায় প্রস্তুত উন্নতমানের বস্তু হিসেবে বৈরম, নমন, লিজতি, কৈঁতার, দৌজারা ইত্যাদির নাম উল্লেখ করেছেন। তিনি কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে লিখেছেন যে, পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে তিনি বাংলাদেশের মতো সুতিবস্ত্রের এত প্রাচুর্য দেখেননি। পর্যটক বারবোসা উল্লেখ করেছেন যে, বাংলায় প্রস্তুত ‘সিনবফ’ নামক কাপড় আরব পর্যটকদের খুবই প্রিয় ছিল। এই কাপড় দিয়ে তারা কামিজ বানাত বলে অধ্যাপক আশরাফ উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া ‘শিরবস্ত্র’ নামক এক প্রকার কাপড়ের উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন যে, ইউরোপীয় মহিলাদের মাথার স্কার্ফ হিসেবে এবং পারসিক ও আরব বণিকদের পাগড়ি হিসেবে এর প্রভূত চাহিদা ছিল। কার্পেট, কুশন ইত্যাদি বুননের ক্ষেত্রেও মধ্যযুগের ভারতীয় বয়ন-শিল্পীরা বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। মধ্যযুগের শিল্পীরা রঞ্জন-শিল্পে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। বারবোসা ও বার্থেমা প্রমুখ রঙিন পাড়যুক্ত শাড়ি ও রঙিন সিল্ক, মসলিন ইত্যাদির উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়া রঙিন চাঁদোয়া ও লেপের ব্যবহারও তাঁর দৃষ্টিগোচর হয়েছিল।
সুলতানি আমলে ধাতুশিল্প :
সুলতানি আমলে বস্ত্রশিল্পের পরেই ছিল ধাতুশিল্পের স্থান। ধাতু-শিল্পীরা নানাধরনের ধাতু, যেমন—লোহা, তামা, রূপা, দস্তা ইত্যাদি বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের সামরিক অস্ত্র ছাড়াও ছুরি, কাঁচি, গামলা, কাপ ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে তৈরি করা হত। মধ্যযুগের উন্নত ধাতুশিল্পের নিদর্শন হিসেবে দিল্লির লৌহস্তম্ভ আজও বিজ্ঞানীদের বিস্ময় উদ্রেক করে। লৌহ তরবারি ও ছোরা নির্মাণেও তৎকালীন শিল্পীদের দক্ষতা ছিল। দিল্লির সুলতানেরা উৎকৃষ্ট ইস্পাত উৎপাদনের ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন। ফকরুদ্দিন মোবারক শাহের মতে, কাঠিন্যের দিক থেকে ভারতে প্রস্তুত তরবারি ছিল বিশ্বের সেরা। ভারতে প্রস্তুত নানা ধরনের তরবারির মধ্যে ‘মান-মোহর’ নামক তরবারি ছিল সর্বোৎকৃষ্ট। তবে এর নির্মাণে বহু সময় ও অর্থ ব্যয় হত। তাই সুলতানদের অস্ত্রশালায় এই জাতীয় তরবারি বেশি থাকত না। চামড়াশিল্পেও মধ্যযুগের শিল্পীরা দক্ষতার স্বাক্ষর রাখেন। তখন চামড়া থেকে ঘোড়ার জিন ও লাগাম, তরবারির খাপ, জুতো এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় নানা দ্রব্য প্রস্তুত করা হত। সাধারণ কৃষকেরা চামড়া সেলাই করে জলবাহী পাত্র তৈরি করত। মধ্যযুগে পশুপাখির চিত্র-সমন্বিত চামড়ার আসন চর্মশিল্পীদের দক্ষতার চূড়ান্ত নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। গোরু, ছাগল, মহিষ, গণ্ডারের ছাল এবং অন্যান্য বন্য পশুর চামড়া সংগ্রহ করে শিল্পীরা কাজ করত। চর্মশিল্পে সবথেকে অগ্রণী ছিল গুজরাট। এদের উৎপাদনের গুণগত উৎকর্ষ ছিল সর্বজনস্বীকৃত। মার্কোপোলো গুজরাটের সূক্ষ্ম কারুকার্য শোভিত চামড়ার মাদুরের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। প্রতি বছর গুজরাট থেকে চর্মদ্রব্য আরব-সহ নানা দেশে রপ্তানি করা হত। এ ছাড়া চিনি শিল্প, কাগজ শিল্প, প্রবাল, গজদন্ত ও অলংকার-শিল্পেও মধ্যযুগের শিল্পীদের দক্ষতা ছিল। স্বর্ণশিল্পীদের দক্ষতা সম্পর্কে অনেকেই প্রশংসা করেছেন। সোনা-রূপার ফলমূল, অলংকার, মুকুট, কোমরবন্ধ ইত্যাদির সূক্ষ্ম কারুকার্য তৈমুর লঙ’কে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, তিনি ভারতে গণহত্যা চালানোর সময় এই সকল কারুশিল্পীকে হত্যা করেননি। এদের অনেককেই তিনি বন্দি করে স্বদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। নিকলো কন্টি এবং সমকালীন লেখক খসরু ‘শামি’ নামক এক প্রকার কাগজের উপস্থিতি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। খসরু উল্লেখ করেছেন যে, তখন অতি সাধারণ ও মসৃণ—দু-ধরনের কাগজ উৎপাদন হত। তবে মসৃণ বা রেশমি কাগজের উপাদান সম্পর্কে তিনি আলোকপাত করেননি। অধ্যাপক আশরাফের মতে, সম্ভবত ‘ফেন্ট’ থেকে তা তৈরি করা হত। খসরু দিল্লিতে পুস্তক বিক্রেতার অবস্থানের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এ থেকে অনুমান করা যায় যে, সেকালে সাধারণ মানুষ কাগজের ব্যবহারে রপ্ত ছিলেন। সাধারণভাবে মনে করা হয় যে, সুলতানি আমলে ভারতের নৌশিল্পের ক্রমাবনতি ঘটেছিল। কিন্তু নিকলো কন্টি উল্লেখ করেছেন যে, তাঁর দেশে প্রস্তুত নৌযানের থেকেও ভারতে বড়ো নৌযান প্রস্তুত হত। সুতরাং নৌ-শিল্পে তখন ভারত সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল—একথা মানা যায় না। তবে নৌ-নির্মাণশিল্প কেন্দ্রীভূত ছিল প্রধান পূর্ব উপকূল অঞ্চলে।
সুলতানি আমলে কারিগরদের অবস্থা :
সাধারণভাবে কারিগরদের অবস্থা ভালো ছিল না। কৃষকশ্রেণির মতো এরা সরাসরি জমি-মালিক দ্বারা হয়তো শোষিত হত না ; কিন্তু সার্বিকভাবে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অত্যন্ত সীমিত ছিল বলে কারিগরদের বৃত্তি কখনোই আর্থিক সমৃদ্ধির সম্ভাবনা জাগাতে পারত না। কামার, কুমোর, ছুতোর, ধোপা, ধাঙড় ইত্যাদি গ্রামীণ কারিগরশ্রেণি কৃষিজীবীদের মতোই কোনোক্রমে জীবনধারণের ন্যূনতম রসদ জোগাড় করেই সন্তুষ্ট থাকতে বাধ্য হত। সরকারি কারখানায় নিযুক্ত শিল্পশ্রমিকদের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। অন্যান্যদের অবস্থা গ্রামীণ কারিগরদের প্রায় সমতুল্য ছিল। অতি সাধারণ যন্ত্রপাতি নিয়ে এদের কাজ করতে হত। স্বভাবতই দ্রুত এবং উন্নতমানের উৎপাদন এদের ক্ষমতার বাইরে ছিল। তথাপি সহজাত দক্ষতা ও আন্তরিক আন্তরিকতার মাধ্যমে শিল্পী-কারিগররা যে উৎপাদন করত, তা বিদেশিদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এই সকল ব্যক্তিগত বা পারিবারিক শিল্পে নিয়োজিত কারিগরদের উৎপাদন পদ্ধতির উন্নতিবিধান কিংবা আর্থিক নিরাপত্তার দিকে কোনো নজর দেওয়া হত না। শিল্পসংঘগুলিও জাতিভেদ প্রথার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। জাতিভিত্তিক এবং বংশগত উৎপাদন পদ্ধতি পরোক্ষে কারিগরি শিল্পের বিকাশের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করত। কারণ এই ব্যবস্থায় কোনো একটি বিশেষ শিল্পের সৃষ্টিতত্ত্ব ওই বিশেষ গোষ্ঠী বা বংশের কাছে গোপন থেকে যেত। কোনো কারণে ওই গোষ্ঠী বা পরিবার শিল্পোৎপাদন থেকে আকস্মিক সরে গেলে ওই শিল্পে অবলুপ্তি ঘটে যেত। বার্থেমা বর্ণিত ‘বিশ্বের মহত্তম ও শ্রেষ্ঠ ভারতীয় কারিগরশ্রেণি সমাজ বা সরকার থেকে উপযুক্ত সমর্থন ও সাহায্য না পেলেও জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে খুব একটা অসন্তুষ্ট ছিল না।
সুলতানি আমলে বাণিজ্য :
ইবন বতুতা এবং বারবোসার বিবরণ থেকে আমরা সুলতানি আমলের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, উপকূল বাণিজ্য ও সামুদ্রিক বাণিজ্যের বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারি। সুলতানি শাসনকালেও ভারতের ঐতিহ্যশালী বাণিজ্যের ধারা প্রচলিত ছিল। রাজনৈতিক ও আর্থিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে অনিবার্যভাবে বাণিজ্যিক পণ্য এবং পরিমাণের পরিবর্তন ঘটেছিল। সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরে ত্রয়োদশ শতকের শেষদিকে উত্তর ও পূর্ব ভারতে অনেক নতুন শহর গড়ে ওঠে। শহরের মানুষ ও শাসক-অভিজাতবর্গের চাহিদা অনুসারে নানা ধরনের শিল্প উৎপাদন শুরু হয়। শহরের চাহিদা মেটাতে গ্রামাঞ্চল থেকে খাদ্যশস্য, কাঁচামাল, শাকসব্জি ও অন্যান্য পণ্য শহরের বাজারে আসতে শুরু করে। ওই সময় কৃষক নগদ অর্থে খাজনা দিতে বাধ্য ছিল। বারাণীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, আলাউদ্দিন খলজি নগদ অর্থে খাজনা প্রদানের বিষয়ে যথেষ্ট কঠোর ছিলেন। অর্থাৎ গ্রামীণ কৃষক তাদের উৎপাদন বিক্রয় করলেও নগদ অর্থ ধরে রাখতে পারত না। শহুরে অর্থ গ্রাম ঘুরে আবার শহরেই চলে আসত।
সুলতানি আমলে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য :
অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চলত প্রধানত স্থলপথে। উপকূল বাণিজ্য কিছুটা ব্যয়বহুল ও বিপজ্জনক ছিল। তথাপি সুলতানি আমলে সমৃদ্ধ উপকূল বাণিজ্য চালু ছিল। কারণ এই বাণিজ্যে প্রভৃত মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা দেশি-বিদেশি বণিকদের এই কাজে প্রলুব্ধ করত। মধ্যযুগের বাণিজ্যে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোকই যুক্ত ছিলেন। কোনো কোনো জাতিগোষ্ঠী অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিল। এদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল গুজরাটের বেনে সম্প্রদায়, রাজস্থানের মাড়োয়ারি সম্প্রদায় এবং মুলতানিদের। মাড়োয়ারি ও গুজরাটিদের অনেকেই জৈনধর্মাবলম্বী। মুসলমান বোহরা বণিকেরাও এই ব্যবসা-বাণিজ্যে অংশ নিতেন। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সাথে ভারতের স্থলপথ-বাণিজ্যে মুলতানি, খোরাসানি ও পারসিকদের আধিপত্য ছিল। মুলতানি বণিকদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু এবং খোরাসানিরা ছিলেন মুসলমান। ‘বান্জারা’ নামক একদল যাযাবর ব্যবসায়ীগোষ্ঠী অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিত। এরা ছিল অনেকটা ইউরোপীয় ‘জিপ্সি’দের মতো। এরা চাষিদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করে নানা বাণিজ্যকেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে তা বিক্রি করত। অনেক সময় কোনো ব্যবসায়ীর সংগৃহীত পণ্য এরা মালবাহী পশুর পিঠে চড়িয়ে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দিত। পথিমধ্যে স্থাপিত সরাইখানাগুলি স্থানীয় বাণিজ্যকেন্দ্র রূপে ব্যবহৃত হত। অনেক সময় দু-দল ব্যবসায়ীর মধ্যে পণ্য আদান-প্রদান হত সরাইখানাতেই। দেশের অভ্যন্তরে ও উপকূলবর্তী বাণিজ্যে একদল সংগঠিত দালাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই দালালশ্রেণি ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছ থেকেই ‘দস্তুরি’ (মধ্যস্থতাবাবদ কমিশন) আদায় করত। ফলে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি ঘটত। সুলতান আলাউদ্দিন খলজি এই মধ্যবর্তী শ্রেণির অবস্থানজনিত বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তাই তিনি কঠোর হাতে এদের নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। কিন্তু ফিরোজ তুঘলকের আমলে এদের দাপট আবার বেড়েছিল। সুলতানি আমলের বাণিজ্যে সুদখোর মহাজনশ্রেণিরও বিশেষ ভূমিকা ছিল। ‘সাহু’ ও ‘মহাজন’ নামক অর্থলগ্নীর কারবারীরা চড়া সুদের বিনিময়ে ব্যবসায়ীদের টাকা ধার দিতেন। ‘হুন্ডি’ বা ‘তমসুক’ নামক জামিনপত্র (Security Bond) রেখে অর্থ লেনদেন হত। আমির খসরুর মতে, টাকার পরিমাণ অনুসারে বার্ষিক ১০ থেকে ২০ শতাংশ টংকা সুদ হিসেবে দিতে হত। সুদের হার নির্ধারণ এবং এই সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য যথাযথ নিয়মবিধি ও বিচারবিভাগ সক্রিয় ছিল।
ইবন বতুতা উল্লেখ করেছেন যে, ভারতের বাণিজ্যকেন্দ্রগুলিতে বহু বিদেশি বণিক বসবাস করতেন। রপ্তানি-বাণিজ্য লাভজনক হওয়ার কারণে কোনো কোনো বিদেশি ভারতীয় মেয়েকে বিবাহ করে এখানকার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে যেতে পারতেন। ইবন বতুতা স্বয়ং মালদ্বীপে চারটি বিবাহ করেছিলেন। সাধারণভাবে বণিকদের নৈতিকতা কখনোই খুব উচ্চস্তরের ছিল না। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ স্থলবাণিজ্যে ব্যবসায়ীদের প্রধান লক্ষ্য ছিল যত বেশি সম্ভব মুনাফা অর্জন করা। অধ্যাপক আশরাফ লিখেছেন : “ব্যবসায়ীরা অর্থ উপার্জনের জন্য যে-কোনো অসাধু উপায় অবলম্বন করতে দ্বিধা করত না।…….. কোনো নীতিবাক্যের সাধ্য ছিল না এদের স্বভাব শোধরায়।” সম্ভবত, এই কারণে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাউদ্দিন খলজিকে কঠোরতম একাধিক ‘জাওবিৎ’ জারি করতে হয়েছিল। কিন্তু সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিয়োজিত বণিকদের ক্ষেত্রে ন্যায়নীতির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যেত। বিদেশি পর্যটকদের প্রায় সবাই নৌবাণিজ্যে লিপ্ত বণিকদের উন্নত নৈতিক মানের প্রশংসা করেছেন। ড. রোমিলা থাপার মনে করেন, “সেকালে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সততার মান খুব উন্নত ছিল।”
অভ্যন্তরীণ স্থলপথ-বাণিজ্যের সহায়ক হয়েছিল সুপ্রশস্ত রাজপথ। পেশোয়ার থেকে সোনারগাঁও পর্যন্ত একটি রাজপথ ছিল। মহম্মদ-বিন্-তুঘলক দিল্লি থেকে দৌলতাবাদ পর্যন্ত একটি রাজপথ নির্মাণ করেছিলেন। পায়ে হেঁটে এই পথ অতিক্রম করতে লাগত চল্লিশ দিন। দৌলতাবাদ থেকে এই রাজপথ সম্প্রসারিত হয়েছিল তেলেঙ্গানা এবং মাবার পর্যন্ত। সাধারণভাবে তখন পথঘাট দস্যু-তস্করের উপদ্রবে বিপজ্জনক ছিল। তবে রাজপথগুলিতে যাত্রীদের নিরাপত্তা ও বিশ্রামের জন্য বহু সরাইখানা থাকত। এগুলি বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব পেত। বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে রাজধানী দিল্লি ছিল জমজমাট। ইবন বতুতার মতে, দিল্লি শুধু ভারতের নয়, সারা মুসলিম দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ শহর ছিল। ইউ. এন. ঘোষালের মতে, দিল্লিতে সারাদেশ থেকে ভালো ভালো পণ্য আমদানি করা হত। স্থলপথে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য পণ্যের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বস্তু, ফল, ঘোড়া, দাসদাসী ইত্যাদি। ঘোড়া আসত মধ্য-এশিয়ার দেশগুলি থেকে। খোরাসানী বণিকেরা ঘোড়া নিয়ে মুলতানে আসত। সেখান থেকে চলে যেত দিল্লির বাজারে, এখান থেকে দাসদাসী নিয়ে স্থলপথেই ফিরে যেত। ঘোড়া ও দাসদাসীর বাজার মুঘল শাসনের শেষ পর্যন্ত যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। ইরান থেকে আসত নীল। চিন থেকে আনা হত রেশম। মুলতান বাণিজ্য পণ্য লেনদেনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। দিল্লি থেকে মিছরি, সরৌতি থেকে ঘি মুলতান হয়ে দিল্লি ও দূরবর্তী শহরে বা বিদেশে চালান যেত। আলিগড়, মিরাট, আমরোহা, মালব ইত্যাদি অঞ্চল থেকে নানা প্রকার খাদ্যসামগ্রী জোগান দেওয়া হত। বাংলার রঙিন বস্ত্র, দেবগিরির মসলিন, গুজরাটের পট্টবস্ত্রের যথেষ্ট চাহিদা ছিল। সারসুতের সরু চাউল, কনৌজের চিনি, মাড়-এর গম, ধর-এর পান ইত্যাদির প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল দিল্লি। বহু রাষ্ট্রীয় কারখানা দিল্লিতে ছিল। বারবোসার বিবরণ অনুযায়ী খ্রিস্টীয় ষোড়শ শতকে গুজরাটের লিমোেদরা শহর, রন্দের বন্দর, দাক্ষিণাত্যের ভাটকল বন্দর, গোয়া বন্দর এবং পুলিকট ইত্যাদি অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
তবে সেকালেও ব্যবসার প্রধান আকর্ষণ ছিল বৈদেশিক বাণিজ্য, এবং এই বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্রগুলি ছিল উপকূল অঞ্চলে। ইবন বতুতা ও বারবোসার বিবরণ থেকে জানা যায় যে, দেশের পশ্চিম উপকূলে বহু ব্যস্ত বন্দরের অস্তিত্ব ছিল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল দিও (গুজরাট), গোয়া (দাক্ষিণাত্য), কালিকট, কোচিন, কুইলন (মালাবার) ইত্যাদি। দাক্ষিণাত্যের উপকূল-বাণিজ্যে গুজরাটি ও মালাবারী ব্যবসায়ীরা সমানভাবে অংশ নিত। গুজরাটিরা প্রধানত সিল্ক, সুতিবস্ত্র, আফিং, গম ইত্যাদি আমদানি করতেন এবং তুলা ও ক্ষৌমবস্ত্র রপ্তানি করতেন। অন্যদিকে মালাবারী বণিকেরা নানারকমের মশলা, ঔষধ, নারকেল, তালমিছরি, মোম, তামা ইত্যাদি আমদানি করতেন এবং রপ্তানি করতেন সুতিবস্ত্র, চাল, গম, মসলিন ইত্যাদি। প্রতিবেশী উপকূল-রাষ্ট্র সিংহলের বাণিজ্যেও ভারতীয় বণিকদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ঘটত। করমণ্ডল উপকূল, মালাবার অঞ্চল, বিজয়নগর, গুজরাট প্রভৃতি স্থানের বণিকদের সিংহলের রাজধানী কলম্বো শহরে যাতায়াত ছিল। করমণ্ডল ও বিজয়নগরের উপকূল-বাণিজ্যে মালবার অঞ্চলের হিন্দু ও মুসলিম বণিকরা অংশগ্রহণ করতেন। এখানে দুর্ভিক্ষের সময়ে শিশু-পুত্র-কন্যাদের ক্রীতদাস হিসেবে ক্রয়-বিক্রয়ের ঘটনাও ঘটত। মুসলিম বণিকেরা বাংলাদেশের মসলিন বস্ত্র সংগ্রহ করে নিজ নিজ জাহাজে মালাবার, ক্যাম্বে ও অন্যান্য কেন্দ্রে প্রেরণ করতেন।
সুলতানি আমলে সামুদ্রিক বাণিজ্য :
আগের মতোই সুলতানি আমলে ব্যাপক সামুদ্রিক বাণিজ্য চলত। সামুদ্রিক বাণিজ্য পথেরও বিশেষ পরিবর্তন হয়নি। পূর্বে প্রচলিত দুটি সমুদ্রপথ মধ্যযুগেও ব্যবহৃত হত। একটি পথে পশ্চিম ভারতীয় উপকূল থেকে পারস্য উপসাগর হয়ে মেসোপটেমিয়ার মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরে যাওয়া যেত। এবং অন্যটি ছিল লোহিত সাগর এবং মিশরের মধ্য দিকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত। সেখান থেকে ভেনেসীয় ও অন্যান্য ইতালীয় বণিকদের মাধ্যমে পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ত। প্রথম পথটি ধরে ওরমুজ বন্দরে এবং দ্বিতীয় পথ ধরে এডেন ও জেড্ডা বন্দরে ভারতীয় জাহাজগুলি উপস্থিত হত এবং মাল খালাস করত। এডেন বন্দরে ভারতীয় বণিকদের একটি উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। পার্শ্ববর্তী বন্দর ঝাকর (ডোকার)-এও কিছু ভারতীয় জাহাজ চাউল ও তুলা নিয়ে আসত। এখান থেকে ওই জাহাজগুলি ঘোড়া নিয়ে স্বদেশে ফিরে যেত। পশ্চিম ইউরোপের সাথে ভারতের লাভজনক সামুদ্রিক বাণিজ্যের কথা বারবোসার বিবরণ থেকেও জানা যায়। ষোড়শ শতকে ভারতের দিউ, চাউল, দাভোল, গোয়া, ভাটকল, কালিকট ও অন্যান্য বন্দর থেকে জেড্ডা, এডেন, ওরমুজ প্রভৃতি বন্দরের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক লেনদেন চলত। একাদশ শতকে মিশরের ফতেমাইদ বংশের শাসনকালে কায়রো এবং আলেকজান্দ্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ভূমধ্যসাগরকে কেন্দ্র করে মুসলিম বণিকদের একটি বাণিজ্যমণ্ডল গড়ে ওঠে।
ভারতে আমদানি দ্রব্যের মধ্যে প্রধান ছিল ধনী ব্যক্তিদের জন্য হরেক বিলাস সামগ্রী এবং সামরিক ও বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্য উন্নতমানের ঘোড়া ও অন্যান্য পশু। আলেকজান্দ্রিয়া, চিনদেশ ও ইরাক থেকে মহামূল্যবান রেশমি মখমল, নক্সাদার পর্দার কাপড় ও গৃহসজ্জার বিবিধ উপকরণ আমদানি করা হত। দিল্লির অভিজাত ও সুলতানি মহলে চিনের রেশমের প্রবল চাহিদা ছিল। চিনা রেশম বা চিনাংশুক ছাড়াও ওদেশ থেকে আনা হত মশলা ও ঔষধ। চিনা শিল্পীদের চিনামাটির বাসন (পোর্সেলিন) সারা বিশ্বে জনপ্রিয় ছিল। ভারতেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। এ ছাড়া রঙিন, সুদৃশ্য বড়ো বড়ো কলশি। বিদেশ থেকে আমদানি করা এবং ভারতে প্রবল চাহিদার অন্য জিনিসটি ছিল উন্নত মানের ঘোড়া। স্থলপথে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়েও কিছু ঘোড়া ভারতে আসত। তবে জলপথেই ঘোড়া আমদানি হত বেশি। এ ব্যপারে বেশি ব্যবহৃত গোয়া বন্দর। ইরাক, ইরান, তুর্কিস্তান, বন্ধ, ভুটান থেকে নানাজাতের ঘোড়া হরমুজ ও এডেন হয়ে এদেশে আসত। মুসলমান শাসকদের পাশাপাশি হিন্দু-ভারতীয় রাজারাও যুদ্ধের কাজে ঘোড়ার উপযোগিতা উপলব্ধি করলে ঘোড়ার চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। রাজপুতানা ও দাক্ষিণাত্যে উন্নতমানের অশ্ব উৎপাদন সম্ভব হত না। কারণ ওই স্থানের জলবায়ু অশ্বপালনের পক্ষে যথেষ্ট উপযোগী ছিল না। তাই ওই অঞ্চলে ঘোড়া আমদানির বিশেষ চাহিদা ছিল। এ ছাড়া আমদানি-দ্রব্যের মধ্যে ছিল খেজুর, কিসমিস, লবণ, প্রবাল, সিসা, সিন্দুর, সোনা, রূপা, পারদ, ফটকিরি, কর্পূর, জাফরান, একপ্রকার লাল রং ইত্যাদি। ভারতে আমদানিকৃত দ্রব্যাদির মধ্যে গোলাপজল, ধুনা এবং ঘোড়া ছিল প্রধানত আরবদেশীয় সামগ্রী। অন্যান্য জিনিসের জোগানদার ছিল ইউরোপীয় দেশগুলি। ভারত থেকে রপ্তানি-দ্রব্যের মধ্যে ছিল সুতিবস্ত্র, মসলিন, চন্দনকাঠ, চাউল, নীল, নারকেল, চিনি, মোম, লোহা, দামী পাথর, গোলমরিচ ইত্যাদি। ইবন বতুতা বলেছেন, পারস্য উপসাগরবর্তী কোনো কোনো দেশ, যেমন—কলহট, ইয়েমেন প্রভৃতি তাদের মূল খাদ্য জোগানের জন্য ভারতের ওপর বিশেষভাবে নির্ভর করত। বারবোসা লিখেছেন যে, সুতি ও অন্যান্য বস্ত্রই ভারতের প্রধান রপ্তানি দ্রব্য। পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলি ও মালয় দ্বীপপুঞ্জে বোরখা বানানোর জন্য ভারত থেকে প্রচুর সুতি ও মসলিন কাপড় রপ্তানি হত। গুজরাট থেকে রপ্তানি হত সুতি কাপড়, মসলিন ও রেশমি ছাপা কাপড়। নিকিতন-এর বিবরণে গুজরাট থেকে বিদেশে কম্বল রপ্তানির কথা বলা হয়েছে। বাংলা ও গুজরাটে বন্দরগুলির মাধ্যমেই ভারতের মূল রপ্তানি বাণিজ্য পরিচালিত হত।
চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে পূর্ব আফ্রিকার সাথে ভারতের বাণিজ্য সম্পর্কের তথ্য ইবন বতুতা ও বারবোসার বিররণ থেকে জানা যায়। আফ্রিকার উপকূল অঞ্চলে আরবীয় উপনিবেশ স্থাপিত হলে এবং চিনা দূত চেঙ-হো’র উদ্যোগে ওইসব অঞ্চলের সাথে ভারতীয় বণিকদের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। ষোড়শ শতকে আফ্রিকার সাথে ভারতের ব্যাপক বাণিজ্য সম্পর্কের নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় বারবোসার বিবরণ থেকে। ওই সময় ক্যাম্বে থেকে ভারতীয় বস্তু ও মশলা বোঝাই জাহাজ আফ্রিকার মাকদাসাউ উপকূলে ভিড়ত। সেখান থেকে ওইসব জাহাজ দেশে ফিরত সোনা, গজদন্ত ও মোম বোঝাই করে। গুজরাটি বণিকেরা ক্যাম্বে থেকে বস্তু ও রুদ্রাক্ষ বোঝাই জাহাজ নিয়ে উপস্থিত হতেন আফ্রিকার মেলিন্দে, মোম্বাসা ও কিলোয়া বন্দরে। সেখান থেকে স্থানীয় মুসলমান বণিকেরা ওই পণ্যসম্ভার আরও দক্ষিণে চালান দিত। ফেরার পথে ভারতীয় জাহাজগুলি সোনা ও গজদন্ত নিয়ে আসত।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে ভারতের বাণিজ্য-সম্পর্কের ধারা খুবই পুরোনো। সুলতানি আমলেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে গড়ে ওঠা ভারতীয় উপনিবেশগুলিও ভারতীয় পণ্যের আগ্রহী ক্রেতা ছিল। কম্বোডিয়া ও ইন্দোনেশিয়া উন্নত মানের চাল উৎপাদন করতে সক্ষম ছিল। মশলা ও ঔষধ শিল্পেও তারা দ্রুত উন্নতি ঘটিয়েছিল। ভারত থেকে ওই সকল দেশে কাপড় রপ্তানি হতে থাকে। আবার ওই অঞ্চল থেকে ভারতে আমদানি করা হয় মশলা, ঔষধ ইত্যাদি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে এসে ভারতীয় ও চিনা বণিকদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়। চিন ও ভারতের পণ্যের বিনিময় কেন্দ্র হিসেবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। মৌসুমি বায়ুর গতিবিধির ওপর নির্ভর করে পালতোলা জাহাজে বাণিজ্যপণ্য লেনদেন করা হত। খ্রিস্টীয় প্রথম শতক থেকেই মৌসুমি বায়ু-নির্ভর নৌ-চালনার ক্ষেত্রে পারস্য উপসাগর থেকে জাহাজগুলি সরাসরি চিনে যেতে পারত না। তাই ভারতের পশ্চিম উপকূলের বন্দরে কিংবা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনো বন্দর শহরে ইউরোপ ও চিন দেশে পণ্য লেনদেন করতে হত। বাণিজ্যে মধ্যবর্তীর ভূমিকা দ্বারা ভারত আর্থিক ক্ষেত্রে লাভবান হত। চতুর্দশ শতকের গোড়া থেকেই চিনা জাহাজগুলি ভারতের দক্ষিণ উপকূলের বন্দরগুলিতে যাতায়াত করত। চিনা সম্রাট ইউং-লো’র উদ্যোগে এই বাণিজ্য দ্রুত বৃদ্ধিলাভ করেছিল। চিনা লেখকদের বিবরণী থেকেও চিন-ভারত বাণিজ্যের ব্যাপকতার কথা জানা যায়। এই পর্বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম ও ব্যস্ততম বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল মালাক্কা। মালাক্কার পরেই ছিল পেগু’র স্থান। এই স্বাধীন মুসলিম রাজ্যটিতে ভারতীয়-সহ বহু বিদেশি বণিক বসবাস করতেন। বাংলাদেশ, পুলিকট, করমণ্ডল, মালাবার, গুজরাট প্রভৃতি ভারতীয় বন্দর থেকে প্রতিবছর বহু মালবোঝাই জাহাজ এখানে আসত। ভারত থেকে রপ্তানি-দ্রব্যের মধ্যে ছিল মরিচ, রুদ্রাক্ষ, ধূপ, জাফরান, প্রবাল, রঙিন ও সাদা বস্ত্র, সিন্দুর ইত্যাদি। এই দ্রব্য এখান থেকে চালান দেওয়া হত জাভা, সুমাত্রা, তিমোর, বোর্নিও, বান্দা ইত্যাদি অঞ্চলে। ফেরার পথে জাহাজগুলি নিয়ে আসত শ্বেত-চন্দন, সোনা, লবঙ্গ, জৈত্রী, জায়ফল, কর্পূর, ঘৃতকুমারী ইত্যাদি। পূর্ব এশীয় বাণিজ্যে ভারতীয় বণিকেরা সরাসরি সুরাট এবং বাংলদেশ থেকে পেগু, তেনাসেরিম, সুমাত্রা ও মালাক্কাতে যাতায়াত করতেন।
পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে হিন্দু-বণিকদের তুলনায় বিদেশি ‘মুর’ মুসলমান বণিকদের আধিপত্য ছিল অনেক বেশি। ভারতের সামুদ্রিক বাণিজ্য বেশ কিছুকাল এদের কুক্ষিগত ছিল। বার্থেমা লিখেছেন : “The Pagans (hindu) do not nevigate much, but it is Moors who carry the merchandise.” আরবীয় ও পারসিক বণিকদের সাথে প্রতিযোগিতা করে এরা সামুদ্রিক বাণিজ্যে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছিল। পোর্তুগীজদের আধিপত্য বিস্তারের আগে পর্যন্ত মুসলমান বণিকদের এই আধিপত্য অব্যাহত ছিল। মুসলিম বণিকদের এই বাণিজ্যিক কর্তৃত্ব বিশেষ করে লক্ষণীয় ছিল পশ্চিম এশিয়া ও পূর্ব আফ্রিকার সাথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। ইবন বতুতার বিবরণ থেকে জানা যায় যে, তৎকালীন ভারতের প্রধানতম বাণিজ্যকেন্দ্র ক্যাম্বেতে বিদেশি মুসলমানদের সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক। এই সকল বহিরাগত বা বিদেশি মুসলমান বণিক ছিল খুবই সম্পদশালী এবং বৃহৎ জাহাজের মালিক। হিন্দু-বণিকেরা প্রধানত অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে লিপ্ত থাকতেন। বারবোসা উল্লেখ করেছেন যে, গুজরাটি বণিকরা (বেনে) বা দক্ষিণী ও মালাবারী হিন্দু-বণিকেরা প্রধানত দেশের অভ্যন্তর থেকে পণ্যদ্রব্য সংগ্রহ করে উপকূলবর্তী বন্দরে বিদেশি বণিকদের বিক্রি করার কাজে লিপ্ত ছিলেন। প্রায় অর্ধশতক আগে ভারতে আগত চিনা পর্যটক মা হুয়ানও কোচিন ও কালিকটের ‘চেট্টি’ সম্প্রদায়ভুক্ত বণিকদের বাণিজ্যধারা সম্পর্কে একই কথা লিখেছেন। মালাবারের ‘মোপলা’ বণিকেরা অবশ্য উপকুল-বাণিজ্যে কিছুটা কর্তৃত্ব করতেন। তা ছাড়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সাথে বাণিজ্যে মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুরাও কর্তৃত্ব ভাগাভাগি করে নিতে পেরেছিলেন। মালাক্কাতে বহু সমৃদ্ধশালী হিন্দু-বণিক যে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন, একথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমান শাসকদের সমর্থন ও সহানুভূতির জন্যই যে মুসলমান বণিকদের আধিপত্য বৃদ্ধি পেয়েছিল, তা নয়। দেখা গেছে, তৎকালীন হিন্দুরাজা-শাসিত রাজ্যেও মুসলমান বণিকদের ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য নানারকম সরকারি সাহায্য দেওয়া হত এবং তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হত। মালাবার, কালিকট, কুইলম, বিজয়নগর ইত্যাদি হিন্দুরাজাশাসিত অঞ্চলে মুসলিম বণিকদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির একাধিক দৃষ্টান্ত ইবন বতুতার বিবরণে লিপিবদ্ধ আছে।
Leave a comment